ফোন ব্যবহার করছেন অথচ রং নাম্বার থেকে কল আসেনি এমন কোন ব্যবহারকারী হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবেনা। রং নাম্বার থেকে পরিচয় অতঃপর প্রেম পর্ব সেরে ঘর সংসার করা জুটির অভাব নেই আমাদের দেশে। ২০০৫ থেকে নিয়মিত কিছু মানুষ আমাকে ফোন করে রঙ মিস্ত্রী বেলালের খোঁজ করতো। কারণ বেলাল নামের কোন এক রঙ মিস্ত্রী তার ভিজিটিং কার্ডে ভুলক্রমে আমার নাম্বারটা ছাপিয়ে দেয়। কিন্তু সে আর নাম্বারটা সংশোধন না করেই মানুষজনকে কার্ড বিতরণ করতে থাকে, ফলে প্রায়শই তার ঝামেলা আমাকে সামাল দিতে দিতো।

রং নাম্বার থেকে ফোন এসে সবচে মজার কান্ডটি ঘটেছে বছর তিন আগে, মধ্য বয়স্ক একজন মহিলা আমাকে ফোন করেছেন কিন্তু আমাকে হ্যালো বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি এক নাগাড়ে বলেই চলেছেন… “বাবাজি, মেয়েটা আমার খুবই অবুঝ কতই বা আর বয়স এখনো ভালো মন্দ বুঝতে শেখেনি। আমি জানি তার এভাবে রাগ করে চলে আসাটা ঠিক হয়নি কিন্তু আগেই ত বললাম ও একটা অবুঝ, ওর যদি কান্ড জ্ঞান থাকতো তাহলে কি এভাবে একটা দুধের বাচ্চা রেখে ফেলে আসতো ? বাবাজি আপনি কিছু মনে করবেন না। শাকিল বাড়িতে নেই ও ঢাকায় গেছে এ্যাম্বেসিতে কাগজ পত্র জমা দিতে ও যদি বাড়িতে থাকতো তাহলে ওকে দিয়েই আমি নাসিমা-কে পাঠিয়ে দিতাম। তোমার শ্বশুড়ও খুব অসুস্থ্য নইলে তিনিই নাসিমা’কে পৌছে দিয়ে আসতেন। তাই রাগ গোস্যা না করে কাল আপনিই চলে এস নাসিমা’কে নিয়ে যাবেন” এই পর্যায়ে আমি ওই ভদ্র মহিলাকে থামালাম বললাম আপনি ভুল নাম্বারে ফোন করেছেন আমি আপনার মেয়ের জামাই নই, কিন্তু তিনি আমার কথা শুনতে নারাজ, একা একা বলেই চলেছেন। এক পর্যায়ে আমি লাইনটা কেটে দিই, একটু পর আবারো কল আসে ওই নাম্বার থেকে। আমি ধরলাম, যথারীতি হ্যালো বলার আগেই মহিলার কন্ঠ “বাবা দয়া করে আর রাগ করবেন না, মানুষ ভুল করে আবার মানুষই তার সংশোধন করে ও একটা ভুল করে ফেললো তাই বলে আপনি কি তাকে সংশোধন করে দিতে পারেন না ? ঝগড়া ঝাটি আপনারা করেছেন কিন্তু মাঝ পথে বাচ্চাটা কষ্ট পাচ্ছে, অন্তত বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে ওকে ক্ষমা করে দিন” আমি আবারো মহিলাটিকে থামালাম বললাম আন্টি আপনি আসলে ভুল নাম্বারে ফোন করেছেন আপনি যাকে ভেবে ফোন করেছেন আমি সেই জন না, তিনি আবারো আমাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে নানান কথা বলতে শুরু করেছেন। আমি বাধ্য হয়ে আবারো লাইনটি কেটে দিই, কিন্তু মহিলাটি নাছোড় বান্দা আবারো কল করেন আমি আর রিসিভ করিনি, এরপর তিনি আরোও কয়েক বার কল দিয়েছিলেন কিন্তু আমি কল রিসিভ না করে কয়েক ঘন্টার জন্য ফোনটাই অফ করে দিই।

