সে আছে অনুভবে

রিমি রুম্মান ১৮ মে ২০১৫, সোমবার, ১২:০১:৫৯অপরাহ্ন বিবিধ ২৫ মন্তব্য

শৈশবের খেলার সাথী দিনাকে হিংসে হতো খুব। ওদের কতো বড় পরিবার ! নানা-নানু, মা, মামা-খালা সবাই একসাথে। কি ভয়ানক আনন্দের জীবন ওদের ! দুপুরে যখন পুরো শহর নিথর হয়ে থাকতো কিছুক্ষনের জন্যে, বাসার সবাই ঘুমিয়ে, আমি পা টিপে টিপে ছুটে যাই। ওর নানাভাইয়ের বড় বাড়ি। বড় উঠোন। ছুটোছুটি খেলি। অনেকটা খাঁচার পাখি ছাড়া পাবার মত। যেন বিশাল আকাশে ডানা ঝাপটে উড়োউড়ি। ওদের ছাদে উঠি। যদিও সেখানে উঠবার কোন সিঁড়ি নেই। তবুও বিপদজনকভাবে দেয়াল বেয়ে উঠা। ছাদে নুইয়ে থাকা আতাফল গাছ। পাকা আতাফল খাই। গল্প করি। বাড়ির পেছনে গভীর পরিত্যক্ত ডোবা কচুরিপানায় ভরপুর। ছাদ থেকে নীচে তাকাই। ভাবি, অসাবধানে পরে যাই যদি কখনো, কেউ খুঁজে পাবে না আমাদের। কচুরিপানার নীচেই ভেসে থাকবো হয়তো অনাদিকাল সকলের অজানার মাঝে। রেলিঙবিহীন সেই স্যাঁতস্যাঁতে ছাদ থেকে ছোট্ট দু’টি শিশু পরে যাবার অনেক কারন ছিল যদিও…

 

প্রায়-ই দুপুরে বাবা লাঠি হাতে তীব্র বেগে ছুটে আসেন। দূর থেকে দেখে আমি ছুটি অন্য পথে বাড়ির দিকে। একদিন আমরা পয়সা জমিয়ে “ছুটির ঘণ্টা” দেখি বাসার পাশের হলে। অন্ধকার হলরুম। পর্দার দৃশ্যকে বাস্তব মনে হয়। ছবিতে__ “অনেকদিনের জন্যে স্কুল ছুটি হয়। ছুটির ঘণ্টা বাজে। সবাই বাড়ি ফিরে যায়। ছোট্ট ছেলেটি যেতে পারেনি। সে বাথরুমে আটকে পরেছে। স্কুলের সবাই সব তালা দিয়ে চলে যায়। ছেলেটিকে পরিবারের সবাই পাগলের মতন খুঁজছে। এইদিকে না খেতে পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ধীরে ধীরে বাথরুমেই নিস্তেজ হয়ে সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে।”___ আমি চিৎকার করি, ঐ যে… ওখানে… ও-খা-নে। হলভর্তি মানুষ। কেউ আমার কথা শুনতে পায় না। আমি চেঁচাতে থাকি… চেঁচাতেই থাকি। গলা বসে যায়, জোর কমে আসে। অতঃপর …একদিন ছুটি হবে, অনেক দূরে যাবো… গানটি স্লোমোশনে বাজতে থাকে। অন্ধকার হলরুমে আলো জ্বলে উঠে। দিনা এবং আমি, আমরা একে অপরের চোখের কোন বেয়ে জল গড়িয়ে পরতে দেখি…

 

ধীরে ধীরে আমি বড় হই। আমার পরিধি বাড়ে। কলেজ পেরিয়ে ঢাকায় ভর্তি হই। দিনা সেই শহরেই থাকে। ওর পরিধি বাড়ে না। বরং সংকুচিত হতে থাকে। নানাভাই, নানু, মা মারা যায়। মামা-খালা’দের আলাদা সংসার হয়। ততদিনে আমি বুঝতে শিখেছি, দিনার জীবন আসলে ভয়ানক আনন্দের নয়। ওর বাবা-মা’র সুন্দর সংসার নেই। মা মানসিকভাবে অসুস্থ। এভাবে তো আর জীবন চলে না। সংসার চলে না। তাই নানার বাসায় থাকে। লোকমুখে শুনেছি, ওর বাবা ভীষণ ভালোমানুষ। যদিও আমি তাঁকে কখনো দেখিনি।

 

এক সন্ধ্যায় আঁধার ঘনাবার আগে বড়বেলার আমাদের দেখা। আমি আমেরিকা চলে যাচ্ছি শুনে খানিক বিষণ্ণ দিনা বলল__ “রিমি, আমেরিকায় তো নাকি সবাই ব্রেড খায়। ভাত ছাড়া তুই ওখানে ক্যামনে বাঁচবি।” আমি চুপ করে থাকি। বুঝি__ সব-ই মায়া। অনেক বছর বাদে ক্ষণিকের জন্যে একবার আমাদের দেখা। ততদিনে আমরা দু’জনেই সংসারী। ফোনে আমার বাবার কাছ হতে খবর নেই। ফোন নাম্বার জোগাড় করে একদিন ফোন দেই। সে কি উচ্ছ্বাস ! হর্‌হর্‌ করে বলে যায় যাবতীয় খবরাখবর। উত্তরের অপেক্ষা না করেই প্রশ্ন করে যায় অনবরত। আমি কেমন আছি… সুখে আছি কিনা… শ্বশুর বাড়ির মানুষজন কেমন… ওরা আমায় ভালোবাসে কিনা… আপন করে নিয়েছে কিনা…

 

এরপর লাইন কেটে যায়। সেই নাম্বারে আর কখনোই ফোন যায় না। ফোন করলেই ভেসে আসে___ আপনি ভুল নাম্বারে ডায়াল করেছেন। অনুগ্রহপূর্বক পরে আবার কল করুন…

 

হাজার হাজার মাইল দুরের এই শহরে সব ব্যস্ততা শেষে সবাইকে খাইয়ে বেলা শেষে আমি যখন একাকি প্লেটে ভাত নিয়ে বসি, দিনাকে খুব মনে পরে। একা একা (শব্দহীন) বলি__ দিনা, আমেরিকায় কিন্তু ভাতও পাওয়া যায়। ভাত ছাড়া কি আর বাঙালি বাঁচে !

 

## কিছু সম্পর্ক কখনো শেষ হয়ে যায় না। যোগাযোগ না থাকলেও, হাজার মাইল দূরে থাকলেও সম্পর্কগুলো বেঁচে থাকে ভালোবাসায়, অনুভবে…

৯৬৪জন ৯৬৪জন

২৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