দীপ খুব সন্তুষ্টির সাথে রাইনার প্রশংসা করছে । মুগ্ধ হয়ে আমরা অতিথিরা তার আত্মতৃপ্তির ভাষ্য শুনছি । দীপ রগরগে গলায় বলেই চলেছে ,
“রাইনা আমাকে সবটুকু বোঝে । ও আমার মুখ দেখলেই বলে দিতে পারে আমার মনের অবস্হা । আমার প্রতিটি
পছন্দ অপছন্দ ও জানে। সেভাবেই চলে সে।
আছিরে দোস্তরা , বেশ ভালোই আছি আমি !!
তৃপ্ত দীপের এই কথাটা কেমন যেনো দাম্ভিক লাগলো আমার কাছে। ও কেনো বললো “ ভালো আছি আমি !!
“ভালো আছি আমরা “, বললে কত মধুর শুনাতো !আমার দুষ্ট মনটাকে কষে ধমক দিলাম ।
দীপ – রাইনা আমার কমন বন্ধু । একই সাথে লেখা পড়া করেছি আমরা । রাইনা ছিলো আমার সবচেয়ে কাছের বান্ধবী । দারুন উচ্ছল আর মেধাবী মেয়ে রাইনা । দীপ ও ছিলো উজ্জ্বল ছাত্র । পেশা জীবনেও বেশ সফল সে ।
না কোনো প্রেম না , পারিবারিক ভাবেই বিয়ে হয় ওদের । আমরা সব বন্ধুরা খুব মজা করে ছিলাম ওদের বিয়েতে । রাইনা ও খুশি ছিলো বিয়েতে ! প্রেম না হোক ছেলেটা তো চেনা জানা । ভদ্র শান্ত । মেয়েদের সম্মান করতে জানে । খুব ভালো লেগেছিলো ওর কথা গুলো ।
ওদের বিয়ের আজ ১২ বছর হলো । তাইতো সবার নিমন্ত্রণ । কত লোক চারিদিকে । দীপ রাইনা সফল জুটি । হাসি মুখে সবার খোঁজ খবর করছে । আতিথেয়তায় কোনো কমতি নেই । আমরা বন্ধুরাও খুশি, ওদের উপলক্ষে আজ কত কত বছর পর সবাই এক সাথে হলাম!!
দীপের মুখে রাইনার প্রশংসা চলছেই । অন্য বন্ধু রা কি মনে মনে হাহুতাস করছে নাকি !!! রাইনা কেনো তাদের হয় নি । অথবা নিজের ঘরের বউটাকে রাইনার সাথে তুলনা !!
এই হলো আমার সমস্যা ।। মানুষের ভিতরটা আর বাহিরটা তুলনা করা !! চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করা !!
দীপের প্রথম কথাটাই কেমন স্বার্থপর লাগলো !!
নিজেকে কষে দুটি বকা দিয়ে আবার খোশ গল্পে মেতে উঠলাম।
দীপ ঠিক আমার পাশেই দাড়ানো, খুব টেনে টেনে জানতে চাইলো ,কেমন আছো রুম্পা ? সাথে তার সন্ধানী চোখ আমার সাজ সজ্জায় খুঁজে নিতে চাইছে আমার প্রাচুর্যের পরিমান। সেখানে সে আমার সাদামাটা জীবনের দেখাই হয়তো পেলো । আমার স্বামী সংসারের খোঁজ নিয়ে বেশ খুশিই হলো মনে হয়। আমার প্রাচুর্যহীন জীবন কি ওকে খুশি করলো !!!
একটা সম্পর্কে পা রাখতে গিয়ে আমি সেদিন থমকে গিয়েছিলাম। বাবা, মা আর ছোট বোনটার কথা ভেবে থেমে গিয়েছিলাম প্রথমেই। বেশ আহত অথবা অপমানিত হয়েছিল দীপ সেদিন। আজ আমার দারিদ্র আর ওর প্রাচুর্য সামনা সামনি দাড়িয়ে ।
আচ্ছা আমি কি ভুল করেছিলাম!!!
