শিউলি, তেজপাতা আর রংগনের গল্পঃ

তৌহিদুল ইসলাম ৮ মার্চ ২০১৯, শুক্রবার, ০৮:৩৮:১২অপরাহ্ন গল্প ৩১ মন্তব্য

আমার স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন ছিল আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়। জাতীয় শোক দিবসে বাসার সামনে মাইকে গান বাজছিলো- যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই…

মেঘমুক্ত পরিষ্কার আকাশে উজ্জ্বল নীলরঙ যেন খেলা করছিলো। প্রখর রৌদ্রতাপে ত্রাহিত্রাহি অবস্থা। বাসার সামনে মেইন গেটের পাশে নারকেল গাছটার উপর একটি কাক কর্কশ কা কা শব্দ করে যেন জানান দিচ্ছিলো দু-একদিনের মধ্যেই বৃষ্টি হবে। এমন সময় গেটের দরজা খুলে আম্মার আগমন- তৌহিদ কই গেলি?
কি আম্মা?
দেখ কি এনেছি।
ও মা! তার হাতে একটা শিউলি ফুল আর একটা তেজপাতার গাছ। গাছগুলোর সবুজ লকলকে পাতার উজ্জলতা যেন রৌদ্রের প্রখরতাকে ম্লান করে দিয়েছে।
বাহ দারুন তো!

ছবিঃ শিউলি গাছ

আম্মা গাছ লাগাব কোথায়? বাসায় তো টব নেই – বললাম আম্মাকে ।
আরে পাগল, বাইরে রিক্সা দাঁড়িয়ে আছে, টবও আছে নিয়ে আয়।
ওবাব্বাহ! আম্মা গাছের সঙ্গে টবও নিয়ে এসেছে, ভালোই হলো।
বিকেলেই লাগাবি তখন রোদ পরে যাবে। আম্মা দাঁড়িয়ে থেকে আমাকে কিভাবে টবের মাটি তৈরি করবো,গাছ লাগানো শেষে কোন দিকে টবের মুখ করে রাখবো আর পানি কিভাবে দিবো সব যেন কোচিং ক্লাসের মত শিখিয়ে দিচ্ছে। আমার মনে হতে লাগলো টিভিতে শাইখ সিরাজের কৃষি অনুষ্ঠান দেখছি। অথচ বাসার বেশিরভাগ টবের গাছ আমার হাতেই লাগানো।

যথারীতি পড়ন্ত বিকেলে আম্মার তত্ত্বাবধানে অনেক আয়োজন করে শিউলি গাছ আর তেজপাতার গাছ দুটি লাগানো হলো। গাছে পানি দেয়ার সময় হঠাৎ লক্ষ্য করলাম শিউলি গাছ কলি এসেছে। তার মানে দু-তিন দিনের মধ্যেই শিউলি তার সাদা পাপড়ি আর কমলা বোঁটা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। তাইতো বলি আম্মার এত উৎসাহ কেন?

মনে পড়ে গেল আমার ছোটবেলার কথা। প্রচন্ড এলার্জি সমস্যা ছিল আমার। আম্মা আর ছোট খালা মিলে আমাকে কাঁচা হলুদের সাথে শিউলি পাতা বেঁটে খাওয়াতেন। উফ! কি বিশ্রী স্বাদ ছিল সেই পানীয়টার। অতি দুষ্টু আমাকে সেটা খাওয়ানো থেকে শুরু করে হলুদ আর শিউলি পাতা জোগাড়ের আয়োজনটাও ছিল এক তুঘলকি কাণ্ড।

দেশী কাঁচা হলুদ নিয়ে আসতেন মামা সেই গ্রাম থেকে। যাতায়াতের জন্য তখন এখনকার মতো পাকা রাস্তা ছিল না, অটোরিকশাও ছিল না। সাইকেল ছিল নিম্ন মধ্যবিত্তের বাহন আর উচ্চ মধ্যবিত্তের অনেকেরই ছিল মোটরসাইকেল তাও পঞ্চাশ বা আশি সিসি’র গাড়ি। প্রতি সপ্তাহেই মামা প্রায় বিশ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা সাইকেল চালিয়ে আসতেন কাঁচা হলুদ নিয়ে।

