বিজয়ের মাস চলছে । লাল সবুজের এই পতাকার জন্য ১৯৭১ সনে এক সাগর রক্ত দিতে হয়েছিল আমাদের। শুধু মাত্র দেশ মাতাকে মুক্ত করার জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরেছিল এই দেশের দামাল ছেলেরা। বাবা মা ভাই বোন স্ত্রীর ভালোবাসার টানকে উপেক্ষা করে ঝাঁপিয়ে পরেছিল যুদ্ধে।রণাঙ্গন থেকে মুক্তিযোদ্ধারা চিঠি দিয়েছেন তাঁদের প্রিয় জনকে। চিঠিতে যুদ্ধের অবস্থা , মুক্তিযোদ্ধাদের দেশের প্রতি ভালবাসা স্পর্শ করে যায় আমাদের ।
মুক্তিযোদ্ধাদের এমন চিঠি প্রকাশ করেছে প্রথম আলোর প্রকাশনী প্রথমা । সুন্দর এই ঐতিহাসিক বইটির মুল্য ৩০০ টাকা।

 

তারিখ: ০৫/০৮/১৯৭১ইং
বেনু ভাই,
শুভেচ্ছা জানবেন।
হাবীব সাহেবের সিগনাল এইমাত্র এসেছে। আপনার সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই বলে তিনি জানিয়েছেন। গতকাল তার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য এবং তার কাছাকাছি অবস্থান করার জন্য আপনাকে লিখেছিলাম। হাবীব সাহেবের কাছাকাছি থাকবেন। পুংলীর পুল পার হবেন না। কারণ, বিপদে পড়তে পারেন। হাবীব সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফেলুন। আজ এনায়েত করীম সাহেব কিছু লোকজন এবং অস্ত্র নিয়ে আসবেন। সম্ভব হলে আপনাকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করব। বর্তমানে কোনো রিস্ক না নিয়ে হাবীব সাহেবের সঙ্গে মিলিত হয়ে ওই এলাকার অপারেশন সফল করুন। কারণ, এই অপারেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশেষ জরুরি পরিকল্পনা অনুযায়ী তৈরি হয়েছে। সব সময় আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন। কারণ, হেডকোয়ার্টারে নিয়মিত খবর পাঠাতে হয়। আপনারা কোনো চাঁদা জোর করে তুলবেন না। জয় বাংলা।
বুলবুল খান মাহবুব।

চিঠি লেখক: মুক্তিযোদ্ধা বুলবুল খান মাহবুব।
ঠিকানা: সদর সড়ক, জনতা ব্যাংক ভবন, ৪র্থ তলা, টাঙ্গাইল।
চিঠি প্রাপক: হাবিবুল হক খান বেনু। গ্রাম: কোলাহাট, গৌরঙ্গী, টাঙ্গাইল।
চিঠিটি পাঠিয়েছেন: আবদুস ছত্তার খান। গ্রাম ও পো: অর্জুনা, উপজেলা: ভুয়াপুর, জেলা: টাঙ্গাইল।

তারিখ: ০৮/০৮/১৯৭১ইং
রফিক,
আজকে এক জরুরি কাজের জন্য আতাউর, সামসুসহ ভালো ভালো ৬ জন ছেলে সন্ধ্যার খাওয়ার পর পাঠিয়ে দেবে। তাদের সঙ্গে একটি অটোমেটিক ও বাকি সব রাইফেল থাকবে। কালকে সকালে ইনশাল্লাহ সবাইকে ফেরত পাবে। ওই  password থাকবে।
খাজা নিজামুদ্দিন

বি:দ্র: কিছুক্ষণ আগে এক গাড়ি পাকসেনা আটগ্রাম গিয়েছে। ওরা আচমকা আমাদের আক্রমণ করতে পারে। আটগ্রাম খবর পাঠবে।

