‘সভ্যতা হলো সাংস্কৃতিক সৃজনশীলতা, যা সামাজিক শৃঙ্খলা, আইনি শাসন ও তুলনামূলক জনকল্যাণের মধ্য দিয়ে অস্তিত্ব লাভ করে। সভ্যতা হচ্ছে জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক ফসল। আর যে সমাজ, সামাজিক শৃঙ্খলা সাধন করে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়ন, অগ্রগতি ও মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধির কথা ভাবে, সেই সমাজই সভ্য সমাজ।’
পাঠক,ডোরান্টের উক্তিটির প্রথম লাইনটি লক্ষ্য করুন- সভ্যতা হলো সাংস্কৃতিক সৃজনশীলতা, যা সামাজিক শৃঙ্খলা, আইনি শাসন ও তুলনামূলক জনকল্যাণের মধ্য দিয়ে অস্তিত্ব লাভ করে।
লাইনটির সারকথাটি এমন যে সভ্যতার অস্তিত্ব লাভের জন্য সামাজিক শৃঙ্খলা, আইনি শাসন ও “তুলনামূলক জনকল্যাণ” ভূমিকা রাখে। বলে রাখা ভালো সভ্যতার অস্তিত্ব রক্ষায় এই তিনটি উপাদানের একটি উপাদানের ঘাটতি হলে সভ্যতার অস্তিত্ব কিছুটা হলেও বিলীনের আশংকা রয়েই যায়। আমাদের এই আধুনিক বিশ্বে সামাজিক শৃঙ্খলা ও আইনি শাসন এই দুটি উপাদানের ঘাটতি না থাকলেও “জনকল্যাণ” নামক এই উপাদানটির যথেষ্ট ঘাটতি রয়ে গিয়েছে বলে আমি মনে করি, যদিও সেটা কিছু কিছু বিশেষ সম্প্রদায়, দেশ কিংবা জাতির জন্যই প্রযোজ্য।
পাঠক, নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছেন হঠাৎ কেন আমার এরকমটা মনে হল, তাও আবার “কিছু কিছু বিশেষ সম্প্রদায়, দেশ কিংবা জাতির জন্যই”… হ্যাঁ, আমি এটার কিছু দৃষ্টান্ত আপনাদের দেবো এবং এক্ষুণি দেবো।
“নেপালে ভূমিকম্পের ত্রান হিসেবে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে গরুর মাংস পাঠানো হয়েছে”- হ্যাঁ ঠিকই পড়ছেন। উল্লেখ্য, নেপালের অধিকাংশ মানুষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তাঁরা সাধারণত গরুর মাংস খান না। ত্রান পাঠানোর এই ব্যাপারটিকে তাহলে “নির্মম রসিকতা” ছাড়া আর কি বলবো? তা, এরকম দুর্যোগে পড়লে মুসলমান ভাইয়দের “শূকরের মাংস” খেতে আপত্তি থাকবে নাতো?
ভারতের মৌলবাদী হিন্দুরা বলছে, রাহুল গান্ধীর গরুর মাংস খেয়ে কেদারনাথ মন্দির দর্শনই নাকি ভূমিকম্পের কারণ! আহা ঈশ্বর! মাত্র একজন “নিয়মভঙ্গ কারীর” সাজা তুমি এতো “নিয়ম পালনকারী” কে দিলে? কই যে নিয়মভঙ্গ কারীরকে সাজা দেবার কথা সে তো দিব্যি বেঁচে আছে, বরং তুমি বিনাশ করেছো তোমার পূজারীদের কেই। যারা দিন রাত তোমার চরণে ফুল নিবেদন করতো। বলি এখন কি করে যোগাবে সেই ফুল? তুমি নাকি তাতেও অপারগ…..
এদিকে খ্রিষ্টান মিশনারিজ থেকে পাঠানো হয়েছে লাখখানেক “বাইবেল”। এতো দুঃখেও না হেসে পারছি না। যেখানে ইট-সুড়কির নিচে পিষ্ট হয়ে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে সেখানে “ঈশ্বরের বন্দনা” কতোটুকু সাজে? বলি ঈশ্বরের বন্দনাই যদি মানবতা থেকে মুখ্য হয় তাহলে কোথায় ছিলেন তিনি যখন সবকিছু নিমিষেইই মিলিয়ে যাচ্ছিলো মাটিতে? তখন তো তাঁরই বন্দনা চলছিলো…..
