কাও ধনেশ বা পাকড়া ধনেশ বিউসেরোটিড (Bucerotidae) পরিবার বা গোত্রের অন্তর্গত একটি মোটামুটি বৃহদাকার ধনেশ প্রজাতির পাখি। ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বাংশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উত্তর-পূর্বাংশের বিভিন্ন দেশ কাও ধনেশের প্রধান আবাসস্থল। বাংলাদেশ, ভারত (উত্তর-পূর্বাঞ্চল), ভুটান, নেপাল, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড , ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, লাওস, ব্রুনাই, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, সিঙ্গাপুর এবং চীন (দক্ষিণাঞ্চলে ইউনান প্রদেশ) কাও ধনেশের প্রধান আবাসস্থল। এরা মূলত পাহাড়ি মিশ্র চিরসবুজ বনের বাসিন্দা।
কাও ধনেশের উপরের দিক চকচকে কালো রঙের, নিচের দিক সাদা। ডানার পালকের ডগা এবং লেজের বাইরের পালকের আগার দিক সাদা। গলায় পালকহীন নীল চামড়ার পট্টি থাকে। চোখের চারপাশে ও গলায় নীলাভ-সাদা চামড়া দেখা যায়। পা ও পায়ের পাতা স্লেট রঙের সবুজ। চোখের তারা লালচে। নিচের দিকে বাঁকানো বড় ঠোঁটের উপরের বর্ম মাথার পেছনের দিকে বেশি প্রলম্বিত কিন্তু সামনের দিকে একটু বাড়ানো ও এক ডগাযুক্ত। আপাতদৃষ্টিতে এদের ঠোঁট অনেক ভারি মনে হলেও আসলে বেশ হালকা, কারণ ঠোঁট আর বর্মের ভেতর আছে অনেক ফাঁপা প্রকোষ্ঠ। পুরুষ পাখির বর্মের সামনে-পেছনে কালো অংশ আছে, কিন্তু মূল ঠোঁটে কালো অংশ নেই। স্ত্রী ধনেশ যে কেবল আকারে ছোট তাই নয়, তাদের বর্ম পর্যন্ত ছোট এবং এর ঠোঁটের উপর কালোর ছোপ বেশি আর নিচের ঠোঁটের গোড়ায় লালচে অংশ আছে। তাছাড়া এর চোখও বাদামী। কাও ধনেশ দৈর্ঘ্যে কমবেশি ৯০ সেন্টিমিটার। সাধারণত জোড়ায় জোড়ায় থাকে। কখনও সঙ্গে অপরিণত ছানাও থাকতে পারে। বনের বটজাতীয় গাছের যখন ফল পাকে, তখন অন্য অনেক প্রজাতির পাখি ও স্তন্যপায়ীদের সঙ্গে মিলে সে খাবারে হামলা চালায়। বনের ছোট-বড় সব নরম ফল খেতে পারদর্শী, সেই সঙ্গে খেয়ে থাকে পাখির ছানা, ডিম, ইঁদুর, ব্যাঙ, সরিসৃপ প্রভৃতি।
এদের বাসা বানানো থেকে শুরু করে প্রজনন ও ডিম পাড়ার পর বাচ্চাদের সংরক্ষণ করার পদ্ধতি অন্য কোনো পাখির সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। এক জোড়া একই এলাকায় বছরের পর বছর থাকতে পছন্দ করে। বেশিরভাগ সময় একই মরা গাছের উপরের দিকের কাণ্ডে গর্ত করে বাসা বানায়। কোনো কোনো গাছে পরপর কয়েকটি গর্ত থাকতে পারে। স্ত্রী ধনেশ বাসায় ঢুকে নিজের