আমার শহরে বাবা’র একটি আইসক্রিম ফ্যাক্টরি ছিল। সেখানে কুষ্টিয়ার একজন ম্যানেজার ছিল, যিনি আমাদের ভালোবাসতেন, খোকী বলে ডাকতেন অনেকটা রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালা স্টাইলে। আর সেই ভালোবাসা থেকেই আমাদের তিন ভাইবোনের জন্যে স্পেশাল মজার আইসক্রিম বানাতেন নিজস্ব রেসিপি দিয়ে। কিন্তু ততদিনে উপরিভাগের অংশটুকু যে আসলে নারকেল নয়, পাউরুটি__ সেটা আমরা জেনে গেছি। আমাদের আর আইসক্রিম ভালো লাগে না। যখন নিজস্ব ফ্যাক্টরি ছিল না, তখন পাশের দোকান থেকে লুকিয়ে কেনা আইসক্রিম অমৃত মনে হত। আসলে, কোন কিছু যতক্ষণ দূরের থাকে, ততক্ষণই আকর্ষণ থাকে। কাছের এবং হাতের মুঠোয় পাবার পর আকর্ষণ কমে যেতে থাকে…
খুব ভোরে হকাররা আইস্ক্রিম ভর্তি বাক্স কাঁধে চাপিয়ে গ্রাম-গঞ্জের উদ্দেশ্যে শহর ছেড়ে যেতো। গ্রামের মেঠো পথ, ক্ষেতের আইল ধরে হেঁটে হেঁটে প্রচণ্ড গরমে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে সেগুলো বিক্রি করতো। কিছু হকার আইস্ক্রিম ভর্তি গাড়ি নিয়ে শহরময় আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াতো। বেচাকেনা শেষে সারাদিনের বিরামহীন হেঁটে চলা পা’গুলো, ঘেমে-নেয়ে একাকার ক্লান্ত শরীরগুলো সন্ধ্যায় আঁধার ঘনাবার সময়টাতে ফিরে আসতো। দেনা-পাওনা হিসেব-নিকেশ মিটাবার মুহূর্তে ক্লান্তি ভুলে হাসি-গল্পে মেতে উঠতো। অতঃপর স্ত্রী-সন্তানদের কাছে নীড়ে ফিরে যেতো। তাঁদের সন্তানরা, যারা জন্ম থেকেই আর্থিক সংকট চলমান দেখতে দেখতে বেড়ে উঠেছে, তাদের কাছে দু’বেলা অন্নের সংস্থান আগে। যেন বাবাকে কাছে না পাওয়াতে তাদের কোন অতৃপ্তি নেই। বাবা’কে কাছে পাওয়াই বরং তাদের জন্যে একরকম বিলাসিতা ! তবুও তাঁরা হাসি-খুশি ঘুরে বেড়ায়, ডাংগুলি খেলে, কট্কটি কিনে খায়। এটি তাঁদের শৈশব…
ছেলেকে নিয়ে এক জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যাই। ওর বাবার কাজ থাকাতে যেতে পারেনি। সব বাচ্চারা অনেক হৈ, হুল্লোড়, আনন্দ করে। অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফিরছি। পিছনের সীটে বসা ছেলে প্রশ্ন করলো___পার্টিতে সবার বাবা ছিল, আমার আব্বুজি কেন ছিল না ? বাবাকে ছাড়া সে পার্টি এন্জয় করেনি, সেটিও জানিয়ে দিলো। এটি জানার পর তাঁর বাবা খুশিতে আত্মহারা। ছেলে তাঁকে মিস করে__ বিশাল ব্যাপার ! সেই থেকে যেদিন পার্টি থাকে, সেদিন সব কাজ ফেলে বাবা তাঁর ছেলেদের সাথেই থাকেন। ছেলেরাও হাসি, আনন্দে মেতে থাকে পুরোটা সময়। এটি ওদের শৈশব …
একই আকাশের নিচে শিশুদের দুই রকম শৈশব ! কি অদ্ভুত__ তাই না ?
১৭টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
” আসলে, কোন কিছু যতক্ষণ দূরের থাকে, ততক্ষণই আকর্ষণ থাকে। কাছের এবং হাতের মুঠোয় পাবার পর আকর্ষণ কমে যেতে থাকে…” অত্যন্ত সঠিক উপলব্দি।
আপনার লেখা প্রথম দিকে পড়ে বুঝা যায়না,শেষ কিভাবে হবে
আর এমন ভাবে লেখা শেষ করেন যে লেখাকে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যান
আপনিও দিন দিন ভিন্ন উচ্চতায় পৌছে যাচ্ছেন।
একই আকাশের নীচে আলাদা শৈশব,সবার জীবন।
রিমি রুম্মান
জীবন থেকে নেয়া সব লেখা। আমি লিখি মনে যা আসে। তবুও কেউ কেউ ভালোলাগা নিয়ে পড়ে। ভালো লাগে, উৎসাহিত হই।
স্বপ্ন নীলা
আমারও শৈশবের কথাগুলো মনে পড়ে গেল,কত সুন্দর রাঙানো ছিল সেই সব দিন — আমাদের আর এখনকার সন্তানদের শৈশবের মধ্যে কত ফারাক !!
দারুনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন। শুভকামনা নিরন্তর।
নীলাঞ্জনা নীলা
উফ আইসক্রিমের কথা লিখলেন।কিছু আইসক্রিম ছিল লাল টকটকে,খেলেই ঠোট লাল হয়ে যেতো 🙂 খেতাম আমিও।
আইসক্রিমে পাউ রুটি দেয়া হয়,জানলাম আজ প্রথম।এই বিভক্তি থাকবেই।সবার শৈশব এক নয়,সবার জীবন এক নয়। অত্যন্ত ভালো লিখেছেন।
রিমি রুম্মান
নারকেল মনে করে যে অংশটুকু তৃপ্তি নিয়ে খেতাম, সেটি আসলে পাউরুটি 😀
শুন্য শুন্যালয়
আমিও তো জানতাম না আইসক্রিমে পাউরুটি দেয়া হয়!! আপনার কথা শুনে এখন মনে হচ্ছে আইসক্রিম ওয়ালা বিয়ে না করে ভালোই করেছি। কতো যে ভেবেছি সে সময়, ইশ যদি একজন আইসক্রিম ওয়ালাকে বিয়ে করতে পারতাম 😛
মানুষের জীবনে ভিন্নতা থাকবেই। নানা রঙের মানুষ। খুব ভালো লেখা।
রিমি রুম্মান
আইসক্রিম ওয়ালা বিয়ে না করাতে একদিকে ভালই হল। 😀
ব্লগার সজীব
আপু আপনার লেখা পড়ে আইসক্রিম ওয়ালা আংকেলের কথা মনে পড়ে গেলো।কাঠের বাক্সে আইসক্রিম নিয়ে এসে দাড়াতেন স্কুলের গেটের সামনে।টিফিনের সময় এক দৌড়ে তার কাছে যেতাম আইসক্রিম কিনে খেতে।অনেকদিন টাকা দিতাম না ইচ্ছে করে।পরদিন যখন বলতাম,আংকেল আমার কাছে একটির দাম পাবেন,উনি হেসে উড়িয়ে দিতেন, মানতেই চাইতেন না যে টাকা পাওনা আমাদের কাছে।এখন বুঝি,উনি ইচ্ছে করে এর দাম নিতেন না।দীর্ঘ দিন স্কুলের গেটেই আইসক্রিম বিক্রী করতেন। শীতের সময় দেখতাম না।
ভিন্নতা থাকবেই আপু।সমাজটাই যে এমন। আপনার লেখা খুবই ভালো লাগে।
রিমি রুম্মান
ইস্ এমন আইসক্রিম ওয়ালা যদি আমার ছোটবেলায় পেতাম…
খেয়ালী মেয়ে
কোন কিছু যতক্ষণ দূরের থাকে, ততক্ষণই আকর্ষণ থাকে। কাছের এবং হাতের মুঠোয় পাবার পর আকর্ষণ কমে যেতে থাকে (Y)
লোভনীয় খাবার এই আইসক্রীম, এই খাবারটাকে ছোটবেলায় এড়িয়ে চলতে পেরেছে এমন মানুষের সংখ্যা খুব নগন্যই হবে হয়তো….
অদ্ভুত আর বিচিত্রতায় ভরপুর এই জীবন…আরো অনেক বিচিত্রতা আর পরিবর্তন অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য………
রিমি রুম্মান
জীবনের প্রতিটি ধাপেই পরিবর্তন অপেক্ষা করছে আমাদের জন্যে। তবে যায় দিন ভাল, আসে দিন খারাপ অবশ্যই ।
ছাইরাছ হেলাল
অনেকদিন পর্যন্ত পাউরুটিকে নারকেল ই ভেবে মজা করে খেয়েছি।
অবস্থান ভেদে শিশুদের আনন্দ ও আলাদা হয়ে যায়।
রিমি রুম্মান
কেউ অল্পতেই আনন্দিত, কেউ অনেক পেয়েও আনন্দিত নয়। দুই রকম শৈশব ভাবায় খুব…
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
নদীর এপার ওপারের দীর্ঘষাসের কথার মতো এটা মনে খোরাক।এমনি হয় শিশুদের বেড়ে মা বাবার আদর অনেক প্রয়োজন।
সঞ্জয় কুমার
লেখাটা পড়ে নষ্টালজিক হয়ে গেলাম । শৈশবের স্মৃতি ভোলা যায় না । সুন্দর উপস্থাপনা
ইমন
নস্টালজিক 🙂