লাল সবুজের এই পতাকার জন্য ১৯৭১ সনে এক সাগর রক্ত দিতে হয়েছিল আমাদের। শুধু মাত্র দেশ মাতাকে মুক্ত করার জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরেছিল এই দেশের দামাল ছেলেরা। বাবা মা ভাই বোন স্ত্রীর ভালোবাসার টানকে উপেক্ষা করে ঝাঁপিয়ে পরেছিল যুদ্ধে।রণাঙ্গন থেকে মুক্তিযোদ্ধারা চিঠি দিয়েছেন তাঁদের প্রিয় জনকে। চিঠিতে যুদ্ধের অবস্থা , মুক্তিযোদ্ধাদের দেশের প্রতি ভালবাসা স্পর্শ করে যায় আমাদের ।
মুক্তিযোদ্ধাদের এমন চিঠি প্রকাশ করেছে প্রথম আলোর প্রকাশনী প্রথমা । সুন্দর এই ঐতিহাসিক বইটির মুল্য ৩০০ টাকা।
২৭/০৯/৭১
প্রিয় কমরেড মঞ্জুর,
আশা করি এত দিনে আপনারা ট্রেনিং শেষ করিয়া ফিরিয়া আসিয়াছেন। এখনো আপনাদের ট্রেনিং সম্বন্ধে সমস্ত খবর জানিতে পারি নাই, কিন্তুু তাহা স্বত্বেও আপনাদের এই সাফল্যজনক প্রত্যাবর্তনে আপনিসহ আপনাদের সকলকে অভিনন্দন জানাইতেছি। আপনাদের সহিত দেখা করিবার জন্য অত্যন্ত আগ্রহের সহিত অপেক্ষা করিতেছি। আরও কয়েক দিন পরও হয়তো দেখা করা সম্ভব হইবে না। যাহা হউক, দেখা হইলে সমস্ত কিছু জানা যাইবে এবং তাহার ফলে আমাদেরও কিছুটা অভিজ্ঞতা হইবে। প্রথম ইধঃপয – এর ব্যাপারেও কতকগুলি অভিজ্ঞতা হইয়াছে কিন্তুু সেগুলি খুব বেশি ভালো নয়।
আশা করি আপনারা সকলেই সুস্থ আছেন। আপনাদের খবর জানিবার জন্য খুবই উদগ্রীব আছি। সম্ভব হইলে একখানা চিঠি দিবেন।
আমি এক প্রকার ভালো আছি। আমার জন্য কোন চিন্তা করিবেন না। আপনি যে ঐড়ৎষরপশং (……) দিয়াছিলেন তাহা বেশ কিছুদিন খাইয়াছি। আপনারা আমার ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা গ্রহন করিবেন।
জ্ঞান চক্রবর্তী
চিঠি লেখক: জ্ঞান চক্রবর্তী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা।
চিঠি প্রাপক : মুক্তিযোদ্ধ মনজুরুল আহসান খান। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি।
চিঠি পাঠিয়েছেন : মনজুরুল আহসান খান।
সোনাটোলা, ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
প্রিয়তম স্বামী,
সালাম নিয়ো এবং ভালোবাসা। জাহান ভাই এর হাতে একটা চিঠি পাঠিয়েছ। চিঠিটা পড়ে বেশ কিছু দিন পর ছিঁড়ে ফেলেছি রাজাকারদের ভয়ে। কারন রাজাকাররা ২৪ ঘন্টা আমাদের বাড়ি পাহারা দিচ্ছে- তোমাকে ধরার জন্য। তোমার দ্বিতীয় সন্তানের বয়স যখন ৬ দিন, তখন তোমার চিঠিটা পাই। তুমি লিখেছিলে আমি বেঁচে থাকি তোমার গর্ব তোমার স্বামী। বাংলাদেশকে ছিনিয়ে আনব। আমি ছুটোছুটি করতে থাকি। প্রচন্ড কষ্ট বোঝাতে পারব না। আমি যেদিন তোমাদের বাড়ি থেকে আমার বাবার বাড়ি আসি, সেদিন ছিল ১৪ই জুলাই। সেদিন তুমি বাড়িতে ছিলে না। বুঝেছিলাম তুমি অস্থির আছ এবং বেশ কয়েক মাস ধরে লুকিয়ে থাকছ এবং অস্থিরতার মধ্যে থাকছ। কিন্তুু আমাকে কিছু বলো না। বুঝতে পারতাম তুমি যুদ্ধে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছ। আমার বাবার বাড়িতে আসার কয়দিন পর বাবুর জন্ম হলো, ২১শে জুলাই। আশা করেছিলাম তুমি আসবে। তার বদলে এল চিঠি। আগামীকাল আমি শ্বশুরবাড়ি অর্থাৎ তোমাদের বাড়ি যাব। রাজাকারদের অত্যাচারে। জাহান ভাই এর মাধ্যমে খবর পেতাম। তুমি বেঁচে আছ। ওখানে খবর পাব কীভাবে? তাই লিখছি।
তোমার আড়াই বছরের বড় ছেলে সব সময় পতাকা হাতে নিয়ে জয় বাংলা বলতে থাকে আর রাজাকাররা ধমক দেয়। আব্বা ছেলের মুখ চেপে ধরে, ছেলে ছটফট করতে থাকে আর বলে, নানু, আমাকে ছেড়ে দাও এবং বলে বাংলাদেশের জয় হোক। রাজাকাররা আব্বাকে বলে, তোমার জামাই তোমার বাড়িতে আসে, তোমাকে ধরিয়ে দিব। তোমার বাড়ি পুড়িয়ে দিব। এই সমস্ত কারনে আব্বাকে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, দেশ স্বাধীন করে ফিরে এসো সুস্থ দেহে।
ইতি
তোমার কদবানু আলেয়া
চিঠি লেখক : কদবানু আলেয়া। মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রাজ্জাকের স্ত্রী
চিঠি প্রাপক : মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রাজ্জাক।
চিঠিটি পাঠিয়েছেন : এবিএম কাইসার রেজা, সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ,
কুমারখালী ডিগ্রী কলেজ, কুমারখালী, কুষ্টিয়া। তিনি আবদুর রাজ্জাকের ছেলে।
তারিখ : ০৪.১০.১৯৭১
মাগো,
সবেমাত্র রণাঙ্গন থেকে ফিরে এসে শিবিরে বিশ্রাম নিচ্ছি। একটা বিস্তীর্ণ এলাকা শত্র“মুক্ত করতে পেরে স্বস্থির নি:শ্বাস ফেলছি। মনটা তাই বেশ উৎফুল্ল। হঠাৎ মনে পড়ল তোমাকে। বাড়ি থেকে আসার পর এই প্রথম তোমাকে লিখছি। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তোমায় লিখতে পারিনি। বাঙ্কারে বসে আছি। বাইরে ভীষণ বৃষ্টি আর বাতাসের শব্দ কমিলে একটা চাপা আর্তনাদ ভেসে আসছে।
মাগো, আজ মনে পড়েছে বিদায় নেবার বেলায় তোমার করুণ হাসিমুখ।সাদা ধবধবে শাড়িটা বেশ মানিয়েছিল তোমাকে। সেদিনের পূর্ব দিগন্তের সূর্যটা বেশ লাল মনে হয়েছিল। আমার কী মনে হয়েছিল জানো মা? অসংখ্য বাঙালির রক্তে রঞ্জিত ওই লাল সূর্যটা । ওর প্রতিটি কিরণচ্ছটা প্রথিবীতে জন্ম দিয়েছে অগ্নি – শপথে বলীয়ান, স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত এক একটা বাঙালি সন্তান । মগো- তোমার কোলে জন্মে আমি ধন্য । শহীদের রক্তরাঙা পথে তোমার আদুরে ছেলেকে এগিয়ে দিয়েছে। ক্ষণিকের জন্যও তোমার বুক কাঁপেনি, স্নেহের বন্ধন – দেশমাতৃকার ডাক উপেক্ষা করতে পারোনি। মা, তুমি শুনে খুশি হবে যে তোমারই মতো অসংখ্য জননী তাঁদের স্নেহ ও ভালোবাসার ধন-পুত্র-স্বামী, আতœীয়-সর্বস্ব হারিয়েও শোকে মুহ্যমান হয়নি; বরং ইস্পাতকঠিন মনোবল নিয়ে আজ অগ্নি-শপথে বলীয়ান।
মাগো বাংলার প্রতিটি জননী কি তাঁদের ছেলেকে দেশের তরে দান করতে পারে না- পারে না মা- বোনের ভাইয়েদের পাশে এসে দাঁড়াতে? তুমিই তো একদিন বলেছিলে, সেদিন বেশি দূরে নয়- যেদিন এ দেশের শিশুরা মা- বাবার কাছে বিস্কুট- চকলেট না চেয়ে চাইবে পিস্তল -রিভলবার। সেদিনের আশায় পথ চেয়ে আছে বাংলার প্রতিটি সন্তান, যেদিন বাংলার স্বাধীনতার সূর্য প্রতিফলিত হবে, অধিকারবঞ্চিত,শোষিত, নিপীড়িত, বুভুক্ষু, সাড়ে সাত কোটি বাঙালির আশা- আকাঙ্খা। যে মনোবল নিয়ে প্রথম তোমা থেকে বিদায় নিয়েছিলাম, তা আজ শত গুণ বেড়ে গেছে। শুধু আমার নয়,প্রতিটি বাঙালি খুনের হানছে মাতোয়ারা। তাই তো বাংলার আনাচকানাচে এক মহাশক্তিতে বলীয়ান তোমার অবুঝ শিশুগুলোই আজ হানাদার বাহিনীকে চরম আঘাত হেনেছে- পান করছে হানাদার পশুদের তাজা রক্ত। ওরা ওরা মানুষ হত্যা করছে- আর আমরা পশু হত্যা করছি। মা, মাগো। দুটি পায়ে পড়ি মা। তোমার ছেলে ও মেয়েকে দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে ঘরে আটকে রেখো না। ছেড়ে দাও স্বাধীনতার উত্তপ্ত রক্তপথে। শহীদ হয়ে অমর হব; গাজী হয়ে তোমারই কোলে ফিরে আসব মা। মাগো – জয়ী আমরা হবই। দোয়া রেখো। জয় বাংলা।
তোমারই
দুলাল
চিঠি লেখক: মু্িক্তযোদ্ধা দুলাল। তাঁর বিস্তারিত পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি।
ফুলবাড়িয়ার সম্মুখেসমরে তিনি আহত হন এবং পরে মারা যান। আহত হওয়ার সময় চিঠিটি তাঁর পকেটে ছিল। এটি পরে, মুক্তিযুদ্ধকালে পত্রিকাটি ময়মসিংহের ভালুকা থেকে প্রকাশিত হতো।
চিঠি প্রাপক: মা। তাঁর পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি।
চিঠিটি পাঠিয়েছেন: এস এ কালাম, সম্পাদক, সাপ্তাহিক চরকা ও ’৭১ মুক্তিযুদ্ধে জাগ্রত বাংলা । তাঁর বর্তমান ঠিকানা : ৫/৪৬ আউটার স্টিডিয়াম, ময়মনসিংহ।
০৫/১০/৭১
শ্রদ্ধাবরেষু,
ভাই, সালাম জেনো, তোমার চিঠি পেয়েছি ১৪ তারিখ লেখা। কুচবিহারে যে চিঠিটা দিয়েছ, তা পাইনি। এর ভিতরে হয়তো আমার আর একটা চিঠি পেয়ে গেছ। ওখানে রংপুরে আর গাইবান্ধায় দুটো চিঠি দিতে পাঠিয়েছিলাম । ও দুটো পাঠিয়ে দিয়ো। রংপুরের কোনো খোঁজখবর পাইনি। কাজেই মানসিকভাবে কী রকম চলছি বোঝ।
যাক, করার কিছু নেই। ভাই বা চিনুর চিঠি পাইনি অনেক দিন। আমি খোঁজ নিবার চেষ্টা করছি। তুমি এখনো কিছু ঠিক করো না কী করবে। তবে দেশে ফিরবার চেষ্টা একেবারেই করবে না। কদিন আগেই বিদেশ থেকে কজন শিক্ষক আর রেলওয়ের এক ডাইরেক্টর দেশে ফেরার সাথে সাথে প্রাণ হারিয়েছেন করাচিতেই। সমাধানের কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না। তোমার ওপর একটা অনুরোধ, বন্ধুবান্ধবদের অনেকেই প্রাণ নিয়ে এ দেশে পালিয়ে এসেছে-দেশে তাদের কেউ কোনো খোঁজ জানেন না। তুমি ওদের বিরাট উপকার করতে পার। চিঠিগুলো ওদের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়ো। কৃতজ্ঞ থাকবে ওরা।
আমাকে চিঠি দিয়ো। কীভাবে আমি আছি- তুমি চিন্তা করতে পার না। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার যা বাকি। এবং তোমার কাছ থেকে ছাড়া অন্য কোথা থেকেও চিঠি পাবার উপায় নাই। সাথের চিঠি কটার সানু মিয়া হেডমাস্টারের চিঠিটা আগে পাঠিয়ে দিয়ো। পরে চেয়ারম্যানের চিঠিটা পাঠিয়ো। প্রেরককে তোমার ঠিকানা না দেওয়াই ভালো। এমনি একটা কিছু লিখে দিয়ো।
ইতি
জীমু
চিঠি লেখক: জীমু, মুক্তিযোদ্ধা কে মুশতাক ইলাহী। জীমু ছদ্ম নাম। তাঁর পিতার নাম: খোন্দকার দাদ ইলাহী। ঠিকানা: ধাপ, মেডিকেল মোড়, রংপুর।
চিঠি প্রাপক: ভাই; কে মউদুদ ইলাহী।
চিঠিটি পাঠিয়েছেন: ড. কে. মউদুদ ইলাহী; প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, স্ট্রামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, ঢাকা। তিনি মুক্তিযোদ্ধা কে মুশতাক ইলাহীর ভাই।
তারিখ: ১১/১০/৭১ইং
স্নেহের শামীম,
কারও কোনো বিপদে এখন আর এক পয়সার সাহায্যও আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়। এ অবস্থা আমার কাছে অসহ্য।
সারা জীবন পরিশ্রম করে আজ বলতে গেলে একেবারে নতুন করে সংসারযাত্রা শুরু করতে হচ্ছে। কোনো অপঘাতে যদি মৃত্যু হয়, জানি না কোনো অকূল পাথারে সকলকে ভাসিয়ে রেখে যাব। কোনো দিন স্বপ্নেও ভাবিনি যে, সংসারজীবনে এমনি করে পেছনে ফিরে যেতে হবে। এ বয়সে নতুন করে দু:খ কষ্টের মধ্যে যাওয়ার যাওয়ার মতো মনের বল আর অবশেষ নেই। যা হোক, তোমাকে আশীর্বাদ করি, জীবনে সত্য ও ন্যায়ের পথে থেকে সামনে এগিয়ে যাও। আমার বন্ধুবান্ধবের সম্পর্কে যে কথা লিখছে, ওতে আমি বিস্মিত হইনি, কারণ আমি অনেকের বন্ধু হলেও কেউ আমার বন্ধু ছিল না। কারণ, এ সংসারে সকলেই স্বার্থের দাস, জীবনের মহত্ত্বের গুণাবলি কজনের আছে? আমার জীবনে অপরিচিত জন ছিল যারা, বিপদে-আপদে তারাই আমার পশে এসে দাঁড়িয়েছে, পরিচিত কোনো বন্ধুজন নয়।
শুনে খুশি হলম, তুমি* মানিকের স্নেহাস্পর্শে আছ। ওদের ক’ জনকে আমি বরাবর স্নেহের নয়, শ্রদ্ধার চোখেই দেখেছি। ওকে আমার শুভেচ্ছা জানাবে।
