“আমার মল্লিকাবনে যখন প্রথম ধরেছে কলি
তোমারি লাগিয়া তখনই বন্ধু বেঁধেছিনু অঞ্জলী।”
হারমোনিয়মে এ গানটি যখন প্রথম শুনি, যার কন্ঠে শুনি সে আমার মামনি। এতো দারুণ কন্ঠ, নৃত্যশৈলীতেও কম না। আর জ্ঞান হবার পর যে গানটির সাথে বড়ো হয়ে উঠেছি, যা না শুনলে আমি কিছুতেই চোখ বুজতাম না। সেটি হলো,
“আমার সকল দুঃখের প্রদীপ
জ্বেলে দিবস
গেলে করবো নিবেদন
আমার ব্যথার পুজার হয়নি সমাপন।”
আমার মা। কখনও বুঝিনি কিছু একটা অনুভূতি তাঁর জন্যে আমার আছে। সবসময় বাপি, বাপি করে গেছি। আচ্ছা তখন কি তাঁর কষ্ট হতোনা একটুকুও? কতো কষ্ট করে জন্ম দিয়েছিলো, তার আত্মজার মুখ তিনদিন অজ্ঞান থাকার পর দেখেছে। শুনেছি আমার জন্মের সময় অনেক কষ্ট পেয়েছিলো মামনি। সব মায়েরাই পেয়ে থাকে যদিও। কিন্তু তখন ছোট্ট একটা চা’ বাগানে ইলেক্ট্রিসিটি ছাড়া হারিকেনের আলোয়, ডাক্তার ছাড়া শুধুমাত্র একজন মিডওয়াইফ আর একজন ধাত্রীর সহায়তায় আমার জন্ম। সেই মায়ের কাছে কতোবার গিয়েছি? যখন মা হলাম, তখন বুঝেছি মা আসলে কি!
আজ ২৫ আগষ্ট আমার মামনির জন্মদিন। কিছু মজার কথা বলি। মামনি অনেক আহ্লাদী ভাব দেখায়। যখনই ফোন দেই, গান গেয়ে উঠি—
Happy Birthday to you
Happy Birthday to You
Happy Birthday dear Mamoni
Happy Birthday to you.
তখন বলবে, “আরে কবে জন্মদিন? তুই যে কি! আজ বুঝি?” আসলে ঠিক জানে আমি তার জন্মদিনের তারিখ ভুলিনা কখনো। যখন ঢাকায় থাকতাম তখন হাজার ব্যস্ততা থাকুক যে কোনো একটা গিফট নিয়ে আসতামই না জানিয়ে। বাপি চিঠি লিখতো, “তোর মামনি জানতে চেয়েছে তুই সামনের সপ্তাহে আসবি তো?” উত্তরে লিখতাম আসা তো হবে না। ক্লাশ টেষ্ট আছে। একবার যা হলো মামনির রান্নায় অনেক কষ্ট হতো, টাকা জমিয়ে গ্যাসের চুলা বানানোর অর্ডার দিলাম গ্রীনরোডের একটি দোকানে। যেদিন শমশেরনগর রওয়ানা হই, অনেক ভোরে বেবীট্যাক্সি নিয়ে, পথে পুলিশ দিলো আটকে। পুলিশ তো বুঝিনি। কারণ তারা সিভিল ড্রেসে ছিলো। আমি ভাবলাম এরা ছিনতাইকারী। বেবীট্যাক্সিওয়ালা শুধু বললো আপা ব্যাগ যদি দেখতে চায় সেটা যেনো দেখাই। তাহলে নাকি আর ঝামেলা হবেনা। চেক করা শুরু করলো, এই গ্যাসের চুলা নাকি ভারত থেকে এনেছি। মেমোটা ভাগ্যিস ছিলো। বললো নামুন আপনি। বললাম দেখুন আমার হল বন্ধ হয়ে গেছে, টাকাও নেই যে আবার ট্রেনের টিকিট কিনবো।যাক কি ভাগ্যে সিনিয়র ইন্সপেক্টর এসে পড়লো। আমায় দেখে বললেন, “উনাকে যেতে দাও।” সেদিন বেবীট্যাক্সিওয়ালাটা যা সার্ভিস দিলো। সোনারগা হোটেলের সামনে থেকে দশ মিনিটের মধ্যে নিয়ে পারাবত ট্রেনটা ধরিয়েছিলো। বেবীট্যাক্সিটাকে স্ট্যান্ডে রেখেই বললো, “আপা ব্যাগ দেন, চিন্তা কইরেন না ট্রেনে আপনারে উঠাইয়াই দিমু।” শুধু মামনির জন্মদিনটা যাতে মিস না হয়। এই মাসটাকে আমি ভালোবাসি শুধু আমার এই আহ্লাদী মেয়েটির জন্মদিন বলে। এই মেয়েটি না এলে, আমি তো আসতেই পারতাম না।
