রঙধনু আকাশ (৫ম পর্ব)

ইঞ্জা ৭ জুলাই ২০২০, মঙ্গলবার, ০৯:১৯:৩৯অপরাহ্ন গল্প ২৮ মন্তব্য

পরিশ্রান্ত রুদ্র  সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে ড্রয়িংরুমে বসলে ওর মা এবং ভাবী পাশে এসে বসেছেন, কাজের লোক পানি দিয়ে গেলে রুদ্র বললো, আমাকে কফি দাও।

উদ্বীগ্ন মা ভাবীর দিকে তাকিয়ে রুদ্র হেসে দিয়ে বললো, আমি জানি তোমরাও টেনশন করছো, ভাবী ভাইয়ার আজ সিটি স্ক্যান করেছো?

হাঁ, ডাক্তারকে দেখিয়ে মেডিসিনও নিয়ে এসেছি।

ডাক্তার ফাইন্ডিংস কি দিলো?

তোমার ভাইয়া ছোটো খাটো স্ট্রোক করেছিলো, হাল্কা ধরণের ব্লাড ক্লট দেখা গেছে, যার কারণেই এই সমস্যা।

কি বলছো ভাবী।

তেমন অসুবিধা নেই, ধীরে হলেও তোমার ভাইয়া ঠিক হয়ে যাবে। 

কতদিন লাগতে পারে?

ডাক্তার বললো, সময় নেবে।

আজ ব্যাংকে গেলি বাবা, উদ্বীগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলেন রুদ্রর মা।

মম শুকরিয়া আল্লাহর কাছে, উনি বড়ই মেহেরবান, আজ কি হয়েছে জানো, আমি যখন বেরুচ্ছিলাম তখন এবি ব্যাংকের এমডি সাহেব ফোন করেছিলেন, এবং উনি এসেছিলেন আমাদের অফিসে।

তাই, তারপর কি হলো?

রুদ্র সব খুলে বললো, এমডি সাহেব কি কি হেল্প করবেন, সব খুলে বললো। 

 

তাহলে পঞ্চাশ কোটি দিচ্ছিস।

হাঁ মা।

যাক কিছুটা নিশ্চিন্ত হলাম, এইবার তুই আমাদের সব ব্যবসা গুছিয়ে নে।

জ্বি মম।

আমি আর রেনু মিলে কিছু সিদ্ধান্ত নিলাম আজ।

কি সিদ্ধান্ত মম?

এখন থেকে তুই এমডি হিসাবে গ্রুপটা চালাবি।

না মম, ওতো ভাইয়ার, আমি যা আছি তা ঠিক আছে।

না বাবা, নীল তো অসুস্থ, ও সুস্থ হয়ে উঠলে তখন না হয় ওকে সিইওর পদ সামলাবে।

সরি মম, এইটা ঠিক হবেনা, এই গ্রুপ চালানোর অভিজ্ঞতা ভাইয়ার বেশি, তোমরা এইটি করোনা মম।

রুদ্র তোমার ভাইয়া তো আগে সুস্থ হোক, আপাতত তুমিই হচ্ছো গ্রুপ এমডি, আগামীকাল সেক্রেটারি সাহেব এসে সকল ডকুমেন্টস করে স্টক এক্সচেঞ্জে জমা করে আসবে, এর বিপরীতে তুমি আর না বলবেনা, রেনু বললো।

কাজের ছেলে এসে কফি আর বিস্কিট দিয়ে গেলো।

চাচ্চু চিৎকার শুনে রুদ্র ফিরে তাকালো, দেখলো সিঁড়ি ধরে ধরে নিচে নামছে রুহি সাথে ওর খালা। 

রুদ্র তাড়াতাড়ি কোটের পকেট থেকে চকলেটের প্যাকেটটা বের করে নিলো দেখে রেনু বলে উঠলো, মেয়েটার সব দাঁত যাবে।

কেন ও চকলেট খাওয়ার পর দাঁত ব্রাশ করবে তুমি, বলেই মুখ ভেংচালো রুদ্র। 

রুহি নিচে এসে দৌঁড়ে আসতে লাগলো দেখে রুদ্র উঠে গিয়ে ওকে কোলে তুলে নিয়ে চুমু খেয়ে বললো, আমার বুড়ী কি করছিলো?

কি তরবো, তোমার জন্য ওয়েত (ওয়েট) কচ্চিলাম।

ওমারে, বলেই অনিক রুদ্র রুহির দুই গালে চকাম চকাম করে চুমু খেলো।

 

কিছু সময় রুহিকে নিয় খেললো রুদ্র, এরপর রেনুর কাছে দিয়ে নিজে গেলো ফ্রেস হতে, শাওয়ার শেষে ড্রেস আপ করে নিচে নেমে এসে রুহিকে নিয়ে গার্ডেনে গেলো।

রুহি কোল থেকে নেমে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছে, রুদ্র বাগান বিলাসের পাশে রাখা দোলনায় বসে রুহিকে খেয়াল রাখছে।

রুদ্র খেয়াল করলো নীলকে নিয়ে রিয়া আসছে, রুদ্র এগিয়ে গিয়ে ভাইকে ধরে বললো, ভাইয়া আসো এইখানে বসি, কেমন লাগছে তোমার?