আরো একবার অন্য একটা রং নাম্বার থেকে ফোন এসে আমার পারিবারিক মান-সম্মানের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিলো। আমি তখন আমার ফোনটা আমার বেড রুমে রেখে কোন একটা জিনিষ কিনতে পাশের দোকানে গেছি ততক্ষণে আমার মোবাইলে একের পর কল আসতে শুরু করে, আমার ফোন সাধারণত অন্য কেউ রিসিভ করেনা। কিন্তু এক নাগাড়ে ফোন বাজতে দেখে আমার ছোট ভাই কলটি রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে অভিমান ভরা কন্ঠে বলতে লাগলো “তুমি এখনো আসছো না কেন ? সেই কখন থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি, বাংলালিংকটা অফ করে রাখছো কেন ? ভেবেছিলাম আজ সারাদিন তোমাকে নিয়ে রিক্সায় ঘুরবো কিন্তু সারাটা দিন ত তোমার অপেক্ষাতেই চলে যাচ্ছে আর কত অপেক্ষা করাবে ?” শেষ লাইনটিই আমার ছোট ভাইয়ের জন্য যথেষ্ট ছিলো ওই অভিমানী মেয়েটার সাথে আমার কি সম্পর্ক তার নির্ণয় করতে। “ভাইয়া বাইরে গেছে আপনি পাঁচ মিনিট পরে তাকে ফোন দিন” আমার ছোট ভাইয়ের কথা শেষ করতে না করতেই অপর প্রান্ত থেকে কলটি কেটে দেয়। আমি ঘরে ফিরে এসেছি, কিন্তু কোথাও বের হচ্ছিনা দেখে একটু পর পর আমার ছোট ভাইটা আমার ঘরের আশ পাশে সন্দেহ জনক ভাবে ঘুর ঘুর করতে লাগলো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম কিরে কি হয়েছে ? সে আমাকে কিছু না বলেই চলে গেলো। আমি সারাদিন বাসাতেই ছিলাম কোত্থাও আর বের হইনি। সন্ধার দিকে সাধারণত আমি আড্ডা দিতে বের হই বন্ধুদের সাথে, তেমনি সেদিন আড্ডা শেষ করে ঘরে ফিরেই দেখি আমার জন্য পারিবারিক পার্লামেন্ট বসেছে, সবাই গোল হয়ে ড্রয়িং রুমে ফ্লোরে বসে আছে। স্পিকারের দায়িত্বে আছেন আমার মা, বাকিরা সবাই আমার বিরোধী দল। অবশ্য এই সংসদে আমার বাবা আর বড় ভাই অনুপস্থিত। আমি বাসায় ফিরতেই মা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন কিরে মেয়েটা কে, বাড়ি কোথায় ? আমি তাৎক্ষনিক ভাবে কিছু বুঝতে না পেরে পাল্টা প্রশ্ন করলাম কোন মেয়েটা ? অন্য সবাই তখন চোখ ট্যারা করে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে মা তখন গলার স্বর কিছুটা বিকৃত করে বললেন আর ভান করতে হবেনা আমরা যা জানার জেনে গেছি, এবার চট করে বল কে ঐ মেয়ে ? আমি অনেকটা অসহায়ের মতো বললাম মা তোমরা কি জানতে চাচ্ছো আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। আমার ছোট ভাইটা তখন বলে উঠলো দুপুরে তুমি যখন বাইরে ছিলে তখন তোমার লাভার ফোন করেছিলো আমি ফোনটা রিসিভ করি। এবং মেয়েটি কি বলেছিলো তাও ভেংচি কেটে বললো। আমি আঁৎকে উঠি, আমার লাভার !! বলে কি ওরা… আমি সাথে সাথে আমার ফোনের কল লিষ্ট বের করে দেখলাম অপরিত একটা নাম্বার থেকে তখন আমার মোবাইলে ফোন এসেছিলো। কিন্তু ওই মেয়েটি আমাকে পরে আর ফোন করেনি তাই বিষয়টা আমার জানা ছিলো না। আমি বললাম এটা একটা রং নাম্বার ছিলো কিন্তু কেউ বিশ্বাস করতে চাচ্ছেনা দেখে আমি লাউড স্পিকার অন করে ওই নাম্বারে কল ব্যাক করলাম। ফোনটা রিসিভ করতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম এই নাম্বার থেকে দুপুরে আমার মোবাইলে একটা কল এসেছিলো সেটা কি আপনি করেছিলেন ? তখনি ওই মেয়েটা বললো সরি ভাইয়া আসলে একটা ডিজিট ভুল করে ফেলায় আপনার নাম্বারে চলে গিয়েছিলো আই এ্যাম এক্সট্রিমলি সরি ফর দ্যাট। আমি তখনি আচ্ছা ঠিক আছে বলে ফোনটা কেটে দিলাম। কিন্তু তারপরও কাউকে বিশ্বাস করানো যাচ্ছে না, সবাই ভাবছে এটা আমাদের পরিকল্পিত। বেশ কিছু দিন সবার সন্দেহের তীর আমার দিকে ছিলো, আমার কোন ফোন আসলেই দরজার ওপাশে গোয়েন্দাদের আনা গোনা টের পেতাম আমি ফোনটা ছেড়ে দিলে তারা পরাজিত সৈনিকের বেশে ফিরে যেতো এবং একটা সময় তারা নিজেরাই বুঝতে পারলো যে আসলেই এটা একটা রং নাম্বার থেকে ফোন এসেছিলো।