মামনি বাসায় বাচ্চাদের নিয়ে খেলার আসরও বসাতো। লুকোচুরী, কানামাছি, হাডুডু কতোরকমের যে খেলা। নাচ শেখাতো। মামনি গার্লস হাইস্কুলের টিচার ছিলেন। তার ছাত্রীরা এতো ভালোবাসতো, মামনি অনেক গরীব ছাত্রীদের বেতন, বই-খাতাও কিনে দিতো। ভালোবাসা না পেয়ে কি পারে? বেতন জমতোই না। পৌষ-পার্বণের অনুষ্ঠানে বন্ধুদের নেমন্ত্রণ দিতাম, মামনি বলতো আমাকেও শিখতে। বলতাম কি ভাবো পারবো না? মামনি জানতো মারাত্মক ফাঁকিবাজ আমি রান্নায়। তাও ভাব নিয়ে বসেই একটু পর বলতাম আরে কিছু পড়া তো বাকী থেকে গেছে। মামনি বলতো, “এতো ফাঁকি দিতে পারিস।” একবার পিঠা চুরী করে খাওয়া। মামনি জানি কার জন্যে বানিয়ে রেখেছিলো। তাকে দিতে গিয়ে দেখে বয়াম পুরো খালি। নীচে দুটো পদ্মখাজা পড়ে আছে। কোনোদিন মারেনি, চোখের ওই নীরব চাহনিতেই কাৎ। বন্ধুরা এলে বলতো, “তুই একটা বোরিং। আন্টি কোথায়?” গালা-গালি করে মারও দিতাম ওদের। মামনি বলতো, “আহারে করিস কি?” আমার একটা বন্ধু কাইয়ূম হিসেব রাখতো কয়টা মার খেয়েছে আমার হাতের? মামনি অনেক আদর করতো ওটাকে। “কাইয়ূম বাবা রে আজ কয়টা?” কাইয়ূম বলতো, “কাকী আজ বেশী না, দুইটা।” মামনি শান্ত কিন্তু দারুণ আড্ডা দিতে পারতো। আসরকে মাতিয়ে রাখার একটা বিশাল শক্তি ছিলো তার মধ্যে। এখনও কিছুটা থেকে গেছে। আজ সকালে নাতী আর দিদিমনির আড্ডা হলো স্কাইপে। আমি তো ঘুম। আমার ছেলেটাও কি যে দুষ্টু ভিডিও অন করে নিয়ে এসে আমায় দেখালো। মামনির গলা শুনে ঘুম ভাঙ্গলো। চশমা ছাড়া দেখিনা। চশমা পড়লাম, পাশে বাপি। বলে গান শোনা। বললাম কোনটা? বলে, “তোর ঘুমের সময় তোর মা যে গানটা গাইতো।” যেই গাইলাম কান্না শুরু। থামিয়ে দিয়ে বললাম, “কষ্ট করে ঘুম থেকে উঠে না খেয়ে গান শোনাই আর তুমি কাঁদো?” বলতেই হাসি। বলে, “তুই বলে চুল কাটছোস? দেখা।” বললাম তুমি শেভ করোনা কেন? মামনি পাশ দিয়ে বললো, “আর বলিস না, পরশু শেভ করেছে আজ এতো আবার। একেবারে রাস্তার পাশে আগাছা আছে না, ওভাবে বাড়ে।” এমনভাবে বলে মামনি হাল্কা হাসি দিয়ে পেট ফেঁটে যায় কথায়। আর কি বলবো? বড্ড অভিমানী, কষ্ট এ জীবনে কাউকে শেয়ার করেনি। মামনিকে আজোও বুঝে উঠতে পারিনা, ওই হাসিটুকুর জন্য। তার কান্না দেখিনি। ওটাই আমি পেয়েছি। নাহ আজ এটুকুই থাক।
শুভ জন্মদিন মামনি।
৩৪টি মন্তব্য
অরুনি মায়া
শুভ জন্মদিন মামনি <3
নীলাঞ্জনা নীলা
অরুনি মায়া আপনার শুভেচ্ছা মামনিকে পৌঁছে দিয়েছি। -{@
ছাইরাছ হেলাল
মাকে নিয়ে দারুণ দারুণ এক উপলব্ধি।
বেঁচে থাকুক মা ও মেয়ে হাজার বছর ধরে।
মায়ের ন্যাওটা ছিলেন বুঝি!!