ইতি
আব্বা
এগারোই অক্টোবর
উনিশ শ’ একাত্তর
চিঠি লেখক: শহীদ বুদ্ধিজীবী সিরাজুদ্দীন হোসেন। দৈনিক ইত্তেফাক এর প্রবীণ সাংবাদিক। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর আলবদর বাহিনী তাঁকে বাড়ি থেকে নিয়ে যায়, তারপর তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
চিঠি প্রাপক: মুক্তিযোদ্ধা শামীম, পুরো নাম শামীম রেজা নূর। শহীদ সিরাজুদ্দীনের বড় ছেলে।
সংগ্রহ: স্মৃতিপটে সিরাজুদ্দীন হোসেন গ্রন্থ থেকে।
12.10.71
খালা ও মমিন
আমাদের আন্তরিক স্নেহ ও দোয়া ভালোবাসা জানিবা। আজ ৬ মাস তোমাদের কোনো সংবাদ পাই না। তিন মাস পর জেনেছি তোমরা ও বাড়িতে আছ এবং ভালো আছ। প্রথম তিন মাস আমাদের কী অবস্থা হয়েছিল অনুমান করতে পার। যাক তোমরা বেঁচে আছ জেনে কিছুটা নিশ্চিত হয়েছি। আমাদের মানসিক অবস্থা খুবই খারাপ। এপ্্িরল মাসের প্রথমদিকেই আমার বাড়িঘর সম্পূর্ণভাবে পুড়িয়ে দিয়েছে। সমস্ত জিনিস পুড়ে গিয়েছে কিংবা লুট হয়েছে। আমরা সত্যিকারের সর্বহারা। অনেক বাড়িই পুড়ে গিয়েছে এবং সমস্ত বাড়িই লুট হয়েছে। মাঝে মাঝে ২/১ খানা ভাল আছে। অপূরণীয় ক্ষতি। স্মৃতিচিহ্ন সবই গিয়েছে। জামাকাপড় থেকে আরম্ভ করে যাবতীয় জিনিস নষ্ট হয়েছে। এমনকি শোয়ার মতো বিছানা, খাট ইত্যাদিও নাই। বাড়ি মেরামত করা ছাড়া বাড়িতে যাওয়ার উপায় নাই। বর্তমানে সাধুপাড়া বাসাতে থাকি, ওই দিকটা বেশি নষ্ট হয় নাই। এই ছয় মাস বহু জায়গায় থেকে বর্তমান তিন সপ্তাহ হলো এখানে আছি। লাভলুর চিঠি পেয়েছি, ভালো আছে। করিম ও গিনি ঢাকা এসিছিল। করিম গত ৩০/৯ করাচি গিয়েছে। টিটোও গিয়েছে। টুটুরা অনেক জায়গায় ছিল, বর্তমানে চিটাগাং আছেু। বেবী ও পিয়া ৪ মাস ঢাকাতে। গত মাসে ঢাকায় তুহিনের বিবাহ হয়েছে। ছেলে এমবিবিএস-ময়মনসিংহ জেলায় বাড়ি। হিরার শ্বশুর ও শালা আয়নাল গুলিতে মারা গিয়েছে। বাড়িঘর সব লুট হয়েছে। আমিনউদ্দিন অ্যাডভোকেট গুলিতে মারা গিয়েছে। ঘুটুর শ্বশুর, আনিসের শ্বশুর, তুহিনের বড় মামা ইত্যাদি ইত্যাদি মারা গিয়েছে। পল্টু মামাও মেহমানদের নিকট। আমরা প্রথমেই বাড়ি ছেড়ে দিয়ে জীবনে বেঁচে আছি। এই শুধু সান্ত্বনা। খোদা তোমাদের সবাইকে বাঁচিয়ে রাখুন,এই দোয়াই করি। ইমনের জন্য সব সময়ই মনে হয়, ও-ই সব সময় খেতে চাইত-এখন কত কষ্টই পাচ্ছে। মেয়ে হওয়ার সংবাদ যদিও পেয়েছি প্রথমে ঘুটু উ.অ.উ জধহমঢ়ঁৎ গৎ গড়সঃধু শাহানা ও অন্যান্য ২/১ জনের নিকট কিছু কিছু সংবাদ পেয়েছিলাম। পরে হেলেনের চিঠিতে সব জানি মাঝে মাঝে, এমনকি সপ্তাহে সপ্তাহে রফিকের নিকট লিখে আমাদের জানাব্ েশুভেচ্ছা রইল। ইমনকে আমাদের প্রীতি ভালোবাসা জানাবে। খোদা হাফেজ।
আশীর্বাদক
তোমাদের আব্বা
১২.১০.১৯৭১
চিঠি লেখক: মেজর ডা. মোহাম্মদ মোফাজ্জল হোসেন।
চিঠি প্রাপক: মেরিনা ইসলাম ও মুক্তিযোদ্ধা মুজহারুল ইসলাম। মেরিনা ইসলাম ডা. হোসেনের কন্যা। ডা. হোসেন তাঁর কন্যা মেরিনাকে ‘খালা’ বলে মম্বোধন করতেন।
চিঠিটি পাঠিয়েছেন: মেরিনা ইসলাম।
১০টি মন্তব্য
প্রজন্ম ৭১
তারিখ : ১৬/০৪/৭১
প্রিয় ফজিলা,
জানি না কী অবস্থায় আছ। আমরা তো মরণের সঙ্গে যুদ্ধ করে এ পর্যন্ত জীবন হাতে নিয়ে বেঁচে আছি। এর পরে থাকতে পারব কি না বুঝতে পারছি না। সেলিমদের বিদায় দিয়ে আজ পর্যন্ত অশান্তির মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। আবার মনে হয় তারা যদি আর একটা দিন আমাদের এখানে থাকত তাহলে তাদের নিয়ে আমি কী করতাম। সত্যিই ফজিলা, রবিবার ১১ এপ্রিলে কথা মনে হলে আজও ভয় হয়। রাইফেল, কামান, মেশিনগান, বোমা, রকেট বোমার কী আওয়াজ আর ঘরবাড়ির আগুনের আলো দেখলে ভয় হয়। সুফিয়ার বাড়ির ওখানে ৪২ জন মরেছে। সুফিয়ার আব্বার হাতে গুলি লেগেছিল। অবশ্য তিনি বেঁচে আছেন। সুফিয়াদের বাড়ি এবং বাড়ির সব জিনিস পুড়ে গেছে। আমাদের বাড়িতে তিন-চার দিন শোয়ার মতো জায়গা পাইনি। রাহেলাদের বাড়ির সবাই, ওদের গ্রামের আরও ১৫-১৬ জন, সুফিয়ার বাড়ির পাশের বাড়ির চারজন, দুলালের বাড়ির সকলে, দুলালের ফুফুজামাই দীঘির কয়েকজন এসে বাড়িতে উঠল। তাই বলি, সেই দিন যদি আব্বা এবং সেলিমরা থাকত তাহলে কী অবস্থা হোত। এদিকে আমরাও আবার পায়খানার কাছে জঙ্গলে আশ্রয় নিলাম। কী যে ব্যাপার, থাকলে বুঝতে। বর্তমানে যে পরিস্থিতি তা আর বলার নয়, রাস্তার ধারের মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নেই। রোজ গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি ছাড়াও যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। দুই- এক দিন পর আধা মরা অবস্থায় রাস্তার ধারে ফেলে দিয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেক দিন এসব ঘটনা। বাড়িতে আগুন আর গুলি করে মানুষ মারার তো কথাই নেই। তা ছাড়া লুটতরাজ, চুরি, ডাকাতি সব সময় হচ্ছে। কয়েক দিন বৃষ্টির জন্য রাস্তাঘাটে কাদা হওয়ায় আমরা বেঁচে আছি। রাস্তাঘাট শুকনা থাকলে হয়তো আমাদের এদিকেও আসত। জানি না ভবিষ্যতে কী হবে। তবে ওরা শিক্ষিত এবং হিন্দুদের আর রাখবে না বলে বিশ্বাস। হিন্দু এবং ছাত্রদের সামনে পেলে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করছে। গত রাতে পাশের গ্রামে এক বাড়িতে ডাকাতরা এসে সেই বাড়ির মানুষদের যা মেরেছে তা আর বলার নয়। কখন যে কী হয় বলার নেই। তবু খোদা ভরসা করে বেঁচে আছি। আমাদের এদিকের ছেলেরা প্রায় সবাই বাড়ি ছেড়ে দূরে থাকে। কারণ বাড়িতে থাকা এ সময় মোটেই নিরাপদ নয়। তোমাদের দেখার জন্য চৌবাড়ি যাওয়ার অনেক চেষ্টা করেছি। দুঃখের বিষয়, একটি দিনও বৃষ্টি থামেনি। অবশ্য বৃষ্টি না থামার জন্য আমাদের একটু সুবিধাই হয়েছে। তোমাদের সংবাদ জানানোর মতো কোনো পথও নেই। কীভাবে যে সংবাদ পাব ভেবে পাই না। মিঠু বোধ হয় এখন হাঁটতে শিখেছে তাই না? মিঠুকে দেখতে খুব ইচ্ছা করছে।কিন্তু পথ নেই। সান্ত্বনা এইটুকুই যে বেঁচে থাকলে একদিন দেখা হবে। কিন্তু বাঁচাটাই সমস্যা। রাতে ঘুম নেই, দিনে পালিয়ে বেড়াই। মা- বাবা তো প্রায়ই আমার জন্য কাঁদে। যাক, দোয়া করো যেন ভালো থাকতে পারি। বুবুদের যে কী অবস্থায় পাঠিয়েছি, তা মনে হলে দুঃখ লাগে। আমি সঙ্গে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সম্ভব হয়নি। অবশ্য সেদিন না পাঠালে তাদের নিয়ে দারুণ মুশকিলে পড়তে হোত। রবিবার দিন বাবলুর আম্মা মেরীগাছা এসেছিল। বাবলুরা ভালো আছে। তোমাদের সংবাদটা জানাতে পারলে জানাবে। আমার মানসিক এবং শারীরিক অবস্থা ভীষণ খারাপ। বুবু, আম্মা, দুলাভাইকে আমার সালাম এবং সেলিমদের ও মিনাদের আমার স্নেহ দেবে। সম্ভব হলে তোমাদের সংবাদটা জানাবে। আমরা তো মরেও কোন রকমে বেঁচে আছি। শেষ পর্যন্ত কী হবে জানি না।
ইতি
আজিজ
চিঠি লেখক: শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজ।
চিঠি প্রাপক: স্ত্রী ফজিলা আজিজ।
চিঠিটি পাঠিয়েছেন: মো: ফারুক জাহাঙ্গীর, গ্রাম: কুজাইল, নাটোর।
ফারুক জাহাঙ্গীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজের পুত্র।
১৮/৪/৭১
মা,
আপনি এবং বাসার সবাইকে সালাম জানিয়ে বলছি, দেশের এই সংকটময় মুহূর্তে আমি ঘরে বসে থাকতে পারি না। তাই ঢাকার আরও ২০ টা যুবকের সাথে আমিও পথ ধরেছি ওপার বাংলায়। মা, তুমি কেঁদো না, দেশের জন্য এটা খুব ন্যূনতম চেষ্টা। মা, তুমি এ দেশ স্বাধীনের জন্য দোয়া করো। চিন্তা করো না, আমি ইনশাল্লাহ বেঁচে আসব। আমি ৭ দিনের মধ্যেই ফিরে আসতে পারি কি বেশিও লাগতে পারে। তোমার চরণ মা, করিব স্মরণ। আগামীতে সবার কুশল কামনা করে খোদা হাফেজ জানাচ্ছি।
তোমারই বাকী (সাজু)
চিঠি লেখক: শহীদ আবদুল্লাহ হিল বাকী (সাজু), বীর প্রতীক।
পিতা: এম এ বারী।
চিঠি প্রাপক: মা আমেনা বারী, ২০৩/সি বাকী ভবন, খিলগাঁও, ঢাকা।
চিঠিটি পাঠিয়েছেন: মনজুর-উর রহমান ও নাজা রাসকিন।
২৩/৪/৭১
মা,
দোয়া করো। তোমার ছেলে আজ তোমার সন্তানদের রক্তের প্রতিশোধ নিতে চলেছে। বর্বর পাকিস্তানি জঙ্গিগোষ্ঠী আজ তোমার সন্তানদের ওপর নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। যেখানে তোমার সন্তানদের ইজ্জতের ওপর আঘাত করেছে, সেখানে তো আর তোমার সন্তানরা চুপ করে বসে থাকতে পারে না। তাই আজ তোমার হাজার হাজার বীর সন্তান বাঁচার দাবি নিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে।’ তোমার নগন্য ছেলে তাদের মধ্যে একজন।’ পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে দু’ হাত তুলে দোয়া করি তোমার সন্তানরা যেন বর্বর পাকিস্তানি জঙ্গিগোষ্ঠীকে কতল করে এ দেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করতে পারে। ‘এ দেশের নাম হবে বাংলাদেশ’, সোনার বাংলাদেশ। এ দেশের জন্য তোমার কত বীর সন্তান শহীদ হয়ে গিয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। ইনশাল্লাহ্ শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না। দেশকে স্বাধীন করে ছাড়বই। জয় আমাদের সুনিশ্চিত। দোয়া করো যেন জয়ের গৌরব নিয়ে ফিরে আসতে পারি, নচেৎ- বিদায়।
ইতি
তোমার হতভাগ্য ছেলে খোরশেদ
চিঠি লেখক: মো. খোরশেদ আলম। মুক্তিযোদ্ধা, সেক্টর ২, বর্তমান ঠিকানা : ১-ই-৭/৪ মিরপুর, ঢাকা ১২১৬।
চিঠি প্রাপক : মা রাহেলা খাতুন।
চিঠিটি পাঠিয়েছেন : লেখক নিজেই।
৬.৫.৭১
প্রিয় মোয়াজ্জেম সাহেব,
তসলিম। আশাকরি খোদার রহমতে কুশলে আছেন। কোনোমতে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে (মুরগি যেমন তার ছানাগুলো ডানার তলে রাখে) বেঁচে আছি। পত্রবাহক আপনার পূর্বে দেওয়া আশ্বাস অনুযায়ী আপনার কাছেই যাচ্ছে। শ্বাপদসংকুল ভরা এ দুনিয়ার পথ। নিজের হেফাজতে যদি রাখতে পারেন তবে খুবই ভালো- নতুবা নিরাপদ স্থানে (চিতলমারীর অভ্যন্তরে কোন গ্রামে) পৌছানোর দায়িত্ব আপনার। বিশেষ লেখার কিছু দরকার মনে করি না। মানুষকে মানুষে হত্যা করে আর মানুষের সেবা মানুষেই করে। হায়রে মানুষ! আমার অনুরোধ আপনি রাখবেন জানি – তা সত্ত্বেও অনুরোধ থাকল।
ইতি আপনাদের
আ.হা.চৌধুরী
চিঠি লেখক: আবদুল হাসিব চৌধুরী। ১৯৭১ সালে তাঁর ঠিকানা: আমিনা প্রেস, কোর্ট মসজিদ রোড, বাগেরহাট।
চিঠি প্রাপক : মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মো. মোয়াজ্জেম হোসেন। বাগেরহাট পি.সি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৮ অক্টোবর তিনি শত্রুপক্ষের গুলিতে শহীদ হন। অর্থনীতি বিষয়ে তাঁর বেশ কিছু বই বিভিন্ন কলেজে পাঠ্য হয়েছে।
চিঠিটি পাঠিয়েছে : মোয়াজ্জেম হোসেন ফাউন্ডেশন, বাগেরহাট।
প্রজন্ম ৭১