রং নাম্বার থেকে ফোন আসার বিব্রতকর ঘটনা এই দুই তিন ঘটনায় সীমাবদ্ধ নয়। সব ঘটনা মনে নেই তারপরও যেগুলো মনে আছে সেগুলো একটা একটা করে বলতে গেলে এক টানা এক সপ্তাহ লাগবে। যাপিত জীবনের এইসব খন্ড খন্ড বিব্রতকর ঘটনা গুলো আড়ালেই থাক, এবার আমি অপেক্ষায় আছি একটা কাঙ্ক্ষিত রং নাম্বার থেকে ফোন এসে আমাকে আনন্দে ভাসিয়ে দিবে বলে। আমি প্রায়ই ভাবি কোন এক ভোরে আমার ঘুম ভাংবে একটা রং নাম্বার থেকে ফোন এসে। ফোনের অপর প্রান্তে যিনি থাকবেন তিনি স্বয়ং আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি তার মন্ত্রী সভার বিশ্বস্থ কোন এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর ফোনে ফোন করেছেন কিন্তু নাম্বার ভুল হয়ে যাওয়ায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কলটা আমার ফোনে চলে এলো। আমি ফোনটা রিসিভ করেছি কিন্তু আমাকে হ্যালো বলার সুযোগ না দিয়েই তিনি বলতে শুরু করলেন… বয়স ত অনেক হলো আর ক’দিনই বা বাঁচবো, এবার সত্যিকার অর্থেই দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য বসবাস যোগ্য একটা দেশ রেখে যেতে চাই। এমন একটি দেশ গড়তে চাই যে দেশে কোন রকমের দূর্নীতি থাকবেনা, যেসব দূর্নীতিবাজ লোক আছে তাদেরকে ধরে ধরে অপরাধ অনুসারে দৃষ্টান্তমূলক সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, বোমাবাজি, গুম, ইভ টিজিং, নারী নির্যাতন, ঘুষের লেনদেন, মারা-মারি, জ্বালাও-পোড়াও, অবরোধ আন্দোলন কোন কিছুই থাকবে না। শিক্ষাঙ্গন থাকবে সম্পুর্ণ সন্ত্রাস, রাজনীতি ও সেশন জট মুক্ত, ছাত্র ও শিক্ষকদের জন্য রাজনীতি থাকবে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য থাকবে সাধারণ মানুষের ক্রয়-ক্ষমতার মধ্যে, যাতে কেউ আর অনাহারে অর্ধাহারে না থাকে। দেশে কোন বিদ্যুৎ ঘাটতি থাকবে না, থাকবেনা কোন লোডশেডিং নামক যন্ত্রণা। পুলিশের আচরণ থাকবে মার্জিত, তারা যেন সত্যিকার অর্থেই জনগণের বন্ধু হয়ে জনগণের পাশে থাকে। বিচার ব্যবস্থা থাকবে সম্পূর্ণ স্বাধীন, যেকোন ধরনের মামলা সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি হবে। শিশু শ্রম থাকবেনা, উন্নত বিশ্বের মতোই শিশুদের মৌলিক চাহিদার সবটুকুই সরকার বহন করবে। দেশে কোন বেকার থাকবেনা, শিক্ষিত, আধা শিক্ষিত ও অশিক্ষিত বেকারদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয়া হবে। দেশের কোথাও ভাঙ্গা-চোরা বা চলাচলের অনুপোযোগী কোন রাস্তা ঘাট থাকবেনা, থাকবেনা রাস্তায় কোন জ্যাম… আমি শুনেই যাচ্ছি, শুনতে শুনতে আনন্দে আমার চোখে পানি চলে এসেছে। অপর প্রান্তে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আরোও অনেক কিছুই বলে যাচ্ছেন, বলতে বলতে হঠাৎ একসময় লাইনটা কেটে যায় কারণ ততক্ষণে আমার মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে গেছে…

জবরুল আলম সুমন
সিলেটে।
১১ই মে ২০১২ খৃষ্টাব্দ।

১৫১১জন ১৫১১জন
0 Shares

৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