বিজয়ের মাস চলছে । লাল সবুজের এই পতাকার জন্য ১৯৭১ সনে এক সাগর রক্ত দিতে হয়েছিল আমাদের। শুধু মাত্র দেশ মাতাকে মুক্ত করার জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরেছিল এই দেশের দামাল ছেলেরা। বাবা মা ভাই বোন স্ত্রীর ভালোবাসার টানকে উপেক্ষা করে ঝাঁপিয়ে পরেছিল যুদ্ধে।রণাঙ্গন থেকে মুক্তিযোদ্ধারা চিঠি দিয়েছেন তাঁদের প্রিয় জনকে। চিঠিতে যুদ্ধের অবস্থা , মুক্তিযোদ্ধাদের দেশের প্রতি ভালবাসা স্পর্শ করে যায় আমাদের ।
মুক্তিযোদ্ধাদের এমন চিঠি প্রকাশ করেছে প্রথম আলোর প্রকাশনী প্রথমা । সুন্দর এই ঐতিহাসিক বইটির মুল্য ৩০০ টাকা।
তারিখ: ২১ জুলাই ১৯৭১
মা,
সর্বপ্রথম আমার সালাম ও কদমবুসি গ্রহণ করবেন। পর সমাচার এই যে আমি আজ এমন এক স্থানে রওয়ানা হলাম, খোনানে মিলিটারির কোনো হামলা নেই। তাই আজ আপনার কাছে লিখতে বাধ্য হলাম। আমার সমস্ত দোষ। তাই আপনি আমার অন্যায় বলতে যা কিছু আছে, সমস্ত ক্ষমা করে দিবেন। আমার প্রতি কোনো দাবি রাখবেন না। কারণ আমার মৃত্যু যদি এসে থাকে, তবে আপনারা আমায় বেঁধে রাখতে পারবেন না। মৃত্যুর সঙ্গে আমাদের সংগ্রাম করতে হবে। মৃত্যুর জন্য আমি সব সময় প্রস্তুত। গ্রামে বসে শিয়াল- কুকুরের মতো মরার চেয়ে যোদ্ধাবেশে আমি মরতে চাই। মরণ একদিন আছে। আজ যদি আমার মরণ আসে, তাহলে আমাকে আপনারা মরণ থেকে ফিরাতে পারবেন না। মরণকে বরণ করে আমার যাত্রা শুরু করলাম। আমার জন্য দুঃখ করবেন না। মনে করবেন, আমি মরে গেছি। দোয়া করবেন, আমি যাতে আমার গন্তব্যস্থানে ভালোভাবে পৌঁছাতে পারি। আব্বাকে আমার জন্য দোয়া করতে বলবেন। সে যেন আমার সমস্ত অন্যায়কে ক্ষমা করে দেয়। নামাজ পড়ে আমার জন্য দোয়া করবেন। আপনার ছেলে যদি হয়ে থাকি, তবে আমার জন্য দুঃখ করবেন না। বাড়ির সবার কাছ থেকে আমার দাবি ছাড়াবেন। খোদায় যদি বাঁচায়, তবে আমি কয়েক দিনের ভেতর ফিরে আসব। ইনশাল্লাহ খোদা আমাদের সহায় আছেন। মিয়াভাইয়ের কাছে আমার সালাম ও দোয়া করতে বলবেন। আর আমার জন্য কোনো খোঁজ বা কারও ওপর দোষারোপ করবেন না। এটা আমার নিজের ইচ্ছায় গেলাম। আমি টাকা কোথায় পেলাম সে কথা জানতে চাইলে আমি বলব, বাবুলের মায়ের ট্রাংক থেকে আমি ৬০ টাকা নিলাম এবং তার টাকা আমি বাঁচলে কয়েক দিনের ভেতর দিয়ে দেব। বাবুলের মায়ের টাকার কথা কারও কাছে বলবেন না। আর বাবুলের মাকে বলবেন, সে যেন কয়েকটা দিন অপেক্ষা করে। জানি, আমাকে দিয়ে আপনাদের সমস্ত আশা-ভরসা করছেন। কিন্তু আমার ছোট ভাই দুইটাকে দিয়ে যে সমস্ত আশা সফল করতে চেষ্টা করবেন। দাদা ও মুনিরকে মানুষ করে ওদের দ্বারা আপনারা সমস্ত আশা বাস্তবরূপে ধারণ করবেন। আমাদের এ যাত্রা মহান যাত্রা। আমরা ভালোর জন্য এরূপ যাত্রা করলাম। অতি দুঃখের পর এ দেশ থেকে চলে গেলাম। দোয়া করবেন। খোদা হাফেজ।
ইতি
আপনাদের হতভাগা ছেলে
আমি
চিঠি লেখক: মুক্তিযোদ্ধা দুদু মিয়া। তাঁর পুরো নাম আবু বকর সিদ্দিক, পিতা মৃত: আবুল হোসেন তালুকদার। ঠিকানা: গ্রাম: নরসিংহলপট্টি, ডাকঘর: শাওড়া,
উপজেলা: গৌরনদী, জেলা: বরিশাল।
চিঠি প্রাপক: মা আনোয়ারা বেগম।
চিঠিটি পাঠিয়েছেন: লেখক নিজেই।
তারিখ: ২৩/৭/১৯৭১ইং
১.
