লেখক নামদার

প্রিন্স মাহমুদ ১৪ নভেম্বর ২০১৩, বৃহস্পতিবার, ০৫:৪৮:৪৭পূর্বাহ্ন অন্যান্য, একান্ত অনুভূতি, সমসাময়িক ১৫ মন্তব্য

আপনি বলেছিলেন- রবীন্দ্রনাথের প্রত্যেকটা লাইন আপনার মনোযোগ দিয়ে পড়া । তাই বারেবার তাঁর কাছে আশ্রয় নিয়েছেন । অনেক বইয়ের নাম তাঁর কবিতা থেকে দিয়েছেন । প্রেম করেছি বেশ করেছি , প্রেম না দিলে থাপ্পড় খাবি টাইপ নামের চেয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইন থেকে দেয়া নাম অনেক সাবলীল ওঁ সুন্দর ।

দেশে ফিউশন নাটক হয় , নজরুলের নাটক , রবীন্দ্রনাথের নাটক । রবি বাবুর গল্প থেকে নাটকে প্রায় মেয়ে চরিত্রকে পিঠখোলা ব্লাউজ ব্যবহার করতে দেখে হতাশ হয়ে বলেছিলেন ” রবীন্দ্রনাথ কি মেয়েদের পিঠ দেখতে পছন্দ করতেন ? আমি রবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়ে নাটক বানাইনা কারন আমি জানি রবীন্দ্রনাথ নিয়ে ভুল করা চলেনা ” ।

জীবনানন্দ দাশকে কতো সুন্দর ভাবে আপনি তুলে ধরেছেন । আপনার বইয়ের প্রথমে ওঁ গল্পের কবিতার ব্যবহার ছিল । এসব দেখেই তো আমার মতো কতজন তাদের কাছে আবার আশ্রয় নিল । হয়তো অনেকেই স্বীকার করবেনা । আমি করবো । আরনেস্ট হোমিংওয়ে, জন স্টেইনবেক , রবার্ট ফ্রস্ট , টেনিসন এর লেখা ও যে পড়ার মতো এবং পড়া উচিত আপনার বইয়ের মাধ্যমেই জেনেছি । কি অদ্ভুত ভাবেই না আপনার বইগুলো সাহিত্যর সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হতো আমাদের কাছে । হুমায়ুন দিয়ে শুরু তারপর কঠিন সব লেখকদের বই অবলীলায় আমরা পড়ে যাই ।

আপনি অজস্র নাটক বানিয়েছেন । সবাই জানে । আপনার বাকের ভাই , কাদের , হাসান , আনিস,  হিমু , মিসির আলী , শুভ্রকে সবাই চিনে । আপনি না থাকার সময়েও বাংলায় জোছনা ছিল , বর্ষা ছিল , তবুও আমরা বলি আপনি জোছনা -বর্ষা আমাদের কাছে প্রিয় করেছেন । এখানেই একজন লেখকের সফলতা ।

বাংলাদেশে অনেক সুশিল লেখক আছে । দেশপ্রেম বলে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন । তাদের মুখে শুধুই তৎসম শব্দ বের হয় । তাদের কলম থেকে কিন্তু “তুই রাজাকার” বের হয়নি ।

র‍্যব এর ক্রসফায়ার দেখে আপনি ” হলুদ হিমু কালো র‍্যব ” লিখে প্রতিবাদ করেছিলেন ।

আপনার লেখার গভীরতা কম , হাল্কা লেখা এসব বলার কারনে একবার আপনি নাকি এক সমালোচক এর কাছে একটা গল্প লিখে নিয়ে গিয়েছিলেন ।
সমালোচক বা সাহিত্তের সেই কঠিন অধ্যাপক গল্প পড়ে জানান , গল্প ভালো কিন্তু গভীরতা কম । সেই পাণ্ডুলিপি পকেটে ভরতে ভরতে আপনি তখন বলেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর গল্পে যখন গভীরতা কম তখন আমার লেখায় গভীরতা না থাকলে কিছু যায় আসেনা । আনিসুজ্জামান এক লেখায় এই কথা বলেছেন । মানিক বাবুর গল্প উনি হাতে লিখে নিয়ে গিয়েছিলেন । সেই অধ্যাপক বুঝতে পারেননি ।

আপনি সবসময় বলেছেন ” আমি গল্পে শুধু আমার কিছু চিন্তা ভাবনার কথা বলতে চাই , কিছু দৃষ্টিভঙ্গীর কথা ” আপনি সফল ভাবে বলতে পেরেছেন ।