তারিখ: ২৩-০৫-১৯৭১ ইং
জনাব বাবাজান,
আজ আমি চলে যাচ্ছি। জানি না কোথায় যাচ্ছি। শুধু এইটুকু জানি, বাংলাদেশের একজন তেজোদৃপ্ত বীর স্বাধীনতাকামী সন্তান হিসাবে যেখানে যাওয়া দরকার আমি সেখানেই যাচ্ছি। বাংলার বুকে বর্গী নেমেছে। বাংলার নিরীহ জনতার ওপর নরপিশাচ রক্তপিপাসু পাক-সৈন্যরা যে অকথ্য বর্বর অত্যাচার আর পৈশাচিক হত্যালীলা চালাচ্ছে, তা জান সত্ত্বেও আমি বিগত এক মাস পঁচিশ দিন যাবৎ ঘরের মধ্যে বিলাস-ব্যসনে মত্ত থেকে যে ক্ষমাহীন অপরাধ করেছি, আজ সেই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য যাত্রা শুরু করলাম। সমগ্র বাঙালী যেন আমার ক্ষমা করতে পারেন। আপনি হয়তো দুঃখ পাবেন। দুঃখ পাওয়ারই কথা। যে
সন্তানকে দীর্ঘ যোল বছর ধরে তিল তিল করে হাতে- কলমে মানুষ করেছেন, যে ছেলে আপনার বুকে বারবার শনি কৃপাণের আঘাত হেনেছে, যে ছেলে আপনাকে এতটুকু শান্তি দিতে পারেনি, অথচ আপনি আপনার সেই অবাধ্য দামাল ছেলেকে বারংবার ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেছেন, যার সমস্ত অপরাধ আপনি সীমাহীন মহানুভবতার সঙ্গে ক্ষমা করেছেন। আপনি আমাকে ক্ষমা করেছেন সম্ভবত একটি মাত্র কারণে যে, আপনার বুকে পুত্রবাৎসল্যের রয়েছে প্রবল আকর্ষণ।
আজ যদি আপনার সেই জ্যেষ্ঠ পুত্র ফারুক স্বেচ্ছায় যুদ্ধের ময়দানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে যুদ্ধে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে, তাহলে আপনি দুঃখ পাবেন, বাব? আপনার দুঃখিত হওয়া সাজে না, কারণ হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যদি নিহত হই, আপনি হবেন শহীদের পিতা। আর যদি গাজী হিসেবে আপনাদের স্নেহছায়াতলে আবার ফিরে আসতে পারি, তাহলে আপনি হবেন গাজীর পিতা। গাজী হলে আপনার গর্বের ধন হব আমি। শহীদ হলেও আপনার অগৌরবের কিছু হবে না। আপনি হবেন বীর শহীদের বীর জনক। কোনোটার চেয়ে কোনোটা কম নয়। ছেলে হিসেবে আমার আবদার রয়েছে আপনার ওপর। আজ সেই আবদারের ওপর ভিত্তি করেই আমি জানিয়ে যাচ্ছি বাবা, আমি তো প্রবেশিকা পরীক্ষার্থী। আমার মনে কত আশা, কত স্বপ্ন। আমি প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করে কলেজে যাব। আবার কলেজ ডিঙিয়ে যাব বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে। মানুষের মতো মানুষ হব আমি। আশা শুধু আমি করিনি, আশা আপনিও করেছিলেন। স্বপ্ন আপনিও দেখেছেন। কিন্তু সব আশা, সব স্বপ্ন আজ এক ফুৎকারে নিভে গেল। বলতে পারেন, এর জন্য দায়ী কে? দায়ী যারা সেই নরঘাতকের কথা আপনিও জানেন। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ ওদের কথা জানে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে- গড়ঃযবৎ ধহফ গড়ঃযবৎষধহফ ধৎব ংঁঢ়বৎরড়ৎ :ড় যধাবহ. স্বর্গের চেয়েও উত্তম মা এবং মাতৃভূমি। আমি তো যাচ্ছি আমার স্বর্গাদপী গরীয়সী সেই মাতৃভূমিকে শত্রুর কবল থেকে উদ্ধার করতে। আমি যাচ্ছি শত্রুকে নির্মূল করে আমার দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে। বাব, শেষবারের মতো আপনাকে একটা অনুরোধ করব। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নিকট সব সময় দোয়া করবেন, আমি যেন গাজী হয়ে ফিরতে পারি। আপনি যদি বদদোয়া বা অভিশাপ দেন, তাহলে আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
জীবনে বহু অপরাধ করেছি। কিন্তু আপনি আমায় ক্ষমা করেছেন। এবারও আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন, এই আশাই আমি করি। আপনি আমার শতকোটি সালাম নেবেন। আম্মাজানকে আমার কদমবুসি দেবেন এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করতে বলবেন। ফুফু আম্মাকেও দোয়া করতে বলবেন। ফয়সল, আফতাব, আরজু, এ্যানি ছোটদের আমার স্নেহসিস দেবেন। আমার জন্য দোয়া করবেন আর সব সময় হুঁশিয়ার থাকবেন।
ইতি
আপনার স্নেহের ফারুক
চিঠি লেখকঃ ফারুক। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আমানউল্লাহ চৌধূরী ফারুক। চট্রগ্রাম সিটি কলেজিয়েট স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ থানার বামনী বাজারের দক্ষিণে বেড়িবাঁধের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। এই যুদ্ধে আরও চার মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। চিঠিটি মৃত্যুর কদিন আগে লেখা।
চিঠি প্রাপকঃ বাবা হাসিমউল্লাহ চৌধুরী। ঠিকানা: অম্বরনগর মিয়াবাড়ি, বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী।
চিঠিটি পাঠিয়েছেনঃ মেজর(অব.) কামরুল হাসান ভুঁইয়া।
তারিখ: ২৮/৫/১৯৭১ ইং
স্নেহের মা জানু,
আমার আন্তরিক স্নেহ ও ভালোবাসা নিয়ো। তোমার শাশুড়ি আম্মাকে আমার সালাম দিয়ো। দুলা মিয়া, পুত্রা মিয়ারা, ঝিয়ারীগণ ও সোহরাব, শিমুলকে আমার আন্তরিক স্নেহ ও ভালোবাসা জানাইয়ো। এখানে খাওয়াদাওয়ার যেমন অসুবিধা, তেমন লোকের ঝামেলাও অনেক বেশি। সেদিন তোমাদের বাড়ি হইতে আসিতে কোনো অসুবিধা হয় নাই। দেড় ঘন্টার মধ্যে বিলোনিয়া পৌঁছিয়াছি। তোমাদের বাড়ি হইতে যেদিন ফিরিয়াছি সে রাতে মোটেই ঘুম হয় নাই। দুলা মিয়া, তুমি এবং আমার স্নেহের নাতিদের কথা মনে পড়ার সাথে সাথে ২৩/০৪/৭১ ইং তারিখে (….) তোমার মাতা, রেখা, রেণু, রুবি, রৌশন ও তার চারটি ছেলে। আমার বৃদ্ধ ও রুগণ আব্বা ও জীবনের যৎসামান্য *২ লক্ষ টাকার নগদ টাকা ও সম্পদ সবকিছুর কথা। দোকান, বাসা ও মালপত্র ছাড়াও সরকারের ঘরে ৮০ হাজার টাকার মতো পাওনা রহিয়াছে। তা পাওয়া যাইকে কি না যাইবে তাহার কথা বেশি ভাবি কি না। বাংলাদেশে যখন ফিরিতে পারি এবং যদি কখনো ফিরি তবে ফেলিয়া আসা ছাইয়ের উপর দাঁড়াইয়া আবার নতুনভাবে গড়িয়া তোলার চেষ্টা করিবার আশা নিয়া বাঁচিয়া আছি। জানু, কয়েকটা কথা প্রায় দিন বারবার মনে পড়ে। এই কথাগুলো ভুলিতে পারিব দেশে ফিরিবার পরিবেশ সৃষ্টি করিয়া, দেশে ফিরিয়া গিয়া, নতুবা মৃত্যুর পর। ২২/৪/৭১ ইং তারিখ দিবাগত রাত্র দেড়টার সময় দেশের বাড়ি হইতে বাহির হওয়ার সময় সকলের থেকে বিদায় নেওয়ার পর যখন আব্বার থেকে বিদায় নিতে যাই তখন আব্বা আমাকে কোনো অবস্থায় যাইতে দিবেন না বলিয়া হাত চাপিয়া ধরেন এবং জোরে কাঁদা আরম্ভ করিয়া দেন। বাড়িতে বা দেশে থাকা নিরাপদ নহে ভাবিয়া রৌশন এবং অন্যরা জোর করিয়া আব্বার হাত হইতে আমাকে ছিনাইয়া লয় এবং আল্লাহর হাতে সঁপিয়া দিয়া রাত্র ২ ঘটিকার সময় সকলের কাঁদা রোল ভেদ করিয়া তোমার আম্মার সাথে দেখা করিবার জন্য কায়ুমকে সাথে লইয়া কচুয়ার পথে রওনা হই। কচুয়া একদিন থাকিয়া তোমার আম্মা, রেখা, রেণু ও রুবিকে কাঁদা অবস্থায় ফেলিয়া রাত্র ৪টার সময় রওনা হইয়া তোমার নিকট আসিয়া পৌঁছাই।
বাড়ি হইতে রওনা হওয়ার পূর্বেই কথা হইয়াছিল যে রৌশন পরের দিন সকালে চর চান্দিয়া রওয়ানা হইয়া যাইবে। এই ঋতুতে যে কোনো দিন সে এলাকায় থাকার অন্য বিপদ ছাড়াও ঘূর্ণিঝড়ের বিপদ যেকোনো মুহূর্তেই হইতে পারে। কোনো গত্যন্তর না থাকায় আমার প্রাণের ‘মা’ রৌশন ও সোনার বরন চারজন নাতিকে সমুদ্রের ঢেউয়ের মুখে ঠেলিয়া দিতে বাধ্য হইয়াছি। তুমিও জানো যে তোমার মাতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি তাহাদিগকে উক্ত কারণে রাখিতে চাহিতাম। তোমাদের সকলের মুখ উজ্জ্বল করিবার জন্য নিজের চেষ্টায় যাহা গড়িয়া তুলিয়াছিলাম, তাহা আজ অবস্থার গতি পরিবর্তনের সাথে সাথে সব ধূলিসাৎ হইয়া গেল। সবকিছু ভুলিবার চেষ্টা করিয়াও ভোলা যায় না। ‘মা’ তুমি অনুভব করিতে পার কি না জানি না, তবে আমার ছেলেদের অপেক্ষা তোমাদেরকে অন্তরে অধিক ভালোবাসি। সে ক্ষেত্রে আজ আমার পাঁচ মেয়েকে ভিনদেশে রাখিয়া আসিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিতে পারিতেছি না। জানু, আজকে তুমি আমার একমাত্র নিকটে, তাই তোমাকে দেখিবার চেষ্টা করি। দুলা মিয়া, তুমি ও সোহরাব, শিমুলকে সামনে দেখিতে পাইলে একটু আনন্দ পাই এবং কিছুটা মনের ভাব লাঘব হয়। আত্মীয়স্বজন সকলের আগ্রহ দেখিয়া নিজেকে হালকা বোধ করি, চিন্তামুক্ত থাকি। কায়ুম, মোতা, কবীর, আপসার ও আক্তার সব এখানে আছে। ক্যাম্পে জায়গা হয় নাই বলিয়া। এখানে ফেরত আসিয়াছে। আগামী ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করিতেছে। আশা, কয়েক দিনের মধ্যে যাওয়া হইবে। সোহরাব ও শিমুলের প্রতি লক্ষ রাখিয়ো। আমি ভালো। তোমাদের কুশল কামনা করি।
ইতি তোমারই
বাবা
চিঠি লেখক: মরহুম আবদুল মালেক, ফেনী জেলা চেম্বার অব কমার্স ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি। মুক্তিযোদ্ধা চলাকালে তিনি ফেনীর বিলোনিয়া ট্রানজিট ক্যাম্পের প্রধান ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণের জন্য ফেনীর মধুপুরের নিজ গ্রাম থেকে রওনা হয়ে বিলোনিয়া ট্রানজিট ক্যাম্পে আসেন। ক্যাম্পে পৌঁছানোর পর এই চিঠিটি লেখেন।
চিঠি প্রাপক: মেয়ে জানু।
চিঠিটি পাঠিয়েছেন: ফরহাদ উদ্দীন আহাম্মদ। চিঠি লেখকের নাতি এবং জানুর দ্বিতীয় পুত্র।
তারিখ: আগরতলা, ১৬ই জুন ১৯৭১
প্রিয় পাশা মামা,
অবাক হয়ো না! এটা লেখা হয়েছিল আর তোমার কাছ পর্যন্ত পৌঁছালও। পড়ার পর চিঠিটা নষ্ট করে ফেলো। এ নিয়ে আম্মাকে কিছু লিখে জানানোর চেষ্টা কোরো না। তাহলে তাদের বিপদে পড়তে হবে। তাড়াহুড়া করে লিখলাম। হাতে সময় খুব কম। বেস ক্যাম্পের উদ্দেশে কাল এখান তেকে চলে যেতে হবে।
আমরা একটা ন্যায়সংগত যুদ্ধে লড়ছি। আমরা জয়ী হব। আমাদের সবার জন্য দোয়া কোরো। কী লিখব বুঝতে পারছি না- কত কী নিয়ে যে লেখার আছে। নৃশংসতার যত কাহিনী তুমি শুনছ, ভয়াবহ ধ্বংসের যত ছবি তুমি দেখছ, জানবে তার সবই সত্য। ওরা আমাদের নৃশংসতার সঙ্গে ক্ষতবিক্ষত করেছে, মানব-ইতিহাসে যার তুলনা নেই। আর নিউটন আসলেই যথার্থ বলেছেন, একই ধরনের হিংস্রতা নিয়ে আমরাও তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ব। ইতিমধ্যে আমাদের যুদ্ধ অনেক এগিয়ে গেছে। বর্ষা শুরু হলে আমরা আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়ে দেব। জানি না আবার কখন লিখতে পারব। আমাকে লিখো না। সোনার বাংলার জন্য সর্বোচ্চ যা পারো করো।
এখনকার মতো বিদায়।
ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাসহ
রুমি
চিঠি লেখক: শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রুমী। পুরো নাম শাফী ইমাম রুমী। বাবা শরীফুল আলম ইমাম আহমেদ, মা জাহানারা ইমাম।
চিঠি প্রাপক: সৈয়দ মোস্তফা কামাল পাশা। শহীদ রুমীর মামা।
বর্তমান ঠিকানা: ৫ এৎবহভবষষ এধৎফবহং, ঐধৎৎড়ি গরফফষবংবী, ঐঅ৩ ০ছত, টক.