বিষ্ঠা দিয়ে বন্ধ করে দেয় বাসার প্রবেশ পথ। ডিম পাড়া থেকে বাচ্চা বড় না হওয়া পর্যন্ত মা ধনেশ গর্তের বাসায় বন্দী থাকে। ছোট একটি ফুটো দিয়ে বাবা ধনেশ এই দীর্ঘ সময় স্ত্রী পাখির খাবারের জোগান দেয়। ব্যাপারটি খুবই বিস্ময়কর এবং এই কাজের জন্য অস্বাভাবিক ধৈর্যের প্রয়োজন পড়ে। ছানা ডিম ফুটে বের হওয়ার পর বাবা ধনেশ বাসার মুখ ভেঙে দেয়। তখন মা ও বাবা ধনেশ পাখি সম্মিলিতভাবে বাচ্চাদের খাবার দেয়। এরা পালাক্রমে বাচ্চাদের খাওয়ায়। বাচ্চাদেরও খাবার বট-ফল। বাবা ও মা পাখি মুখে করে বেশ কয়েকটি ফল নিয়ে আসে। পরে বাচ্চাদের মুখের ভিতর ঠোঁট ঢুকিয়ে খাবার দেয়।
দেশে বন ধ্বংস এবং আদিবাসী সম্প্রদায় কর্তৃক এদের ধরে খাওয়া, হাতুড়ে চিকিৎসায় ও গৃহপালন বা চিড়িয়াখানায় সংগ্রহের কারণে এদের সংখ্যা অতি দ্রুত কমে আসছে। চিড়িয়াখানায় এদের বংশ বিস্তরের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশে ধনেশ পাখির তেল বিক্রির নামে কাও ধনেশ ব্যাপক হারে মারা হচ্ছে। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্রেতারা ধনেশ পাখির তেল মনে করে পোড়া মবিল নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। এক্ষেত্রে ধনেশ পাখি মারা হয় কেবলমাত্র তেলের বিজ্ঞাপনের জন্য। এসব স্বার্থান্বেষী ও লোভী মানুষের জন্য আজ প্রকৃতির অলঙ্কার ধনেশ পাখি বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মচারীদের যোগসাজশে এই ভণ্ড কবিরাজরা পাখিগুলো শিকার করছে। বান্দরবানের দূর্গম পাহাড়ি এলাকায় প্রতিটি ধনেশ পাখির মাথা ৫০০ টাকায় পাওয়া যায়। স্থানীয় সচেতন জনগণ যদি নিজ উদ্যোগে অপরাধীদের দমন না করতে পারে তবে একদিন এই সুন্দর পাখিটি আমাদের দেশ থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে। আসুন, আমরা সবাই একসঙ্গে প্রকৃতির সৌন্দর্যবর্ধক এই পাখিকে রক্ষা করি। নিজেরা সচেতন হই, অন্যকেও সচেতন করি। আমাদের মনে রাখতে হবে, পাখি বাঁচলে বন বাঁচবে। আর বন বাঁচাতে পারলে আমরা বাঁচবো। না হলে অক্সিজেনের অভাবে মানব জাতিই হুমকির মুখে পড়বে কোনো একদিন।
বাংলা নাম: কাও ধনেশ বা উদয়ী পাকড়া ধনেশ
ইংরেজি নাম: Oriental pied horn bil
বৈজ্ঞানিক নাম: Anthracoceros albirostris
ছবিগুলি হবিগঞ্জের সাতছড়ি বন থেকে তোলা।
৩০টি মন্তব্য
প্রদীপ চক্রবর্তী
লোভী মানুষের জন্য এরকম কত পাখি বিলুপ্তপ্রায় হতে চলছে।
তাই স্থানীয় জনগণ সচেতন হওয়া খুবি প্রয়োজন।
.