মা ও বাবাজান,
আমার সালাম ও কদমবুসি জানিবেন। আজ কয়েকদিন গত হয় আপনাদের নিকট হইতে বহুদূরে অবস্থান করিতেছি। খোদার কৃপায় মঙ্গলেই পৌঁছিয়াছি। হযরতের কাছ হইতে হয়তো এ কয়দিনে একখানা পত্র পাইয়াছেন। তাহা হইতে বুঝিতে পারিয়াছেন আমি কোথায় আছি। আমি ভালো আছি। আমার জন্য সবাইকে ও আপনারা দোয়া করিবেন। শ্রেণীগতভাবে সবাইকে আমার সালাম ও স্নেহশিস দিবেন। নানা অসুবিধার জন্য খোলাখুলি সবকিছু লিখিতে পারিলাম না।
ইতি: হাকিম
ঘ.ই: হয়তো মাস দুই পরে বাড়ি ফিরিব। আবার তা নাও হইতে পারে।
২.
শ্রদ্ধেয় মামাজান,
আমার ভক্তিপূর্ণ সালাম ও কদমবুসি গ্রহণ করিবেন। আশা করি ভালো আছেন। আমরা আপানাদের দোয়ায় ভালোই আছি। আমার জন্য কোনোরূপ চিন্তা করিবেন না। দোয়া করিবেন যেন ভালোভাবে আপনাদের নিকট ফিরিয়া যাইতে পারি ও উদ্দেশ্যকে সাফল্যমন্ডিত করিতে পারি। অধিক কি আর লিখিব। আমাদের বাড়িতে সংবাদ দিবেন।
ইতি
আপনার স্নেহের মতি
একই কাগজে পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা চিঠি লিখেছেন। তাঁদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা মতি শহীদ হন্ তাঁরা চিঠিগুলো লিখেছেন পশ্চিমবঙ্গের করিমগঞ্জ ষ্টেশনের নিকটবর্তী কেচুয়াডাঙ্গা হাইস্কুলে ট্রানজিট সেন্টারে অবস্থানকালে। পত্র লেখকদের নাম: হাকিম, হাশমত, হাসু, মতি ও মোতালেব। এখানে হাকিম ও মতির চিঠি প্রকাশিত হলো।
চিঠি প্রাপক: মো: শামসুল আলম, প্রযতেœ: মৌলভী সেহাবউদ্দিন, গ্রাম: নলসন্দা, পো: ডিগ্রীর চর, উল্লাপাড়া, পাবনা ( বর্তমানে সিরাজগঞ্জ জেলা)।
চিঠিটি পাঠিয়েছেন: মো: শামসুল আলম। তিনি বর্তমানে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের দিনাজপুর দক্ষিণের উপমহাব্যবস্থাপক।
ঝালকাঠি,মিলিটারি, ক্যান্টনমেন্ট
২৪/০৭/১৯৭১, বাংলা ৬ শ্রাবণ, ১৩৭৮
স্নেহের ফিরোজা,
তোমাকে ১৭ বৎসর পূর্বে সহধর্মিণী গ্রহণ করিয়াছিলাম। অদ্যাবধি তুমি আমার উপযুক্ত স্ত্রী হিসাবে সংসারধর্ম পালন করিয়া আসিয়াছ। কোনো দিন তোমার উপর অসন্তুষ্ট হইতে পারি নাই। আজ আমি (….) তোমাদের অকূল সাগরে ভাসাইয়া পরপারে চলিয়াছি। বীরের মতো সালামা- ইনশাল্লাহ জয় আমাদের হইবে, দুনিয়া হইতে লাখ লাখ লোক চলিয়া গেছে খোদার কাছে। কামনা করি যেন সব শহীদদের কাতারে শামিল হইতে পারি। মনে আমার কোনো দুঃখ নাই। তবে