১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের ভয়াল কালো রাত্রিতে “অপারেশন সার্চলাইট”-এর নামে পাক বাহিনী বাঙ্গালীদের ওপর চালায় নির্মম গণহত্যা। তার ঠিক দুইদিন পর, ২৭ মার্চে নির্মমভাবে জবাই করে দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে হত্যা করা হয় কবি মেহেরুন নেসা, তাঁর মা ও দুই ভাইকে। মেহেরুন নেসার দুই ভাইয়ের মাথা নিয়ে ফুটবলের মতো খেলেছিল সেদিন ঘাতকেরা। মেহেরুন নেসার কাটা মাথা তাঁরই লম্বা চুল দিয়ে ফ্যানের সাথে বেধে ঘুরানো হয়, আর নিচে পড়ে থাকে জবাই করা মুরগীর মতো রক্তাক্ত মেহেরুন নেসার দেহটা। মিরপুরের কসাই কাদের মোল্লার নেতৃত্বে, তার দোসরদের সাথে পরিচালিত এই হত্যাকান্ড ছিল মানবতার ইতিহাসে অন্যতম এক কালো অধ্যায়।
কেন হত্যা করে হয়েছিল তাকে?
কারণ মেহেরুন নেসা বাংলাদেশের মুক্তির সপ্ন দেখেছিল। কারণ তিনি অন্যায় ও দুঃশাসনের কাছে মাথা নত করেননি। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার পর কবি মেহেরুন নেসা ঠিক করে্ন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবেন। ২৩ মার্চ পাকিস্তানের “প্রজাতন্ত্র দিবস” হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের পতাকা না উড়িয়ে বাড়ির ছাদে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলেন অদম্য সাহসী এই মানুষটি। এতে ক্ষিপ্ত হয় ঐ এলাকার রাজাকার ও বিহারীরা, কিন্তু তাদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেন মেহেরুন নেসা। অবাঙ্গালী ও বিহারীদের হাতে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত হতো মিরপুরের বাঙ্গালীরা। এই অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য গঠিত হয় “অ্যাকশন কমিটি” যেখানে প্রেসিডেন্ট হন মেহেরুন নেসার খুব কাছের বান্ধবী কাজী রোজি ও মেহেরুন নেসা হন সদস্য। ২৫ তারিখেও কমিটির মিটিং শেষে দুই বান্ধবী গল্প করেন দেশের অবস্থা নিয়ে, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে অনুমান করে্ন তাঁরা।
এর ঠিক দুদিনের মাথায় ঘটে যায় এই নির্মম হত্যাকান্ড। ২৭ মার্চ, বেলা ১১ টার দিকে কাদের মোল্লার নেতৃত্বে মাথায় লাল ও সাদা পট্টি পরে মেহেরুন নেসার মিরপুরের বাসায় আসে কাদের মোল্লা, হাসিব হাশমি, আব্বাস চেয়ারম্যান, আখতার গুন্ডা, নেহাল ও আরো অনেকে। মেহেরুন নেসা বুঝতে পেরে কুরআন শরীফ বুকে নিয়ে সকলের প্রাণ ভিক্ষা চায়, কিন্তু পিশাচেরা সেই আকুতি শোনেনি। একে একে সবাইকে জবাই করে হত্যা করে তারা, তারপর মেতে ওঠে নারকীয় উল্লাসে। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার পর দুইজন অবাঙ্গালী বিহারীর মুখে শোনা যায় সেই নারকীয় উল্লাসের নির্মম ইতিহাস।
এই সেই মিরপুরের কসাই কাদের মোল্লা, যে সেই সময় ছিল ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা। এই সেই কাদের মোল্লা, যে ’৭০-এর নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে মিরপুর এলাকায় জামায়াতে ইসলামের পক্ষ থেকে দাঁড়ানো গোলাম আজমের নির্বাচনী প্রচারণায় পুরোদমে অংশ নিয়েছিল। এই সেই কাদের মোল্লা, যে ছিল রায়েরবাজারে বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যতম প্রধান খলনায়ক। এই সেই কাদের মোল্লা, যার দৌড়াত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দেড়মাস পরে ৩১ জানুয়ারি, ১৯৭২-এ মিরপুর স্বাধীন হয়েছিল।