আমার কি হয়েছে, আমি একদম ফিট, বাবা বলেছে আমাকে তোর F5 টির মতো আমাকেও একটা নিতে, হে হে হে…

আমারটা নাও, ওটা থাকতে আরেকটা কেন?

না ওটা তোর।

আমার যা আছে সবই তোমার ভাইয়া।

না না রেনু বকা দেবে, আমি নতুন নেবো।

ঠিক আছে নিও, তা মোটরসাইকেল তুমি তো চালাতে জানোনা, কিভাবে চালাবে।

না না ঐ রিয়া ধরে রাখবে আর আমি চালাবো, ধুর ভালো লাগছেনা, আমি মমের কাছে যাচ্ছি, বলেই হন হন করে ভিতরে চলে গেলো।

বেয়াইন বসেন। 

হি হি বেয়াইন বসেন, আমি আপনার অনেক ছোটো।

তাতে কি? 

আপনি আমাকে তুমি করেই বলবেন, আর বেয়াইন ডাক আমার পছন্দ না, রিয়া ডাকলেই হবে। 

তাই।

হুম। 

তা আপনার, সরি তুমি কি এখনো পড়াশুনা করছো?

হাঁ, কম্পিউটার সাইন্স শেষ করলাম, এখন এমএসসিতে ভর্তি হবো৷ 

বাহ। 

 

আপনিও তো অনেক পড়াশুনা করেছেন, দেশে ফিরে এলেন কেন, ওখানেই সেটেল করতে পারতেন?

হুম তা পারতাম, কিন্তু ওখানে আমার ভালো লাগেনা, এদেশটা আমাকে ভীষণ টানে।

আপনি নাকি কারাতে পারেন?

কে বলেছে৷ ভাবী?

হাঁ আপা বলেছে, শুনলাম আপনি ওরেঞ্জ বেল্ট হোল্ডার।

হুম।

আমাকে শেখান না, আমার খুব ইচ্ছা শেখার।

তাই, তাহলে কারাতে ক্লাস জয়েন করে শিখছো না কেন?

বাবা না করেছে, বলেছে ওসব মেয়েদেরকে মানায় না। 

না এইটা ঠিক কথা না, এ নিজের আত্মরক্ষার জন্য হলেও ছোট বড়, নারী পুরুষ সবার শেখা উচিত। 

আমিও তা বলি, কিন্তু বাবার জন্য পারিনা। 

হুম আচ্ছা চলো, নিশ্চয় মম এখন ডিনার রেডি করছে।

দুজনেই এক সাথে পা বাড়ালো, কিন্তু রুদ্র হটাৎ দাঁড়িয়ে গেলো যেখানে ওর বাবাকে শেষ গোসল দেওয়া হয়েছে সেখানে, জায়গাটিতে বড়ইবগাছের ঢাল দেয়া আছে, একটা হারিকেন টিমটিম করে জ্বলছে। 

আপনার বাবা খুব ভালো মানুষ ছিলেন, রিয়া বললো।

হাঁ বলে রুদ্র এগুলো, গাড়ি বারান্দায় বেশ কিছু ছিন্নমূলকে ভাত দিয়েছে ওর মা, প্রায় সময়ই উনি এমন করে খাওয়ান এদেরকে, যাওয়ার সময় কিছু টাকাও দেন।

রুদ্র ভিতরে এসে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে পড়লো, রুহি এসে কোলে উঠে খেলতে শুরু করলো, চাচ্চু আব্বি আমি তোমার ছাতে ঘুমাবু।

আচ্ছা মা ঘুমাইও।

রাতে মাম নিয়ে যায়।

আচ্ছা আমি না করবো, ঠিক আছে?

রুহি মাথা নেড়ে সায় দিলো। 

 

ডিনার শেষে সবাই এসে বসলো ডলার ড্রয়িংরুমে, সুমি টিভিতে নাটক দেখছিলো, সাউন্ড ছোটো করে বললো, ভাইয়া এখন তো বিভিন্ন সমস্যা চলছে, তাই ভাবছিলাম আগামী মাসে আমার আমেরিকা যাওয়ার প্রোগ্রামটা পোস্টপন করবো। 

কেন এই কথা বলছিস, তোর ইউনিভার্সিটির সব ডিউস দিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাবিনা কেন?