সে সময় আমাদের বাসায় ফ্রিজ ছিলোনা। থাকলে হয়তো অনেক দিনের হলুদ একসাথে নেয়া যেত। তারপর সেই কাঁচা হলুদ আর শিউলি পাতার সঙ্গে বেজোয়ার নামের একটি মিশ্রনের একসাথে করে বেঁটে রাখা হতো কাপে। আমি সেই তেঁতো কষ্টা স্বাদের জিনিসটা আর খাবোনা বলে প্রাণপণ ছুটোছুটি করে বেড়াতাম। আর আম্মা খালা মিলে মিশ্রণ নিয়ে আমার পিছন পিছন ছুটতো। অবশেষে আমার ধরা পড়া আর গলাধঃকরণ। সেই বিষাদ তিতকুটে স্বাদ আমি আজও ভুলিনি, কিন্তু সত্যিই আমার অ্যালার্জি এরপর সেই যে সেরে গিয়েছিল যা এখন পর্যন্ত আর হয়নি।

সে সময় আমাদের বাসায় শিউলি ফুলের গাছ ছিল না। প্রায় আধা কিলোমিটার দূরের পরিচিত এক প্রাইমারি স্কুল শিক্ষিকার বাসা থেকে শিউলি পাতা নিয়ে আসা হতো।

আমার মনে আছে যখন সেই শিক্ষিকার বাসায় পাতা আনতে যেতাম তখন তার চোখ মুখের কি যে অবস্থা হতো! শিউলি ফুলে ভর্তি গাছের নীচটা ফুলে ফুলে ছেয়ে থাকতো মখমলের চাদর হয়ে। নীচে থাকা শিউলি ফুলগুলো মাড়িয়ে যখন গাছ থেকে পাতা ছিঁড়তাম তখন ভদ্রমহিলা উহ্ আহ্ শব্দ করে উঠতেন। তখন ছোট ছিলাম তাই বুঝি নি। কিন্তু এখন বুঝি, নিজ হাতে লাগানো ফুল গাছের পাতা ছিঁড়লে কত কষ্ট লাগে। তাও একটা দুটো নয় প্রতিদিন ১৫/২০টা পাতা! তারতো খারাপ লাগবেই। শুধুমাত্র ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বলেই ভদ্রমহিলা পাতা দিয়েছেন অনেক দিন। তা না হলে আমি নিশ্চিত তিনি কখনোই ভরা ফুল গাছের পাতা ছিঁড়তে দিতেন না।

এরপর আম্মা কোনওভাবে বিষয়টা জেনে গিয়েছিলেন, তাই নিজেই একটি শিউলি ফুলের গাছ এনে লাগিয়েছিলেন বাসায়‌। কিন্তু সেই গাছটাও একদিন কেউ চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। আমার মনে আছে আম্মা মনে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন সেদিন। তাই এই শিউলি গাছ আনা নিয়ে আম্মার চোখে মুখে যেন স্বস্তির তৃপ্তি খেলা করছে। হয়তো পুরনো অনেক কথা তার মনে পড়ছিল আর গাছটার দিকে তাকিয়ে দেখছিল।

আম্মা কি দ্যাখো?
তোর মনে আছে ছোটবেলায় শিউলি পাতা খাওয়ার দিনগুলো? কি যে জ্বালাতন করতি সে সময় তুই! নে নে এবার তেজপাতার গাছটা লাগা।

আম্মা আম্মাকে বলছিলেন- তোর জন্মের সময় আমরা তোর দাদা’র বাসায় থাকতাম, তেজপাতা আর আদা দিয়ে র’ চা আমার খুব পছন্দ ছিল। প্রতিদিন তোর বাবার সাথে সকালে একসঙ্গে চা খেতাম আমি। তোর বাপ চাচাদের জমিজমা ভাগাভাগির সময় সেই তেজপাতা গাছটাকে তারা কেটে ফেলে। সেই দুঃখে তখন থেকে আমি তেজপাতা দিয়ে চা খাই না।

ছবিঃ তেজপাতার গাছ

বুঝলাম বাড়ির নতুন বৌ, আমার চাচাদের কাছে আবদার করেছিল যেন তেজপাতার গাছটা কাটা না হয়। কিন্তু তারা আম্মার সে আদুরে আবদার রাখেনি আর সেই কষ্টটাও এখনও আম্মা মনে পুষে রেখেছেন।

