শুভ জন্মদিন মামনি

নীলাঞ্জনা নীলা ২৫ আগস্ট ২০১৫, মঙ্গলবার, ১২:০৮:৪৩পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি, বিবিধ ৩৪ মন্তব্য
বাপি এই ছবিটি-ই দেখে প্রথম
বাপি এই ছবিটি-ই দেখে প্রথম

“আমার মল্লিকাবনে যখন প্রথম ধরেছে কলি
তোমারি লাগিয়া তখনই বন্ধু বেঁধেছিনু অঞ্জলী।”

হারমোনিয়মে এ গানটি যখন প্রথম শুনি, যার কন্ঠে শুনি সে আমার মামনি। এতো দারুণ কন্ঠ, নৃত্যশৈলীতেও কম না। আর জ্ঞান হবার পর যে গানটির সাথে বড়ো হয়ে উঠেছি, যা না শুনলে আমি কিছুতেই চোখ বুজতাম না। সেটি হলো,

“আমার সকল দুঃখের প্রদীপ
জ্বেলে দিবস
গেলে করবো নিবেদন
আমার ব্যথার পুজার হয়নি সমাপন।”

আমার মা। কখনও বুঝিনি কিছু একটা অনুভূতি তাঁর জন্যে আমার আছে। সবসময় বাপি, বাপি করে গেছি। আচ্ছা তখন কি তাঁর কষ্ট হতোনা একটুকুও? কতো কষ্ট করে জন্ম দিয়েছিলো, তার আত্মজার মুখ তিনদিন অজ্ঞান থাকার পর দেখেছে। শুনেছি আমার জন্মের সময় অনেক কষ্ট পেয়েছিলো মামনি। সব মায়েরাই পেয়ে থাকে যদিও। কিন্তু তখন ছোট্ট একটা চা’ বাগানে ইলেক্ট্রিসিটি ছাড়া হারিকেনের আলোয়, ডাক্তার ছাড়া শুধুমাত্র একজন মিডওয়াইফ আর একজন ধাত্রীর সহায়তায় আমার জন্ম। সেই মায়ের কাছে কতোবার গিয়েছি? যখন মা হলাম, তখন বুঝেছি মা আসলে কি!

বিয়ের ঠিক পর
বিয়ের ঠিক পর

আজ ২৫ আগষ্ট আমার মামনির জন্মদিন। কিছু মজার কথা বলি। মামনি অনেক আহ্লাদী ভাব দেখায়। যখনই ফোন দেই, গান গেয়ে উঠি—
Happy Birthday to you
Happy Birthday to You
Happy Birthday dear Mamoni
Happy Birthday to you.

তখন বলবে, “আরে কবে জন্মদিন? তুই যে কি! আজ বুঝি?” আসলে ঠিক জানে আমি তার জন্মদিনের তারিখ ভুলিনা কখনো। যখন ঢাকায় থাকতাম তখন হাজার ব্যস্ততা থাকুক যে কোনো একটা গিফট নিয়ে আসতামই না জানিয়ে। বাপি চিঠি লিখতো, “তোর মামনি জানতে চেয়েছে তুই সামনের সপ্তাহে আসবি তো?” উত্তরে লিখতাম আসা তো হবে না। ক্লাশ টেষ্ট আছে। একবার যা হলো মামনির রান্নায় অনেক কষ্ট হতো, টাকা জমিয়ে গ্যাসের চুলা বানানোর অর্ডার দিলাম গ্রীনরোডের একটি দোকানে। যেদিন শমশেরনগর রওয়ানা হই, অনেক ভোরে বেবীট্যাক্সি নিয়ে, পথে পুলিশ দিলো আটকে। পুলিশ তো বুঝিনি। কারণ তারা সিভিল ড্রেসে ছিলো। আমি ভাবলাম এরা ছিনতাইকারী। বেবীট্যাক্সিওয়ালা শুধু বললো আপা ব্যাগ যদি দেখতে চায় সেটা যেনো দেখাই। তাহলে নাকি আর ঝামেলা হবেনা। চেক করা শুরু করলো, এই গ্যাসের চুলা নাকি ভারত থেকে এনেছি। মেমোটা ভাগ্যিস ছিলো। বললো নামুন আপনি। বললাম দেখুন আমার হল বন্ধ হয়ে গেছে, টাকাও নেই যে আবার ট্রেনের টিকিট কিনবো।যাক কি ভাগ্যে সিনিয়র ইন্সপেক্টর এসে পড়লো। আমায় দেখে বললেন, “উনাকে যেতে দাও।” সেদিন বেবীট্যাক্সিওয়ালাটা যা সার্ভিস দিলো। সোনারগা হোটেলের সামনে থেকে দশ মিনিটের মধ্যে নিয়ে পারাবত ট্রেনটা ধরিয়েছিলো। বেবীট্যাক্সিটাকে স্ট্যান্ডে রেখেই বললো, “আপা ব্যাগ দেন, চিন্তা কইরেন না ট্রেনে আপনারে উঠাইয়াই দিমু।” শুধু মামনির জন্মদিনটা যাতে মিস না হয়। এই মাসটাকে আমি ভালোবাসি শুধু আমার এই আহ্লাদী মেয়েটির জন্মদিন বলে। এই মেয়েটি না এলে, আমি তো আসতেই পারতাম না।

