গতমাসে আমার বন্ধুর ডাক্তারি পড়ুয়া মেয়েটি যেদিন হোস্টেলে চলে গেল, সেদিন সে বারংবার ভুল করতে থাকলো। কাছেই এক আত্মীয়ের বাসা থেকে তাঁকে নিয়ে ফিরছিলাম। পথিমধ্যে জানালো তাঁর গায়ের শাল, ফোনের চার্জার রেখে এসেছে ভুলে। বাসায় ফিরে আমার একটি শাল দিয়ে আপাতত কাজ চালিয়ে নেয়া হল। দু’জন মিলে শপিং এ গেলাম। কেনাকাটা শেষে ফিরে এসে দেখি গাড়ির প্যাসেঞ্জার সাইডের দরজা খোলা ! ভুল করে দরজা খোলা রেখেই সে হেঁটে গেছে আমার পিছু পিছু ! আমি যারপরনাই বিরক্ত হই। তাঁকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে ফিরে আসি। গাড়ি গ্যারেজে পার্ক করে নামতে গিয়ে দেখি ফোনটিও ভুলে ফেলে গেছে ! রাতে ফোনটি ফেরত চাইলে বিরক্তিতে বলি, “আজ আর তা ফেরত দিচ্ছি না, তোমার শিক্ষা হওয়া জরুরি, সচেতন হওয়া প্রয়োজন, এমন অন্যমনস্ক হলে চলে !” ফোনের অন্যপ্রান্তে যেন পৃথিবীর সমস্ত শব্দ’রা থেমে গেল আচমকা। যেন ওপ্রান্তের মানুষটির মুখখানা রাতের অন্ধকারের চেয়েও অন্ধকার হয়ে থাকলো। অনুভূতি শূন্য এক পাহাড়ের মত ভাবলেশহীন নিস্তব্দতা।
ক’দিন আগে এক পা’য়ে তীব্র যন্ত্রণা। হঠাৎ এমন ব্যথা’র কারন খুঁজছিলাম। মনে পড়লো, খুব ভোরে বড় ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বাসায় ফিরে ছোটজনকে রেডি করে স্কুলের উদ্দেশ্যে বের হই যখন, তখন হাতে সময় থাকে একেবারে কাঁটায় কাঁটায়। সঠিক সময়ে পৌঁছে দিবো বলে পাঁচ বছরের রিহানকে কোলে নিয়ে দ্রুত পায়ে ছুটি। সম্ভবত এটিই পা’য়ের মাসল পেইন এর কারন। ঈদের আগের রাত। আমি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছি। ছোট্ট রিহান উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিগ্যেস করে, “কি হইসে?”। আমি পৃথিবীর সবচাইতে কষ্টের অভিব্যক্তি চোখে মুখে ফুটিয়ে বলি, “উহু্ ব্যথা”। আচ্মকা সে ফ্লোরে শুয়ে ব্যথাযুক্ত পা’য়ে চুমু খায়, আদর করে। অবশেষে বলে উঠে, “ব্যথা নাই, রাইট মাম্মি ?” আমি পৃথিবীর তীব্র বিস্ময়ে চেয়ে থাকি মাত্র পাঁচ বছর আগে পৃথিবীর বুকে আসা এই ছোট্ট মানুষটির দিকে। একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে ঘটনাটি ওর দাদুকে বলি, বাবা’কে বলি, যার সাথে দেখা হয়, তাঁকেই বলি। আমি কি অল্পতেই অনেক খুশি ! মা, মাতৃত্ব কি এমনই ?
এমন ছোট ছোট মায়াময় ঘটনাগুলোর মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠছে আমাদের সন্তান’রা।
ওরা বড় হবে। হোস্টেলে যাবে। কিংবা দূরের কোন শহরে। ঘরের আনাচে-কানাচে সব মায়া রেখে যেদিন ওরা দূরে যাবে, আমি সম্ভবত বেঁচে থেকেও বারংবার মারা যাবো। মনে পরে গেল, বন্ধুটির অন্যমনস্ক মুখখানা। কানে বেজে উঠলো, বারবার বলে উঠা ছোট্ট অথচ ভয়ংকর কষ্টের একটি লাইন__ “বুকের ভেতরটায় বারবার এমন মোচড় দেয় ক্যান !”