বুকে জোড়া কেবল আমার বাদল। ওকে মানুষ করিয়ো। আজ যে অপরাধে আমার মৃত্যু হইতেছে খোদাকে সাক্ষী রাখিয়া আমি বলিতে পারি যে এই সব অপরাধ হইতে আমি নিষ্পাপ। জানি না খোদায় কেন যে আমাকে এরূপ করিল। জীবনের অর্ধেক বয়স চলিয়া গিয়াছে, বাকি জীবনটা বাদল ও হাকিমকে নিয়া কাটাইবে। (….) পারিলাম না। (….) বজলু ভাইয়ের বেটা ওহাবের কাছে ১৫ হাজার টাকা আছে। যদি প্রয়োজন মনে কর তবে সেখান হইতে নিয়া নিয়ো।
ইতি
তোমারই
বাদশা
(বাবা হাকিম, তোমার মাকে ছাড়িয়া কোথাও যাইয়ো না)
চিঠি লেখক: শহীদ বাদশা মিয়া তালুকদার, গ্রাম: বাঁশবাড়িয়া, উপজেলা: টুঙ্গিপাড়া, জেলা: গোপালগঞ্জ।
চিঠি প্রাপক: স্ত্রী ফিরোজা বেগম।
চিঠিটি পাঠিয়েছেন: মো: বাদল তালুকদার। ১/২ ব্লক জি, লালমাটিয়া, ঢাকা।
তারিখ: ২৯/০৭/১৯৭১ ইং
নীলু,
নাসিরের হাতে পাঠানো চিঠি কাল পেয়েছি ও আজ পোষ্টের চিঠিটা পেলাম। খোকন যাবার পর মনসুর থাকতে তবুও সময় চলে গেছে। সেদিন ও চলে যাবার পর এখন একদম খড়হষু লাগছে, তবে গত ৩-৪ দিন খুব ব্যস্ত ছিলাম। তাই সময় কেটে গেছে। গতকাল ভোর রাত্রে ছোটিপুর (……….) আক্রমণ করেছিলাম ও দারুণ যুদ্ধ হয়েছে। গুলি ফুরিয়ে যাওয়াতে আমরা পিছে চলে আসতে বাধ্য হই। আমরা মাত্র ৪০ জন আর ওরা ১৫০-র মতো ছিলো। কিন্তু আক্রমণে টিকতে না পেরে বতহু পালিয়ে যায়। আমরা শেষ পর্যন্ত ওদের শেষ উবভবহপব- এর দেড় শ গজের মধ্যে চলে যেতে পেরেছিলাম । আমরা আর আধা ঘন্টা টিকতে পারলে দখল করতে পারতাম। কারণ, আজ জানালাম ওরা নৌকা তিনটা করে পালিয়ে যেতে জোগাড় করেছিল। ওদেরও গুলি শেষ হয়ে এসেছিল। ভোর ৪-২০ থেকে ৭-৪৫ পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। ওদের বারজন মারা গেছে ও বহু আহত হয়েছে। আমাদের তরফে একজনের হাতে গুলি লাগে- হাসপাতালে আছে। ঈড়ষ কাপুর এবহবৎধষ কে আমার এই যুদ্ধ সম্বন্ধে একটা দারুণ ফুলে যাওয়ার মতো জবঢ়ড়ৎঃ দিয়েছে।
খোকনকে বলো ইনশাল্লাহ আগামীকাল রাত্রে আমরা সেই ঙঢ়বৎধঃরড়হ টা করব, যেটা সেদিন রওনা হবার সময় ঈধহপবষ করি।
আজ জধফরফড়- তে (উধরষু) ঞবষবমৎধঢ়য- এ চবঃবৎ ইরষষ- এর আমার ও আমার মুক্ত এলাকার জবঢ়ড়ৎঃ শুনে খুব খুশি লেগেছে। আজ বাংলাদেশ মিশন থেকে আমাকে জানিয়েছে যে চবঃবৎ ইরষষ- নাকি এই প্রথমবার আমাদের সম্বন্ধে একটা ঋধাড়ৎধনষব ৎবঢ়ড়ৎঃ দিল। আরও শুনলাম ঞরসব-এ বেরিয়েছে। এসবের ঈড়ঢ়ু- গুলো জোগাড় করো। মওদুদকে বলো, উধরষু গরৎৎড়ৎ- এ কিছুদিন আগে আমার এলাকা সম্বন্ধে যে জবঢ়ড়ৎঃ বেরিয়েছিল, সেটা যেন অবশ্যই দেয় ও অন্য যাদের নিয়েছিল সেগুলোও দেয়।