সংগ্রহ: তাহমীদা সাঈদা ও শহীদজননী জাহানারা ইমাম পাঠাগার থেকে।
তারিখ: ১৬/৬/১৯৭১ইং
হেনা,
আশা করি ভালো আছ। তোমাদিগকে খবর দেওয়া ছাড়া তোমাদের কোনো খবর পাওয়ার কোনো উপায় নেই, আর আশা করেও লাভ নেই। অনেকের নিকট বলে দেই মহিশখালীর ঈ/ঙ ঝবশধহফধৎ ঘঁৎর চিঠি পাঠালে সে আমার নিকট পাঠাতে পারে। আল্লাহর নিকট শুধু প্রার্থনা এই যে, তোমরা সবাই যেন ভালো থাক। আমি অদ্য মহেশখলা থেকে তুরার পথে রওনা হয়েছি। অদ্য আমি মেঘালয় প্রদেশের মহাদেও ক্যাম্পে আছি। আমার সঙ্গে খালেক সাহেব গ.চ.অ ও জবেদ সাহেব গ.ঘ.অ আছেন। আগামীকল্য রংড়া ক্যাম্পে গিয়ে থাকবার আশা রাখি। সমস্ত পথই হেঁটে চলছি। মহেশখলা হতে রংড়া ৩৫ মাইল। রংড়া হতে গাড়ি পাওয়ার রাস্তা হবে তুরা। যা হোক আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। নানান দেশের ওপর দিয়ে চলেছি। ছোটবেলা পড়তাম, ময়মনসিংহের উত্তরে গারো পাহাড় আর এখন গারো পাহাড়ের সর্বোচ্চ টিলার উপর ১০ দিন ঘুমিয়ে এলাম আর পাহাড়ের ভিতর দিয়েই রওনা হলাম। দেশ ভ্রমণে আনন্দ আছে কিন্তু যখন তোমাদের কথা মনে হয় তখন মন ভেঙে যায়। বিশেষ করে সোহেলের কথা ভুলতেই পারি না। সোহেলটাই আমাকে বেশি বিব্রত করছে। ওর দিকে বিশেষ লক্ষ রেখো। তোমাকে আর কী লিখব। তোমরা বাড়ি থেকে সরে গেছ কি না জানি না। তোমাদের উপর আক্রমণ আসতে পারে; তাই পূর্ব পত্রে লিখেছিলাম বাড়ি থেকে সরে যেতে। কোথায় আছ তা যেন অন্য লোক না জানে। যেখানেই যাও রাস্তায় যেন কোনো অসুবিধা না হয় তার প্রতি বিশেষ নজর রেখে চলো। সোহেল বোধহয় আমাকে খোঁজে। আস্তে আস্তে হয়তো ভুলেই যাবে। যা হোক নামাজ নিয়মিত পড়তে চেষ্টা করি। তার জন্য কোনো চিন্তা করো না। পূর্বে আরও ২টি চিঠি দিয়েছি তাতে ধান ও গাড়িটার কথাও বলেছিলাম সরিয়ে রাখতে। আজকে স্বাধীন বাংলা বেতারের খবরে নিশ্চয়ই শুনেছ যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িও আক্রমণ করতে ছাড়েনি। সুতরাং খুব সাবধান। বিশেষ আর কি লিখব। ইচ্ছা আছে তুরা হতে ফিরে আসব আসব আবার মহিশখালী দোয়া করিয়ো।
আখলাক
চিঠি প্রেরখ: আখলাকুল হোসেইন আহমেদ। ১৯৭০ সালে তিনি এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। চিঠিটি তিনি ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তুরা জেলার মাহদেও থেকে লিখেছিলেন। মু্িক্তযুদ্ধ চলাকালে তিনি প্রথমে তুরার মহিশখালীর ক্যাম্প ইনচার্জ ছিলেন। পরে জোনাল অ্যাডমিনিষ্ট্রেটর নিযুক্ত হন।
তাঁর বর্তমান ঠিকানা: ছায়ানীড়, মোহনগঞ্জ, নেত্রকোনা।
চিঠি প্রাপক: হেনা, লেখকের স্ত্রী। তাঁর পুরো নাম হোসনে আরা হোসেইন।
টিঠিটি পাঠিয়েছেন: সাইফ-উল হাসান, অ্যাপার্টমেন্ট ১ সি, বিল্ডিং-২ এ, রোড ১৩, পিসিকালচার হাউজিং সোসাইটি, আদাবর, ঢাকা।
প্রজন্ম ৭১
তারিখ: ২৭/০৬/১৯৭১ ইং
মা,
আমার শত সহস্র সালাম ও কদমবুসি গ্রহণ করিবেন। আব্বার কাছেও তদ্রুপ রহিল। এতদিনে নিশ্চয় আপনারা আমার জন্য খুবই চিন্তিত। আমি আল্লাহর রহমতে ও আপনাদের দোয়ায় বাংলাদেশের যেকোনো এক স্থানে আছি। আমি এই মাসের ২০ হইতে ২৫ তারিখের মধ্যেই বাংলাদেশে আসিয়াছি। যাক, বাংলাদেশে আসিয়া আপনাদের সাথে দেখা করিতে পারিলাম না। আমাদের নানাবাড়ির ও বাড়ির খবরাখবর নিম্নের ঠিকানায় লিখিবেন। আমি বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য আসিয়াছি। আশা করি বাংলায় স্বাধীনতা আসিলেই আমি আপনাদের কোলে ফিরিয়া আসিব। আশা করি মেয়াভাই ও নাছির ভাই এবং আমাদের স্বজন বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত। যাক, বর্তমানে আমি ময়মনসিংহ আছি। এখান হইতে আজই অন্য জায়গায় চলিয়া যাইব। দোয়া করিবেন।
পরিশেষে
আপনার স্নেহমুগ্ধ
ফারুক।
জয় বাংলা
চিঠি লেখক: শহীদ ওমর ফারুক। ভোলা জেলার সদর উপজেলার চরকালী গ্রামের আনোয়ারা বেগম ও আবদুল ওদুদ পন্ডিতের পুত্র। ১৯৭১ সালের অক্টোবরে গাইবান্ধার দনান্দিনায় সংঘটিত যুদ্ধে তিনি শহীদ হন।
চিঠি প্রাপক: মা আনোয়ারা বেগম, গ্রাম: চরকালী, সদর উপজেলা, জেলা: ভোলা।
চিঠিটি পাঠিয়েছেন: জহুরুল কাইয়ুম, থানাপাড়া, গাইবান্ধা ও মাহমুদ আল ইসলাম, স্টালিং ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ৬৬/১ নূর প্যালেস, ঢাকা ক্যান্ট, ঢাকা- ১২০৬।
১৩ আষাঢ় ১৩৭৮
মহৎপুর
০১/০৭/১৯৭১
প্রিয় ফজিলা,
আমার অফুরন্ত ভালোবাসা নিয়ো। আমার এই চিঠির ওপর নির্ভর করছে তোমার আগামী দিনের (সুখ ও দুঃখ)। এই চিঠি পড়ে দুঃখ পাওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ জন্ম ও মৃত্যু মানুষের হাতে নয়, এটা পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলার হাতে। তার নির্দেশ ব্যতীত দুনিয়ার কোনো কাজ হতে পারে না। একটা পা তুললে সে (মানে করুণাময় আল্লাহ) যতক্ষণ পর্যন্ত পা ফেলার হুকুম না দেবে ততক্ষণ কারোর ক্ষমতা নেই পা ফেলে। তাই বলছি দুঃখ করো না যে পরিস্থিতি, কখন কার মৃত্যু হয় কেউ বলতে পারে না। আমি কখন কোথায় থাকব, আমি নিজে বলতে পারি না। তাই বলছি ‘আল্লাহ যদি আমার মরণ লিখে থাকে, হয়তো কোথায় কীভাবে মরণ হবে কারুর সঙ্গে দেখা হবে না, কিছু বলতেও পারব না। মনে দুঃখ থাকবে তাই আগে থেকেই লিখে যাচ্ছি। এটা পড়ে কেদোঁ না। এই লিখছি বলে যে সত্যি সত্যি মরব তা তো নয়! যদি মরি তবে তো বলতে পারব না সেই জন্য লিখলাম। যদি মরি আমার দেওয়ার মতো কিছু নেই। আছে একটু ভালোবাসা আর একটু আশীর্বাদ আর ক-বিঘা জমি। আগেও বলেছি এখনো বলছি, ইচ্ছা যা-ই হোক, কারোর যুক্তি শুনে এক কাঠা জমি বিক্রি কোরো না। যদি কেউ বলে, ওখান থেকে বেচে এখানে ভালো জমি কিনে দেব, খুব সাবধান, তা করেছ কি মরেছ। আমি যদি মরি আমি দেখতে আসব না, সুখে আছ না দুঃখে আছ। তাই আমার আদেশ নয়, অনুরোধ করছি বারবার। আমার কথাগুলো গুনো। কারোর কথা শুনে কোনো কাজ করো না, তাই যতই ভালো কাজ হোক না কেন, তাতে দুঃখ পাবে, তখন আমার কথা মনে হবে। বাচ্চাটা বুকে নিয়ে থেকো, সুখে থাকবে। কারোর কথা শুনে কোনো কাজ করলে জমি তোমার থাকবে না। তখন কেউ দেখতে পারবে না। যে মেয়ের স্বামী মরে যায় বা নেয় না, তার বাপ- ভাই আত্মীয়স্বজন কেউ ভালো চোখে দেখে না। তাই যত আদুরে হোক না, এটা মেয়েদের অভিশাপ বেশি বলতে হবে না, পাশে অনেক প্রমাণ আছে। জমিজমা ও জিনিসপত্র থাকলে সবাই যতন করবে, তোমার পায়ের জুতো খুলে গতি হবে না। তাই বারবার অনুরোধ করছি জিনিসপত্র যা এর-ওর বাড়ি আছে, ভাই জানে, ভাইয়ের সঙ্গে সব বলা আছে। বাপের বাড়ি হোক আর (….) হোক, যেখানে হোক থেকো (…..) বেশি দিন থেকো, তোমার দেখো সবাই যত্ন করবে, তবে আমি যা বলেছি মনে রেখো। মেয়েটাকে মানুষ করো। লেখাপড়া শিখাও। মামণি যখন যা চায় তখন সেটা দেবার চেষ্টা করো। তুমি তো জানো যে একটা মেয়ে হওয়ার আমার কত আশা ছিল, আল্লাহ আমার আশা পূরণ করেছে। হয়তো নিজ হাতে সেভাবে মানুষ করতে পারব না, তবু আমার আশা আছে, তুমি যদি আমার কথা শোন তবে তুমি সেভাবে মানুষ করতে পারবে। আশা করে মামণির জন্য দোলনা করেছিলাম। দোলনায় বোধহয় মামণির দোলা হলো না। বড় আশা করে হারমোনিয়াম কিনেছিলাম মামণিকে গান শেখাব, হারমনিটা নষ্ট কোরো না, তুমি শিখাও। তোমার কানেরটা- মামণিকে দেব বলে তোমার কানেরটা করলাম, মামণির সেটা তো ডাকাতরা নিয়ে গেছে। আমার আশা আশাই থেকে গেল, আশা বোধহয় পূরণ হবে না। তাই আমার আশা তুমি পূরণ করো। আর কী লিখব, সত্যি যদি মরি আমায় ঋণমুক্ত করো। তোমার কাছে যে ঋণ আছে হয়তো শোধ করতে পারব না। হয়তো সে (….) কষ্ট পাব বা আল্লাহতাআলার কাছে দায়ী থাকব, যদি পারো মন চায় শোধ করে নিয়ো বা মুক্ত করে দিয়ো। আর কিছু লিখলাম না।
ইতি তোমার স্বামী
গোলাম রহমান
মহৎপুর, খুলনা।
চিঠি লেখক: মুক্তিযোদ্ধা মো: গোলাম রহমান।
ঠিকানা: গ্রাম: মহৎপুর, ডাক: ওবায়দুরনগর, উপজেলা: কালিগঞ্জ, সাতক্ষীরা।
চিঠি প্রাপক: স্ত্রী ফজিলা।
চিঠিটি পাঠিয়েছেন: গোলাম রহমানের ছেলে আসলামুজ্জামান।
তারিখ: ০৭/০৭/১৯৭১
শ্রী হেমন্দ্র দাস পুরকায়স্থ
শ্রদ্ধাস্পদেষু,
আপনাদের খবর অনেক দিন পাইনি। বাঁশতলা ক্যাম্প দেখার পর সেই ছেলেদের মুখগুলো সামনেই চোখের ওপর ভাসছে। তাদের মধ্যে যে সাহস, শৃঙ্খলা ও উদ্দীপনা দেখেছি তা আমার জীবনে এক নতুন ইঙ্গিত বয়ে এনেছে। কত লোকের কাছে যে সে কাহিনী বলেছি তা বলার নয়। তাদের কিছু জিনিস দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। কিন্তু শুনছি তারা শিগরিই ুড়ঁঃয পধসঢ়- এ চলে আসবে এবং সেখানে তাদের প্রয়োজনীয় সবকিছু সরবরাহ করা হবে। তাই আমাকে সেগুলো জোগাড় করতে মানা করা হলো।
আমি ক্যাম্পের মেয়েদের জন্য কিছু শাড়ি সংগ্রহ করেছি। আপনি প্রয়োজনমতো তা বিলি করার ব্যবস্থা করে দেবেন। কাকিমার জন্য একখানা লালপাড় শাড়ি পাঠালাম- তিনি যেন তা ব্যবহার করেন। বাচ্চাদের জন্য সামান্য কিছু কাপড়- জামা পাঠালাম। অল্প ওষুধ ও ফিনাইল পাঠালাম, আশা করি কাজে লাগবে। আমি সেলা ক্যাম্পে যাবার পর বালাট, ডাউকী, উমলারেম (আমলারেং) প্রভৃতি ক্যাম্পে ঘুরছি।
অবস্থা দুর্দশার চরম সীমায়, খালি মুক্তিবাহিনীর ছেলেরাই অন্ধকারে আশার আলো বয়ে আনে। ভগবান তাদের স্বাস্থ্য ও দীর্ঘজীবন দিন- এই প্রার্থনা জানাই।
