আমি বিছানায় ঘুমাতে যাওয়ার আগে বারান্দা থেকে আকাশের দিকে তাকালাম, কৃষ্ণপক্ষের একফাঁলি চাঁদটাকে তুলোর মতো উড়ে যাওয়া মেঘগুলো ঢেকে ফেলেছে। হেমন্তের গা শিরশির করা ঠান্ডা বাতাসে নিজের লোমকূপগুলো খাড়া হয়ে উঠলো। মনে হচ্ছে আজ সব অশরীরী আত্মারা জেগে উঠেছে, কেমন যেন মন খারাপ করা অনুভুতি।
আমি বিছানায় নিজের শরীরটাকে এলিয়ে দিলাম। বিছানাটাও টাইলস করা মেঝের মত ঠান্ডা হয়ে আছে। কাঁথা গায়ে দিয়ে মনে মনে বলছি- আয়… ঘুম… আয়।
আমি গভীর ঘুমে নিমজ্জিত, চারিদিকে নিথর নিস্তব্ধতা। শ্বাসপ্রশ্বাস ধীর হয়ে গিয়েছে। জাগতিক কোন কিছুই আমাকে স্পর্শ করছেনা। কেমন দম বন্ধ করা অনুভব, মাঝেমধ্যে শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। মনে হচ্ছে ঘরের বাতাস বদ্ধ হয়ে উঠেছে। কারা যেন আমার আশেপাশে ফিসফাস করছে!
আচ্ছা আমিতো গভীর ঘুমে, তাহলে ঘরে কাদের চলাফেরার অস্তিত্ব পাচ্ছি? আমার হাত পা কানের লতি সব ডিপফ্রীজের মত ঠান্ডা হয়ে আসছে কেনো? আমি বুঝতে পারছি আমার শরীর হালকা হয়ে আসছে। মনে হলো কেউ যেন আমাকে শুন্যে উঠিয়ে ফেলছে, আমি ভেসে ভেসে চলছি। হার্টবিট বেড়ে গেছে, ধ্বক ধ্বক ধ্বক! মনে হচ্ছে বুকের মধ্যে কেউ একজন উঠে বসে হাতুরি পিটাচ্ছে! তবে কি আমি হার্ট এ্যাটাক করছি? আজই এখনই কি আমি মরে যাব!
যত দোয়া জানি সব আওড়ানো শুরু করলাম, কালেমা পড়ছি। আজরাইল যদি জান কবজ করে তবুও যেন কালেমা পড়ে মরতে পারি। শুনেছি আজরাইল যার জান কবজ করে সেই অসীম কষ্ট শুধু সেই মানুষটাই অনুভব করে। পৃথিবীর সমস্ত পাহারপর্বতের ভার যেন তার বুকের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়। উহ! আল্লাহ বাঁচাও, তুমি রহমত করো। অবশ্য নেককার মানুষ যারা ভালো কাজ করে তাদের জান কবজে এত কষ্ট হয়না। আজরাইল তাদের জান কবজ করে এমনভাবে যেন একটি শিশু তার মায়ের স্তন পান করতে করতে ঘুমিয়ে যায় এভাবে। কিন্তু আমি যে গোনাহগার মানুষ!
নাহ! আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে ঠিকই কিন্তু বুকে পাহারসম চাপতো অনুভব করছিনা। মাথাটা যেন অন্তঃস্বার শুন্য হয়ে উঠছে। এখন আমার চিন্তা করার সেই বোধটুকু শেষ হয়ে আসছে। কে বা কারা যেন আমাকে ভেসে নিয়ে চলেছে মহাজাগতিক এক বিশাল শুন্যতায়!
শুনেছি এমন নিশুতি রাতে খারাপ প্রেতাত্মারা পৃথিবীতে ঘোরাফেরা করে। তবেকি আমাকে তারাই নিয়ে যাচ্ছে তাদের সাথে? শেষপর্যন্ত আমাকে তারা নরকে নিয়ে যাচ্ছে? আমি হাত ছোটাছুটি করছি তাদের বন্ধন থেকে মুক্ত হবার জন্য, কিন্তু কই! কে যেন আমার নাক মুখ চেপে ধরেছে যাতে চিৎকার করতে না পারি।
আমি দোয়াদরুদ পড়ছি, আমি জানি দোয়াদরুদ পড়লে খারাপ আত্মারা কাছে আসতে পারেনা। কিন্তু তারাতো আমার বুকে আরো জোরেশোরে চেপে বসছে আর কেউ যেন হ্যাচকা টানে আমায় নিয়ে চলেছে বগলবন্দী করে। আমার মনটা খুব বিষণ্ণতায় ভরে উঠলো। আজকের রাতই আমার শেষ রাত হতে চলেছে। সব প্রিয়জন ছেড়ে আমি চলে যাচ্ছি। আহা! তাদের কারো সাথেতো আমার শেষ কথা হলোনা! তাদের প্রতি কত অন্যায় করেছি, আমার খারাপ ব্যবহারে আমার আচরনে তারা কত কষ্ট পেয়েছে, অথচ শেষবারের মতো ক্ষমা চাইতে পারলামনা তাদের কাছে। আমার বুক ফেটে যাচ্ছে কান্নায়, ভয়ে প্রচন্ড পিপাসা পাচ্ছে। মনেহয় একসাগর পানি আমি এক নিমিষেই শেষ করে ফেলবো!