Explosive চাই।

তারিখ: ০৯/০৮/১৯৭১ইং
রফিক,
এই মাত্র খবর পেলাম রাজপুর স্কুলে ও রামপুরে পাঞ্জাবিরা বাঙ্কার করছে। আমি আজকে সেদিকে যাব। তোমার গ্র“প নদীর পার থেকে রাত্রে আমাদের গ্র“পের পর পরই ঋরৎব খুলবে।

কালকে কেন্দ্রে আসবে।
খাজা নিজামুদ্দীন

Please allow Mr. A.K.M Rafiqul Haq to visit the bazar and return by.
sd/KHAWAJA NIZAMUDDIN
Jalalpur Camp
Mukti Fouj

চিঠি লেখক: শহীদ মুক্তিযোদ্ধা খাজা নিজামুদ্দীন বীর উত্তম। তিনি এই চিঠিগুলো সিলেট জেলার কানাইঘাটের মমতাগঞ্জে মুক্তিবাহিনী দলের অগ্রগামী ক্যাম্পের কমান্ডার থাকাকালে পাশ্ববর্তী মাদারীপুর (সালাম টিলায়) এলাকার মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প কমান্ডার এ কে এম রফিকুল হকের কাছে লিখেছেন।
চিঠি প্রাপক: মুক্তিযোদ্ধা একেএম রফিকুল হক বীর প্রতীক। তাঁর স্থায়ী ঠিকানা: জোনাকী নীড়, পুরাতন কোর্ট রোড, কিশোরগঞ্জ। বর্তমান ঠিকানা: বাড়ি-৫২, সড়ক- ১৫, সেক্টর-১১, উত্তরা, ঢাকা।
চিঠিটি পাঠিয়েছেন: প্রাপক নিজেই।

নলিন
তারিখ: ১২/০৮/৭১
এনায়েত ভাই/বুলবুল ভাই
সালাম নেবেন। পর, আপনার কথামতো পরদিন ও রাত্রিই ছিলাম। যাক, আপনাদের কৃতকার্যতার কথা শুনিয়া খুবই খুশি হইয়াছি। গত দুই দিনই দেখা করার জন্য ছিলাম। আজ এখনই চলিয়া আসিলাম। ভারতী, লুৎফর ভাই ও তার দল-ওখানে যাইতে চায়, আমাকে বলিয়াছে খাবার ম্যানেজ করিতে। আমি কী করিব কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। আপনার কী মত তাহাও তো জানি না। আপনার মত ছাড়া আমি ঠিক মনে করি না। উহাদের কথা না শুনিয়াও কী করা যায়।

ইহারা হেমনগর উঠিতে চায়। আপনি আপনার বুদ্ধি দিয়া আমাকে সাহায্য করুন। এদিকে ভুয়াপুরের চৎড়ঃবপঃরড়হ দেওয়া নেহাত উচিত। ভুয়াপুর খোদা না করুক, কিছু হইলে আমাদের আর উপায় নাই।
ইতি
আঙ্গুর তালুকদার
নলিন
 

চিঠি লিখেছেন: মুক্তিযোদ্ধা আঙ্গুর তালুকদার ( পুরো না মো: নূর হোসেন আঙ্গুর তালুকদার) কাদেরিয়া বাহিনীর একটি ইউনিটের কমান্ডার ছিলেন।  তাঁর বর্তমান ঠিকানা: নলি, গোপালপুর, টাঙ্গাইল।
চিঠি প্রাপক: আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিম ও বুলবুল খান মাহবুব। টাঙ্গাইল।
চিঠিটি পাঠিয়েছেন: আব্দুস ছাত্তার খান।

তারিখ: ১৫/০৮/৭১
রাত- ৯.৩০ মি.
প্রীতিভাজনেষু ফজলু ও নবাবত,
মনের খুঁতখুঁতির জন্য লিখছি। সাবধানের মার নেই। আজ বিকেলে পাক- ফোর্স নাকি চক গোপাল বিওপি পশ্চিম ধানক্ষেতের মধ্যে এক পুকুরের পাড়ে জমায়েত হয়েছে। তারা সোজা এসেছে দিনাজপুর থেকে। কেন এসেছে, কী জন্য এসেছে- মনে সন্দেহ। তোমরা Camp – এ সাবধানে থেকো।