মাসের ২০ তারিখের পরই যখন খরচের টাকাগুলো অমূল্য মনে হয় , তখন মাঝে মাঝে ক্লান্ত লাগে সত্যি।
মন দিয়ে রাইনাকে দেখি আমি । কি সুন্দর শাড়ি ওর শরীরে!! গয়না গুলো আধুনিক। প্রাচুর্য্র ঝলকানিতে আমার চোখ নেমে আসে নিম্ন পানে।
রাইনা , খুব গোছানো মেয়ে। প্রতিটি টেবিলে ঘুরে ঘুরে খোঁজ নিচ্ছে সবার। ওর মার্জিত হাসি , কথার মাধুর্য , সব কিছুই সুন্দর । দীপ ও আছে তার পাশে পাশে।
আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি দুজন কে।
হঠাৎ ই পাশের টেবিলের ছোট বাচ্চাটাকে কোক ঢেলে দিতে যেয়ে তারাহুরায় কোকটা গ্লাস উপচে টেবিল গড়িয়ে ভিজিয়ে দিলো রাইনার শাড়ির সামনের দিকটা। প্রচন্ড আতংকে কেপে উঠল রাইনা। ওর চোখে জমাট ভয় , দৃষ্টি এড়ালো না আমার।দীপ তীব্র কটাক্ষে চাপা গর্জে উঠল রাইনার উপর। “ সামান্য কোক ঢালতে শেখো নি!! শাড়িটার দাম জানো !!” মূহুর্তে ফ্যাকাসে হয়ে গেলো রাইনার মুখ। ঝড়ের গতিতে রাইনা যেনো পালিয়ে গেলো দীপের সামনে থেকে।
আমি দীপের চোখে মুখে যে তাচ্ছিল্য আর ক্রোধ দেখলাম , তাতে নিজের উত্তর নিজেই পেয়ে গেলাম। সত্যি দীপ সুখে আছে । আর রাইনা তার ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে বেঁচে আছে।
মূহুর্তে দীপের সমস্ত চাকচিক্য বড্ড ম্লান মনে হয় আমার কাছে। খুব সংকীর্ণ লাগে দীপের তৃপ্ত জীবন। নিজেকে রায়নার স্হানে কল্পনা করে চমকে উঠি আমি। আমার দারিদ্র আমার কাছে অহংকার মনে হতে থাকে।
নিজের ঘরের ছোট কামড়া দুটি তখন আমার চোখে স্বপ্নিল আচড় কাটে। সেখানে বাহারি প্রশংসা নেই , তবে স্নিগ্ধ সম্মান বোধ আছে। নিজেকে খুব সুখি লাগে তখন নিজের কাছে।মাসের শেষে আর্থিক টানাটানিতে স্বামী স্ত্রীর যুগোল সমস্যাও বেশ মধুর লাগে নিজের কাছে ।
১৬টি মন্তব্য
শাহরিন
জ্বি আপু, মেয়েরা একটু সম্মান পেলেই সন্তুষ্ট হয়ে যায়। কোটি টাকাও সম্মান পাওয়ার সুখ এনে দিতে পারবে না।
আমার কাছে রুম্পার মনোভাব খুবই ভালো লেগেছে, মুখের ভাষার চেয়ে চোখের ভাষা শেখা বেশী দরকার।
রোবায়দা নাসরীন
প্রতিটি মানুষ তার নিজস্ব সম্মানটা অপরের কাছে আশা করে । ঐটুকু পেলেই সে সন্তষ্ট।
শাহরিন
সহমত আপু। অনেক ধন্যবাদ কঠিন কথা
অনেক সুন্দর করে উপস্থাপন করেছেন।
মাছুম হাবিবী
খুব সুন্দর লিখেছেন অাপু। মেয়েদের সম্মান করাটাই উচিৎ, কারণ তারা মায়ের জাত। গল্পটা দারুন