দুজনে দুজনার
দুজনে দুজনার

মামনি বাসায় বাচ্চাদের নিয়ে খেলার আসরও বসাতো। লুকোচুরী, কানামাছি, হাডুডু কতোরকমের যে খেলা। নাচ শেখাতো। মামনি গার্লস হাইস্কুলের টিচার ছিলেন। তার ছাত্রীরা এতো ভালোবাসতো, মামনি অনেক গরীব ছাত্রীদের বেতন, বই-খাতাও কিনে দিতো। ভালোবাসা না পেয়ে কি পারে? বেতন জমতোই না। পৌষ-পার্বণের অনুষ্ঠানে বন্ধুদের নেমন্ত্রণ দিতাম, মামনি বলতো আমাকেও শিখতে। বলতাম কি ভাবো পারবো না? মামনি জানতো মারাত্মক ফাঁকিবাজ আমি রান্নায়। তাও ভাব নিয়ে বসেই একটু পর বলতাম আরে কিছু পড়া তো বাকী থেকে গেছে। মামনি বলতো, “এতো ফাঁকি দিতে পারিস।” একবার পিঠা চুরী করে খাওয়া। মামনি জানি কার জন্যে বানিয়ে রেখেছিলো। তাকে দিতে গিয়ে দেখে বয়াম পুরো খালি। নীচে দুটো পদ্মখাজা পড়ে আছে। কোনোদিন মারেনি, চোখের ওই নীরব চাহনিতেই কাৎ। বন্ধুরা এলে বলতো, “তুই একটা বোরিং। আন্টি কোথায়?” গালা-গালি করে মারও দিতাম ওদের। মামনি বলতো, “আহারে করিস কি?” আমার একটা বন্ধু কাইয়ূম হিসেব রাখতো কয়টা মার খেয়েছে আমার হাতের? মামনি অনেক আদর করতো ওটাকে। “কাইয়ূম বাবা রে আজ কয়টা?” কাইয়ূম বলতো, “কাকী আজ বেশী না, দুইটা।” মামনি শান্ত কিন্তু দারুণ আড্ডা দিতে পারতো। আসরকে মাতিয়ে রাখার একটা বিশাল শক্তি ছিলো তার মধ্যে। এখনও কিছুটা থেকে গেছে। আজ সকালে নাতী আর দিদিমনির আড্ডা হলো স্কাইপে। আমি তো ঘুম। আমার ছেলেটাও কি যে দুষ্টু ভিডিও অন করে নিয়ে এসে আমায় দেখালো। মামনির গলা শুনে ঘুম ভাঙ্গলো। চশমা ছাড়া দেখিনা। চশমা পড়লাম, পাশে বাপি। বলে গান শোনা। বললাম কোনটা? বলে, “তোর ঘুমের সময় তোর মা যে গানটা গাইতো।” যেই গাইলাম কান্না শুরু। থামিয়ে দিয়ে বললাম, “কষ্ট করে ঘুম থেকে উঠে না খেয়ে গান শোনাই আর তুমি কাঁদো?” বলতেই হাসি। বলে, “তুই বলে চুল কাটছোস? দেখা।” বললাম তুমি শেভ করোনা কেন? মামনি পাশ দিয়ে বললো, “আর বলিস না, পরশু শেভ করেছে আজ এতো আবার। একেবারে রাস্তার পাশে আগাছা আছে না, ওভাবে বাড়ে।” এমনভাবে বলে মামনি হাল্কা হাসি দিয়ে পেট ফেঁটে যায় কথায়।  আর কি বলবো? বড্ড অভিমানী, কষ্ট এ জীবনে কাউকে শেয়ার করেনি। মামনিকে আজোও বুঝে উঠতে পারিনা, ওই হাসিটুকুর জন্য। তার কান্না দেখিনি। ওটাই আমি পেয়েছি। নাহ আজ এটুকুই থাক।

শুভ জন্মদিন মামনি।

শুভ জন্মদিন মামনি
শুভ জন্মদিন মামনি
৭৪০২জন ৭৩৯০জন
0 Shares

৩৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