ভাইয়া এক বছরের পেমেন্ট সব দেওয়া হয়েছে কিন্তু এরপর কি হবে, এদিকে আমাদের মাথায় লোনের বোজা।

তুই এইসব চিন্তা করিস না, ওসব আমরা বুঝবো, তুই যা পড়ালেখা শেষ করে নিজের পায়ে নিজে দাঁড়া।

রুদ্র তোর বিয়েটাও ভেঙ্গে গেলো, এ নিয়ে কিছু চিন্তা করেছিস, রুদ্রর মা জিজ্ঞেস করলেন।

মম ওসব নিয়ে আমি চিন্তা করছিনা এখন, আগে সব কিছু সামলে নিই, তারপর চিন্তা করবো।

তুই সামলা, আমরা এদিকে মেয়ে খুঁজে বের করি।

মম তুমিও না বেশি বেশি করো, বললাম তো এখন কোনো বিয়ে নয়, আমি উঠছি ঘুমাবো, মম তুমি আমার সাথে শুবে।

না বাবা, আমি সুমিকে নিয়েই ঘুমাবো, তুই যা।

আচ্ছা মম, গুড নাইট।

 

পরদিন সকালে যথারীতি রুদ্র অফিসের কাজে ব্যস্ত, এ সময় জিএম সাহেব ইন্টারকমে কল দিয়ে বললো, স্যার একটা লোক পেয়েছি যে টেক্সটাইল ইউনিট চালাতে দক্ষ।

কোথা থেকে পেয়েছেন?

স্যার আজই এসেছে, একটু কথা বলে দেখুন।

ঠিক আছে, আপনি সহ আসেন। 

কিছু সময় পর দরজায় নক হলে রুদ্র কাম ইন বলে সামনের ফাইল গুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলো। 

সালামালেকুম।

ওয়া আলাইকুম আসসালাম বলেই চোখ তুলে তাকালো, এরপর আবার কাজে ডুবে যেতে গিয়ে থমকে গেলো, আবার চোখ তুলে দেখেই অবাক হয়ে বললো, আরে চিনু তুই কোথা থেকে?

স্যার আপনি উনাকে চিনেন, উনিই জবের জন্য এসেছেন। 

রুদ্র উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো, আমাকে চিনেছিস, আমি রুদ্র।

না চিনলে কেমনে চলবে দোস্তো, কেমন আছিস।

আমি ভালো, তোর খবর বল, ভাবী বাচ্চারা সবাই ভালো?

লতিফ সাহেব আপনি যান, আমি দেখছি।

জ্বি স্যার, বলেই জিএম সাহেব রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। 

 

কি খাবি বন্ধু, কফি দিতে বলি, বলেই ইন্টারকমে কফি আর বিস্কিট দিতে বলে ফিরে তাকালো, বল এখন ভাবী বাচ্চারা কেমন আছে।

শুন্য চোখে চিনু ওরফে চিং সু প্রু বললো, বন্ধু আমরা কেউই ভালো নেই?

মানে কি?

গত ২০২০ সালের মহামারীর সময় আমি আমার জব হারাই, হাতে যা ছিলো তা দিয়েই এতোদিন চলে এসেছি, আর পারছিনা বন্ধু, চোখ ছলছল করে উঠলো চিনুর। 

বলিস কি, শুনেছিলাম তুই খুব ভালো স্যালারি পাস, এক ফরেন বায়িং কোম্পানির এশিয়ার এরিয়া ইনচার্জ ছিলি।

তা এখন অতীত বন্ধু,এখন জবলেস হয়ে আমি প্রায় শেষ, হয়তো বড়জোর আগামী ছয় মাস চলতে পারবো, তারপর আই এম নাথিং।

পিয়ন এসে কফি দিয়ে গেলে দুজনই কফিতে চুমুক দিলো।

রুদ্র চিন্তিত স্বরে বললো, বন্ধু আমার কাছে দুইটা টেক্সটাইল মিল আছে, সমস্যা হলো সাপ্লায়ার আমাদের সাথে বেঈমানী করে সেকেন্ড হ্যান্ড মেসিনারিজ পাঠিয়েছে, ফলশ্রুতিতে পুরা দুই ফ্যাক্টরিই বসা আছে।

তুই কি করতে চাইছিস, চিনু জিজ্ঞেস করলো।

তুই কি পারবি এই দুইটাকে চালিয়ে প্রফিট বের করতে?

যদি প্রপার সাপোর্ট পাই, জনবল পাই, তাহলে নিশ্চয় পারবো।

সব আমি দেবো, কিন্তু যা করবি কমের মধ্যে বেশি বেনেফিট আনবি, আমি জানি এইটার জন্য ইউ আর দ্যা  বেস্ট, এর জন্য আপাতত আমি বেশি তোকে দিতে পারবোনা, কিন্তু প্রফিট এনে দে আমাকে, তার ১০% তুই নিয়ে যাবি, চলবে তো?

অনেক ধন্যবাদ বন্ধু, সত্যি তুই আমাকে বাঁচালি।

না বন্ধু, আমাদের দুজনেরই এখন বাঁচা মরার প্রশ্ন, রুদ্র বললো। 

 

……. চলবে।

ছবিঃ গুগল।

৯১৭জন ৭৬৪জন
0 Shares

২৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