কাও ধনেশ বা উদয়ী পাকড়া ধনেশ বিস্তারিত বিষয় জেনে ভালো লাগলো।
আর এসব লেখা খুবি মনযোগ দিয়ে পড়ি।
এমন লেখা আরও চাই, দাদা।
শামীম চৌধুরী
শুভ কামনা রইলো দাদাভাই।
সুরাইয়া পারভীন
লোভী হিংস্র মানুষের থাবায় প্রকৃতির সৌন্দর্য বর্ধনকারী যে কোনো প্রাণী বিনষ্ট হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা যদি সচেতন হয় এবং এই সব দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে তবেই সম্ভব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষা করা
শামীম চৌধুরী
একদম সঠিক বলেছেন আপু। আমাদের নিজেদের আগে সচেতন হয়ে পরে জনগনের মাঝে সচেতনতাবোধ বাড়াতে হবে। তাহলে যদি সমস্যাগুলির সমাধান হয়।
শুভ কামনা রইলো।
বন্যা লিপি
উপর্যুপরি বর্ধিত মানুষের লালসার স্বীকার প্রকৃতির প্রত্যেকটি প্রানীকুল থেকে শুরু করে বনাঞ্চল। সর্বস্তরের মানুষের ‘মানুষ’ হয়ে ওঠা সর্বাগ্রে জরুরী। পৃথিবী আজ হুমকির মুখে পতিত। পাখি বিষয়ক তদুপরি কাও ধনেশ পাখির তথ্যবহুল পোষ্ট পড়ে ভালো লাগলো। জাগ্রত হোক মানবতার মনুষ্যত্ব।
শামীম চৌধুরী
বফু,
মানুষ সেরা জীব। আবার সেরা লোভীও। এই প্রকৃতি আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন মানুষের জন্য। মানুষের কল্যানের জন্য। তবে মানুষ সেটা বুঝে না। তার বুঝে কি করে প্রকৃতি ধ্বংস করে অর্থ উপার্জন করা যায়। যার ফলে প্রকৃতিও প্রতিশোধ নেয়।
মনির হোসেন মমি
চমৎকার একটি পোষ্ট।এটাকে বলা যায় বন্য প্রানী ধ্বংসে একটি প্রতিবাদী ও গণসচেতন মুলক পোষ্ট।প্রাকৃতিক ভারসম্য রক্ষার্থে লোভী মানুষদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হবে।
শামীম চৌধুরী
একদম ঠিক বলেছেন ভাইজান। আমাদের উচিত হবে প্রকৃতি রক্ষার জন্য একত্রিত হয়ে কাজ করা।
শুভ কামনা রইলো।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
বিষ্ঠা দিয়ে গর্ত বন্ধ করে সেখানে বাচ্চা জন্ম দেয়া, মা ও বাচ্চার খাবারের জোগান দেয়া অদ্ভুত সুন্দর ব্যবস্থা। সবটাই ঈশ্বরের খেলা।ওদের ফল বাদে অন্য খাদ্য গুলো মাংস জাতীয় । কিন্তু ওদের বিলুপ্তির কারণ গুলো খুবই কষ্টের। আমি সত্যিই মর্মাহত। মানুষ গুলো সত্যিই অমানুষ । তাইতো করোনা প্রকৃতির জন্য আশীর্বাদ হয়ে ধরা দিয়েছে। এভাবে প্রতিশোধ না নিলে এ সুন্দর পৃথিবী অচিরেই বাসযোগ্যতা হারাবে প্রাণী, বৃক্ষ দের জন্য। কারণ মানুষ শিক্ষা নেয়না নিলে এমন ভয়াবহতার সম্মুখীন হতো না। এ পাখি সম্পর্কে জেনে ভালো লাগলো। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন শুভকামনা অবিরাম
শামীম চৌধুরী
সৃষ্টিকর্তা একের জীবকে একেক বৈশিষ্ট দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। কারো সঙ্গে কারো মিল নেই। আর এখানেই সৃষ্টিকর্তার নিদর্শন প্রকাশ পায়।
আপনিও ভাল থাকুন। শুভ কামনা রইলো।
আরজু মুক্তা
মনে হয় সব পাখিদেরি একেক ধরনের ক্ষমতা আছে।
ভালো লাগলো। অনেক কিছু জানলাম।
নিজে সচেতন হই। অন্যদেরও সচেতন করি।
শুভকামনা
শামীম চৌধুরী
জ্বী মুক্তা আপু। আমাদের সকলের শ্লোগান হোক নিজে সচেতন হই অপরকে সচেতন করে তুলি।
ধন্যবাদ আপনার মূল্যবান মন্তব্য দেবার জন্য।
মোঃ মজিবর রহমান
এখন প্রশাসনের কথা বললে অনেকেই বলে সরকার কি করবে? আমার প্রশ্ন সরকারের কাজ আইন প্রয়োগ না সেটা প্রয়গের ব্যবস্থা কে করবে জনগন?
