বারান্দায় বসে উঠোনের দিকে তাকিয়ে আছে কৈলাস। শক্ত সমর্থ ভাদু শক্ত হাতে কাঠ চিরছে দা দিয়ে। উদোম পিঠ, কাপড় পেঁচিয়ে রাখা শুধু, কানে বেশ ওজনদার ঝুমকা, কানের লতি ছিড়ে যাবার মত অবস্থা, কিন্তু ছিড়ে যাবেনা জানে কৈলাস। গলায় মোটা রুপার হাঁসুলি । এ সংসারের কর্ত্রী ভাদু। কৈলাসের মত সবার বিশ্বাস নারীরা সমস্ত শক্তির উৎস । তাঁরা নিজেরা সন্তান উৎপাদন করে, তাই জমিতে চাষাবাদের পূর্বে তাঁদেরকে পূজা করা হয়। মা মনসার প্রতীক তাঁরা । তাই জঙ্গলের বিষাক্ত সাপের হাত থেকে বাঁচতে বউকেই পূজা করতে হয়। তাঁরা মা দূর্গা হয়ে প্রতিটি সংসারে এসেছে, অসুরকে বদ তো তাঁরাই করেন। লক্ষ্মী, সরস্বতী হয়ে আছে তাঁরা সবার সংসারে । ডাকিনী বিদ্যাও তাঁদের আয়ত্বে শুধু। তাই সবসময় তুষ্ট রাখতেই হয়।
সব কিছু দিয়েই ভাদু আগলে রেখেছে এই সংসার। মাটি থেকে ছয় ফুট উচুতে তাঁদের থাকার ঘর। মোটা গাছের গুড়ির সাথে লম্বা লম্বা আস্ত কাঠের পার, মাটাম দিয়ে মজবুত করে বানানো। বাঁশের পাটাতন। সুপারি গাছ চিরে ঘরের বেড়া, গোলের ছাউনি। উচু ঘরে উঠতে হয় কাঠের সিড়ি বেয়ে। রাতে সে সিড়ি সরিয়ে বারান্দায় রাখা হয়। জন্তু জানোয়ার হাটে বাড়ির নীচে, উঠতে পারেনা। মাঝে মাঝে ভয়ংকর পিলে চমকানো ডাক দিয়ে ওঠে। ভাদু আছে বলে এসব থোরাই কেয়ার করে কৈলাস।
রাতের জন্য রান্না শেষ করেছে ভাদু। উঠোনের মাঝে তুলসী তলায় শুয়ে আছে কুকুরটা। ভাদুর দিকে তাঁর নজর। বাঁধা চারটে বোন মোরগের একটি ধরলো ভাদু। এক হাতের ছুঁড়ির এক কোপে মাথা আলাদা, দৌড়ে ঘরের পশ্চিম দিকে মোরগের বিচ্ছিন্ন গলা থেকে বের হওয়া রক্ত ছিটিয়ে দিলো। একে একে সব কটা মোরগের পরিণতি এক হলো, বাড়ির চতুর্দিকে রক্তের একটি সীমানা দিয়ে দিলো ভাদু। কুকুরটা উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গিয়েছে। অপেক্ষা করছে ভাদুর পরবর্তী আচরনের দিকে। রান্না বান্না সব ধীরে ধীরে ঘরের মধ্যে নিলো। শেষ মাটির পাতিলটা হাতে নিয়ে এক দৌড়ে ঘরের বারান্দায়, কুকুরটাও তাঁর পিছে পিছে বারান্দায় এসে বসলো। কাঠের সিড়ি উঠিয়ে কুকুরকে কিছু খাবার দিয়ে মাথায় হাত বুলালো। আদর নিলো কুকুর চোখ বন্ধ করে। ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে গেলো।
কুপির মিটিমিটি আলোতে ভাদুকে অদ্ভুত লাগছে। রাতে খাবার সাজিয়ে কৈলাসকে ডাক দিলো ভাদু। ভাত নেই আজ। হাতে ভাংগা আটার মোটা মোটা রুটি আর নিরামিষ । দ্রুত খেয়ে নে কৈলাস । আজ বছরের সবচেয়ে কালো রাত। অমাবশ্যা । রক্তের বাধ দিয়ে দিয়েছি, ভয় নেই।
বাঁশের উচু খাটে শুয়ে আছে ভাদু কৈলাস । কমানো কুপির মৃদু আলোয় ভাদুর চোখ চকচক করছে। কিছুটা ভীত। ‘ কৈলাস জড়িয়ে রাখ আমাকে। ভয়ের কিছু নেই, আমি আছি না !’ দুজনে দুজনকে জড়িয়ে, তারপরেও অজানা আশংকায় কাঁপতে কাঁপতে ঘুমিয়ে পরে।
=========
এই ভাদু এবং কৈলাসরাই আমাদের পূর্ব পুরুষ। বাঙ্গালীর বিশুদ্ধ রক্তের উৎস। এরপর কেটে গিয়েছে কয়েকশত বছর। আমরা এদের গর্বিত উত্তরাধিকার।
ফিরে যাই শিকড়ের কাছে – সেই হাজার বছর আগের আমাদের পূর্ব পুরুষদের কাছে
৪০টি মন্তব্য
আদিব আদ্নান
এ সব আমরা জানিই না । জেনে ভালো লাগল । শিকড়ের সন্ধান পেলাম ।
জিসান শা ইকরাম
লেখাটা লিখে সন্তষ্ট হতে পারলাম না ।
কিছুটা পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাচ্ছি।
সাবালক
এ ব্যাপারে আগে কখনো শুনেছি বলে মনে হয় না দাদা। আপনার পোষ্ট দুটো পড়ে কিছুটা জেনেছি। আরো বিস্তারিত হলে ভাল হবে অনেক কিছু জানতে পারব আমাদের শেকড় সম্পর্কে। কে না চায় তার শেকড়ের সন্ধান করতে!!! ধন্যবাদ।
জিসান শা ইকরাম
আসলে প্রাচীন বাঙ্গালী পরিবার সম্পর্কে তেমন কোন বই নেই।
ইতিহাস, প্রাচীন সমাজ, পুজা অর্চনা এসব থেকে ধারনা করা যায় মাত্র ।
চেষ্টা করবো কিছু কিছু লেখার ।
শুভ কামনা আপনার জন্য ।
মিসু
কেমন একটা ভয়ের পরিবেশ। এরাই কি আমাদের আদি বাঙ্গালী ?