নীলাঞ্জনা নীলা
হাজার বছর? এই নিয়ে আজ কথা হলো মামনির সাথে।
হাজার বছর নিয়ে যা হাসি-ঠাট্টা হলো, ভাবছি আজই সেটি লিখবো।
আমি ছিলাম বাপির ন্যাওটা। বকলেও বাপি, মারলেও বাপি। এখন আমি-ই বাপিকে বকি। :p
ইমন
শুভ জন্মদিন মামনি। \|/ \|/ \|/
নীলাঞ্জনা নীলা
🙂 -{@
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
আপনার মায়ের জন্ম দিনের জন্য জগতের সকল লাল গোলাপের শুভেচ্্ছা -{@ -{@ -{@ -{@ -{@ -{@ -{@ -{@ -{@ -{@ -{@ -{@ -{@ -{@ -{@ -{@ -{@ -{@ -{@ -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
মামনির একটা গোলাপ বাগান ছিলো। তবে মামনির প্রিয় ফুল চাঁপা।
মনির ভাই ধন্যবাদ এমন ফুলেল শুভেচ্ছার জন্যে। -{@
অরণ্য
আন্টিকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা আর অনেক অনেক শুভ কামনা। -{@
অনেক বছর পরে হয়তো আমার মেয়েটাও আপনার মতো করে গাইবে “আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে…”। এ গানটি ছিল আমার মেয়ের ঘুম পাড়ানি গান। তবে শোনাতো ওর মা না – ওর বাবা। 🙂
নীলাঞ্জনা নীলা
ও মা, তাই? অবশ্যই আপনার পরীটা বাবার মতো গাইবে, শুধু “আগুনের পরশমনি” কেন, “আকাশ-ভরা সূর্য-তারা বিশ্ব-ভরা প্রাণ”ও। অনেক অনেক আদর ওর জন্যে। ওকে দেখতে চাই। দেখাবেন?
-{@
অরণ্য
ভাবছি একটা পোস্ট দেব ওকে নিয়ে। কিন্তু আমি হুট করে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। একটু সময় লাগবে। আবার তা কালও হয়ে যেতে পারে। ভাল থাকবেন।
নীলাঞ্জনা নীলা
অপেক্ষায় রইলাম। সে যতো সময়ই লাগুক। আমাদের পেলেই হলো আপনার রাজকন্যাকে। -{@
জিসান শা ইকরাম
এখন বুঝে দেখো বরিশাইল্যা মাইয়ার কত গুন
তুমি তো সিলেটি,আস্ত একটা বেগুন 🙂
বরিশাল থাকলে এমন গুনবতী তুমিও হইতা
অবশ্য কিছু কিছু গুন বরিশাইল্যা মা হবার কারনে তুমি পেয়েছো 🙂
শুভ জন্মদিন আমার মেয়ে
আমাদের মামনি -{@ -{@
হাসি বজায় থাকুক সারা জীবন।
নীলাঞ্জনা নীলা
নানা শোনো মামনিকে বলেছি তার বাবা যে তাকে উইশ করেছে। কি একটা মিষ্টি হাসি দিলো। 🙂
আবু খায়ের আনিছ
সত্যিই অসাধারণ একজন মা আপনার। ভালো থাকুক উনি, ভালো থাকুন আপনি এবং সবাই। উনার জন্য রইল জন্ম দিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা। শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা মায়ের জন্য।
নীলাঞ্জনা নীলা
সব মায়েরাই অসাধারণ। কারণ কোনো মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে অবহেলা দেয়না।
