বাহিরে এখনও বিকেলের আলো কিন্তু ঘরের ভেতরে অন্ধকার গলে গলে পড়ছে। দমবন্ধ করা অন্ধকার। এমন অন্ধকার দেখলেই আমার ভীষন ভয় করে। আমার ভিতরের দৈত্যগুলো বের হয়ে আসতে চায়। জীবনের বিভিন্ন সময়ে আমি যে দৈত্যগুলোর মুখোমুখি হয়েছি আর সমাজ আর পরিবারের কারনে যাদের মুখোশ খুলতে পারিনি কিন্তু বোতলে ভরে ছিপি দিয়ে রেখেছি নিজের ভিতরের সেই সব দৈত্য।
মনে পড়ছে ছোট বেলার সেই নতুন দাদুর সর্পিল হাত। অন্ধকারের সুযোগে আমার শরীরে ঘুরে বেড়িয়েছে। বাবার বয়সী কিন্তু সম্পর্কে বাবার দূর সম্পর্কের চাচা, তাই আমাদের দাদু। বাসায় সবাই জানত আমাকে ভীষন আদর করেন নতুন দাদু, আমাকে বেড়াতে নিয়ে যান। কিন্তু কেউ জানত না বেড়ানটা আমার কাছে কতটা বিভীষিকার ছিল। অন্ধকারে অথবা একলা আমার সামনে নতুন দাদুর শরীর হয়ে যেত কাঁটাওয়ালা গাছ। এমন ভাবে জড়িয়ে ধরেতেন, মনে হত সারা শরীরে আমার কাটা বিঁধছে। ভীষন অসস্তি হত, ভীধন খারাপ লাগা। কাউকে বলে বোঝানো যেত না, এই খারাপ লাগাটা কি। মা’কে বলেছিলাম অই লোকটা এত পচা কেন??বলেছিলাম আর কখনও বেড়াতে যাব না লোকটার সাথে। মা বলেছিলেন “ ছিঃ গুরুজনদের নিয়ে এভাবে বলতে নেই, দেখনা তোমাকে কত্ত আদর করেন”। আচ্ছা মা কেন তার ছোট্ট মেয়েটিকে বুঝতে পারল না!!!
স্কুলের দিনগুলোতে যখন গুচ্ছ গুছ সাদা মেঘের মত, সাদা পোশাক পরে ছেলেরা উদ্দাম হাওয়ার মত স্কুলে যেত, আমি যেতাম ভয়ে জড়সড় হয়ে মাটির দিকে চোখ রেখে। জানিই চোখ তুললেই দেখব রাস্তার মোড়ে দাড়ান, পাড়ার সেই ছেলেটা, বিশ্রী ইঙ্গিত করছে আমার শরীরের দিকে। প্রানপনে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্ঠা করতাম সেই দৃষ্টি, কিন্তু এড়াতে পারিনি শব্দ। নোংরা ভাষায় ধর্ষিত হয়েছি প্রতিদিন। নোংরা, অশ্লীল শব্দগুলো আমার ঝকঝকে কিশোরী আকাশে কি তীব্র কালো রঙ লাগিয়ে দিয়েছিল!! আমার প্রজাপতির ডানা গুলো ভেঙ্গে যাচ্ছিলো ক্রমাগত… প্রতিদিন একটু একটু করে। আমি আবারও বুঝতে পারছিলাম, আমি মেয়ে। প্রতিদিনের জীবনের আনন্দ, প্রজাপতি, মেঘ , প্রতিদিনের রঙ মেখে উচ্ছল দিন কাটানো এই সমাজে মেয়েদের জন্য সম্ভব না। মেয়েদের প্রতি মুহুরতে শিখতে হবে বেচে থাকার কৌশল, নোংরা চোখ এড়িয়ে, বাজে শব্দ, কামুক হাত এড়িয়ে চলার কৌশল। সেই প্রথম ভীষন অভিমান হয়েছিল, মেয়ে হয়ে জন্মানোর জন্য।