এখন আমি আর নিশ্বাস নিতে পারছিনা। শেষবারের মত আমার নিজের হৃদপিন্ডের ধুক ধুক আওয়াজ টের পাচ্ছি, অক্সিজেন স্বল্পতায় বেচারা ধীরেধীরে দুর্বল হয়ে পরছে। আমার দু’চোখ বেয়ে অশ্রুধারা নেমে আসছে। প্রানপ্রিয় সব রক্তের বাঁধন, মায়ের নাড়ির বাঁধন, আমার প্রেমিকার স্বার্থহীন মায়া, আমার ভাইবোনের ভালোবাসা সবকিছু ছিন্ন করে কারা যেন আমায় নিয়ে চলেছে তাদের সাথে!
নাহ! আমি আর ভাবতে পারছিনা, চিন্তাভাবনা করার সময়টাও যে শেষ! আমি বুঝতে পারছি চোখ বেয়ে নেমে পড়া অশ্রু আমার কান স্পর্শ করছে। ঠান্ডা কানের লতিতে সেই পানির স্পর্শে আমার নিস্তেজ হয়ে পরা হৃদপিন্ডটা যেন একটু সতেজ হয়ে পড়লো। সেখানে লুকানো একটি আওয়াজ আমার কানে কানে বলে উঠলো- এই শোনো, এখনো পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার সময়তো তোমার হয়নি! এখনো অনেক ভালো কাজ করার বাকী আছে। অনেককে অনেক কিছু দেবার আছে, অনেক ঋন পরিশোধ করার বাকী আছে যে! গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসো।
এসব কি হচ্ছে? তবে কি আমি মরে যাচ্ছিনা? কিন্তু আমার দম যে বন্ধ! মানুষ বাঁচার জন্য খড়কুটো পর্যন্ত আঁকড়ে ধরে; আর আমি? আমি কিভাবে এখান থেকে এই অশরীরীদের থেকে বাঁচবো, যারা আমার হাত পা শক্ত করে ধরে রেখেছে? আমার বুকে হাতুরি পিটাচ্ছে, নাক মুখ চেঁপে ধরেছে?
নাহ! আমাকে শেষ চেষ্টা করতেই হবে। মরন কপালে লেখা থাকলে সেটা খণ্ডানোর শক্তি আমার নেই কিন্তু এই অশুভশক্তি আমাকে আজ অন্তঃত নিয়ে যেতে পারবে না। আমি লড়াই করবো, আমাকে বাঁচতেই হবে। আর কিছু সাতপাঁচ না ভেবে সেইসব প্রেতাত্মাদের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নিজের শরীরের সবটুকু শক্তি একত্রিত করে চার হাত পা দিয়ে সজোরে ঝাঁকি দিলাম। মনে হলো যে অসীম শুন্যতায় আমি ছিলাম সেখান থেকে কেউ সজোরে আমাকে ছুঁড়ে ফিরিয়ে দিলো। পিঠে মাথার পিছনে প্রচণ্ড ব্যথায় কুঁকড়িয়ে উঠলাম।
আশ্চর্য! বুকের মধ্যে সেই চাপলাগা; অশরীয় চেপে ধরার অনুভূতিটাও আর নেই। বিশুদ্ধ অক্সিজেন পেয়ে হৃদপিন্ড সচল হয়ে উঠছে।
তবে ঠান্ডা লাগার অনুভুতিটা প্রকট। আমি ধীরেধীরে চোখ মেললাম। আশেপাশের পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছি। কিন্তু একি! আমি বিছানা থেকে ঠান্ডা মেঝেতে পড়ে আছি কেনো? আমার গায়ের কাঁথাটা কই? নীচের মেঝের তীব্র শীতলতা আর উপরের সিলিং ফ্যানের ঠান্ডা বাতাসে মনে হচ্ছিলো হাত পা কানের লতিতে কে যেন বরফ ঘষে দিয়েছে। বালিশটাই বা নাক ঘেসে বুকের উপর চেপে আছে কেন ?
এতক্ষন কি তবে এক অতৃপ্তিকর ঘুম আমাকে আচ্ছন্ন করে পরিচিত করাতে নিয়ে গিয়েছিল জীবনের অমোঘ সত্য মৃত্যুর কাছ থেকে?