আপনার শরীর কেমন আছে? কাকিমা কেমন আছেন? ক্যাম্পের ও মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা কেমন আছে? আজ এখানেই শেষ করি।
আপনারা আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম নেবেন।
ইতি
অঞ্জলি
পথের ধারের বাড়ী
১৫ জুলাই, ১৯৭১
মা,
পথ চলতে গিয়ে ক্ষণিকের বিশ্রামস্থল রাস্তার ধারের এ বাড়ি তোমায় চিঠি লিখতে সাহায্য করছে। বাড়ি থেকে আসার পর এই প্রথম তোমায় লিখার সুযোগ পেলাম। এর পূর্বে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কাগজ, কলম, মন ও সময় একীভূত করতে পারিনি। টিনের চালাঘরে বসে আছি। বাইরে ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার সর্বত্র প্রকৃতির একটা চাপা আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে টিনের ওপর বৃষ্টি পড়ার শব্দে শব্দে। মাগো, আজ মনে পড়ছে বিদায়বেলায় তোমার হাসিমুখ। সাদা ধবধবে শাড়িটায় বেশ মানিয়েছিল তোমায়। বর্ষার সকাল। আকাশে খন্ড খন্ড সাদা মেঘের ভেলা ভাসছিল। মেঘের ফাঁকে সেদিনকার পূর্ব দিগন্তের সূর্যটা বেশ লাল মনে হয়েছিল। সেদিন কি মনে হয়েছিল জানো মা, অসংখ্য রক্তবীজের লাল উত্তপ্ত রক্তে ছেয়ে গেছে সূর্যটা। ওর এক একটা কিরণচ্ছটা পৃথিবীতে জন্ম দিয়েছে এক একটি বাঙালি। অগ্নিশপথে বলীয়ান, স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত। মাগো, তোমার কোলে জন্মে আমি গর্বিত। শহীদের রক্ত রাঙা পথে তোমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলেকে তুমি এগিয়ে দিয়েছ। ক্ষণিকের জন্যও তোমার বুক কাঁপেনি, স্নেহের বন্ধন দেশমাতৃকার ডাককে উপেক্ষা করতে পারেনি। বরং তুমিই আমাকে মুক্তিবাহিনীতে যোগদানের জন্য প্রেরণা দিয়েছ। দেশকে ভালোবাসতে শিখিযেছ। মা, তুমি শুনে খুশি হবে তোমারই মতো অসংখ্য জননী তাঁদের স্নেহ ও ভালোবাসর সম্পদ পুত্র- সন্তান, স্বামী, আত্মীয়, ঘরবাড়ি সর্বস্থ হারিয়ে শোকে মুহ্যমান হয়নি, বরং ইস্পাতকঠিন মনোবল নিয়ে আজ অগ্নিশপথে বলীয়ান। মাগো, বাংলার প্রতিটি জননী কি তাদের ছেলেকে দেশের তরে দান করতে পারে না? পারে না এ দেশের মা- বোনেরা ছেলে ও ভাইদের পাশে এসে দাঁড়াতে? মা তুমিতো একদিন বলেছিলে, ‘সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন এ দেশের মায়ের কোলের শিশুরা মা-বাবার কাছে বিস্কুট-চকলেট চাইবে না জেনো, চাইবে রিভলবার পিস্তল।’ সেদিনের আশায় পথ চেয়ে আছে দেশের প্রতিটি সন্তান। যেদিন বাংলার স্বাধীনতা সূর্যে প্রতিফলিত হবে অধিকারবঞ্চিত, শোষিত, নিপীড়িত বুভুক্ষ সাড়ে সাত কোটি জাগ্রত বাঙালির আশা, আকাঙ্খা। যে মনোবল নিয়ে প্রথম তোমা থেকে বিদায় নিয়েছিলাম তা আজ শতগুণে বেড়ে গেছে, মা। রক্তের প্রবাহে আজ খুনের নেশা টগবগিয়ে ফুটছে। এ শুধু আমার নয়, প্রতিটি বাঙালি পাঞ্জাবি হানাদার লাল কুত্তাদের দেখলে খুনের নেশায় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। তাই তো বাংলার প্রতিটি আনাচ-কানাচে এক মহাশক্তি ও দুর্জয় শপথে বলীয়ান মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা অনেক বেড়ে গেছে। তোমাদের এ অবুঝ শিশুগুলিই আজ হানাদার বাহিনীকে চরম আঘাত হানছে। পান করছে হানাদার পশুশক্তির রক্ত। ওরা মানুষ হত্যা করে। আমরা পশু (ওদের) হত্যা করছি। এই তো সেদিন বাংলাদেশ ময়মনসিংহ জেলার সদর দক্ষিণ মহকুমার কোনো এক মুক্ত এলাকায় ভালুকাতে (থানা) প্রবেশ করতে গিয়ে হানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধাদের হাতে চরম মার খেয়েছে। মা, তোমার ছোট্ট ছেলে বিপ্লবের হাতেই লেগে আছে বেশ কয়টা পশুর রক্ত। এমনি করে বাংলার প্রতিটি আনাচ-কানাচে মার খাচ্ছে ওরা। মাত্র শুরু। যুদ্ধনীতি ওদের নেই, তাই বাংলার নিরীহ অস্ত্রহীন কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-শিক্ষক, বৃদ্ধ, শিশু ও নারীর ওপর হত্যাকান্ডের মই চালাচ্ছে। এ হত্যাকান্ড ভিয়েতনামের একাধিক ‘মাইলাইয়ের’ হত্যাকান্ডকেও ছাড়িয়ে গেছে।
ওরা পশু। পশুত্বের কাহিনী শুনবে, মা? তবে শোনো। শত্রুকবলিত কোনো এক এলকায় আমার এক ধর্ষিতা বোনকে দেখেছিলাম নিজের চোখে। ডেকেছিলাম বোনকে। সাড়া দেয়নি। সে মৃত। সম্পূর্ণ বিবস্ত্র দেহে পাশবিক অত্যাচারের চিহ্ন শরীরের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে। বাংলার শিশু ছিল তার গর্ভে। কিন্তু তবু পাঞ্জাবি পশুর হায়না কামদৃষ্টি থেকে সে রেহাই পায়নি। সে মরেছে কিন্তু একটা পশুকেও হত্যা করেছে। গর্বিত, স্তব্ধ, মূঢ় ও কঠিন হয়েছিলাম। আজ অসংখ্য ভাই ও বোনের তাজা রক্তকে সামনে রেখে পথ চলছি আমরা। মাগো, বাংলাদেশে হানাদার বাহিনীর এমন অত্যাচারের কাহিনী শুনে ও দেখে কি কোনো জননী তার ছেলেকে প্রতিশোধের দীক্ষা না দিয়ে স্নেহের বন্ধনে নিজের কাছে আটকে রাখতে পারে? পারে না। প্রতিটি জননীই আজ তাঁর ছেলেকে দেবে মুক্তিবাহিনীতে, যাতে রক্তের প্রতিশোধ, নারী নির্যাতনের প্রতিশোধ শুধু রক্তেই নেওয়া যায়। মা, আমার ছোট্ট ভাই তীতু ও বোন প্রীতিকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। পারবে না আমাদের তিন ভাই-বোনকে ছেড়ে একা থাকলে? মা, মাগো। দুটি পায়ে পড়ি, মা। তোমার ছেলে ও মেয়েকে দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে ঘরে আটকে রেখো না। ছেড়ে দাও স্বাধীনাতার উত্তপ্ত রক্তপথে। শহীদ হবে, অমর হবে, গাজী হয়ে তোমারই কোলে ফিরে আসবে, মা। মাগো, জয়ী আমরা হবই। দোয়া রেখো।
জয় বাংলা।
ইতি
তোমারই ‘বিপ্লব’
চিঠি লেখক: মুক্তিযোদ্ধা বিপ্লব। চিঠি লেখকের পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি। মুক্তিযুদ্ধকালে এই চিঠি ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে প্রকাশিত জাগ্রত বাংলায় প্রকাশিত হয়।
চিঠি প্রাপক: মা। তাঁর পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি।
চিঠিটি পাঠিয়েছেন: ডা: মো: শফিকুল ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক, চক্ষুবিজ্ঞান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
প্রজন্ম ৭১
তারিখ: ২১ জুলাই ১৯৭১
মা,
সর্বপ্রথম আমার সালাম ও কদমবুসি গ্রহণ করবেন। পর সমাচার এই যে আমি আজ এমন এক স্থানে রওয়ানা হলাম, খোনানে মিলিটারির কোনো হামলা নেই। তাই আজ আপনার কাছে লিখতে বাধ্য হলাম। আমার সমস্ত দোষ। তাই আপনি আমার অন্যায় বলতে যা কিছু আছে, সমস্ত ক্ষমা করে দিবেন। আমার প্রতি কোনো দাবি রাখবেন না। কারণ আমার মৃত্যু যদি এসে থাকে, তবে আপনারা আমায় বেঁধে রাখতে পারবেন না। মৃত্যুর সঙ্গে আমাদের সংগ্রাম করতে হবে। মৃত্যুর জন্য আমি সব সময় প্রস্তুত। গ্রামে বসে শিয়াল- কুকুরের মতো মরার চেয়ে যোদ্ধাবেশে আমি মরতে চাই। মরণ একদিন আছে। আজ যদি আমার মরণ আসে, তাহলে আমাকে আপনারা মরণ থেকে ফিরাতে পারবেন না। মরণকে বরণ করে আমার যাত্রা শুরু করলাম। আমার জন্য দুঃখ করবেন না। মনে করবেন, আমি মরে গেছি। দোয়া করবেন, আমি যাতে আমার গন্তব্যস্থানে ভালোভাবে পৌঁছাতে পারি। আব্বাকে আমার জন্য দোয়া করতে বলবেন। সে যেন আমার সমস্ত অন্যায়কে ক্ষমা করে দেয়। নামাজ পড়ে আমার জন্য দোয়া করবেন। আপনার ছেলে যদি হয়ে থাকি, তবে আমার জন্য দুঃখ করবেন না। বাড়ির সবার কাছ থেকে আমার দাবি ছাড়াবেন। খোদায় যদি বাঁচায়, তবে আমি কয়েক দিনের ভেতর ফিরে আসব। ইনশাল্লাহ খোদা আমাদের সহায় আছেন। মিয়াভাইয়ের কাছে আমার সালাম ও দোয়া করতে বলবেন। আর আমার জন্য কোনো খোঁজ বা কারও ওপর দোষারোপ করবেন না। এটা আমার নিজের ইচ্ছায় গেলাম। আমি টাকা কোথায় পেলাম সে কথা জানতে চাইলে আমি বলব, বাবুলের মায়ের ট্রাংক থেকে আমি ৬০ টাকা নিলাম এবং তার টাকা আমি বাঁচলে কয়েক দিনের ভেতর দিয়ে দেব। বাবুলের মায়ের টাকার কথা কারও কাছে বলবেন না। আর বাবুলের মাকে বলবেন, সে যেন কয়েকটা দিন অপেক্ষা করে। জানি, আমাকে দিয়ে আপনাদের সমস্ত আশা-ভরসা করছেন। কিন্তু আমার ছোট ভাই দুইটাকে দিয়ে যে সমস্ত আশা সফল করতে চেষ্টা করবেন। দাদা ও মুনিরকে মানুষ করে ওদের দ্বারা আপনারা সমস্ত আশা বাস্তবরূপে ধারণ করবেন। আমাদের এ যাত্রা মহান যাত্রা। আমরা ভালোর জন্য এরূপ যাত্রা করলাম। অতি দুঃখের পর এ দেশ থেকে চলে গেলাম। দোয়া করবেন। খোদা হাফেজ।
ইতি
আপনাদের হতভাগা ছেলে
আমি
চিঠি লেখক: মুক্তিযোদ্ধা দুদু মিয়া। তাঁর পুরো নাম আবু বকর সিদ্দিক, পিতা মৃত: আবুল হোসেন তালুকদার। ঠিকানা: গ্রাম: নরসিংহলপট্টি, ডাকঘর: শাওড়া,
উপজেলা: গৌরনদী, জেলা: বরিশাল।
চিঠি প্রাপক: মা আনোয়ারা বেগম।
চিঠিটি পাঠিয়েছেন: লেখক নিজেই।
তারিখ: ২৩/৭/১৯৭১ইং
১.
মা ও বাবাজান,
আমার সালাম ও কদমবুসি জানিবেন। আজ কয়েকদিন গত হয় আপনাদের নিকট হইতে বহুদূরে অবস্থান করিতেছি। খোদার কৃপায় মঙ্গলেই পৌঁছিয়াছি। হযরতের কাছ হইতে হয়তো এ কয়দিনে একখানা পত্র পাইয়াছেন। তাহা হইতে বুঝিতে পারিয়াছেন আমি কোথায় আছি। আমি ভালো আছি। আমার জন্য সবাইকে ও আপনারা দোয়া করিবেন। শ্রেণীগতভাবে সবাইকে আমার সালাম ও স্নেহশিস দিবেন। নানা অসুবিধার জন্য খোলাখুলি সবকিছু লিখিতে পারিলাম না।
ইতি: হাকিম
ঘ.ই: হয়তো মাস দুই পরে বাড়ি ফিরিব। আবার তা নাও হইতে পারে।
২.