আজ শহীদ কবি মেহেরুন নেসার মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁরই লেখা শেষ কবিতাটি পাঠকদের কাছে শেয়ার করছি। এটি প্রকাশিত হয়েছিল “সাপ্তাহিক বেগম” পত্রিকায় তার মৃত্যুর ঠিক ৪ দিন আগে, ২৩ মার্চ, ১৯৭১-এ।
জনতা জেগেছে
মুক্তি শপথে দীপ্ত আমরা দুরন্ত দুর্বার,
সাত কোটি বীর জনতা জেগেছি, এই জয় বাঙলার।
পাহাড় সাগর, নদী প্রান্তর জুড়ে-
আমরা জেগেছি, নবচেতনার ন্যায্য নবাঙ্কুরে।
বাঁচবার আর বাঁচাবার দাবী দীপ্ত শপথে জ্বলি,
আমরা দিয়েছি সব ভীরুতাকে পূর্ণ জলাঞ্জলি।
কায়েমী স্বার্থবাদীর চেতনা আমরা দিয়েছি নাড়া,
জয় বাঙলার সাত কোটি বীর, মুক্তি সড়কে খাড়া।
গণতন্ত্রের দীপ্ত শপথে কণ্ঠে কণ্ঠে সাধা-
আমরা ভেঙ্গেছি, জয় বাঙলার যত বিজয়ের বাধা।
কায়েমী স্বার্থবাদী হে মহল! কান পেতে শুধু শোনো-
সাতকোটি জয় বাঙলার বীর! ভয় করিনাকো কোনো।
বেয়নেট আর বুলেটের ঝড় ঠেলে-
চিরবিজয়ের পতাকাকে দেবো, সপ্ত আকাশে মেলে।
আনো দেখি সাত কোটি এই দাবীর মৃত্যু তুমি,
চিরবিজয়ের অটল শপথ, এ জয় বাঙলা ভূমি।
২০টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
এই সব সাহসীদের আমরা ভুলে গেছি ।
ফাহিমা কানিজ লাভা
ভুলে না যাওয়ার জন্যই স্মরণ করিয়ে দেওয়া।
বোকা মানুষ
লাভা, ধন্যবাদ দিয়ে তোমাকে ছোট করবোনা। শুধু অন্তর নিংড়ানো কৃতজ্ঞতা তোমার প্রতি কবি মেহেরুন্নেসার এই দুর্লভ কবিতাটা সবার সাথে শেয়ার করার জন্য
ফাহিমা কানিজ লাভা
স্বাগতম। 🙂
প্রহেলিকা
ধন্যবাদ এই পোষ্টি উপস্থাপন করার জন্য শ্রদ্ধেয়া। শুভকামনা। (y)
ফাহিমা কানিজ লাভা
আপনাকেও শুভ কামনা।
আদিব আদ্নান
ঘটনাটি জানতে পারলাম এই প্রথম ।
ধন্যবাদ ।
ফাহিমা কানিজ লাভা
আপনাকেও শুভেচ্ছা।
হতভাগ্য কবি
কবির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা 🙁
ফাহিমা কানিজ লাভা
বিনম্র শ্রদ্ধা।
নীহারিকা
যতবার পড়ি, ভাষা হারিয়ে ফেলি। কতটা বর্বরতা আর নির্মমতার শিকার হয়েছিলেন কবি ভাবাই যায় না। ওনার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। ওনার আত্মা শান্তি পাক।
ফাহিমা কানিজ লাভা
বিবেকবান মানুষ হলে এই বর্বরতায় মন কাঁদবে, এটাই স্বাভাবিক। কবির প্রতি শ্রদ্ধা।
লীলাবতী
শহীদ কবি মেহেরুন নেসা, তার মা, ভাইদের জানাই শ্রদ্ধা। খুব কস্ট হচ্ছে লেখাটি পড়ে। কাদের মোল্লার ফাসী হয়েছে, কিন্তু অনেক কাদের বেচে আছে।
কবির কবিতাটি অসাধারন লেগেছে।
ধন্যবাদ আপনাকেও।
ফাহিমা কানিজ লাভা
ধন্যবাদ অনুভূতি জানাবার জন্যে।
মা মাটি দেশ
-{@ (y)
ফাহিমা কানিজ লাভা
Thanks
বনলতা সেন
এই কবিকে অবশ্যই শ্রদ্ধা ।
জানতাম না ।
আপনাকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য ।
ফাহিমা কানিজ লাভা
জানাতে পেরে ভাল লাগছে। ধন্যবাদ।
খসড়া
ধন্যবাদ কবিতাটা শেয়ার করার জন্য।
ফাহিমা কানিজ লাভা
Welcome