কাল যখন আমাদের আবার দেখা হলো, আমি ক্ষণিক আমার বন্ধুকে দেখি, ক্ষণিক তাঁর কষ্ট দেখি। বছরের পর বছর বুকের সাথে আগ্লে রাখা সন্তানকে বাঁধন আল্গা করে ছেড়ে দেয়া এক মায়ের কষ্ট…
এই মুখ, এই কষ্ট প্রতিটি মায়ের। আমি যেমন আমার মা’কে ছেড়ে হোস্টেলে গিয়েছি, বিদেশ বিভূঁইয়ে এসেছি, তেমনি প্রতিটি মানুষকেই বাস্তবতার কারনে মা’কে ছেড়ে যেতে হয়। বুকে আগলে রাখা সন্তান দূরে গেলে মায়ের অনুভূতি কেমন হয়, আমি আমার বন্ধুকে দেখে জানলাম… খুব কাছ থেকে জানলাম।
আমি যখন বাড়ি ছেড়ে হোস্টেলে যাই তখন মা এটা সেটা গোছায়ে দেয়। তার জন্য একটা আলাদা ব্যাগ হয়ে যায়। আমি বিরক্ত হয়ে বলি আম্মা এত সব কেনো?? আম্মা আমার মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে ” যখন মা হবি তখন বুঝবি”। আমি এটার কারন ঠিক বুঝি না।
আসলেই মায়ের ভালবাসার সামনে পৃথিবীরর সব কিছুই তুচ্ছ মনে হয়। মা ই একমাত্র যিনি জীবিতাবস্থায় সন্তান কে নয়ন ছাড়া করতে চান না, আবার সন্তানের মৃত্যুতেও তাকে কোল ছাড়া করতে চান না,,,,,, (3
রিমি আপু পড়লাম। কি লিখবো বুঝে পাচ্ছিনা।
১৩ বছরের ছেলেটার ছোটবেলার ছবি দেখি আর এখন ওকে দেখি। ওর জগৎ, তাতেই কেমন একটা অনুভূতি। আর ওই ভাবীর মেয়ে বাইরে গেছে, সেটা যে কেমন বুঝছি। না খুব কষ্ট হচ্ছে, এখন বুঝি বাপি-মামনি কেমন ফিল করে এখনও।
২৩টি মন্তব্য
লীলাবতী
আপনার লেখার মাধ্যমে আমিও আপনার বন্ধুর মুখের কষ্টকে দেখলাম আপু।
রিমি রুম্মান
এই মুখ, এই কষ্ট প্রতিটি মায়ের। আমি যেমন আমার মা’কে ছেড়ে হোস্টেলে গিয়েছি, বিদেশ বিভূঁইয়ে এসেছি, তেমনি প্রতিটি মানুষকেই বাস্তবতার কারনে মা’কে ছেড়ে যেতে হয়। বুকে আগলে রাখা সন্তান দূরে গেলে মায়ের অনুভূতি কেমন হয়, আমি আমার বন্ধুকে দেখে জানলাম… খুব কাছ থেকে জানলাম।
নীতেশ বড়ুয়া
আপনারা মাজে মাজে এমন করে লিখেন যে কি বলবো শব্দ খুঁজে পাই না… পৃথিবীর সকল মায়ের জন্য (3 (3 (3 -{@ -{@ -{@ (3 (3 (3
রিমি রুম্মান
একজন মা’য়ের অনুভূতি আরেকজন মা দেখলো খুব কাছ থেকে। সে অভিজ্ঞতা নিয়েই লেখা। সেই সাথে ভবিষ্যতে নিজের সন্তানকে দূরে পাঠিয়ে একাকি থাকতে হবে ভেবে আতংকিত হই।
নীতেশ বড়ুয়া
-{@
মরুভূমির জলদস্যু
বাঁধন সবদাই ধীরে ধীরে আগলা হয়, আবার কখনো কোন কোন ক্ষেত্রে উল্টটাই হয়, সময়ের সাথে সাথে আরো আটসাট হয়ে বসে।
রিমি রুম্মান
সময়ের সাথে সাথে আঁটসাঁট হয়ে বসা বাঁধন আজকাল খুব কমই আছে। আলগা হয়ে আসা বাঁধনই বেশি। কখনো সময়ের প্রয়োজনে, কখনো বাস্তবতার প্রয়োজনে।
মেহেরী তাজ