শ্রদ্ধেয় মামাজান,
আমার ভক্তিপূর্ণ সালাম ও কদমবুসি গ্রহণ করিবেন। আশা করি ভালো আছেন। আমরা আপানাদের দোয়ায় ভালোই আছি। আমার জন্য কোনোরূপ চিন্তা করিবেন না। দোয়া করিবেন যেন ভালোভাবে আপনাদের নিকট ফিরিয়া যাইতে পারি ও উদ্দেশ্যকে সাফল্যমন্ডিত করিতে পারি। অধিক কি আর লিখিব। আমাদের বাড়িতে সংবাদ দিবেন।
ইতি
আপনার স্নেহের মতি
একই কাগজে পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা চিঠি লিখেছেন। তাঁদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা মতি শহীদ হন্ তাঁরা চিঠিগুলো লিখেছেন পশ্চিমবঙ্গের করিমগঞ্জ ষ্টেশনের নিকটবর্তী কেচুয়াডাঙ্গা হাইস্কুলে ট্রানজিট সেন্টারে অবস্থানকালে। পত্র লেখকদের নাম: হাকিম, হাশমত, হাসু, মতি ও মোতালেব। এখানে হাকিম ও মতির চিঠি প্রকাশিত হলো।
চিঠি প্রাপক: মো: শামসুল আলম, প্রযতেœ: মৌলভী সেহাবউদ্দিন, গ্রাম: নলসন্দা, পো: ডিগ্রীর চর, উল্লাপাড়া, পাবনা ( বর্তমানে সিরাজগঞ্জ জেলা)।
চিঠিটি পাঠিয়েছেন: মো: শামসুল আলম। তিনি বর্তমানে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের দিনাজপুর দক্ষিণের উপমহাব্যবস্থাপক।
ঝালকাঠি,মিলিটারি, ক্যান্টনমেন্ট
২৪/০৭/১৯৭১, বাংলা ৬ শ্রাবণ, ১৩৭৮
স্নেহের ফিরোজা,
তোমাকে ১৭ বৎসর পূর্বে সহধর্মিণী গ্রহণ করিয়াছিলাম। অদ্যাবধি তুমি আমার উপযুক্ত স্ত্রী হিসাবে সংসারধর্ম পালন করিয়া আসিয়াছ। কোনো দিন তোমার উপর অসন্তুষ্ট হইতে পারি নাই। আজ আমি (….) তোমাদের অকূল সাগরে ভাসাইয়া পরপারে চলিয়াছি। বীরের মতো সালামা- ইনশাল্লাহ জয় আমাদের হইবে, দুনিয়া হইতে লাখ লাখ লোক চলিয়া গেছে খোদার কাছে। কামনা করি যেন সব শহীদদের কাতারে শামিল হইতে পারি। মনে আমার কোনো দুঃখ নাই। তবে বুকে জোড়া কেবল আমার বাদল। ওকে মানুষ করিয়ো। আজ যে অপরাধে আমার মৃত্যু হইতেছে খোদাকে সাক্ষী রাখিয়া আমি বলিতে পারি যে এই সব অপরাধ হইতে আমি নিষ্পাপ। জানি না খোদায় কেন যে আমাকে এরূপ করিল। জীবনের অর্ধেক বয়স চলিয়া গিয়াছে, বাকি জীবনটা বাদল ও হাকিমকে নিয়া কাটাইবে। (….) পারিলাম না। (….) বজলু ভাইয়ের বেটা ওহাবের কাছে ১৫ হাজার টাকা আছে। যদি প্রয়োজন মনে কর তবে সেখান হইতে নিয়া নিয়ো।
ইতি
তোমারই
বাদশা
(বাবা হাকিম, তোমার মাকে ছাড়িয়া কোথাও যাইয়ো না)
চিঠি লেখক: শহীদ বাদশা মিয়া তালুকদার, গ্রাম: বাঁশবাড়িয়া, উপজেলা: টুঙ্গিপাড়া, জেলা: গোপালগঞ্জ।
চিঠি প্রাপক: স্ত্রী ফিরোজা বেগম।
চিঠিটি পাঠিয়েছেন: মো: বাদল তালুকদার। ১/২ ব্লক জি, লালমাটিয়া, ঢাকা।
তারিখ: ২৯/০৭/১৯৭১ ইং
নীলু,
নাসিরের হাতে পাঠানো চিঠি কাল পেয়েছি ও আজ পোষ্টের চিঠিটা পেলাম। খোকন যাবার পর মনসুর থাকতে তবুও সময় চলে গেছে। সেদিন ও চলে যাবার পর এখন একদম খড়হষু লাগছে, তবে গত ৩-৪ দিন খুব ব্যস্ত ছিলাম। তাই সময় কেটে গেছে। গতকাল ভোর রাত্রে ছোটিপুর (……….) আক্রমণ করেছিলাম ও দারুণ যুদ্ধ হয়েছে। গুলি ফুরিয়ে যাওয়াতে আমরা পিছে চলে আসতে বাধ্য হই। আমরা মাত্র ৪০ জন আর ওরা ১৫০-র মতো ছিলো। কিন্তু আক্রমণে টিকতে না পেরে বতহু পালিয়ে যায়। আমরা শেষ পর্যন্ত ওদের শেষ উবভবহপব- এর দেড় শ গজের মধ্যে চলে যেতে পেরেছিলাম । আমরা আর আধা ঘন্টা টিকতে পারলে দখল করতে পারতাম। কারণ, আজ জানালাম ওরা নৌকা তিনটা করে পালিয়ে যেতে জোগাড় করেছিল। ওদেরও গুলি শেষ হয়ে এসেছিল। ভোর ৪-২০ থেকে ৭-৪৫ পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। ওদের বারজন মারা গেছে ও বহু আহত হয়েছে। আমাদের তরফে একজনের হাতে গুলি লাগে- হাসপাতালে আছে। ঈড়ষ কাপুর এবহবৎধষ কে আমার এই যুদ্ধ সম্বন্ধে একটা দারুণ ফুলে যাওয়ার মতো জবঢ়ড়ৎঃ দিয়েছে।
খোকনকে বলো ইনশাল্লাহ আগামীকাল রাত্রে আমরা সেই ঙঢ়বৎধঃরড়হ টা করব, যেটা সেদিন রওনা হবার সময় ঈধহপবষ করি।
আজ জধফরফড়- তে (উধরষু) ঞবষবমৎধঢ়য- এ চবঃবৎ ইরষষ- এর আমার ও আমার মুক্ত এলাকার জবঢ়ড়ৎঃ শুনে খুব খুশি লেগেছে। আজ বাংলাদেশ মিশন থেকে আমাকে জানিয়েছে যে চবঃবৎ ইরষষ- নাকি এই প্রথমবার আমাদের সম্বন্ধে একটা ঋধাড়ৎধনষব ৎবঢ়ড়ৎঃ দিল। আরও শুনলাম ঞরসব-এ বেরিয়েছে। এসবের ঈড়ঢ়ু- গুলো জোগাড় করো। মওদুদকে বলো, উধরষু গরৎৎড়ৎ- এ কিছুদিন আগে আমার এলাকা সম্বন্ধে যে জবঢ়ড়ৎঃ বেরিয়েছিল, সেটা যেন অবশ্যই দেয় ও অন্য যাদের নিয়েছিল সেগুলোও দেয়।
তুমি শুনে খুশি হবে যে সেদিন জিওসির ঈড়হভবৎবহপব- এ জানলাম যে আমার ঈড়সঢ়ধহু শত্র“ ধ্বংস করার জবপড়ৎফ এ সমস্ত পশ্চিম রণাঙ্গনে প্রথম স্থানে ও আমার ঈড়সঢ়ধহু- কে ইবংঃ বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। আগামীকাল ওহফরধহ ভরষস ফরারংরড়হ আমার এলাকার গড়ারব তুলতে আসবে। এত সব হওয়া সত্ত্বেও ভীষণ একা লাগছে এবং কেমন যেন অসহ্য লাগছে। চযুংরপধষষু ্ গবহঃধষষু পড়সঢ়ষবঃবষু ঃরৎবফ সব সময়। সবকিছু ছেড়ে চলে আসতে ইচ্ছা করে, কিন্তু তখনই বিবেকের কাছে ভীষণ অপরাধী মনে হয়। আজ তো প্রায় ঋৎবহপয ষবধাব এ চলে আসছিলাম। সকালে গিয়ে বিকেলে চলে আসা, কিন্তু পরে আমার বিবেকের তাড়নায় ইচ্ছা ছাড়লাম।
………………………….
ইত্তু ও নাহীদ মনিরা কেমন আছে? ওদের আমার অনেক আদর দিয়ো। বরিশালের আর নতুন কোনো খবর পেলে কি না জানাবে। লোক পেলে আমি লিখব।
আশা করি তোমরা সবাই ভালো আছ। আব্বা-আম্মা ও আপাকে আমার সালাম দিয়ো। খোকন ও খুশনুদকে ভালোবাসা দিয়ো।
জলদি উত্তর দিয়ো।
ইতি
গুডু
চিঠি লেখক: মুক্তিযোদ্ধা কর্ণেল খন্দকার নাজমুল হুদা। সাব সেক্টর কমান্ডার। লিখেছেন বয়ড়া থেকে। তিনি ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর নিহত হন।
চিঠি প্রাপক: স্ত্রী নীলুফার দিল আফরোজ বানু। ১৯৭১ সালে তিনি কলকাতায় ছিলেন। তাঁর বর্তমানে ঠিকানা: ১৫৯ ইষ্টার্ন রোড, লেন ৩, নতুন ডিওএইচএস, মহাখালী, ঢাকা।
চিঠিটি পাঠিয়েছেন: নীলুফার দিল আফরোজ বানু।
প্রজন্ম ৭১
টেকেরহাট থেকে,
তারিখ: ৩০/০৭/১৯৭১ইং
প্রিয় আব্বাজান,
আমার সালম নিবেন। আশা করি খোদার কৃপায় ভালোই আছেন। বাড়ির সকলের কাছে আমার শ্রেণীমতো সালাম ও স্নেহ রইল। বর্তমানে যুদ্ধে আছি আলী রাজা, রওশন, সাত্তার, রেনু, ইব্রাহিম, ফুল মিয়া। সকলেই একত্রে আছি। দেশের জন্য আমরা সকলেই জান কোরবান করেছি। আমাদের জন্য ও দেশ স্বাধীন হওয়ার জন্য দোয়া করবেন। আমি জীবনকে তুচ্ছ মনে করি। কারণ দেশ স্বাধীন না হলে জীবনের কোনো মূল্য থাকবে না। তাই যুদ্ধকেই জীবনের পাথেয় হিসেবে নিলাম। আমার অনুপস্থিতিতে মাকে কষ্ট দিলে আমি আপনাদেরকে ক্ষমা করব না। পাগলের সব জ্বালা সহ্য করতে হবে। চাচা- মামাদের ও বড় ভাইদের নিকট আমার সালম। বড় ভাইকে চাকুরীতে যোগ দিতে নিষেধ করবেন। জীবনের চেয়ে চাকুরি বড় নয়। দাদুকে দোয়া করতে বলবেন। মৃত্যুর মুখে আছি। যেকোনো সময় মৃত্যু হতে পারে এবং মৃত্যুর জন্য সর্বদা প্রস্তুত। দোয়া করবেন মৃত্যু হলেও যেন দেশ স্বাধীন হয়। তখন দেখবেন লাখ লাখ ছেলে বাংলার বুকে পুত্রহারাকে বাবা বলে ডাকবে। এই ডাকের অপেক্ষায় থাকুন।
আর আমার জন্য চিন্তার কোনো কারণ নাই। আপনার দুই মেয়েকে পুরুষের মতো শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবেন। তবেই আপনার সকল সাধ মিটে যাবে। দেশবাসী, স্বাধীন বাংলা কায়েমের জন্য দোয়া করো, মীরজাফরী করো না। কারণ মুক্তিফৌজ তোমাদের ক্ষমা করবে না এবং বাংলায় তোমাদের জায়গা দেবে না।
সালাম, দেশবাসী সালাম।
ইতি
মো: সিরাজুল ইসলাম
১৯৭১ সালের ৮ আগষ্ট ৫ নম্বর সেক্টরের বড়ছড়া সাবসেক্টরের সাচনা জামালগঞ্জে পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনী ব্যাপক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। বীর যোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম একটিমাত্র প্লাটুন নিয়ে পাকবাহিনীর সুরক্ষিত ঘাঁটি সাচনা আক্রমন করেন। সুসংগঠিত পাকবাহিনীর আধুনিক অস্ত্রের মুখে মুক্তিযোদ্ধাদের টিথে থাকাই ছিল অসম্ভব। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ছিল সীমিত অস্ত্র। এমন পরিস্থিতিতে সাহসী কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম সহযোদ্ধাদের আক্রমণ অব্যাহত রাখার নির্দেশ দিয়ে নিজে গ্রেনেড নিয়ে ক্রলিং করে শত্রু বাংকারের দিকে এগিয়ে যান। শত্রুর দুটি বাংকারে গ্রেনেড চার্জ করে তছনছ করে দেন। এক পর্যায়ে শত্রপক্ষের এলএমজির বুলেট বিদীর্ণ করে দেয় তাঁর দেহ। তিনি শহীদ হওয়ার কিছুদিন আগে ৩০ জুলাই টেকেরহাট থেকে বাবার কাছে এই পত্রটি লিখেছেন।
সংগ্রহ: মেজর (অব.) কামরুল হাসান ভুঁইয়া ও ড. সুকুমার বিশ্বাসের কাছ থেকে।
তারিখ: ০১/০৮/১৯৭১ইং
মাগো,
তুমি আমায় ডাকছিলে? আমার মনে হলো তুমি আমার শিয়রে বসে কেবলই আমার নাম ধরে ডাকছো, তোমার অশ্র“জলে আমার বক্ষ ভেসে যাচ্ছে, তুমি এত কাঁদছো? আমি তোমার ডাকে সাড়া দিতে পারলাম না। তাই আমায় ডেকে ডেকে হয়রান হয়ে গেল।
স্বপ্নে একবার তোমাকে দেখতে চেয়েছিলাম, তুমি আমার বড় আবদারের, ছেলের আবদার রক্ষা করতে এসেছিলে। কিন্তু মা, আমি তোমার সঙ্গে একটি কথাও বললাম না। দুচোখ মেলে কেবল তোমার অশ্র“জলই দেখলাম। তোমার চোখের জল মুছতে একটুকু চেষ্টা করলাম না। মা, তুমি আমায় ক্ষমা করো- তোমায় বড় ব্যাথা দিয়ে গেলাম। তোমাকে এতটুকু ব্যথা দিতেও তো চিরদিন আমার বুকে বেজেছে। তোমাকে দুঃখ দেওয়া আমার ইচ্ছা নয়। আমি স্বদেশ জননীর চোখের জল মুছাবার জন্য বুকের রক্ত দিতে এসেছি। তুমি আমায় আশীর্বাদ করো, নইলে আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে না। একটিবার তোমাকে দেখে যেতে পারলাম না। সে জন্য আমার হৃদয়কে ভুল বুঝো না তুমি। তোমার কথা আমি এক মুহুর্তের জন্য ভুলিনি, মা। প্রতিনিয়তই তোমার আশীর্বাদ প্রার্থনা করি।
আমার অভাব যে তোমাকে পাগল করে তুলেছে তা আমি জানি। মাগো, আমি শুনেছি, তুমি ঘরের দরজায় এসে সবাইকে ডেকে ডেকে বলছ-“ওগো, তোমরা আমার ‘ইসহাক’- শূন্য রাজ্য দেখে যাও”। তোমার সেই ছবি আমার চোখের ওপর দিনরাত ভাসছে। তোমার এই কথাগুলি আমার হৃদয়ের প্রতি তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে সুর তোলে। মাগো, তুমি অমন করে আর কেঁদো না। আমি যে সত্যের জন্য, স্বাধীনাতার জন্য প্রাণ দিতে এসেছি, তুমি তাতে আনন্দ পাও না? কী করব মা? দেশ যে পরাধীন। দেশবাসী যে বিদেশির অত্যাচারে জর্জরিত। দেশমৃতৃকা যে শৃঙ্খলাভাবে অবনতা, লাঞ্ছিতা, অবমানিতা? তুমি কি সবই নীরবে সহ্য করবে মা? একটি সন্তানকেও কি তুমি মুক্তির জন্য উৎসর্গ করতে পারবে না? তুমি কি কেবলই কাঁদবে?
