গাজী-কালু শুধুমাত্র সুন্দরবন নয়, বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সকল লোকের কাছে পরিচিত নাম। এককালে গাজী তার দুর্জয় শক্তি দিয়ে এমন অভাবনীয় অবস্থার সৃষ্টি করেছিলেন যে সমস্ত দেশ গাজীময় হয়ে গিয়েছিল। শীত বসন্তকালে গ্রামে গ্রামে গাজীর গীতের আসর বসতো। গ্রামাঞ্চলের নিরক্ষর শ্রমজীবী মানুষেরা গাজীর গীত শুনে চিত্ত বিনোদন করতো। এখনো গাজীরগান হয়,তবে আগের মতো এখন তীব্রতা নেই।
আমার বাড়ি যেহেতু সুন্দরবনের কাছেই। তাই এই বিষয়ে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে।
কে এই গাজী কালু! গাজী পূর্ব পুরুষদের সত্যিকার পরিচয় পাওয়া দুষ্কর। কথিত আছে, গৌড়ের সুলতান সেকেন্দারের বড় রানীর গর্ভে গিয়াস উদ্দিন জুলহাস ও বরখান গাজী জন্মগ্রহন করেন। গাজী কালুর পুঁথিতে বলা হয়েছে, বৈরাট নগরের শাহ সেকেন্দারের পুত্র গাজী। তবে মাতার নাম অজুফা সুন্দরী। অজুফা সুন্দরীর গাজী ছাড়াও আর এক প্লিত পুত্র ছিলো যার নাম কালু।
যুবক বয়সে গাজীর পিতা তাকে বাদশাহী গ্রহন করার আদেশ দিলে গাজী তা প্রত্যাখান করেন। তিনি বলেন, ‘আমি বাদশাহী চাই না, ফকির হতে চাই’। বাদশা গাজীর এই কথায় রেগে যান। তিনি গাজীকে বাদশাহী নিতে রাজি করাতে ব্যার্থ হয়ে রাজদন্ড দেন। নিজের পুত্র গাজীকে হত্যা করতে আদেশ দেন। জল্লাদ গাজীর শিরশ্ছেদ করতে গিয়ে অবাক হয়ে দেখেন, ধারালো ছুরির আঘাতে গাজীর একটি লোমও কাটলো না। এরপর গাজীকে সমুদ্রে নিক্ষেপ ও হাতির পায়ের নীচে পিষ্ট হয়ে মারার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। অবশেষে একটি সূচে বিশেষ একটি চিন্হ দিয়ে সমুদ্র থেকে সে সূচ খুঁজে আনতে জলে। অলৌকিক উপায়ে সমুদ্রের পানি শুকায়ে গাজী সূচটি এনে দেয়। একসময় গিজী তার পালিত ভাই কালুকে নিয়ে সংসার ত্যাগ করে ফকিরি বেশে রাজ্য ছেড়ে সুন্দরবনে চলে আসে। এখানে গাজী চম্পাবতী নামে এক অপরুপ সুন্দরী রাজকুমারীকে বিয়ে করেন। গাজীর পুঁথিতে আছে-
“বড় আহ্লাদের মোর কন্যা চম্পাবতী
সাতপুত্র মধ্যে সেই আদরের অতি।
তার প্রতি দয়া তুমি সর্বদা রাখিবা
অনিষ্ট করিলে কোনো মার্জনা করিবা।”
গাজী সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষদের বিশেষ করে কৃষক, জেলে, বনজীবীদের কাছে লৌকিক দেবতা হিসেবে আরাধ্য। গাজী-কালু-চম্পাবতীর পুঁথিতে য্ই থাকুক না কেনো হিন্দু মুসলমান সবাই তাকে স্বরণ করে। তাই দক্ষিণ অঞ্চলের গ্রামের মানুষের উৎসব মানেই গাজী কালুর পুঁথি পাঠের উৎসব।
আমার নানা ও দাদা বাড়ি সুন্দরবন সংলগ্ন রামপাল থানাতে। মোংলা শহর থেকে কাছেই। তাই প্রায়ই দাদা ও নানাবাড়িতে যাওয়া হতো। আমাদের দুই পরিবারে একটা ঐতিহ্য আছে তা হলো, নতুন ধান ঘরে ওঠার পর পরবাসী বিদায় দেবার একটা পারিবারিক উৎসব। পরবাসী বলতে বোঝানো হচ্ছে, গ্রামের গেরস্তরা আগে ধান কাটা, দূর জমি থেকে বড় বড় নৌকা বোঝাই করে ধান বয়ে আনা যে নৌকাকে বলা হতো গুনটানা নৌকা এবং ধান মাড়াই করার জন্য হাঁট থেকে অন্য এলাকার যে সব মানুষ কিনে আনতো তাদেরই বলা হতো ‘পরবাসী’ তারা ধান কেটে গেরস্তর গোলা ভরে দিয়ে যেতো। ততোদিন তারা ঐ গেরস্তর বাড়িতেই থাকতো। তাদের বিদায় উৎসবটা হতো খুব ধুমধাম করে। আমার নানা সব আয়োজন করতো। এ সময় তার সব মেয়ে জামাই, নাতিনাত্নীরা উপস্থিত থাকতো। পরবাসীদের জন্য নতুন লুঙ্গি, গামছা, গেন্জি থাকতো উপহার। নানারকম পিঠা পায়েস, দক্ষিণ অঞ্চলের বিখ্যাত পিঠা রাজহাঁস ও সিয়েই পিঠা অবশ্যই থাকতো। রাতে বসতো পালাগানের আসর। সে বারই আমি প্রথম দেখেছিলাম গাজী-কালুর গীত। পুরো গীতে থাকতো গল্প। চমৎকার সব কথা। গ্রামের চিরচেনা দুঃখ সুখের কথা। না ছিলো তাতে কোনো কান জালা করা শব্দ না ছিলো কোনো মিউজিক। কোনোরকম একটা হারমোনিয়াম, একটা ঢোল আর কাসন্দ। চমৎকার তার তালে তালে শিল্পীরা গেয়ে যেতো এক এক কাহিনী। যাকে আমরা বলি “পুঁথি”।
“”””‘রিতু”””‘”
৪টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
গাজী- কালু- চম্পাবতী সম্পর্কে জানার খুব আগ্রহ ছিল,
তুনি আমার আগ্রহের অনেকটাই পুরন করেছ। তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
১৯৭১সনের যুদ্ধের সময় পালিয়ে বিভিন্ন গ্রামে থেকেছি। ঐ সময়ে আমার নানা প্রতিরাতে গাজীত গীত শুনাতেন। কত যে ভাল লাগত 🙂
অনলাইনে এ বিষয়ে খুব কম লেখা আছে। তোমার এই ধরনের লেখা সুধু সোনেলার পাঠক নয়, গুগলে সার্চ দিয়ে পড়ার পাঠকদের কাছেও সমাদৃত হবে।
শুভ কামনা।
ইঞ্জা
বহুল প্রচলিত বিশেষ করে খুলনা অঞ্চলে এই নাম গুলি সবাই জানে, আমি একসময় খুলনা আসাযাওয়া করার কারণে এই নাম অনেক শুনেছি, আজ ইতিহাসটা জানলাম, ধন্যবাদ আপু।
মোঃ মজিবর রহমান
আর শুনতে বা যাত্রাপালা হয় না দেখতে পাব। তই আপনি সুন্দর ভাবে সামে আনলেন পড়ে জানা গেল। অনেক ধন্যবাদ।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
এবার পুথি শুনবো….আপনার লেখা মানেই এ দেশের তথ্য ভান্ডার।চলুক -{@