পাকিস্তানের ২৩ বছরের শোষণ-বঞ্চনার শিকার হওয়া বাংলাদেশ এখন তার পূর্বসূরির চেয়ে এগিয়ে গেছে সব ক্ষেত্রে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তান যখন ব্যর্থ রাষ্ট্রের কালিমা নিয়ে ধুঁকছে তখন বাংলাদেশ উঠেছে সম্ভাবনাময় অর্থনীতির দেশের তালিকায়। মানব উন্নয়নের ক্ষেত্রে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশ এখন অনুকরণীয়। শুধু অর্থনীতি ও মানব উন্নয়ন নয় বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে গেছে আইনের শাসন, জবাবদিহিতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও। যেন মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা ও অপরিহার্যতা বিশ্বকে আবারও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশ।

জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান মধ্যসারির দেশগুলোর তালিকায় আছে ১৫২ নম্বরে। সেখানে পাকিস্তানের অবস্থান ১৫৭ নম্বরে।
ইউএনডিপির লিঙ্গ সমতার ২০১৪ সালের তালিকায় বাংলাদেশ আছে ১৪২ নম্বরে। এই তালিকায়ও নিম্ন অগ্রসর দেশগুলোর ধাপে আছে পাকিস্তান। তাদের অবস্থান ১৪৬ নম্বরে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ ছিল ১১৫ নম্বরে, পাকিস্তান ছিল ১২৭।
জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন তালিকা অনুসারে, বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যু হার প্রতি লাখে ২৪০, সেখানে পাকিস্তানের মাতৃমৃত্যু হার ২৬০।
ইউনেস্কোর পরিসংখ্যান অনুসারে, বাংলাদেশে মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষিত নারীর হার ৩০.৮ শতাংশ। সেখানে পাকিস্তান ১৯.৩ শতাংশ।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার প্রণীত প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স-২০১৫ এর তালিকায় বাংলাদেশ আছে ১৪৬ নম্বরে। সেখানে পাকিস্তানের অবস্থান বিপজ্জনক তালিকার ১৫৯ নম্বরে।
মতপ্রকাশ ও জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মতে বাংলাদেশে ৩৮ শতাংশ ক্ষেত্রে নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। পাকিস্তানে সেখানে সম্ভব হয় ২৭ শতাংশ ক্ষেত্রে। আইনের শাসন বাংলাদেশ ২০১০ সালে ২৭ শতাংশ ক্ষেত্রে নিশ্চিত হয়। পাকিস্তানের এই হার ২৬ শতাংশ।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাতেও বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে। পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থা সেনা শাসনের ছোবলে বারবার দংশিত হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রশংসনীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সৃষ্টি করেছে।
এদিকে বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন পাকিস্তান আমলের ৯৬ লাখ টন থেকে বেড়ে এখন ৩ কোটি ৬০ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে।
ক্ষুধা ও অপুষ্টি দূরীকরণে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান ও নেপালকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইএফপিআরআই) বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে বলা হয়, ২০১৪-তে সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি সাধনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে। ওই প্রতিবেদনে ক্ষুধা নিরসনে বাংলাদেশের র‌্যাঙ্কিং ৫৭। ২০০৫ সালেও বাংলাদেশের পয়েন্ট ছিল ১৯ দশমিক ৮। ২০১৪ সালে এসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৯ দশমিক ১ পয়েন্টে।
আইএফপিআরআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, সামাজিক সূচকগুলোতে বড় পরিসরে উন্নতি করেছে বাংলাদেশ। বেসরকারি খাত ও সরকারের নেওয়া সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের দেশটির সক্রিয় অংশগ্রহণ চরম দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীর শিশুদের অপুষ্টি কমিয়েছে। ক্ষুধা নিরসনে বাংলাদেশের এ অর্জন সার্ক দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ অর্থাৎ পাকিস্তান ও ভারতের চেয়ে ভালো।
জানা যায়, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৩৯ বছর। কিন্তু সার্কভুক্ত দেশগুলোর ২০১১ সালের তথ্য-উপাত্ত অনুসারে, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৬৯ বছর। সেখানে পাকিস্তানের মানুষের গড় আয়ু ৬৫ বছর।
এক বছরের নিচে শিশুমৃত্যু হার রোধেও পাকিস্তানের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। পাকিস্তানে যেখানে প্রতি হাজারে মৃত্যুবরণ করে ৫৯ জন এক বছরের কম বয়সের শিশু। সেখানে বাংলাদেশে এই হার প্রতি হাজারে ৩৭।
মৃত্যু হার রোধের পাশাপাশি বাংলাদেশে জন্ম হারও কমেছে। বাংলাদেশে জন্ম হার ২ দশমিক ২ শতাংশে, কিন্তু পাকিস্তানের ৩ দশমিক ৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশে যেখানে চলতি হিসাবে ঘাটতি রয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের চলতি হিসাবের উদ্বৃত্ত ২ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
২০১২-১৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, সেখানে এই সময়ে পাকিস্তানের আয় ছিল ২৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার।
একই সময়ে পাকিস্তানের বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি ২০ বিলিয়ন ডলার, সেখানে বাংলাদেশের মাত্র ৭ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও পাকিস্তানের প্রায় দ্বিগুণ।
বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারও ছাড়িয়ে গেছে পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধিকে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ২ শতাংশ আর পাকিস্তানের তখন ৩ দশমিক ৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের আরেকটি বড় খাত হলো প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। এই খাতেও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। গত অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে ১৪ বিলিয়ন ডলার, সেখানে পাকিস্তানের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৯ বিলিয়ন ডলার।
উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশে মাথাপিছু সঞ্চয়ের হার প্রায় ২৮ শতাংশ, সেখানে পাকিস্তানের মাত্র ১৫ শতাংশ। সঞ্চয় কমে গেলে স্বাভাবিকভাবেই একটি দেশের জাতীয় মূলধন বিনিয়োগও কমে যায়। আর এর প্রভাবে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার কমাটাও স্বাভাবিক।
বাংলাদেশের এই উন্নয়নে খোদ পাকিস্তানের পরাক্রমশালী সেনাবাহিনীও বিস্মিত। এ নিয়ে তাদের গবেষণাও আছে। পাকিস্তান আর্মির ওয়েবসাইটে ‘দুই অর্থনীতির গল্প ১৯৭১-বর্তমান বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের তুলনা’ শিরোনামে ১৯৮০ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। একই সঙ্গে ওই সব সূচকের আগামী কয়েক বছরের সম্ভাব্য অগ্রগতি ও পতনের দিকনির্দেশনাও রয়েছে পাকিস্তান আর্মির ওয়েবসাইটে। তুলনামূলক চিত্রে দেখানো হয়েছে যে বিভিন্ন সূচকে পাকিস্তানের অবস্থান বাংলাদেশের চেয়ে নিম্নমুখী।

লেখাটি দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন এর এই নিবন্ধ থেকে নেয়া হয়েছে।

৫৭৯জন ৫৭৯জন
0 Shares

১০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