২২টি মন্তব্য
ইঞ্জা
রাতে ঘুমানোর আগে পাঁচ কলেমা, অন্যান্য সূরা কালাম পড়ে ঘুমাবেন ভাই, একেই বলে বোবায় ধরা।
তৌহিদ ইসলাম
এই অনুভূতি লিখে প্রকাশ করা যায়না দাদা। ইনশাআল্লাহ তাই করবো।
ইঞ্জা
ইনশা আল্লাহ্
তৌহিদ ইসলাম
ধন্যবাদ দাদা
নীলাঞ্জনা নীলা
বেশীরভাগ মানুষের অবচেতন মনে মৃত্যুচিন্তার ভয় কাজ করে। জীবনের সৌন্দর্য নিয়ে ভাবনাকে সময়ের সাথে যুক্ত করলে মন আনন্দময় হয়ে থাকে। মৃত্যু সে না চাইলেও আসবে। তাকে নিয়ে ভাবনার কিছু নেই। বরং অবচেতন মনের ভেতরে সুন্দর স্বপ্নগুলোকে সাজিয়ে নিলে বেঁচে থাকার আনন্দ বাড়বে। আর ঘুমের ভেতর স্বস্তি খুঁজে পাওয়া যায়।
তৌহিদ ইসলাম
ইদানীং আজেবাজে চিন্তাই বেশি হচ্ছে আপু। হয়তো কাজের চাপের কারনে মন অস্থির হচ্ছে বলেই এমনটা হচ্ছে। সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
নীলাঞ্জনা নীলা
ভালো চিন্তা করুন, সুস্থ থাকুন।
তৌহিদ ইসলাম
ধন্যবাদ আপু
ছাইরাছ হেলাল
ইঞ্জা ভাইয়ের কাছ থেকে পানি-পড়া ও তাবিজ নিন,
অবশ্যই উপকৃত হবেন।
তবে তুখোড় বর্ণনা দিতে পেরেছেন, সত্যের কাছাকাছি!!
মায়াবতী
😀
তৌহিদ ইসলাম
মায়াবতী আপু ভুতের হাসি দিলেন যে বড়! আমিও পারি হুম 😀
তৌহিদ ইসলাম
হ ইঞ্জা দাদা মাথায় হাত রাখলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।তিনি আমার বড় ভাই যে!!
রিতু জাহান
এসব স্বপ্ন দেখার পর হাতে পায়ে পুরো শরীরে কেমন যেনো কোনো শক্তি থাকে না।
সত্যি মৃত্যু কি, এটা চিন্তা করলে আর কিছু ভালো লাগে না।
স্বপ্নের বর্ণনা বেশ পরিপক্ত। লিখুন বেশি বেশি করে।
তৌহিদ ইসলাম
পুরো শরীর অবশ হয়ে যায় আপু। আপনি কেমন আছেন আপু?
মোঃ মজিবর রহমান
আমি এম এ জি ওসমানী হোটেলের ছাত্র। নতুন হোটেলে উঠেছি। ৪ জনে রুম বর্ডার। আমার সঙ্গে ছিল মামুন। বাঘেরহাটের। হঠাত রাত্রে গু গু শব্দ জোরে জোরে হচ্ছে তখন তিনজন ছিলাম উঠলাম। আমার প্রি, হাই, ইন্টার বন্ধু জাহিদের কাছে গেলাম নাহ ও না। তারপর গেলাম মামুনের বেডে। হ্যাঁ মামুনই জোরে জোরে গুংড়াচ্ছে। আমি কিন্তু ঐ প্রথম এই অবস্থার সম্মুখীন। জোরে জোরে ধাক্কা দিয়ে তুললাম। ওঠার স্বাভাবিক হবার পর বলে ডেকে আমাকে বাচালি, আমি বললাম কেন? কি হয়েছিলো? মামুন বলে আমাকে বোবা ধরেছিল। কি ওটা। মামুন বলে বুঝবিনা।
তৌহিদ ইসলাম
অনেকেরই এমনটা হয় শুনেছি ভাই।
জিসান শা ইকরাম
ভাইরে আপনার বর্ননা পড়ে আমারই তো দমবন্ধ অবস্থা হয়ে গিয়েছিল।
স্বপ্নই দেখেছেন, যা অবচেতন মন থেকে আসে। ঘুমের মধ্যেই বিছানা থেকে ফ্লোরে চলে এসেছেন।
তৌহিদ ইসলাম
যাক আপনাকে তাহলে অনুভূতিটা কিছুটা হলেও বোঝাতে পেরেছি, লেখাটি স্বার্থক হলো দাদা। হুম ঘুমের মাঝেই ফ্লোরে চলে এসেছি।
সাবিনা ইয়াসমিন
বোবায় ধরলে এমন হয় শুনেছি।একেক জনের সাথে একেক রকম ঘটে।তবে সবাই সেই অভিজ্ঞতার বিবরন দিতে পারে না।লেখা ভালো হয়েছে।আপানার জিবনে এই অভিজ্ঞতা আর না আসুক এই দোয়াই করি।
তৌহিদ ইসলাম
অনেক ধন্যবাদ আপু, অনুপ্রেরিত হলাম।
সাবিনা ইয়াসমিন
স্বাগতম। -{@
তৌহিদ ইসলাম
-{@