আমাদের স্কুলের সামনে ছিলো দুনিয়ার সবচেয়ে বড় মাঠটা, তার পাশে ছিলো দুনিয়ার সবচেয়ে উচু নিমগাছটা …. সেই মাঠে জমা হতো দুনিয়ার সবচেয়ে পরিষ্কার বৃষ্টির জল। আমাদের ছিলো দুনিয়ার মাঝে সবচেয়ে শান্তির সবচেয়ে উজ্জ্বল একটা দীঘি। সেই. সবচেয়ে বড় মাঠে টলটল বৃষ্টির জলে তুমুল ফুটবল খেলা হতো বল থাকলে বল না থাকলে জাম্বুরা দিয়া। আমাদের ছিলো একটা কালো আর সাদা ছোপানো গাইগরু – দুনিয়ার সবচেয়ে শান্ত। সেই গরুটাই একদিন আব্বুকে তারা করেছিল, কোন কারণ ছাড়াই। গোয়ালের পাশেই ছিলো আমাদের ফুটবল গাছ অহো, জাম্বুরা গাছ।
আমাদের প্রাইমারী স্কুলের সামনেই ছিলো একটা রাধাচূড়া গাছ (এখনো আছে মনে হয়) আর সেই গাছের নীচেই বসতো এই পৃথিবীর সবচেয়ে স্বাদের জিনিস গুলোর দোকান –
আইসক্রিম ছিলো তিন রকমের – চার আনা (২৫ পয়সা) শক্ত লাল টুকটুকে, আট আনা (৫০ পয়সা) একটু নরম, এই দুইটা থাকতো খোলা। আর একটাকার দুধ মালাই … প্লাস্টিকের প্যাকেটে
আর ছিলো হজমি পকেটের ছোট বোতল থিকা এক ফোটা তরল দিয়া হজমিতে আরেকটা বোতল থেকে স্পোকের মাথায় করে আরেক ফোটা তরল দিলেই আগুন জ্বইলা উঠতো।
শাজাহান ভাইয়ের আচার ছিলো তিন রকমের। চালতার, বড়ইয়ের আর জলপাইয়ের।
আরও ছিলো চটপটি – এখনকার আধুনিক ফুচকা বা চটপটি না, একদম গ্রাম্য। আলু আর ডাবলি বুটের মিক্স সেদ্ধতে তেঁতুলের টক বিটলবণ আর শুকনো মরিচগুঁড়া আর সেদ্ধডিম কুচিকরা চাইলে দ্বিতীয়বার টক নেয়া যেত। সাদা সাদা পিচকি পিচকি টিনের প্লেটে দিতো।
সেই একটাকা প্লেটের চটপটি তে যে স্বাদ ছিলো, এখনও মুখে লাইগা আছে। তারপর কত নামকরা চটপটি কত দাম দিয়া খাইছি ……
আমাদের ছিলো একটা সাদাকালো ন্যাশনাল টেলিভিশন। আব্বা আম্মা আর বোনদের নিয়ে সেই সাদাকালো টেলিভিশনে রাত্রিগুলো কি ভীষণরকম রঙ্গীন ছিলো। …… শুক্রবারের সকালগুলোয় ঢাকায় থাকি, সংশপ্তক থেকে বর্ডার টাউন, গার্ল ফ্রম টুমরো হয়ে একদম জাতীয় সংগীত দেখানো পর্যন্ত – মুখস্ত ছিলো ক্যাপ্টেন প্লানেট, নিনজা টার্টলস আর ম্যানিমেল থান্ডার ক্যাটস। বারের নামই ছিলো ম্যাকগাইভার। ম্যাকগাইভার মলাটের খাতা প্রথম যখন বের হলো, কি উত্তেজনা!
– এখন একা একা এলইডি স্ক্রিনে ট্রু কালারে বিশ্বখ্যাত মুভিতেও হাই ওঠে। সাদাকালো ন্যাশনাল টিভি দেখতে ইচ্ছে করে, খাটের ওপর গেদা ছোটবোনটাকে কোলে নিয়ে বসে থাকা আম্মার গায়ে হেলান দিয়ে….