,
রোবায়দা নাসরীন
আন্তরিক ধন্যবাদ । প্রতিটি মানুষকেই তার প্রাপ্য সম্মানটা দিতে হবে।
প্রদীপ চক্রবর্তী
পড়ে বেশ ভালো লাগলো দিদি।
নিশ্চয় মেয়েদের সম্মান করা উচিত।
টাকাপয়সা দ্বারা এই সম্মান দেওয়া সম্ভব নয় স্নেহ মমতা আর ভালোবাসা।
শিরিন হক
অনেক সময় আমরা অন্যের বিলাসিতা দেখে দুখী হই।
নিজের অপুর্নতাকে তুলনা করি অন্যের সাথে।মানুষ চিরোকাল নাপাওয়ার বেদনায় আর্তনাদ করে একবারো ভেবে দেখেনা আমার চেয়েও কেউ কষ্টে আছে।
সুখ অপ্রাচুর্য এনে দিতে পারেনা সুখি হতে হয় মনে।আত্বম্মান বলি দিয়ে কেউ সুখি হয়। কেউ সুখি হয় নিজের দাম্ভিকতায়।
টাকা পয়সার চেয়েও যে একটু সম্মান, ভালোবাসা,বিশ্বাস আর একটু ত্যাগ বেশী সুখ দিতে পারে লেখায় তা সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন।
শুভকামনা রইলো
মোঃ মজিবর রহমান
সমাজে কি কার ব্যাবহার বুঝা খুবিই অসম্ভব মনে হই ।
মাসুদ চয়ন
আপনারা লেখা প্রথম পাঠ করলাম।শুভেচ্ছা আপনার জন্য,গল্প বলার ধরন বেশ ভালো।
শিরিন হক
স্যরি একই লেখা আরো কথায় যেনো পড়েছি অনেক আগে তবে পাত্র পাত্রী ভিন্ন ছিলো সেখানে। আপনার লেখা কেউ কপি করতে পারে। একটু খেয়াল রাখবেন।
সাবিনা ইয়াসমিন
মানুষকে সব সময় মুখের ভাষায় বা বাহিরের চাকচিক্য দেখে আসলেই পরিমাপ করা যায় না। চোখের ভাষার এক আলাদা রুপ আছে, চোখ কখনো মিথ্যা বলতে পারেনা। নতুন শাড়ি, গয়না আর আভিজাত্যের আড়ালে কত গল্প লেখা থাকে! একমাত্র চোখ দিয়েই সেই গল্পগুলো শোনা যায়।
অনেক দিন পর এলে। নিয়মিত এসো, তাহলে এমন গল্প আরও অনেক পড়তে পারবো।
ভালো থেকো, শুভ কামনা ও ভালোবাসা ❤❤
আরজু মুক্তা
ভালো লাগলো। শুভকামনা!
শামীম চৌধুরী
নারীকে সম্মান দেখানো উচিত।
শিপু ভাই
যেখানে সম্মান নেই সেখানে প্রেম নেই, ভালোবাসা নেই।
প্রেমহীন জীবন কিভাবে তৃপ্ত করে একজন মানুষকে!?
ভাল লাগলো গল্পটা। সাবলীল!
জিসান শা ইকরাম
অর্থ প্রাচুর্য সুখ বয়ে আনতে পারেনা, দীপ ভালো আছে একা তার ক্রোধ, রাগ একচেটিয়া ভাবে রায়নার উপর চাপিয়ে দিতে পারে বলে। রায়না সব মেনে নেয় বলে।
সম্মানের সাথে বেঁচে থাকা অনেক আনন্দের, প্রাচুর্য সেখানে অর্থহীন।
ভালো গল্প,
শুভ কামনা।
মনির হোসেন মমি
দারুণ লেখাটা।সত্যিই আপু টানপুরনের সংসারে যদি সমযোজতা থাকে তবে এদের চেয়ে সুখী আর কেউ নয়।