তোমাদের সর্বাঙ্গীণ কুশল ও মঙ্গল কামনা করি। প্রীতিসহ্
পত্র নিয়ে Camp- এ হইচই কোরো না।
প্রীতিধন্য
মো: আ: রহিম  

চিঠি লেখক: মুক্তিযোদ্ধা মো: আ: রহিম
চিঠি প্রাপক: ফজলুর রহমান ও জনাব নওয়াব, ওসি, কাটলা ক্যাম মুক্তিযোদ্ধা।
সংগ্রহ: মে. জে. (অব) ফজলুর রহমানের কাছ থেকে।

তারিখ: ২৫/০৮/১৯৭১ইং
মা,
আমার সালাম নিবেন। ভাবির কাছ থেকে আপনার চিঠি পেলাম। আপনি আমার জন্য সব সময় চিন্তা করেন। কিন্তু মা, আপনার পুত্র হয়ে জন্ম নিয়ে মাতৃভূমির এই দুর্দিনে কি চুপ করে বসে থাকতে পারি? আর আপনিই বা আমার মতো এক পুত্রের জন্য কেন চিন্তা করবেন? পূর্ব বাংলার সব যুবকই তো আপনার পুত্র। সবার কথা চিন্তা করুন। আমাদের সবাইকে আশীর্বাদ করুন, যেন আমরা যে কাজে নেমেছি তাতে সাফল্য লাভ করতে পারি। তবেই না আপনার পুত্র হয়ে জন্ম নেওয়া সার্থক হবে।

আমাদের বিজয়েই না আপনার এবং শত শত জননীর গৌরব। শুনতে পেলাম আপনার শরীর খুব খারাপ। শরীরের দিকে নজর দেন। কেননা বিজয়ের পর যে উৎসব হবে, সেই উৎসবে আপনাকে তো আমাদের গলায় মালা পরিয়ে দিতে হবে। আপনি তো শুধু আমার জননীই নন, শত শত বিপ্লবী যুবকের মা।

আপনি আমাকে বাড়ি আসতে লিখেছেন। এই মুহূর্তে তা সম্ভব হচ্ছে না। তবে আশা করি সামনের মাসের প্রথম দিকে বাড়ি আসতে পারব। আমার জন্য চিন্তা না করে আশীর্বাদ করবেন। আব্বাকে আমার সালাম জানাবেন আর ছোটদেরকে স্নেহশীষ।

আমি ভাল আছি।
ইতি
আপনার শত শত বিপ্লবী যুবক সন্তানদের একজন
আজু 
 

চিঠি লেখক: শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মুন্সী আবু হাসমত রশিদ। তিনি সাভারের কাছে শিমুলতলীতে ২৫ অথবা ২৭ আগষ্ট শহীদ হন। আজু তাঁর ডাকনাম।
চিঠি প্রাপক: মা, তাহমিনা বেগম। গ্রাম: কমলাপুর, পো: জানিপুর, খোকশা, কুষ্টিয়া।
চিঠিটি পাঠিয়েছেন: পারভিন সুলতানা, মিরপুর ম্যানশন,প্লট-৮, রোড-২, ব্লক ডি, মিরপুর-২, ঢাকা- ১২১৬।

বরিশাল
তারিখ: ২৫/০৮/৭১
রফিক ভাই,
শুভেচ্ছা নিন।
কেমন আছেন, সাবধান ভাই, আমি ধরা পড়েছিলাম মিলিটারি ক্যান্টনমেন্টে। বাংলার স্বাধীনতার স্বাদ আমার জীবন থেকে হয়তো বঞ্চিত হবে না। সেই কারণেই জাঁদরেল পাক বাহিনী আমাকে দীর্ঘদিন আটক রেখে ছেড়ে দিয়েছে। নতুন করে শপথ নিয়েছি ওদের আমরা শেষ চিহ্নটুকুও বাংলার মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন করব।