ইরানের একজন আলেম নাকি জেনেছেন “বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক” ভূমিকম্পের প্রধান কারণ! তাইবুঝি!! তা, যারা এহেন অপরাধ করেছে তাঁদের উপর রুষ্ট না হয়ে শুধু এদের উপরই কেন ভূমিকম্পের আঘাত! আজকাল দীনের (!) পথের লোকেরাও নাকি ৬ বছরের কিশোরীকে ধর্ষণ করছে। সে ব্যাপারে ঈশ্বরের মতবাদ জানতে ইচ্ছে হয়। আচ্ছা, যে বাচ্চাটি ওর বাবা মায়ের “সহী যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে” জন্ম নিয়েছিলো তাঁকেও কেন আজ ইট পাথরে পিষ্ট হয়ে মরতে হল জানেন কেউ?
শুরুতেই বলেছিলাম এই আধুনিক বিশ্বে সামাজিক শৃঙ্খলা ও আইনি শাসন এই দুটি উপাদানের ঘাটতি না থাকলেও “জনকল্যাণ” নামক এই উপাদানটির যথেষ্ট ঘাটতি রয়ে গিয়েছে বলে আমি মনে করি আর আমার মনে করার পেছনের এই কারণই হল এটা।
উপরের প্রতিটি ঘটনায় মানবতার চরম বিপর্যয় প্রকাশ পায়। আর বিপর্যস্ত এই মানুষগুলো যেন নেপালের ইট পাথরের নিচে চাপা পড়ে মরে যাওয়া মানুষগুলোর চাইতেও বেশি বিপর্যস্ত। এদের কাছে মানবতার কোন মূল্য নেই, জীবনের কোন মূল্য নেই। এদের কাছে মূল্য আছে আছে নিজেদের তৈরী মূর্তি মাটির ঈশ্বরের কিংবা অদৃশ্যে বাস করা ঈশ্বরের। আর সেই ঈশ্বরের অতি ভক্তি করতে করতে হয়তো ঈশ্বরের বানীকেই এরা ভুলে গেছে। এরা মানে না “মানব সেবার মাঝেই ঈশ্বরের সেবা নিহিত”। ধর্মান্ধতা এদের চোখকে এমনভাবে অন্ধ করে রেখেছে যে চোখ থাকতেও এরা অন্ধ, আর এরা অন্ধই রয়ে যাবে যতোদিন না এদের চোখ থেকে ধর্মান্ধতার কালো পর্দাটা সরে যাবে।
তবে এতো খারাপ খবরের মাঝে সবচাইতে ভালো খবর কি জানেন এই ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ছোট্ট এই দেশটা নেপালের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্য সবাই যখন ধর্মীয় বিকারগ্রস্ততা চর্চায় ব্যস্ত তখন আমাদের দেশ থেকে নেপালের জন্য ওষুধ, চিকিৎসক, ফায়ারব্রিগেড, বিমানবন্দরে জরুরী অ্যাক্সেস, ট্রানজিট সহ হাজার হাজার মানুষের শুভবার্তা পাঠাচ্ছে। একেই বলে সভ্যতা। আর এই সভ্যতার পথ ধরেই পৃথিবী এগিয়ে যাবে। পৃথিবীর মানচিত্রে এই ছোট্ট দেশটার নাম উজ্জল বর্ণে লেখা থাকবে। শেষ করবো খুব প্রিয় গানের লাইনগুলো দিয়ে-
ঠিক যেখানে দিনের শুরু অন্ধ কালো রাত্রি শেষ
মন যতদুর চাইছে যেতে ঠিক ততদূর আমার দেশ
এই কাঁটাতার জঙ্গী বিমান এই পতাকা রাষ্ট্র নয়
দেশ মানে বুক আকাশ জোড়া ইচ্ছে হাজার সূর্যোদয়
এ মানচিত্র জ্বলছে জ্বলুক এই দাবানল পোড়াক চোখ
আমার কাছে দেশ মানে এক লোকের পাশে অন্য লোক
দেশ মানে কেউ ভোরের স্লেটে লিখছে প্রথম নিজের নাম
হাওয়ার বুকে দুলছে ফসল একটু বেঁচে থাকার দাম
সব মানুষের স্বপ্ন তোমার চোখের তারায় সত্যি হোক
আমার কাছে দেশ মানে এক লোকের পাশে অন্য লোক
এ মানচিত্র জ্বলছে জ্বলুক এই দাবানল পোড়াক চোখ
আমার কাছে দেশ মানে এক লোকের পাশে অন্য লোক…
২২টি মন্তব্য
রিপন তালুকদার
এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে গিয়ে আরো কত তামাশা দেখ্তে হবে আমাদের !