তারপর একটু বড়, পাড়ার স্কুল ছেড়ে দুরের কলেজ। আবার সেই যাত্রাপথে নানারকম ইশারা, ইঙ্গিত, হাত, শব্দকে এড়িয়ে যাবার কৌশল। মনে পড়ছে কলেজ থেকে ফেরার পথে বাসে গায়ে পুরুষাংগ ঠেকিয়ে বিকৃত মজা পাওয়া সেই দৈত্যটার কথা। তখন আমি একটু প্রতিবাদী। একটু একটু বুঝতে পারছি মেয়ে জন্ম নয়, অভিশপ্ত এই সমাজ। প্রয়োজন প্রতিবাদের, প্র্যোজন মুখ খোলার। তাই প্রতিবাদ করেছিলাম, স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলাম আপনার পুরুষাংগটা গায়ে লাগছে, একটু সরে দাড়ান। পুরো বাস জুড়ে আমার বিরুদ্ধে ছিছিক্কার উঠে গেল। এমন ভাষায় কথা বলতে আছে !! যেন লোকটি কোন অপরাধ করেনি, কিন্তু আমার স্পষ্ট উচ্চারনটি ভীষন অপরাধের। পিছনে ফিরে দেখছি সেই লোকটি বিকৃত মজায় হাসছে। এই দেশে এই সমাজে যৌন হয়রানি বৈধ, গ্রহণযোগ্য কিন্তু মুখে আনা পাপ। এর বিরুদ্ধে মুখ খুললে মেয়েটি অভদ্র কিংবা উচ্ছনে যাওয়া বখা মেয়ে।
যখনি উচ্ছল আনন্দে মেতে উঠতে চেয়েছি, যেকোন জাতীয় উৎসবে বা জাতীয় প্রাপ্তিতে যখনি নেচে উঠেছে মন, সার্বজনীন আনন্দে আংশ নিতে চেয়েছি তখনি আমাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে “তুমি মেয়ে”। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে বসন্ত উৎসব, পহেলা বৈশাখ কিংবা খেলায় জিতে যাওয়ার পর আনন্দ মিছিল, সব খানেই সাম্লাতে হয়েছে সুযোগ সন্ধানী হাত কিংবা বাজে মন্তব্য। ভীশন কষ্ট হত, এইসব আনন্দে সমান অংশীদার হওয়ার অধিকার যেন আমার নেই।
কত কত জনের কথা বলব আমি।কত কত দানব চারপাশে কিলবিল করছে। কত জনকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারব আমি!!! কাকে বলব আমি অফিসের সেই পুরুষ সহকমীর কথা। কথায়, চিন্তায়, আচরনে যিনি দারুন প্রগতীশীল। নারী অধিকার কিংবা মানবাধিকারের প্রতিষ্ঠায় যার কন্ঠ অফিসে খুব সোচ্চার। সেই তিনিই ফিল্ড ট্যুরে একলা মহিলা সহকর্মীকে পেয়ে দারুন কামুক। পাশের মহিলা সহকর্মী তখন তার কাছে শুধুই একজন নারী কিংবা যৌন বস্তু, সমযোগ্যতার সহকর্মী নন। আর প্রতিবাদ মানেই মহিলা সহকর্মীর নামে অপবাদ কিংবা কর্মস্থলে হেনস্তা করা।
বিশ্রী ইঙ্গিত, ভীরের মধ্যে সুযোগ সন্ধানী হাত, কিংবা উৎসবের মধ্যে ঝাপিয়ে পড়া হায়েনার দল। কত জনের বুরুদ্ধে মুখ বুঝে থাকব?!! এভাবে কত কত দিন আমি মরে যাচ্ছি নিজের ভিতরে, মরে যচ্ছি প্রতিদিন। প্রতিদিনের অসস্মান, গ্লানি গিলে ফেলে বেচে থাকার চেষ্টা করছি আর মরে যাচ্ছি প্রতিদিন। কবে, কোথায়, কখন আমার দিনগুলি নিরাপদ হবে? কোন বয়সে পৌছুলে এই সমাজ আমাকে বলতে পারবে “না, মেয়ে তুমি এবার নিরাপদ, নির্বিঘ্নে উড়াতে পার তোমার ডানা, পাখা মেলুক তোমার স্বপ্নরা”
১৮টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