আমি যখন বাড়ি ছেড়ে হোস্টেলে যাই তখন মা এটা সেটা গোছায়ে দেয়। তার জন্য একটা আলাদা ব্যাগ হয়ে যায়। আমি বিরক্ত হয়ে বলি আম্মা এত সব কেনো?? আম্মা আমার মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে ” যখন মা হবি তখন বুঝবি”। আমি এটার কারন ঠিক বুঝি না।
আপনার লেখা পড়ে বুঝতে পারছি “কেনো”।
রিমি রুম্মান
অনেককিছুই আমরা সেই সময়ে বুঝি না। পরিস্থিতি যখন সামনে নিয়ে যায়, তখন বুঝি। ততদিনে বড় বেশি দেরি হয়ে যায়। ভাল থাকুন পরিবারের সাথে।
অরুনি মায়া
আসলেই মায়ের ভালবাসার সামনে পৃথিবীরর সব কিছুই তুচ্ছ মনে হয়। মা ই একমাত্র যিনি জীবিতাবস্থায় সন্তান কে নয়ন ছাড়া করতে চান না, আবার সন্তানের মৃত্যুতেও তাকে কোল ছাড়া করতে চান না,,,,,, (3
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন, অরুনি মায়া। স্বার্থহীন ভালবাসা একমাত্র বাবা- মায়ের কাছেই পায় প্রতিটি সন্তান।
জিসান শা ইকরাম
সন্তানের জন্য সব বাবা মা ই এমন করেন।
বাস্তবতা আপনি লেখার মাঝে আনতে পারেন।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন সবসময়। আপনি অনেক ভাগ্যবান যে, এখনো মায়ের শীতল ছায়ায় আছেন।
সিকদার
হারায় মানুষ, হারায় সময়,
মুছে যায় আখি জল।
হারায়া না ভালবাসা হারায় না সে
যতই করি না ভুলে থাকার ছল।
রিমি রুম্মান
বাহ্ ! চমৎকার ছোট্ট লেখা ! শুভকামনা জানবেন।
নীলাঞ্জনা নীলা
রিমি আপু পড়লাম। কি লিখবো বুঝে পাচ্ছিনা।
১৩ বছরের ছেলেটার ছোটবেলার ছবি দেখি আর এখন ওকে দেখি। ওর জগৎ, তাতেই কেমন একটা অনুভূতি। আর ওই ভাবীর মেয়ে বাইরে গেছে, সেটা যে কেমন বুঝছি। না খুব কষ্ট হচ্ছে, এখন বুঝি বাপি-মামনি কেমন ফিল করে এখনও।
রিমি রুম্মান
আমরা যখন সেই পর্যায়ে যাবো তখনকার কথা ভেবে এখনই যেন মনটা খারাপ হয়ে যায়। একজন মায়ের কষ্ট এতোটাই সংক্রামক যে, আরেকজন মা’কে খুব সহজেই এফেক্ট করে, তাই না ?
ব্লগার সজীব
আম্মু আব্বুর কষ্টটি বুঝতে পারলাম আবারো।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন আপনার বাবা-মা’কে নিয়ে। শুভকামনা জানবেন।
অরণ্য
আপনার লেখা পড়েছি অনেক আগেই – মোবাইলে। আমার ভাল লেগেছে। মাতৃত্ব ও পিতৃত্ব আমাকে নাড়াও দিল।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকবেন। শুভকামনা জানবেন।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
বাস্তবতা এটাই মায়ের চিরন্তন ত্যাগতিথিক্ষার এক অভূতপূর্ব রূপ। -{@
রিমি রুম্মান
একজন মায়ের এই রুপ খুব কাছ থেকে আরেকজন মাকে নিয়ে গেল কঠিন এক উপলব্দির দিকে… ভাল থাকুন সব সময়।