তুমি শুনে খুশি হবে যে সেদিন জিওসির ঈড়হভবৎবহপব- এ জানলাম যে আমার ঈড়সঢ়ধহু শত্র“ ধ্বংস করার জবপড়ৎফ এ সমস্ত পশ্চিম রণাঙ্গনে প্রথম স্থানে ও আমার ঈড়সঢ়ধহু- কে ইবংঃ বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। আগামীকাল ওহফরধহ ভরষস ফরারংরড়হ আমার এলাকার গড়ারব তুলতে আসবে। এত সব হওয়া সত্ত্বেও ভীষণ একা লাগছে এবং কেমন যেন অসহ্য লাগছে। চযুংরপধষষু ্ গবহঃধষষু পড়সঢ়ষবঃবষু ঃরৎবফ সব সময়। সবকিছু ছেড়ে চলে আসতে ইচ্ছা করে, কিন্তু তখনই বিবেকের কাছে ভীষণ অপরাধী মনে হয়। আজ তো প্রায় ঋৎবহপয ষবধাব এ চলে আসছিলাম। সকালে গিয়ে বিকেলে চলে আসা, কিন্তু পরে আমার বিবেকের তাড়নায় ইচ্ছা ছাড়লাম।
………………………….
ইত্তু ও নাহীদ মনিরা কেমন আছে? ওদের আমার অনেক আদর দিয়ো। বরিশালের আর নতুন কোনো খবর পেলে কি না জানাবে। লোক পেলে আমি লিখব।
আশা করি তোমরা সবাই ভালো আছ। আব্বা-আম্মা ও আপাকে আমার সালাম দিয়ো। খোকন ও খুশনুদকে ভালোবাসা দিয়ো।
জলদি উত্তর দিয়ো।
ইতি
গুডু
চিঠি লেখক: মুক্তিযোদ্ধা কর্ণেল খন্দকার নাজমুল হুদা। সাব সেক্টর কমান্ডার। লিখেছেন বয়ড়া থেকে। তিনি ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর নিহত হন।
চিঠি প্রাপক: স্ত্রী নীলুফার দিল আফরোজ বানু। ১৯৭১ সালে তিনি কলকাতায় ছিলেন। তাঁর বর্তমানে ঠিকানা: ১৫৯ ইষ্টার্ন রোড, লেন ৩, নতুন ডিওএইচএস, মহাখালী, ঢাকা।
চিঠিটি পাঠিয়েছেন: নীলুফার দিল আফরোজ বানু।
৪টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
ঝালকাঠি,মিলিটারি, ক্যান্টনমেন্ট
২৪/০৭/১৯৭১, বাংলা ৬ শ্রাবণ, ১৩৭৮
স্নেহের ফিরোজা, ——– চিঠিতে বুঝা যায় , মৃত্যুর আগে লেখা এই চিঠি।
এসব পড়লে খারাপ লাগে খুব।
কৃতজ্ঞতা পোস্টের জন্য।
শিশির কনা
এখন বুঝতে পারছি ১৯৭১ এর মুক্তিযোদ্ধাদের আবেগ । ধন্যবাদ এমন চিঠি প্রকাশ করার জন্য।
এই মেঘ এই রোদ্দুর
শরীরের লোম কাটা দিয়ে উঠে এসব পড়লে
জবরুল আলম সুমন
কৃতজ্ঞতায় আবব্ধ হলাম আরো এক বার। গুরুত্বপূর্ণ এই পোষ্টের জন্য কোন ধন্যবাদই যথেষ্ট নয়। শুভ কামনা রইলো।