রামু ও কৃষ্ণা সূর্যাইয়ের মাথা, মুখমণ্ডল চেপে ধরে। শ্রীপদ প্রথমে খেঁজুর কাটা দিয়ে দুই চোখের মডু বরাবর খোঁচা মারে। সূর্যাই মাগো বলে চিৎকার করে ওঠে। জাগতিক যে কোনো বিপদে হোক সে ছোট বা বড়, সম্ভবত অবচেতনেই মানুষের মুখ দিয়ে মা ডাক উচ্চারিত হয় অতঃপর ঈশ্বরের। মুহূর্তের মধ্যেই সূর্যাইয়ের চোখের আলো নিভে যায়, চোখে নামে ঘোর অমানিশা। ছটফট করে সূর্যাই। শ্রীপদ হো হো করে হাসে। নিশুতি চরে সে নিষ্ঠুর হাসি ঝড়ো রাতের নিস্তব্ধতাকে ভেঙ্গে খান খান করে দেয়। তারপর শ্রীপদ কলাপাতার ভেতর সযত্নে রাখা ধারালো ক্ষুরটি হাতে নেয়। একবার তাকিয়ে দেখে, হাতের তালুতে নরসুন্দরের মতো পাথালি ঘষা মারে। তারপর ধীরে ধীরে শ্রীপদের হাতের ক্ষুর সূর্যাইয়ের চোখের সন্নিকটবর্তী হয়। রামু ও কৃষ্ণা সূর্যাইয়ের মাথা, ঘাড় চেপে ধরে। লাশকাটা ঘরের মরন্ত লাশের মতো নির্বিকার শ্রীপদ সূর্যাইয়ের চোখে ক্ষুর স্থাপন করে দ্রুত একটি চোখ তুলে ফেলে। তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করে সূর্যাই, ‘হামরেকে মাফ করদো মালিক বুঝে নেইখে সখে! মাফ করদো বাবু বুঝে নেইখে সখে!’ শ্রীপদ গম্ভীর নিশ্চুপ। হঠাৎ বোনের সর্বনাশের কথা ভেবে তীব্র রাগে-দুঃখে-ক্ষোভ-অভিমানে শ্রীপদ চিৎকার করে বলে, ‘মাফ! কাথিক মাফ!’। পাষণ্ড শ্রীপদ ক্ষুর চালিয়ে সূর্যাইয়ের আরেকটি চোখ তুলে নেয়। সূর্যাইয়ের চিৎকারের সাথে ফিনকি দিয়ে ছোটে রক্ত। রক্তভেজা সদ্য উৎপাটিত চোখ দু’টি হাতে নিয়ে শ্রীপদ দেখে, খেলে, উচ্চস্বরে চিৎকার করে হাসে। প্রচণ্ড রক্তক্ষরণে সূর্যাইয়ের চিৎকার একসময় থেমে যায়। অজ্ঞান হয়ে হাত বাঁধা অবস্থায় মাটিতে এলিয়ে পড়ে। রামু ও কৃষ্ণা কেনো যেনো একটু দমে যায়। এবার শ্রীপদ হাসি থামিয়ে শুষ্ক গলায় বলে…।
শ্রীপদ: তেনি পরেই দেকের সব খুন নিকলযায়েছে সূর্য মরযায়ি। আজই আঁখ দুন্নোসহ উপড়েকে মাটি চাপা দেবো একের পর হামার শান্তি।
রামু: মালিক। মাট্টিমে গাড় দেওয়াতো ধরমকে দিকছে ঠিক না হ। উকারকে চিতা মে দিনা সখেছে এইছেই ফেইক্কে চালা যায়ে?
শ্রীপদ: উকরেকে বিক্কে রককে যায়েছে থানা পুলিশকে ঝামেলা হই।
থানা পুলিশের কথা শুনে রামু ও কৃষ্ণার মহানুভবতা চট্ করে হাওয়া হয়ে যায়।
কৃষ্ণা: তো আসলেই চালাক হোলো তোর বুদ্ধিকে তরিফ করা হোকোল।
শ্রীপদ: তব খোদ বালু। অভিয়ে গারদে।
রামু: মালিক। সূর্যাই তো অভিতক মরে নেইখে।
শ্রীপদ: ওতো মরবেকরেই। ই ধর পাঁচ-দশ মিনিটকে হেরফের হই। ও যব মরবেকরেই তব তেনি আগে মাট্টিকে নীচে গার দিয়েছে কা আয় যায়ি! যো বালু খোদ।
রামু ও কৃষ্ণা ছাউনির নীচ থেকে কোঁদাল এনে চরের বালু খুঁড়ে লম্বালম্বি একটা গর্ত করে। দমকা হাওয়ায় ভারী বৃষ্টির ফোটা চরের তপ্ত বালুকে ভিজিয়ে দিয়ে বালুমাটি করে দিয়েছিলো বলে রামু ও কৃষ্ণা খুব সহজেই গর্ত করে ফেলেছিলো। একটু দূরে নদীর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে শ্রীপদ একটা সিদ্ধির স্টিক ধরিয়ে কষে টানতে থাকে।
কৃষ্ণা: মালিক। গাতা করা শেষ।
শ্রীপদ: সূর্যাইকে গাতামে নামাও।
রামু: জ্বী মালিক।
রামু ও কৃষ্ণা অচেতন মৃতপ্রায় সূর্যাইকে চ্যাংদোলা করে বালুর গর্তে নামায়।
কৃষ্ণা: নামাদিয়াবানি মালিক।
শ্রীপদ: ইবার বালুছে ঢাক দে।
রামু: মালিক।
শ্রীপদ, রামু ও কৃষ্ণার কাছে আসে।
শ্রীপদ: যো বোলেবানি তাই কর।
কৃষ্ণা: জ্বী মালিক।
শ্রীপদ: আরে গাঁধা সূর্যাইকে তো হামনিককে খুন করেবানি। খুনকে আবার রকম কা? খুন মানেই মরণ হ। আগে মরেছেও মরা পরে মরেছেও মরা। হা হা হা…!