আর কেঁদো না মা। যাবার আগে আর একবার তুমি আমায় স্বপ্নে দেখা দিয়ো। আমি তোমার কাছে জানু পেতে ক্ষমা চাইব। আমি যে তোমার মনে বড় ব্যাথা দিয়ে এসেছি মা। ইচ্ছা করে ছুটে গিয়ে তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে আসি। তুমি আদর করে আমাকে বুকে টেনে নিতে চাইছ, আমি তোমার হাত ছিনিয়ে চলে এসেছি। খাবারের থালা নিয়ে আমায় কত সাধাসাধিই না করেছ, আমি পেছন ফিরে চলে এসেছি।
না, আর পারছি না। ক্ষমা চাওয়া ভিন্ন আর আমার উপায় নেই। আমি তোমাকে দুদিন ধরে সমানে কাঁদিয়েছি। তোমার কাতর ক্রন্দন আমাকে এতটুকু টলাতে পারেনি।
কী আশ্চর্য মা, তোমার ইসহাক নিষ্ঠুর হতে পারল কী করে! ক্ষমা করো মা, আমায় তুমি ক্ষমা করো।
ইতি
ইসহাক
চিঠি লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ইসহাক খান। ঠিকানা: ৪৭৬ উইলসন রোড, বন্দর, নারায়ণগঞ্জ। তিনি বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, ভৈরব খাদ্য গুদাম, ভৈরব, কিশোরগঞ্জ।
চিঠি প্রাপক: মা, ফয়জনের নেসা। গ্রাম ও পো: অটোমার কচুয়া, চাঁদপুর (ইসহাক খান এক সহযোদ্ধার মাধ্যমে তাঁর মার কাছে এই চিঠিটি পাঠান)।
চিঠিটি পাঠিয়েছেন: লেখক নিজেই।
তারিখ: ০১/০৮/১৯৭১
যে কথা লিখার জন্য কলম ধরেছি তা থেকে হয়তো এ লেখাটুকু একটু আলাদা ধরনের হলো সে জন্য সত্যিকারেই মর্মাহত। কত দিন বেঁচে থাকি জানি না, তবে আজ পর্যন্ত যে বেঁচে আছি সেটাই ভাগ্য বলে মেনে নিতে হবে। আজ মনে পড়ছে কতগুলো বন্ধু- বান্ধবদের কথা। তারা হলো আকবর, জীবন, খয়ের ভাই, এনায়েত ভাই, আকরাম ভাই, সাইফুল, মকবুল, আনছার, কবির, কুদ্দুছ, ছত্তার, বারী, রঙ্গু, মোসারেফ ভাই, মন্নান ভাই, আলমুজাহিদ ভাই, খালেক ( পানের দোকানদার), খোন্দকার ভাই (দারোয়ান), খালেক ( দারোয়ান), আজিজ, লতিফ, ফারুক, মালেক, সেকেন্দার, কাদের ভাই ( রেস্টুরেন্টওয়ালা), মামু, লালু, শিলু, নাসরীন, নাসরীনের মা-বাবা, রানু, ওর মা বাবা, মিতা, হাই, হাই, ইদ্রিস, মোসারেফ ভাই, কত জনার কথা আর লেখা যায়? এরা ছিলাম এক সূত্রে গাঁথা। কে কে বেঁচে আছেন, আর কার কার সঙ্গে দেখা হবে। মামুন, আজিম, বকুল, ওরাও স্মৃতির পট থেকে বাদ যায়নি। তৈয়ব নানা নানু, রুবী খালা, ওরাও কোথায় আছে তাও জানা নেই। কোনোদিন দেখা করতে পারি কি না সন্দেহ। কালের ভয়াল গ্রাসে কে কোথায় আছে খোদাতায়ালাই জানেন। অনেক বন্ধু নিহত হওয়ার কথাও শুনেছি, কজনারই বা হিসাব দেব। স্মৃতিপটে সবই ভেসে ওঠে।
বাবলু
চিঠি লেখক: শহীদ আবুল কালামা (বাবলু), তাঁর পিতার নাম: শহীদ আবু বকর মিয়া, গ্রাম-পিজগলুয়া, ডাকঘর- জীবনদাসকাঠী, উপজেলা- রাজাপুর, ডিজলা- ঝালকাঠি। ৩ অক্টোবর রাজাপুর থানার আঙ্গারিয়া নামক স্থানে পাক সেনা ও রাজাকারদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে তিনি অস্ত্রসহ ধরা পড়েন। অমানুষিক নির্যাতনের পর ১১ অক্টোবর রাতে রাজাপুর থানায় তাঁকে হত্যা করা হয়। কয়েক দিন পর তাঁর পিতাকেও পাক সেনা ও রাজাকার বাহিনী গুলি করে হত্যা করে।
চিঠি প্রাপক: জানা সম্ভব হয়নি।
চিঠিটি পাঠিয়েছেন: আবুল কাইয়ুম হারিচ, কালাম মনজিল, নবগ্রাম রোড, বরিশাল।
তারিখ: ০৩/০৮/১৯৭১ইং
মা,
আমার সালাম নিয়ো। অনেক পাহাড় পর্বত, নদী প্রান্তর পেরিয়ে, সমস্ত বাধা অতিক্রম করে তোমার ছেলে তার অনেক আকাঙ্খার শেষ ঠিকানা আজ খুঁজে পেয়েছে। হ্যাঁ মা, আমি পৌঁছে গেছি আমার ইচ্ছার কেন্দ্রবিন্দুতে। নিজেকে এবার প্রস্তুত করব প্রতিশোধ নেওয়ার এক বিশাল শক্তি হিসেবে। আমার প্রতিশ্র“তি আমি কখনও ভুলব না। ওদের উপযুক্ত জবাব আমাদের দিতেই হবে। মা, তুমি এই মুহুর্তে আমাকে দেখলে চিনতে পারবে না। বিশাল বাবড়ি চুল, মুখভর্তি দাড়ি গোঁফ। যদিও আমি নিজের চেহারাটা বহুদিন দেখি না কারণ এখানে কোনো আয়না নেই। মিহির বলে, আমাকে নাকি আফ্রিকার জংলিদের মতো লাগে। মিহির ঠিকই বলে, কারণ, এখন আমি নিজেই বুঝি আমার মাঝে একটি জংলি ভাব এসে গেছে। সেই আগের আমি আর নেই। তোমার মনে আছে মা, মুরগি জবাই করা আমি দেখতে পারতাম না। আর সেই আমি আজ রক্তের নদীতে সাঁতার কাটি। খাওয়া দাওয়ার কথা বলে লাভ নেই, দু:খ পাবে। তবে বেঁচে আছি ও খুব ভালো আছি। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আমরা আর সেই দিনটি থেকে খুব দূরে নাই, যখন আমরা আবার মুখোমুখি হব। দোয়া করো মা, যেন সেই দিনটি পর্যন্ত বেঁচে থাকি। মনি ভাই আমাদের অফিসার করেনি কারণ ওনার অন্য কাজের জন্য আমাদের প্রয়োজন পড়বে। এখানে আমার অনেক পুরান বন্ধুর দেখা পেলাম। আমার আগের চিঠিটা হয়তো এত দিনে পেয়ে গেছ। সেলিম তোমার সাথে দেখা করে এসেছে, বলল। তোমরা ভালো আছ জেনে খুশি হলাম। আমার জন্য কোনো চিন্তা কোরো না। মায়ের দোয়া আমার সাথে আছে, আমার ভয় কী? অনেক লেখার ইচ্ছা করছে কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না। কত ঘটনা মনে জমা হয়ে আছে তোমাদের বলার জন্য! হয়তো অনেক বছর লেগে যাবে শেষ করতে। মন্টু চিঠি নিয়ে যাচ্ছে। পারলে ওকে একটু ভালো কিছু খাবারদাবার দিয়ো। অনেক দিন ও ভালো কিছু খায়নি। আজ তাহলে- ৮০, সবাইকে সালাম ও দোয়া দিও।
তোমার স্নেহের ফেরদৌস
চিঠি লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌস উদ্দীন মাহমুদ। তাঁর বর্তমান ঠিকানা: ফ্ল্যাট-৫০০, কনকর্ড কটেজ, প্লট-৮ আই, রোড-৮১, গুলশান-২, ঢাকা।
চিঠি প্রাপক: মা, হাসিনা মাহমুদ। তাঁর তখনকার ঠিকানা: ৮৩ লেক সার্কাস, কলাবাগান, ঢাকা।
চিঠিটি পাঠিয়েছেন: লেখক নিজেই।
বি আহাম্মদ
বড়গ্রাম
০৩/০৮/১৯৭১
শ্রদ্ধেয় শহীদুল্লাহ ভাই,
সালাম নেবেন। আপনার সঙ্গে দেখা করব করব করেও সম্ভব হয়ে উঠছে না। আপনার বড়গ্রাম অপারেশন ক্যাম্প নিয়ে বড় ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। আপনি নিজেও একবার এলেন না। আশা করি আগামীতে একবার এসে ক্যাম্প পরিদর্শন করে যাবেন। তা ছাড়া অপারেশন বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলাপ আছে। অর্থাৎ (গোদাগাড়ী) ক্যাম্প উঠিয়ে দিতে হলে আপনার সঙ্গে মিলিতভাবে একটা প্ল্যান করা দরকার। যা হোক একটু দোয়া রাখবেন, যেন অবিলম্বে আমরা একটা বড় রকমের অপারেশন করতে পারি। আর সে কাজে কিছু অটোমেটিক হাতিয়ার দরকার। অনেক চেষ্টা করেও উদ্ধার বা সংগ্রহ করা গেল না। বর্তমানে কাটলা ইয়ুথ ক্যাম্পে নাকি দু-এক খগএ রাইফেল আছে। যদি দয়া করে সেগুলো আপনাদের বড়গ্রাম ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেন তো যারপরনাই উপকার হবে এবং আশা করি আপনি তার ত্র“টি করবেন না।
ইতি আপনার মাস্টার ভাই
বেশারউদ্দীন আহম্মদ
চিঠি লেখক: মুক্তিযোদ্ধা বেশারউদ্দীন আহমদ। বড়গ্রাম অপারেশন ক্যাম্পে ছিলেন।
চিঠি প্রাপক: মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল্লাহ, কাটলা যুব ক্যাম্প।
সংগ্রহ: মে.জ.(অব) ফজলুর রহমানের কাছ থেকে।
হরিণা যুব প্রশিক্ষণ শিবির
০৩/০৮/১৯৭১
স্নেহের ছোট ভাই বাবুল
লিখার শুরুতেই আমার স্নেহশিস দোয়া নিয়ো। আব্বাকে আমার সালাম ও কদমবুছি বলিয়ো। আমি তোমাদেরকে না বলিয়া ভারত চলিয়া আসিয়াছি। হরিণা ক্যাম্পে আছি, আমার জন্য কোনো চিন্তা করিয়ো না। আমি স্বপন চৌধুরীর অধীনে আছি। রুপেন চৌধুরী হরিণা ক্যাম্পের যুব প্রশিক্ষণ শিবিরের দায়িত্বে আছে। আমাকে বেশ স্নেহ করে। আমার কাজ শুধু ক্যাম্পের ভিতর। আমার জন্য কোনো চিন্তা করিয়ো না। এইখানে আসিয়া বহু বড় বড় ছাত্রনেতার সহিত পরিচয় হইয়াছে। রব ভাই, রাজ্জাক ভাই, তোফায়েল ভাই, মাখন ভাই, ইনু ভাই ও আমাদের দক্ষিণ পাড়ার মনির আহামদ, এ সবাইয়ের সহিত আমার দেখা হইয়াছে, সবাই ভালো আছে। যুদ্ধ যখন শুরু হইয়াছে খুব সাবধানে থাকিবা, না হয় তোমরা নানার বাড়িতে চলিয়া যাও। না হয় রামগড় দিয়া ভারতে চলিয়া আসো। দেশ স্বাধীন করার জন্য দেশের বহু লোকজন এ দেশে আসিয়াছে, যুদ্ধ করিতেছে, তোমরা শুধু দোয়া করিবে দেশ যেন তাড়াতাড়ি স্বাধীন হয়। মৌলানা আবদুল্লাহ মোজাহিদ বাহিনীর প্রধান হইয়াছে। সেই আমাদের গরু নিয়া গিয়াছে বলিয়া শুনিয়াছি, চিন্তা করিয়ো না। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করো, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যেন পরাজয় বরণ করে। রাজাকাররা ধান লইয়া গিয়াছে তাহাও শুনিয়াছি, আদিনাথ কাকা সব ঘটনা বলিয়াছে। শুনিয়া আমার খুবই খারাপ লাগিতেছে। আমার জন্য তোমরা কোনো চিন্তা করিয়ো না। জানিতে পারিলাম মামা আবদুর রাজ্জাক সাহেব পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধ অবস্থায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া যুদ্ধে শহীদ হইয়াছে। মাকে এই কথা বলিয়ো না। যদি দেশ স্বাধীন হয় তাহা হলে তোমাদের সাথে দেখা হইবে। যুদ্ধে যদি আমি মারাও যাই, কোনো চিন্তা করিয়ো না। যদি আমার রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়, দেশের মানুষ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র পায়, তাহা হইলে আমার অত্মা শান্তি পাইবে। আমার জন্য সবাই দোয়া করিবা।
খোদা হাফেজ
তোমার বড় ভাই
মোহা. আইয়ুব খান
মুক্তিবাহিনীর সদস্য
হরিণা যুব প্রশিক্ষণ শিবির, হরিণা, ভারত।
চিঠি লেখক: মো: আইয়ুব খান।
চিঠি প্রাপক: বাবুল।
চিঠিটি পাঠিয়েছেন: জনাব বাবুল। পো: ডেমশা, থানা: সাতকানিয়া, চট্রগ্রাম।
প্রজন্ম ৭১
তারিখ: ০৫/০৮/১৯৭১ইং
বেনু ভাই,
শুভেচ্ছা জানবেন।
হাবীব সাহেবের সিগনাল এইমাত্র এসেছে। আপনার সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই বলে তিনি জানিয়েছেন। গতকাল তার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য এবং তার কাছাকাছি অবস্থান করার জন্য আপনাকে লিখেছিলাম। হাবীব সাহেবের কাছাকাছি থাকবেন। পুংলীর পুল পার হবেন না। কারণ, বিপদে পড়তে পারেন। হাবীব সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফেলুন। আজ এনায়েত করীম সাহেব কিছু লোকজন এবং অস্ত্র নিয়ে আসবেন। সম্ভব হলে আপনাকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করব। বর্তমানে কোনো রিস্ক না নিয়ে হাবীব সাহেবের সঙ্গে মিলিত হয়ে ওই এলাকার অপারেশন সফল করুন। কারণ, এই অপারেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশেষ জরুরি পরিকল্পনা অনুযায়ী তৈরি হয়েছে। সব সময় আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন। কারণ, হেডকোয়ার্টারে নিয়মিত খবর পাঠাতে হয়। আপনারা কোনো চাঁদা জোর করে তুলবেন না। জয় বাংলা।
বুলবুল খান মাহবুব।
চিঠি লেখক: মুক্তিযোদ্ধা বুলবুল খান মাহবুব।
ঠিকানা: সদর সড়ক, জনতা ব্যাংক ভবন, ৪র্থ তলা, টাঙ্গাইল।
চিঠি প্রাপক: হাবিবুল হক খান বেনু। গ্রাম: কোলাহাট, গৌরঙ্গী, টাঙ্গাইল।
চিঠিটি পাঠিয়েছেন: আবদুস ছত্তার খান। গ্রাম ও পো: অর্জুনা, উপজেলা: ভুয়াপুর, জেলা: টাঙ্গাইল।
তারিখ: ০৮/০৮/১৯৭১ইং
রফিক,
আজকে এক জরুরি কাজের জন্য আতাউর, সামসুসহ ভালো ভালো ৬ জন ছেলে সন্ধ্যার খাওয়ার পর পাঠিয়ে দেবে। তাদের সঙ্গে একটি অটোমেটিক ও বাকি সব রাইফেল থাকবে। কালকে সকালে ইনশাল্লাহ সবাইকে ফেরত পাবে। ওই password থাকবে।
খাজা নিজামুদ্দিন
বি:দ্র: কিছুক্ষণ আগে এক গাড়ি পাকসেনা আটগ্রাম গিয়েছে। ওরা আচমকা আমাদের আক্রমণ করতে পারে। আটগ্রাম খবর পাঠবে।
Explosive চাই।
তারিখ: ০৯/০৮/১৯৭১ইং
রফিক,
এই মাত্র খবর পেলাম রাজপুর স্কুলে ও রামপুরে পাঞ্জাবিরা বাঙ্কার করছে। আমি আজকে সেদিকে যাব। তোমার গ্র“প নদীর পার থেকে রাত্রে আমাদের গ্র“পের পর পরই ঋরৎব খুলবে।
কালকে কেন্দ্রে আসবে।
খাজা নিজামুদ্দীন
Please allow Mr. A.K.M Rafiqul Haq to visit the bazar and return by.