আপনারা চাখারের বানাড়ীপাড়ায় কী ধরনের অপারেশন করছেন। সাবধান, শপথ নিয়ে নেমেছেন ও নেমেছি, পিছপা হব না বা হবেন না। রফিক ভাই, জানি না কবে আমরা আবার পাশাপাশি মুক্ত দেশের মুক্ত হাওয়ায় প্রাণ খুলে কথা বলতে পারব।

আপনার মঙ্গল কামনা করি। জয় বাংলা, বাংলাদেশ অমর হউক।
ইতি
আপনারই
মনু
 

চিঠি লেখক: মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন মনু। কাউনিয়া, বরিশাল।
চিঠি প্রাপক: এটিএম রফিকুল ইসলাম। বর্তমান ঠিকানা-৮ নং হাউজিং কলোনি, পটুয়াখালী।
চিঠিটি পাঠিয়েছেন: প্রাপক নিজেই।

তারিখ: ১২/০৯/৭১ইং
মামা,
পত্রের প্রথম আমার হাজার হাজার সালাম জানবেন। এইমাত্র আপনার পত্র পেলাম, পত্র পড়ে সব অবগত হলাম। মামা, বড় অসুবিধায় পড়ে আপনার কাছে পত্র দিয়েছিলাম। আমি ১৫ দিনের জন্য ছুটি নিয়েছিলাম। মনে  করেছিলাম সকলের সঙ্গে একবার দেখা করব কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে কারও সঙ্গেই দেখা করতে পারলাম না। জানি না এরপর আর কোনো দিন দেখা করতে পারব কি না। মামা, আম্মা এবং আব্বার প্রতি নজর রাখবেন, আমার মতো তাদের বিমুখ করবেন না। এখনো কয়েক দিন ছুটি আছে। এ কয় দিন কোথায় থাকব জানি না। এর কয় দিন পর যাব সেখানে যেখানে আমাদের স্থান। তারপর কোথায় থাকব জানি না। আমার জন্য এবং দেশের জন্য দোয়া করবেন। বাড়িতে চিন্তা করতে মানা করবেন। যেমনি হোক বেঁচে থাকব, কেননা ন্যায়ের পথে আছি, মরে যাই যাব, কোনো দুঃখ নেই, তবু মনে করব কিছু করেছি। আমার কাছে একটা ঃৎধহংরংঃড়ৎ আছে। সেটা তোতা মামার কাছে রেখে যাব। যদি পারি তবে পরে পাঠাব। আপনি তোতাকে চিনবেন না। ওরা খুব ভালো তাই সবই নিয়েছে। তাদের জন্যই আপনি(…) মাফ করবেন, একদিন বুঝবেন ঠিকই। মিন্টু ভাইয়ের খোঁজ মনে হয় পাননি। মামনিকে এই পাগলের জন্য দোয়া করতে বলবেন এবং সালাম জানাবেন। মেরী কেমন? তাকেও দোয়া করতে বলবেন। আপনাদের দোয়াই আমাদের সকলের পাথেয়। ভুল ক্ষমা করবেন।
ইতি
আজিজুর 

চিঠি লেখক: মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান তরফদার(আজিজ বাঙ্গাল)
চিঠি প্রাপক: তৎকালীন মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার আবদুল হাই।
সংগ্রহ: আবদুস ছত্তার খান। ২০০১ সালের ২১ জানুয়ারি প্রাবন্ধিক ও গবেষক শফিউদ্দিন তালুকদার চিঠিটি টেপিপাড়া, ভুয়াপুর, টাঙ্গাইল থেকে সংগ্রহ করেন। আবদুস ছাত্তার খান চিঠিটি তাঁর কাছ থেকে সংগ্রহ করে পাঠিয়েছেন।

৬৪১জন ৬৪০জন
0 Shares

৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