রামু ও কৃষ্ণা কেনো যেনো যুক্তিটা মেনে নিতে পারে না। তাদের কেবলই মনে হয় সূর্যাইতো মরবেই কিন্তু যতক্ষণ প্রাণ আছে ততক্ষণ অন্তত মানুষটা বেঁচে থাকুক। এখনো জীবন্ত সূর্যাইকে বালু চাপা দিতে রামু ও কৃষ্ণার হাত থর্ থর্ কাঁপে। শ্রীপদ বিষয়টি লক্ষ করে দ্রুত কৃষ্ণার হাত থেকে কোঁদাল নিয়ে জীবন্ত সূর্যাইয়ের কবরে ভেজা বালুমাটি ফেলতে থাকে। সূর্যাইয়ের মৃতপ্রায় দেহ বালুর নীচে একচুল নড়ে ওঠে। শ্রীপদ বিষয়টি রামু ও কৃষ্ণার কাছে গোপন করার জন্য দ্রুত বালিমাটি ফেলতে থাকে। সূর্যাইয়ের দেহ কয়েক স্তর বালুমাটির নীচে চলে যায়। ওই একবারই সূযাইয়ের মৃতপ্রায় দেহ শেষবারের মতো ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলো নিজেকে জীবিত প্রমাণ করার। নির্বিঘ্নে মৃতপ্রায় সূর্যাইয়ের উপর শ্রীপদের বালুমাটি ফেলতে দেখে রামু ও কৃষ্ণা মনে শক্তি ফিরে পায়। রামু সোৎসাহে বালুমাটি ফেলতে থাকে সূর্যাইয়ের কবরে। তার দেখাদেখি কৃষ্ণা শ্রীপদের হাত থেকে বিনয় এবং লজ্জিতের ভঙ্গীতে কোঁদালটি ছিনিয়ে নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্যাই তলিয়ে যায় বালুমাটির অতলে, মৃত্যুর আলিঙ্গনে।
(……………………………………………চলবে)
আগের পর্বের লিংকগুলো:
১. http://sonelablog.com/archives/12440
২. http://sonelablog.com/archives/12475
৩. http://sonelablog.com/archives/12531
৪. http://sonelablog.com/archives/12788
৫. http://sonelablog.com/archives/12859
৬. http://sonelablog.com/archives/12944
৭. http://sonelablog.com/archives/13003
৮. http://sonelablog.com/archives/13126
৯. http://sonelablog.com/archives/13269
১০. http://sonelablog.com/archives/13617
১১. http://sonelablog.com/archives/14926
১২. http://sonelablog.com/archives/17125
১৩. http://sonelablog.com/archives/17164
১৪. http://sonelablog.com/archives/17210
১৫. http://sonelablog.com/archives/17308
১৬. http://sonelablog.com/archives/17837
১৭. http://sonelablog.com/archives/17968
১৮. http://sonelablog.com/archives/18263
১৯. http://sonelablog.com/archives/18396
২০. http://sonelablog.com/archives/18643
১০টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
খুন করার বীভৎসতা ভালো ভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন।
চোখ দুটো আগে না তুললেও পারতো ।
সাতকাহন
জিসান ভাই, ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না, আপনার মতো নিখুত পাঠকই আমার ভরসা।
নীলাঞ্জনা নীলা
উপন্যাস পড়তে বেশ সময়ের প্রয়োজন হবে। পড়ে ফেলবো একদিন। এই অংশে তো দেখছি খুনোখুনি । উপস্থাপনা ভালো হয়েছে।
সাতকাহন
ধন্যবাদ নীলা, ডোমদের জীবন থেকে নেয়া।
খসড়া
বরাবরের মতই উপভোগ্য।
সাতকাহন
ধন্যবাদ খসড়া।
মিসু
কিছু কথাবার্তা বুঝতে পারিনি, অনুমান করে নিতে হয়েছে। ভালো লিখেছেন।
সাতকাহন
ডোমদের জীবনের সাথে মিশে যাওয়ার জন্য উড়িয়া ভাষা ব্যবহার করছি।
শুন্য শুন্যালয়
কি বিভত্স বর্ননা 🙁
সবুরে মেওয়া ফলে বলেছিলেন। পুরো খালি হাতেই ফিরলাম। দেখি কি আছে এরপর।
জসীম উদ্দীন মুহম্মদ
(3 🙂 :c