সাধারন জনতাকে আইন মানতে বাধ্য করার জন্যই আইন ও আইন সৃংখলা বাহীনি আছে, তাই নয় কি? আমরা সবাই দায়স্বাররা ভাবে চলি।
শামীম চৌধুরী
একদম সত্য বলেছেন ভাই।
ইঞ্জা
যদিও আগে থেকেই জানতাম ওদের জীবনাচরণ, তবে দেশিয় ধনেশ সম্পর্কে আজ প্রথম জানলাম।
অসাধারণ পোস্টির জন্য ধন্যবাদ ভাই।
শামীম চৌধুরী
বণ্যপ্রানী ও পাখির প্রতি আপনার জানার আগ্রহ দীর্ঘদিনের। সুতারাং আপনারই জানার কথা। আমি খোলামেলা আলোচনায় ওদের জীবন ধারাটা তুলে ধরলাম।
শুভ কামনা রইলো আপনার জন্য।
ইঞ্জা
ধন্যবাদ ভাই, শুভকামনা অফুরন্ত।
ছাইরাছ হেলাল
ভাবতে অবাক লাগে এত সুন্দর পাখিটি শুধুমাত্র লাভার কারণে আমাদের দেশ
থেকে হারিয়ে যাচ্ছে, ঠোঁট ওয়ালা পাখির তেল বিক্রি করতে দেখেছি, তা এমন সুন্দর পাখি তা জানতাম না।
আপনি এটি কোন এলাকা থেকে তুলেছেন ? একদম শেষ করতে পারেনি বুঝতে পারছি।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ভাইয়া লিখেছে তো হবিগঞ্জের সাতছড়ি থেকে। ধন্যবাদ ভাইয়া
ছাইরাছ হেলাল
ঠিক বলেছেন, শেষ লাইনটি মনে রাখতে পারিনি।
শামীম চৌধুরী
সাতছড়ি বন থেকে।
আলমগীর সরকার লিটন
খুব সুন্দর কাও ধনেশ পাখির বিস্তার জানলাম শামীম দা
শামীম চৌধুরী
কৃতার্থ রইলাম দাদা।
রোকসানা খন্দকার রুকু
বাবা ধনেশ এই দীর্ঘ সময় স্ত্রী পাখির খাবারের জোগান দেয়। ব্যাপারটি খুবই বিস্ময়কর এবং এই কাজের জন্য অস্বাভাবিক ধৈর্যের প্রয়োজন পড়ে।***
সত্যিই অবাক হয়ে গেলাম। শুভ কামনা।
শামীম চৌধুরী
শুধু তাই নয়। প্রজনন পূর্বেই স্ত্রী ধনেশ প্রমান করে কোন পুরুষ ধনেশ তার জন্য উপযুক্ত। প্রজনন করার আগে পুরুষ ধনেশরা পালাক্রমে স্ত্রী ধনেশের জন্য খাবার আনতে থাকে। এভাবে প্রতিযোগিতায় যে পুরুষ ধনেশ টিকে যায় তার সঙ্গেই প্রজনন করে। একেক পাখির একেক ধরনের চরিত্র। কারো সঙ্গে কারো মিল খুঁজে পাবেন না।
রোকসানা খন্দকার রুকু
হা হা হা এ দেখছি রাজকুমারী জয়ের পাল্লা।
দারুন।
শামীম চৌধুরী
অনেকটা সেই রকমই।
শামীম চৌধুরী
শুধু তাই নয়। প্রজনন পূর্বেই স্ত্রী ধনেশ প্রমান করে কোন পুরুষ ধনেশ তার জন্য উপযুক্ত। প্রজনন করার আগে পুরুষ ধনেশরা পালাক্রমে স্ত্রী ধনেশের জন্য খাবার আনতে থাকে। এভাবে প্রতিযোগিতায় যে পুরুষ ধনেশ টিকে যায় তার সঙ্গেই প্রজনন করে। একেক পাখির একেক ধরনের চরিত্র। কারো সঙ্গে কারো মিল খুঁজে পাবেন না।
তৌহিদ
পাখির নামটাও যেমন সুন্দর, দেখতেতো আরো অসাধারণ! কিছু অসাধু ব্যক্তির জন্য এই পাখি যেন হাড়িয়ে না যায় সেদিকে দায়িত্বশীলদের নজর দেয়া আবশ্যক।
চমৎকার এমন পোষ্টের জন্য ধন্যবাদ ভাই। ভালো থাকুন সবসময়।
শামীম চৌধুরী
বর্তমানে বন বিভাগের উদ্দোগে অনেকটাই রোধ হয়েছে। তাছাড়া প্রযুক্তির যুগে মানুষও সচেতন হয়েছে। তারা এখন কবিরাজিতে খুব একটা বিশ্বাসী না। তারপরও এই গংরা সুযোগ পেলে তাদের কাজ চালিয়ে যায়।
শুভ কামনা রইলো।