জিসান শা ইকরাম
এমনই ধারনা আমার ।
শুন্য শুন্যালয়
এই যে মোরগ কেটে চারদিকে সীমানা দেয়া এটা আমিও দেখেছি, কেনো করে জানিনা।
লেখার বর্ননায় মুগ্ধ হয়ে গেলাম ভাইয়া।
ছমছমে একটা ভাব এসে গেছে কেমন।
তবে আমি কিন্তু আবার কুসংস্কার বিরোধী।
আপনাকে সবসময়ই বলি লেখায় একটু সময় দিতে, এমন লেখাগুলোর জন্য অপেক্ষা কিন্তু কম করতে হয়না আমাদের। সীতাকে নিয়ে একটা লেখা পড়েছিলাম, অসাধারণ ছিলো। বলেছিলেন আরো লিখবেন। কই তা? এবার আন্দোলন আবার বিরুদ্ধেও শুরু করবো বলে দিলাম।
জিসান শা ইকরাম
সংস্কার কিছুটা মানি আমি। তাই যেটুকু আমি মানি তাঁকে আর কুসংস্কার বলিনা আমি।
আমার ডান হাতে তিনটে তাবিজ বাঁধা।
সমস্যা হয়না কোন ।
আসলে সংস্কারও তো আমাদের এক ধরনের অতিহ্য, একে অগ্রাহ্য করে কি লাভ ?
যেটুকু সংস্কার আমাদের অমানুষ না বানাবে, তা মানতে সমস্যা হবার কথা নয়।
আসলে লেখায় মনঃসংযোগ দিতে পারিনা। এই লেখাটায় আমি সন্তষ্ট নই আসলে।
সীতাকে নিয়ে অবশ্যই লিখবো এবার ।
শাদমান সাকিব
আরও বেশি করে লিখুন । তাহলে আরও জানতে পারব ।
জিসান শা ইকরাম
এই লেখাটায় আসলে সন্তষ্ট হতে পারিনি। চেষ্টা থাকবে আরো লেখার।
স্বপ্ন
এমন লেখা আরো চাই ভাইয়া।
জিসান শা ইকরাম
আচ্ছা আরো লিখবো ।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
মোরগ জবাইয়ের সীমানা কিংবা মহিলা হলে মোরগ মোরগী জবাইয়ে নিষিদ্ধ এ সব দেখেছি বলে মনে হয় তবে এখন তা নেই বলা চলে।অনেক ভাল লাগল।
জিসান শা ইকরাম
এখন তো নেই, এসব আমাদের ঐতিহ্যের অংশ ।
বনলতা সেন
আরও সুন্দর করে তুলে ধরুন , আমরা শেকড়েই যেতে চাই ।
লেখাটিতে তাড়াহুড়ো ছিল বলে মনে হচ্ছে কেন ?