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে, শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়ে দেয়া হবে। -{@
ব্লগার সজীব
ধন্য মায়ের ধন্য কন্যা আপনি।আপনার মা এর কথা জেনে মুগ্ধ হলাম। আপনার মাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
নীলাঞ্জনা নীলা
ভাইয়া মায়ের মতো হতে পারিনি। এটাই দুঃখ। 🙁
মেহেরী তাজ
শুভ জন্মদিন মামনি। -{@ (3
নীলার মমনি তো তাজের ও মামনি তাই না?? 😀
নীলাঞ্জনা নীলা
অবশ্যই পিচ্চি আপু। -{@ (3
লীলাবতী
নীলাদি আপনার মামনির এত গুন!আপনার লেখায় একজন ইচ্ছল মা কে দেখলাম।
শুভ জন্মদিন মামনি -{@ (3
নীলাঞ্জনা নীলা
লীলাবতীদি আমার চরিত্র পুরো বাপির মতো। মায়ের একভাগও পাইনি। 🙁
সীমান্ত উন্মাদ
মাকে নিয়ে লিখা মানেই
আমার চোখে জল,
মাকে নিয়ে লিখা মানেই
সীমান্ত উন্মাদ সচল।
আপনার লিখার উপলব্দিটা আমাকে ছুয়ে গেছে আপু।
শুভ জন্মদিন মামনিকে।
নীলাঞ্জনা নীলা
ভাইয়া আজ মামনি যতো শুভেচ্ছা পেলো, সব জানাবো।
এতো ভালোবাসা পেয়ে যে হাসিটুকু ঠোঁটের কোণায় ঝিলিক দেবে,
আমার আত্মা শান্তি পাবে।
তোমাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি মামনির ওই হাসিটুকুর জন্যে।
অফুরান ভালোবাসা ভাইয়া। -{@
শুন্য শুন্যালয়
বরিশালে এত প্রতিভা!! 🙂
তোমার আধা আধা দেখে বুঝতে পারছি আন্টিটা আমাদের কত গুনী, আর অনেক বেশি সুন্দরী।
জন্মদিনের অফুরন্ত শুভেচ্ছা আন্টি। -{@
আপনি চিন্তা করবেন না একদম, আপনার পঁচা মেয়েটিকে আমরা দেখেশুনে রাখছি।
নীলাঞ্জনা নীলা
;( ;( ;( ;( ;(
আমি পঁচা না। আমায় পঁচা বলছো কেন আপু?
শুন্য শুন্যালয়
হিংসায় বলছি, বোঝ না? তুমি এতো লক্ষি যে!!
নীলাঞ্জনা নীলা
আমায় বকছো কেন? আমি লক্ষ্মী যদি হই, তাহলে লক্ষ্মী যারা সবাই পালাবে। :D) :D)
নীতেশ বড়ুয়া
দশ দিন পরে হলেও জানাই মামনিকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা 😀 -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
জানিয়ে দেবো। কিন্তু মামনি যদি জানতে চায়, “ছেলেটি আমার কোথায় ছিলো রে এতোদিন?” কি উত্তর দেবো?
নীতেশ বড়ুয়া
এতদিন নিজেকে দেখার আয়না খুঁজে বেড়াচ্ছিলো 😀
নীলাঞ্জনা নীলা
যাক আয়না পেলেন তাহলে! বাঁচলাম। আর কিন্তু নিরুদ্দেশ হওয়া চলবে না।
নীতেশ বড়ুয়া
লালাখালের আয়না পেয়েছিলো কিন্তু আবার হারিয়ে যাচ্ছে 😀
নীলাঞ্জনা নীলা
হারিয়ে যাওয়া চলবে না। তাহলে :@ করবো।
এরপর :@ এর চোটে হবে 🙁 মন খারাপ
🙁 থেকে শুরু হবে ;(
এটা ঠিক না। হুম :@