বাঙ্গালীদের নাড়ি ধরতে পেরেছেন বলেই আপনার প্রস্থান এর পর টানা সপ্তাহ খানেক আপনি মিডিয়াতে প্রথম পাতায় ওঁ প্রথম শিরোনামে ছিলেন । এই দেশে প্রথম পাতা ওঁ প্রথম শিরোনাম বিরোধীদলীয় নেত্রী ওঁ প্রধানমন্ত্রীর জন্য বরাদ্দ থাকে । শহীদ মিনারে আপনাকে ফুল দিতে ছেলে মেয়ের
পাশে কতো বুড়োও গেছে আপনি যদি জানতেন .. এতো বড় কাভারেজ এই দেশে এখনো কেউ পায়নি । একজন লেখকের জন্য এশিয়া মহাদেশে তা প্রথম । এশিয়ার বাইরের কথা জানিনা  ।

সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক বলতেন – হুমায়ুনের গল্পগুলো লুঙ্গির মতো , পইড়া আরাম কিন্তু বাইরে যাওয়া যায়না ।সেই তিনি মিডিয়াতে হুমায়ুন মহান , হেমিলনের বাশিওয়ালা , সাহিত্তের ক্ষতি হয়ে গেলোর মতো বাণী দিয়ে দিল । আমাদের মতো হুমায়ুন ভক্তরা আফসোস ফেলতে লাগলাম ।

হুমায়ুন কি ছিল দেশের সাধারন মানুষ দেখিয়ে দিয়েছে । সুশিলদের মত তো আমরা চাইনি । চ্যানেল আই আর প্রথম আলো আপনাকে নিয়ে এখনো ভালোই ব্যবসা চালাচ্ছে । স্যার , আপনি তো তাদের ছিলেন না , আপনি ছিলেন সাধারনের । আমাদের । আপনাকে নিয়ে এই খেলা আমাদের ভাললাগেনা ।
ব্যর্থতা নামক কোন কিছু আপনাকে কখনো স্পর্শ করতে পারেনি । যেখানেই হাত দিয়েছেন আপনি সফল । চল্লিশ বছর আপনি লিখেছেন । অনেকেই এই নিয়ে অনেক কিছু বলছে কিন্তু কেউ বলছেনা আপনি দৈনিক লেখক ছিলেন । প্রতিদিন লিখতেন না হলে প্রায় তিনশ বই লেখা সম্ভব না ।

আপনার ভালো উপন্যাসের সংখ্যা প্রচুর – বলে শেষ করা যাবেনা ।নন্দিত নরকে , শঙ্খনীল কারাগার , অন্যদিন , ১৯৭১ , সৌরভ , নির্বাসন , যদিও সন্ধ্যা ,এই বসন্তে , শ্রাবণ মেঘের দিন , তিথির নীল তোয়ালে , রুপা , বৃষ্টি ও মেঘমালা , চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক , ছায়াবীথি , অনীশ , নিষাদ , ময়ূরাক্ষী , দরজার ওপাশে , অচিনপুর , ফেরা , গৌরিপুর জংশন , দেবী , দেয়াল , মধ্যাহ্ন , বাদশাহ নামদার , আয়নাঘর , আমি এবং আমরা , বৃহন্নলা , কে কথা কয় , কবি , অন্যভুবন , শ্যামল ছায়া , কোথাও কেউ নেই , অয়োময় , তেঁতুল বনে জোছনা , তোমাকে কতো কতো নাম বলব?

আপনার প্রথম পড়া উপন্যাস ” নির্বাসন ” বই পড়ে কষ্ট পেয়েছি অনেক , কিন্তু কাদিনি । এই একটি বই আমার মতো কতো জনকে কাদিয়েছে ।
আনিস আর জরির জন্য কতোরাত ঘুম হয়নি । আনিসের এর সাথে জরি শেষ দেখা করতে এসেছে । আনিসের কপালে চুমু দিয়ে চলে যাবে । কি কষ্ট !!!!!!!!! বারান্দায় আনিস দাড়িয়ে আছে , জরি বউ বেশে চলে যাচ্ছে । কি কষ্ট !!!!!

অন্ধকারের গানের বুলু মনে হয়েছে নিজেকে , এখনো ভাবি আমিই হয়তো সেই বুলু । কবি উপন্যাস পড়ে কবি হতে চেয়েছি ।

( এক ছাত্রীকে পড়াতাম – বলদ মার্কা মগজ ছিল তার । আমার মতো বদরে পছন্দ করে ফেলল , ক্লাস নাইনে পড়া একটা মেয়ে ভুল করতেই পারে ।

ইনিয়ে বিনিয়ে জানাল আমাকে । আমি কখনো তাকে আর পড়াতে যাইনি । মাসের ২৮ দিন পড়িয়ে বেতন না নিয়ে চলে এসেছি । সেকি দুঃসময় আমার ।

মেয়ের সাথে পথে দেখা হল – সে জানতে চাইল আমি কিছু বলছিনা কেন ! আমি তখন বললাম

” শোন নৈশব্দবতী তুমি থাকো সুখে

তুমি থাকো চন্দ্র সাদা দুধের সায়রে ”