গাছ লাগানো শেষ, আমি টবে গাছগুলি লাগাচ্ছিলাম আর এতক্ষণ আম্মা পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্মৃতি রোমন্থন করছিল।

আম্মা টব দু’টো কোথায় রাখবো?
দুটি পাশাপাশি মেইন গেটের কাছে রাখ। যখনই কেউ আসবে তারা যেন দেখতে পায় আমার বাসাতেও এখন শিউলি আর তেজপাতার গাছ আছে।
বুঝতে পারছি এতদিনের পুষে রাখা কষ্ট যেন আম্মার মনে অঙ্গার হয়ে জ্বলছে।

কিছুদিন পরে শিউলি গাছের ফুল এসেছিল মোটে তিনটা আর তেজপাতা গাছটাও নতুন পাতা ছেড়েছে। কি যে দারুন লাগছিল দেখতে! আম্মার সুবাদে আমরা তেজ পাতার র’ চা মাঝেমধ্যেই খেতে লাগলাম। এসব দেখে আম্মার মুখের সেই হাসিমুখ ভুলবার নয়।

এরপর অনেকদিন কেটে গেছে- প্রায় বছর খানেক। একদিন আমি একটা রংগনের চারা গাছ নিয়ে আসলাম বাসায়, সিঙ্গেল রংগন। তাই দেখে আম্মা বললো- কিরে এটা কোথায় রাখবি? বাসায় তো আর গাছ রাখার জায়গাই নেই আমাদের।
আম্মা শিউলি গাছটার পাশে রাখি? রংগন আর শিউলি ফুটলে দারুন লাগবে দেখতে।

ছবিঃ রংগনের গাছ

যথারীতি আয়োজন করে আবার রংগনটাও লাগানো হলো, রাখা হলো শিউলিটার পাশে। একটা সময় রংগনের ফুল এলো। সে কি ফুল! প্রতিটা ডালের মাথায় একটা করে লাল টকটকে থোকা, সে এক দেখার মত ফুলের গাছ। যেই আসে সেই তাকিয়ে থাকে রংগন গাছটার দিকে। কিন্তু আম্মার শিউলি গাছটাতে আর কেন যেনো ফুল আসছে না।

একদিন উঠোনে গাছগুলোর কাছে দাঁড়িয়েছিলাম, অনুভব করছিলাম ওরাও যেন তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

শিউলি গাছটাকে জিজ্ঞেস করলাম-
কি শিউলি কেমন আছো?
হূম ভালো- শিউলি গাছটার এক কথায় উত্তর।
তা ফুল দিচ্ছোনা যে? তোমার যত্নেরতো কমতি হচ্ছে না। সার, পানি সব নিয়মিত পাচ্ছো তবুও?
কোন উত্তর নাই, কিছু পাতা নাড়িয়ে মনে হল আমাকে মুখ ভ্যাংচালো।

ভাইয়া ও অভিমান করেছে – পাশ থেকে বলে উঠলো রংগন।
বললাম- কেন কি হয়েছে?
কেন আবার, এতদিন তেজপাতা ভাইয়া তার পাশে ছিল ছায়া হয়ে ; ছোট বোনকে সঙ্গ দিয়েছিল কিন্তু হঠাৎ আমাকে তাদের মাঝখানে নিয়ে আসলেন; তেজপাতা ভাইয়াকে শিউলি আপুর পাশ থেকে সরিয়ে আমাকে দিলেন তাদের মাঝে এতেই তার যত অভিমান।

ও আচ্ছা! এই কথা? ঠিক আছে তাহলে তেজপাতা কে আবার শিউলির পাশে দেই? কি শিউলি এবার খুশি তো? এখন থেকে তাহলে আবার ফুল দাও। তোমার ডালে ফুল নেই আর আমার মায়ের মুখে হাসি নেই।

রংগন তুমি আবার রাগ করোনা সোনা বোন? তুমিও তো আমার কত আদরের, তুমি যেমন ফুলের সৌন্দর্য উপহার দিয়ে যাচ্ছো; তেমনি শিউলিকেও বলো ফুল দিতে ভাই।

তাহলে আমার কাজ কি শুধু ছায়া দেয়া? পাশ থেকে বলে উঠল তেজপাতা।
দুঃখিত তেজপাতা! আসলেই ধন্যবাদ তোমার প্রাপ্য। তুমি অবলীলায় তোমার পাতা বিলিয়ে দিচ্ছ বলেই আমরা র’ চা খাচ্ছি প্রতিদিন। সব্জীতে, পোলাও কিংবা আরও নানান খাবারে তোমাকে পাশে পাচ্ছি ভাই, তোমার কাছেও আমরা কৃতজ্ঞ।