sd/KHAWAJA NIZAMUDDIN
Jalalpur Camp
Mukti Fouj
চিঠি লেখক: শহীদ মুক্তিযোদ্ধা খাজা নিজামুদ্দীন বীর উত্তম। তিনি এই চিঠিগুলো সিলেট জেলার কানাইঘাটের মমতাগঞ্জে মুক্তিবাহিনী দলের অগ্রগামী ক্যাম্পের কমান্ডার থাকাকালে পাশ্ববর্তী মাদারীপুর (সালাম টিলায়) এলাকার মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প কমান্ডার এ কে এম রফিকুল হকের কাছে লিখেছেন।
চিঠি প্রাপক: মুক্তিযোদ্ধা একেএম রফিকুল হক বীর প্রতীক। তাঁর স্থায়ী ঠিকানা: জোনাকী নীড়, পুরাতন কোর্ট রোড, কিশোরগঞ্জ। বর্তমান ঠিকানা: বাড়ি-৫২, সড়ক- ১৫, সেক্টর-১১, উত্তরা, ঢাকা।
চিঠিটি পাঠিয়েছেন: প্রাপক নিজেই।
নলিন
তারিখ: ১২/০৮/৭১
এনায়েত ভাই/বুলবুল ভাই
সালাম নেবেন। পর, আপনার কথামতো পরদিন ও রাত্রিই ছিলাম। যাক, আপনাদের কৃতকার্যতার কথা শুনিয়া খুবই খুশি হইয়াছি। গত দুই দিনই দেখা করার জন্য ছিলাম। আজ এখনই চলিয়া আসিলাম। ভারতী, লুৎফর ভাই ও তার দল-ওখানে যাইতে চায়, আমাকে বলিয়াছে খাবার ম্যানেজ করিতে। আমি কী করিব কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। আপনার কী মত তাহাও তো জানি না। আপনার মত ছাড়া আমি ঠিক মনে করি না। উহাদের কথা না শুনিয়াও কী করা যায়।
ইহারা হেমনগর উঠিতে চায়। আপনি আপনার বুদ্ধি দিয়া আমাকে সাহায্য করুন। এদিকে ভুয়াপুরের চৎড়ঃবপঃরড়হ দেওয়া নেহাত উচিত। ভুয়াপুর খোদা না করুক, কিছু হইলে আমাদের আর উপায় নাই।
ইতি
আঙ্গুর তালুকদার
নলিন
চিঠি লিখেছেন: মুক্তিযোদ্ধা আঙ্গুর তালুকদার ( পুরো না মো: নূর হোসেন আঙ্গুর তালুকদার) কাদেরিয়া বাহিনীর একটি ইউনিটের কমান্ডার ছিলেন। তাঁর বর্তমান ঠিকানা: নলি, গোপালপুর, টাঙ্গাইল।
চিঠি প্রাপক: আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিম ও বুলবুল খান মাহবুব। টাঙ্গাইল।
চিঠিটি পাঠিয়েছেন: আব্দুস ছাত্তার খান।
তারিখ: ১৫/০৮/৭১
রাত- ৯.৩০ মি.
প্রীতিভাজনেষু ফজলু ও নবাবত,
মনের খুঁতখুঁতির জন্য লিখছি। সাবধানের মার নেই। আজ বিকেলে পাক- ফোর্স নাকি চক গোপাল বিওপি পশ্চিম ধানক্ষেতের মধ্যে এক পুকুরের পাড়ে জমায়েত হয়েছে। তারা সোজা এসেছে দিনাজপুর থেকে। কেন এসেছে, কী জন্য এসেছে- মনে সন্দেহ। তোমরা Camp – এ সাবধানে থেকো।
তোমাদের সর্বাঙ্গীণ কুশল ও মঙ্গল কামনা করি। প্রীতিসহ্
পত্র নিয়ে Camp- এ হইচই কোরো না।
প্রীতিধন্য
মো: আ: রহিম
চিঠি লেখক: মুক্তিযোদ্ধা মো: আ: রহিম
চিঠি প্রাপক: ফজলুর রহমান ও জনাব নওয়াব, ওসি, কাটলা ক্যাম মুক্তিযোদ্ধা।
সংগ্রহ: মে. জে. (অব) ফজলুর রহমানের কাছ থেকে।
তারিখ: ২৫/০৮/১৯৭১ইং
মা,
আমার সালাম নিবেন। ভাবির কাছ থেকে আপনার চিঠি পেলাম। আপনি আমার জন্য সব সময় চিন্তা করেন। কিন্তু মা, আপনার পুত্র হয়ে জন্ম নিয়ে মাতৃভূমির এই দুর্দিনে কি চুপ করে বসে থাকতে পারি? আর আপনিই বা আমার মতো এক পুত্রের জন্য কেন চিন্তা করবেন? পূর্ব বাংলার সব যুবকই তো আপনার পুত্র। সবার কথা চিন্তা করুন। আমাদের সবাইকে আশীর্বাদ করুন, যেন আমরা যে কাজে নেমেছি তাতে সাফল্য লাভ করতে পারি। তবেই না আপনার পুত্র হয়ে জন্ম নেওয়া সার্থক হবে।
আমাদের বিজয়েই না আপনার এবং শত শত জননীর গৌরব। শুনতে পেলাম আপনার শরীর খুব খারাপ। শরীরের দিকে নজর দেন। কেননা বিজয়ের পর যে উৎসব হবে, সেই উৎসবে আপনাকে তো আমাদের গলায় মালা পরিয়ে দিতে হবে। আপনি তো শুধু আমার জননীই নন, শত শত বিপ্লবী যুবকের মা।
আপনি আমাকে বাড়ি আসতে লিখেছেন। এই মুহূর্তে তা সম্ভব হচ্ছে না। তবে আশা করি সামনের মাসের প্রথম দিকে বাড়ি আসতে পারব। আমার জন্য চিন্তা না করে আশীর্বাদ করবেন। আব্বাকে আমার সালাম জানাবেন আর ছোটদেরকে স্নেহশীষ।
আমি ভাল আছি।
ইতি
আপনার শত শত বিপ্লবী যুবক সন্তানদের একজন
আজু
চিঠি লেখক: শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মুন্সী আবু হাসমত রশিদ। তিনি সাভারের কাছে শিমুলতলীতে ২৫ অথবা ২৭ আগষ্ট শহীদ হন। আজু তাঁর ডাকনাম।
চিঠি প্রাপক: মা, তাহমিনা বেগম। গ্রাম: কমলাপুর, পো: জানিপুর, খোকশা, কুষ্টিয়া।
চিঠিটি পাঠিয়েছেন: পারভিন সুলতানা, মিরপুর ম্যানশন,প্লট-৮, রোড-২, ব্লক ডি, মিরপুর-২, ঢাকা- ১২১৬।
বরিশাল
তারিখ: ২৫/০৮/৭১
রফিক ভাই,
শুভেচ্ছা নিন।
কেমন আছেন, সাবধান ভাই, আমি ধরা পড়েছিলাম মিলিটারি ক্যান্টনমেন্টে। বাংলার স্বাধীনতার স্বাদ আমার জীবন থেকে হয়তো বঞ্চিত হবে না। সেই কারণেই জাঁদরেল পাক বাহিনী আমাকে দীর্ঘদিন আটক রেখে ছেড়ে দিয়েছে। নতুন করে শপথ নিয়েছি ওদের আমরা শেষ চিহ্নটুকুও বাংলার মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন করব।
আপনারা চাখারের বানাড়ীপাড়ায় কী ধরনের অপারেশন করছেন। সাবধান, শপথ নিয়ে নেমেছেন ও নেমেছি, পিছপা হব না বা হবেন না। রফিক ভাই, জানি না কবে আমরা আবার পাশাপাশি মুক্ত দেশের মুক্ত হাওয়ায় প্রাণ খুলে কথা বলতে পারব।
আপনার মঙ্গল কামনা করি। জয় বাংলা, বাংলাদেশ অমর হউক।
ইতি
আপনারই
মনু
চিঠি লেখক: মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন মনু। কাউনিয়া, বরিশাল।
চিঠি প্রাপক: এটিএম রফিকুল ইসলাম। বর্তমান ঠিকানা-৮ নং হাউজিং কলোনি, পটুয়াখালী।
চিঠিটি পাঠিয়েছেন: প্রাপক নিজেই।
তারিখ: ১২/০৯/৭১ইং
মামা,
পত্রের প্রথম আমার হাজার হাজার সালাম জানবেন। এইমাত্র আপনার পত্র পেলাম, পত্র পড়ে সব অবগত হলাম। মামা, বড় অসুবিধায় পড়ে আপনার কাছে পত্র দিয়েছিলাম। আমি ১৫ দিনের জন্য ছুটি নিয়েছিলাম। মনে করেছিলাম সকলের সঙ্গে একবার দেখা করব কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে কারও সঙ্গেই দেখা করতে পারলাম না। জানি না এরপর আর কোনো দিন দেখা করতে পারব কি না। মামা, আম্মা এবং আব্বার প্রতি নজর রাখবেন, আমার মতো তাদের বিমুখ করবেন না। এখনো কয়েক দিন ছুটি আছে। এ কয় দিন কোথায় থাকব জানি না। এর কয় দিন পর যাব সেখানে যেখানে আমাদের স্থান। তারপর কোথায় থাকব জানি না। আমার জন্য এবং দেশের জন্য দোয়া করবেন। বাড়িতে চিন্তা করতে মানা করবেন। যেমনি হোক বেঁচে থাকব, কেননা ন্যায়ের পথে আছি, মরে যাই যাব, কোনো দুঃখ নেই, তবু মনে করব কিছু করেছি। আমার কাছে একটা ঃৎধহংরংঃড়ৎ আছে। সেটা তোতা মামার কাছে রেখে যাব। যদি পারি তবে পরে পাঠাব। আপনি তোতাকে চিনবেন না। ওরা খুব ভালো তাই সবই নিয়েছে। তাদের জন্যই আপনি(…) মাফ করবেন, একদিন বুঝবেন ঠিকই। মিন্টু ভাইয়ের খোঁজ মনে হয় পাননি। মামনিকে এই পাগলের জন্য দোয়া করতে বলবেন এবং সালাম জানাবেন। মেরী কেমন? তাকেও দোয়া করতে বলবেন। আপনাদের দোয়াই আমাদের সকলের পাথেয়। ভুল ক্ষমা করবেন।
ইতি
আজিজুর
চিঠি লেখক: মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান তরফদার(আজিজ বাঙ্গাল)
চিঠি প্রাপক: তৎকালীন মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার আবদুল হাই।
সংগ্রহ: আবদুস ছত্তার খান। ২০০১ সালের ২১ জানুয়ারি প্রাবন্ধিক ও গবেষক শফিউদ্দিন তালুকদার চিঠিটি টেপিপাড়া, ভুয়াপুর, টাঙ্গাইল থেকে সংগ্রহ করেন। আবদুস ছাত্তার খান চিঠিটি তাঁর কাছ থেকে সংগ্রহ করে পাঠিয়েছেন।
জিসান শা ইকরাম
অনেক ধন্যবাদ এই বিশাল কাজ করার জন্য।
নীহারিকা
একেকটা চিঠি একেকটা প্রাণের অনুভুতি প্রকাশ করছে…দেশের অমুল্য সম্পদ এগুলো…শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ
শিশির কনা
যতই পড়ছি , অনুভব করছি ১৯৭১ কে।
জবরুল আলম সুমন
গুরুত্বপূর্ণ এই ধারাবাহিকের জন্য আবারো ধন্যবাদ জানাই। বিশাল লেখা বলে এখন আর পড়ছিনা, তবে সম্পূর্ণটাই কপি করে নিয়ে গেলাম। সময় নিয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়বো বলে। আবারো ধন্যবাদ জানাই।