এই লাইনদুটো কবি উপন্যাসের জন্য লিখেছিলেন । কীভাবে যেন মগজে গেথে গিয়েছিল ।  সেই উপন্যাসে কবি’র বন্ধু ছাত্রীর প্রেমে পড়ে বলেছিলেন । আমার আর কবিতা দরকার নেই । আমি জীবন্ত কবিতা পেয়ে গেছি । কি ভয়ঙ্কর লাইন ! )

হিমু পড়ে কে হিমু হতে চায়নি ? আর মিসির আলীর বুদ্ধিতে কেউ কি আছে যে চমকিত হয়নি ? আর নিজেক শুভ্র কল্পনায় ভাবেনি এমন মানুষ খুব কম পাওয়া যাবে ।

জোছনাও জননীর গল্প সম্ভবত বাংলাদেশের একমাত্র উপন্যাস যার সমাপ্তি দ্বিপদী হয়েছে । এটি শুধু উপন্যাস ছিল না । ঘরোয়া ভাষায় পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা আমাদের যুদ্ধের , মুক্তি যুদ্ধের বর্ণনা । কেউ পেরেছে এমন ? নকশিকাথার মতো । শীতল পাটির মত । এটা মহাকাব্য । বাংলাদেশের সায়েন্স ফিকশন আপনার হাত ধরেই এসেছে ।

হুমায়ুন আপনি প্রজন্ম তৈরি করেছেন । আপনার ডান হাতে ছিল ছয়টি আঙ্গুল ।একটি কলম । সেই আঙ্গুল দিয়ে সপ্ন নির্মাণ করেছেন । আপনি সফল তা আমরা জানি । এর জন্য মহাকাল , আগামীকালের অপেক্ষা করতে হবেনা । কারন ফেসবুক খুল্লেই প্রতিদিন আমরা আপনার লেখা ছোট ছোট বাণী বা উপলব্ধি গুলো পাই । যদিও আল মাহমুদ বলেছেন ” হুমায়ুন কেমন লেখক ছিলেন আগামী দশ বছর পর দেখা যাবে ” ।

কবি আল মাহমুদের এই কথা অবশ্যই ভুল প্রমানিত হবে ।

” একবার আপনার একটা সাক্ষাৎকারে আপনাকে জিজ্ঞেস করা
হয় আপনি লিখেন কেন ?
আপনার উত্তর – আঙ্গুলের ব্যায়াম হয় বলে লিখি । ”

” কলকাতার সুনীল আমাদের যুদ্ধ , ইতিহাস নিয়ে প্রথম আলো , পূর্ব পশ্চিম লিখেছেন । আপনি কিছু লিখেননি কেন ?

হুমায়ুন – উনি মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি বলে লিখতে পেরেছেন । আমি পেরেছি বলে পারছিনা লিখতে ।

কবে আপনি এরকম লেখা লিখবেন ? বাজারি লেখা ছেড়ে ??

হুমায়ুন – লিখবো । নামও ঠিক করেছি । নামটা একটু বড় ।

কি নাম ?

হুমায়ুন – এই বইয়ে পূর্ব পশ্চিম , উত্তরদক্ষিন সব দিক ধরা হবে । তাই নামটা হবে পূর্ব পশ্চিম , উত্তরদক্ষিন , উর্ধে , পশ্চাতে ।

সাংবাদিক কুপোকাত হাহাহাহ ”

 

হাসন রাজার ছয়শর উপর গান আছে । আমরা জানি কতগুলো ? ১০ থেকে ১৫টা । তাও জানি আপনার কারনে । গানগুলো আপনি অতীতে খুঁড়ে তুলে এনেছেন । বই পড়ে যে হাসা যায় তা আপনি দেখিয়েছেন । কতো সহজ ছোট ছোট বাক্যে লিখতেন ! আপনি যতো বছর বেঁচে ছিলেন রাজার মতোই ছিলেন । তাই , নিরধিধায় বলতে পারি –
শুভ জন্মদিন
হুমায়ুন আহমেদ
লেখক নামদার ।

জলে কার ছায়া পড়ে
কার ছায়া জলে ?
সেই ছায়া ঘুরে ফিরে
কার কথা বলে ?
কে ছিল সেই শিশু
কি তাহার নাম ?
কেন সে ছায়ারে তাঁর
করিছে প্রনাম ?

আমি একটু অলস , ঠিক সময়ে পোস্ট করতে পারিনা । তাই একটু দেরিতে হলেও . . –

পুনশ্চ – স্যার আমি আনিস হতে চেয়েছি শুধু । যার কোন অন্ধকার থাকবেনা । শুধু শুদ্ধতা ও আলো থাকবে ।

যার শুধু একজন জরী থাকবে ।

৬৫১জন ৬৫১জন
0 Shares

১৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