ফাতেমা জোহরা
সেই সাথে অনেক ভালো কিছুও তো দেখবো আমরা।
জিসান শা ইকরাম
ধর্মীয় মৌলবাদীদের এসব কর্মকাণ্ড দেখে,জেনে নিজেকে কোন ধর্মের অনুসারী বলতে লজ্জা করে।
পাকিরা বরাবরই এমন আহাম্মক।
হিন্দু মৌলবাদীদের এমন যুক্তি উন্মাদদের কথা মনে করিয়ে দেয়
খৃষ্টানদের নেপালে এই মুহুর্তে বাইবেল পাঠানো হাস্যকর
আর ইরান তো প্রথম থেকেই ধর্মান্ধ।
এই সব ধর্মান্ধদের কবল থেকে মানবতা মুক্তি পাক।
ভালো লিখেছেন।
ফাতেমা জোহরা
আমিও চাই। কারণ যতোদিন না পর্যন্ত এসব ধর্মান্ধতা পৃথিবীতে টিকে থাকবে এই পৃথিবী প্রকৃতরূপে “মানুষের পৃথিবী” হয়ে গড়ে উঠবে না।
আরিফ আরাফাত রুশো
এরা যে কি পরিমান স্টুপিড হয়…
ফাতেমা জোহরা
হুম, ধারনার বাইরে।
অরণ্য
লেখাটি ভাল লাগলো। তবে একই জিনিসের ভিউ পয়েন্ট চেঞ্জ হলে তা আলাদাভাবেই প্রতিয়মান হয়। আমি কাজ করি ব্র্যান্ড ম্যানেজমেন্টে। আমার এক ছোটভাই আমাকে ধরেছে সেদিন – “বস্!দারুণ সুযোগ যাচ্ছে চারিটি কনসার্ট করার। … নেপালকে সামনে রেখে আপনার ব্র্যান্ডের জানান আপনি দিয়ে দিলেন”।
ক্লোজিং ইজ এক্সিলেন্ট।
“সব মানুষের স্বপ্ন তোমার চোখের তারায় সত্যি হোক
আমার কাছে দেশ মানে এক লোকের পাশে অন্য লোক”
ফাতেমা জোহরা
//তবে একই জিনিসের ভিউ পয়েন্ট চেঞ্জ হলে তা আলাদাভাবেই প্রতিয়মান হয়//
এই লাইনটা বুঝলাম নাহ্ !
সঞ্জয় কুমার
এ বিষয়ে আমার একটা লেখায় উনি এমন মন্তব্য করেছেন । এটা ওনার পাকিস্তান প্রেম না আমাদের বোঝার ভুল । সেটাও ঠিকমতো বোঝাতে পারেন নি ।
ফাতেমা জোহরা
এভাবে ধোয়াশা রেখে কথা বলাটা বিরক্তিকর একটা বিষয়। আগে থেকেই মন্তব্য করবো না। দেখি উনি কি বলেন…
লীলাবতী
এদের আহাম্মকি দেখলে হতবাক হয়ে যাই আপু।
ফাতেমা জোহরা
এটা আহম্মকি না। জেনে বুঝে অন্যের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া।
খেয়ালী মেয়ে
নির্মম রসিকতা ছাড়া এ আর কিছুই না…
ফাতেমা জোহরা
সেটাই আপু।
কৃন্তনিকা
বাংলাদেশ উজ্জ্বল হয়ে থাকবে কিনা জানি না…
তবে আমাদের দেশে এখনো মানুষের অস্তিত্ব আছে, কতদিন থাকবে জানি না… 🙁
অত্যন্ত যৌক্তিক একটি পোস্ট (y)
ফাতেমা জোহরা
থাকবে আপু থাকবে। সবে তো শুরু। আরো অনেক পথ এগুবে আমাদের এই দেশটা…
শুন্য শুন্যালয়
প্রহসনের কি অপূর্ব চিত্র!!
ফাতেমা জোহরা
এরকম প্রহসন একমাত্র এসব ধর্মান্ধদের দ্বারাই সম্ভব।
রিমি রুম্মান
কতটা নির্দয়, নির্মম রসিকতা পৃথিবীর বুকে !!!
ফাতেমা জোহরা
অবাক হই আপু বড্ড অবাক হই 🙁
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
মানুষের আবেগ নিয়ে তামাশা ঠিক নয়।ভাল লিখেছেন।
ইমন
প্রহসন ….