তোমাদের কাছে আমিও কৃতজ্ঞ দাদা- বলে উঠলো তেজপাতা। আমাকে এই বাসায় নিয়ে আসার পর থেকে তোমরা যত্নের কোনো ত্রুটি করোনি। যার ফলে এখনো নিজের পাতা দিয়ে তোমাদের সাহায্য করতে পারছি।

কিরে কার সাথে কথা বলিস আম্মা বাসার ভেতর থেকে বলে উঠলো?
না আম্মা গাছগুলোকে দেখছিলাম।
ও আচ্ছা।
কিন্তু আমি ভাবছি আসলেই তো সত্যি! যেদিন থেকে তেজপাতার গাছটাকে সরিয়ে রংগনটাকে শিউলির পাশে রেখেছি, সেদিন থেকেই শিউলি ফুল দেওয়া বন্ধ করেছে। এই জিনিসটাই আমার চোখে ধরা পড়েনি! আসলেই কি গাছেরও মন আছে? তাদের মনেও যে অভিমান আছে আমাকে যেন তাদের সে অস্তিত্বই জানান দিচ্ছে।

অতঃপর সেদিনই তেজপাতাকে মাঝখানে রেখে শিউলি আর রংগনকে তেজপাতার দু’পাশে রেখেছিলাম। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি এক মাসের মাথায় শিউলির কলি এসেছে আজ দু’বছর পর। তেজপাতার মতন ভাইকে পাশে পেয়ে শিউলি যেন আবার নতুন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। রংগন পাশে থেকে থেকে প্রতিটিক্ষণ নিজের পাতা দুলিয়ে দুলিয়ে হাততালি দিয়ে শিউলিকে উৎসাহিত করছে। এ যেন এক গভীর মেলবন্ধন। আসলে তাদেরও যে মন আছে!

আজকাল যখনি বারান্দায় বা উঠোনে দাঁড়াই শিউলি তেজপাতা আর রংগনের লুটোপুটি দেখি। এক অদ্ভুত শিহরন নিয়ে শিউলি আর রংগন এবং তাদের মাঝখানে বড় ভাই তেজপাতা গাছের ছায়ায় যেন হেসে খেলে প্রতিটি দিন পার করছে। এটা আশ্চর্য এক অনুভুতি।

গাছকে না বুঝলে, তাদের অপ্রকাশিত কথা না অনুভব করলে আপনি নিশ্চিতভাবেই এই অনুভূতি থেকে বঞ্চিত থাকবেন জীবনভর। তাই গাছ লাগান, নিজের ছেলে মেয়ের মতো তাদের যত্ন নিন।

বিশ্বাস করুন সবাই বিশ্বাসঘাতকতা করলেও আপনার লাগানো গাছ কখনোই বিশ্বাস ভাঙবেনা।

(সমাপ্ত)
—————-

মুখবন্ধঃ

এটিও আমার গোলাপ কাহিনীর মত পুরোনো ডাইরি ঘেঁটে বের হওয়া লেখা। আমার উঠোনের পাশাপাশি তিনটি গাছ- শিউলি তেজপাতা আর রংগনের গল্প এটি। যখনি তাদের পাশে দাঁড়াই, মনে হয় আমাকে পাশে পেয়ে ডাল পাতা নাড়িয়ে খিলখিল করে হেসে উঠে। অতি আদরে আদরে দুষ্টু হয়ে যাওয়া গাছগুলো আসলে আমার মনের অংশ হয়ে উঠেছে। তাই তাদের নিয়ে কিছু না লিখলে হয়তো মনে শান্তি পেতামনা।

আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে – যখন তাদের লাগানো হয়েছিলো তখনো ছিল আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময় আর এখন তাদের নিয়ে লেখার সময়টাও আগস্ট মাঝের মাঝামাঝি। কি অদ্ভুত কাকতালীয়!

ছবি: বাসার উঠোনে গল্পের তিনটি গাছ।

(তৌহিদ)
১৬ আগস্ট ২০১৫, রংপুর।

১৭৯২জন ১৬১৪জন
0 Shares

৩১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