আমাদের স্কুল ছিলো সত্যিকারের আমাদের স্কুল।
আব্বা, আম্মা সবাই অই স্কুলে পড়াশোনা করেছেন, স্যারেরা অধিকাংশ আব্বা আম্মা দুজনেরই টিচার। এবং নাতিরা ছাত্র হইলে যা হয়
এইটার সুবিধা যেমন ছিলো অসুবিধা ছিলো তার তিনগুণ। যেমন পাশের গার্লস স্কুলের টিচাররা সব ইয়ং ব্লাড, আমাদের স্কুলের ছাত্ররাই ম্যাক্সিমাম – তারা সবকিছুর খবর রাখেন। শিক্ষা পক্ষ, বিজ্ঞান মেলা ইত্যাদিতে তাদের ছাত্রীদের নিয়ে যান এবং পুরষ্কার নিয়ে আসেন। ছোট বোন পুরষ্কার নিয়ে আসে আর আমি মুখ কালো করে ঘুরে বেরাই আমাদের স্যারদের মতামত হচ্চে ভালো রেজাল্ট করতে হবে ব্যাস। তাদের এইসব ” পুলাপাইন্যা ” কামের জন্য টাইম নাই।
যাইহোক, ক্লাস নাইনে যখন পড়ি – ছোট বোনের তুমুল প্রস্তুতি দেখি শরীয়তপুর সরকারি কলেজের বিজ্ঞান মেলার অনুষ্ঠানের জন্য আর মুখ কালো করে ঘুরি। আমাদের স্কুলের কেউ জানেইনা। অনুষ্ঠানের দিন একরকম জোর করেই বোনের সাথে গেলাম, যাইয়া দেখি উপস্থিত বক্তৃতা আর বিজ্ঞান কুইজে সবাই অংশ নিতে পারবে যদি সে স্কুলছাত্র হয়। সাহস করে নাম দিয়ে আসলাম, অবশ্য গার্লস স্কুলের আলাউদ্দীন স্যার হেল্প না করলে হতোনা। ….. যাই হোক, উপস্থিত বক্তৃতায় বিষয় পরল সুর্য গ্রহণ (মাত্র দুদিন আগেই পুর্ণ গ্রাস গেছে, সুনীল বি এস সি স্যার বেশ রসিয়ে রসিয়ে পড়িয়েছেন আর আমার চোখের সামনে ভাসছে কচিকাচার আসরে ছাপা হওয়া সুর্যগ্রহনের আর্টিকেল যেটায় শীম্পাঞ্জি চোখে পেপার সানগ্লাস দিয়ে গ্রহণ দেখছে এমন ছবি ছিলো) আমাকে আর পায় কে
আর বিজ্ঞান কুইজের প্রশ্ন ছিলো
১. H²o তে o মানে কি
২. লিউকোমিয়া কি
৩. অলিম্পাস মন্স কি
ফলাফল 😀
দুই দুইটা প্রথম পুরষ্কার নিয়া পরদিন স্কুলে যাইয়া বিজ্ঞান ক্লাসেই সুনীল স্যারের চটকানা খাইলাম চিংড়ির উপাঙ্গ আইকা নেই নাই তাই।
১০টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
আহা, সেই সব দিন।
পুংটা আছিলেন জেনেছি আগের পর্ব,ভাল ছাত্র আছিলেন তাও জানলাম এবারে।
সাইদ মিলটন
না দাদা আমি তথাকথিত ভালো ছাত্র কখনই ছিলাম না 🙂
ইনফ্যাক্ট আমি কোনদিনই কোন পরীক্ষাতেই সম্পূর্ণ উত্তর লিখিনি , কখনোই না। আর ইউ নো ঝকঝকে রেজাল্ট নাহলে কিসের ভালু :p
শুন্য শুন্যালয়
আপনি একটা জিনিয়াস ভাই, মুখ কালো করে দিতেও টাইম নেন না, আবার হাসাতেও। ফুটবল গাছ 😀
সাদা-কালো টিভিতেই যদি রঙ্গিন দেখা যায়, তাইলে রঙ্গিন টিভির দরকার কি?
এতো চটকানা খাইয়াই বুঝি এতো গুনী হইছেন 🙂
সাইদ মিলটন
সাদাকালো টিভিতে যে মায়া ছিলো তা আর নাই 🙂
দরকার আমার না জীবনের দরকার ।
মিথুন
আপনি তো দেখছি অনেক দুস্টু ভাইয়া। আমাদের স্কুল ছিলো সত্যিকারের আমাদের স্কুল, এই লাইনটা পড়ে হাসতে হাসতে শেষ আমি। অনেক মজার লেখা——————
সাইদ মিলটন
😀
আব্বা আম্মা চাচা ফুপু মামা খালা সব্বাই একই স্কুলের ছাত্র হৈলে আর কিই বা কইতে পারি :p
ইনফ্যাক্ট এমনো শুনতে হইছে – তোর বাপ চাচারা তো এত বান্দর আছিল না , তুই এত বান্দর কইত্তে হইলি 😀
লীলাবতী
স্মৃতি আমার সোনালী স্মৃতি 🙁
সাইদ মিলটন
🙂
জিসান শা ইকরাম
ছোট বেলার নিজের ভালোলাগা সব কিছুই আসলে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ
সে সব এখনো খুঁজে ফিরি।
সুনীল স্যারেরে মাইনাস
তবে সেইসব চটকাটনা এখনো আলো ছড়ায় 🙂
সাইদ মিলটন
আমিও খুজি দাদা 🙂
হ কইস্যা মাইনাস :p