জিসান শা ইকরাম
আসলে লিখতে বসেছিলাম বেশ আটঘাট বেঁধে,
ব্যস্ততার কারনে মন সংযোগ আর বজায় রাখতে পারিনি।
বুঝতে পেরেছেন আপনি ।
আমি নিজেই সন্তষ্ট নই এই লেখায়
এর চেয়ে এক বছর আগে যেটা লিখেছি, তা আমার কাছে ভালো লেগেছে, প্রথম হলেও।
নিরীক্ষা ধর্মী লেখা , চেষ্টা করবো লিখতে।
নুসরাত মৌরিন
বাহ!! চমৎকার বুনো গন্ধ মেশানো গল্প।
দারুন…। (y)
চলুক চেষ্টা শিকড়ে ফেরার…।
জিসান শা ইকরাম
ধন্যবাদ
চলবে ।
স্বপ্ন নীলা
অনেকদিন মনে মনে কি যেন খোঁজ করছিলাম — হয়তো এমন একটি লেখা — যে লেখা আমায় গভীর মুগ্ধ করবে — আজকে পেলাম সেই ধরণের একটি লেখা —- অসাধারণ লিখেছেন — প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত ভাল লাগার ছড়াছড়ি —
জিসান শা ইকরাম
আপনার এমন প্রশংসা পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার ।
ধন্যবাদ আপনাকে ।
শিশির কনা
প্রাচীন বাঙ্গালী পরিবার নিয়ে লিখলেন মনে হচ্ছে। আরো লিখুন। নারীদেরকে এত গুরুত্ব দেয়া হতো তখন ? অবাক হলাম। ভালো লেগেছে খুব।
জিসান শা ইকরাম
হ্যা , পটভূমি প্রাচীন বাংলা ।
নারীদের অত্যন্ত গুরত্ব দেয়া হতো তখন।
ভারতের কিছু কিছু অঞ্চলে ভাদু পুজা এখনো চালু আছে।
মিথুন
কিছুটা ভয়ের মাঝেই লেখাটি পড়া শেষ করলাম। নারীরা ঐ সময়ে এত গুরুত্বপুর্ন ছিলেন ? ভালো লেগেছে ভাইয়া।
জিসান শা ইকরাম
হ্যা , তাঁদেরকে ভিন্ন উচ্চতায় সন্মান করা হতো ।
ছাইরাছ হেলাল
এটির সাথে আরও লেখা থাকা দরকার ।
আমাদের শিকড়কেই ফিরে দেখতে হয় , আমরা তা দেখতেও চাই ।
জিসান শা ইকরাম
আরো লেখা থাকা দরকার বলে আমিও মনে করি ।
আসলে ঐ সময়ের সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে রেফারেন্সও খুব কম।
ব্লগার সজীব
শুরুটা ভালো হলেও মাঝা মাঝি এসে কিছুটা তাড়াহুড়ো। আরো লিখুন জিসান ভাই। কঠিন একটি বিষয়ে নেমেছেন। প্রাচীন বাংলার ইতিহাস, সমাজ নিয়ে লেখা বই পত্রে বড্ড অভাব।
জিসান শা ইকরাম
কিছুটা তাড়াহুড়া ছিলো লেখার সময়ে।
হুম, এসবের রেফারেন্স খুব কম।
নীলাঞ্জনা নীলা
কত যে অনুরোধ করেছি আপনাকে লেখার বিষয়ে, এখন তো সবাই অনুরোধ করছেন। এমন লেখা আরো চাই।
জিসান শা ইকরাম
এক বছরের বেশী সময় লাগলো জবাব দিতে 🙂
লিখলাম এবার আবার ভাদ্র মাসের সেই কালো অমাবস্যায়।
লীলাবতী
আরো লিখুন জিসান ভাই। শুন্য আপুর সাথে একমত সীতাক্কে নিয়ে লেখাটি দিন এখন।
জিসান শা ইকরাম
আসলে সময় পাচ্ছিনা,
সীতাকে নিয়ে লেখা কঠিন খুব
মনঃসংযোগের অভাব দেখা যাচ্ছে ইদানীং
লেখার ইচ্ছে থাকলো।
মেঘাচ্ছন্ন মেঘকুমারী
অন্য রকম লেখা । এ নিয়ে আরো লেখা চাই দাদা।
জিসান শা ইকরাম
২০১৫ তে এসে লিখলাম আর একটা
সময়ের অভাব দেখা দিয়েছে।
অরুনি মায়া
এখনো কিছু উপজাতি আছে যাদের সমাজে নারি দের মূল্য অনেক।,,,,,,,
জিসান শা ইকরাম
এখানে আমাদের প্রাচীন বাঙ্গালী সমাজের কিছুটা রীতি এবং সংস্কারের কথা বলেছি।
অরুনি মায়া
হুম বুঝেছি। আমি বিভিন্ন ধরনের উপজাতি দের জীবন ধারণ সম্পর্কে পড়েছি। সেখানে এমন অনেক কুসংস্কার সম্পর্কে জেনেছিলাম, ,,,
জিসান শা ইকরাম
জানা থাকলে আমাদেরকেও জানান।
মেহেরী তাজ
কেনো আগে পড়িনি? কারন এটা আগস্টের লেখা আর আমি আসছি সেপ্টেম্বরে।
দাদা আপনাকে কতবার বলবো লেখেন লেখেন! তা শুনেন না! 🙁
এতো ভালো আমি লিখতে পারলে রোজ একটা করে লেখা দিতাম। আপনার লেখা আসছে কবে???
জিসান শা ইকরাম
এসব যখন লিখেছি,তখন ব্লগে তেমন লেখাক ছিলো না
বর্তমানে এখানে প্রচুর মানসম্পন্ন লেখক আছেন,
তাদের লেখার কাছে এই লেখা কিছুই না।
তবে লেখার চেষ্টা করতে আছি ………।