যতই শিক্ষিত আর প্রগতিশীল হইনা কেন আমাদের মধ্যে নারীকে সন্মান করার মানসিকতা নেই বললেই চলে।
সত্যি কথনে গুছানো প্রতিবাদী লেখাটি ভালো লাগলো।
লিখুন নিয়মিত এবং অন্যর লেখাও পড়ুন।
সোনেলায় স্বাগতম
শুভকামনা।
হিজবিজবিজ
ধন্যবাদ
অনিকেত নন্দিনী
আমাদের শিক্ষা, আমাদের প্রগতি, আমাদের সংস্কার, আমাদের সমাজ, আমাদের আত্মিক বোধ এসবের কোনটিই আমাদের শেখায়না নারীকে কী করে সম্মান দিতে হয়।
লেখায় লুকিয়ে থাকা ক্ষোভ দেখতে পাচ্ছি। এ ক্ষোভের চেহারা অনেক চেনা, এ ক্ষোভ আমাদের সবার। আমরা মেয়েরা সবাই কোনো না কোনোভাবে অন্তত একটিবারের জন্য হলেও এই বাজে অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাই। লেখায় প্রখর বাস্তবতাকে তুলে আনা হয়েছে।
সোনেলায় স্বাগতম। -{@
হিজবিজবিজ
ধন্যবাদ। সংবেদনশীল সমাজ এখনও অনেক দুরের পথ। হাতে হাত রেখে এগতে হবে সবাইকে।
প্রজন্ম ৭১
এই অভিশাপ থেকে আমরা যে কবে মুক্তি পাবো জানিনা।আপনি অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভাবে কথা গুলো উপস্থাপন করলেন। ধন্যবাদ আপনাকে।
হিজবিজবিজ
ধন্যবাদ পড়ার জন্য এবং সাহস যোগানোর জন্য
সিকদার
আপনার লেখায় যাদের রুপ প্রকাশ করেছেন ওরা পুরুষ নয় । আসল পুরুষ কখনও কাপুরুষ হয় না। ওদের জন্য ঘৃনা ঘৃনা ঘৃনা ………।।
হিজবিজবিজ
পুরুষ বা কাপুরুষ যাই বলেন না কেন সমাজে এরাই এখনও সংখ্যায় বেশি।
খেয়ালী মেয়ে
এই সমাজ কখনোই মেয়েদেরকে নিরাপত্তা দিতে পারবে না..
হিজবিজবিজ
চাই সমমনাদের সম্মিলিত উদ্যোগ।
সাথে থাকুন, সাথে রাখুন …
নীলাঞ্জনা নীলা
আমি সেসব মেয়েদেরকে সবসময় বলি, ওসব কথাকে পিছে ফেলে রেখে সামনে এগিয়ে এসে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সেই মানুষকে সবার সামনে লাত্থি মারতে।
নিজের জন্য প্রতিবাদ করতে হয়। আমি করেছি, আমায় এসিড ছোঁড়ার হুমকি এসেছিলো, পারেনি। কারণ আমার নিরাপত্তা আমি নিজেই নিয়েছিলাম। অনেক কিছু জীবনে সামনে এসেছে, সবাই যখন ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেছে, আমি এগিয়ে এসেছি। খারাপ কাজের জন্য ভয়, ভালোর জন্য কখনোই না।
এই সিনেমাটা সকলের দেখা উচিৎ। অনলাইন থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। আশা করি ডিভিডি আকারে পাওয়া যাবে।
https://www.youtube.com/watch?v=COesFcvkXaE
হিজবিজবিজ
আপনার মত সাহসী মেয়ে প্রয়োজন সমাজে। কিন্তু দুরভাগ্যজনক ভাবে সমাজ এবং পরিবার ছোট থেকেই মেয়েদের সাহসের জায়গাটা সঙ্কুচিত করতে থাকে। শুরু থেকেই নানারকম “না” আর নিষেধের ঘেরাটোপের মধ্যে মেয়েটি ভিলে যায় নিজস্ব সত্তা। দরকার সাহস যোগানোর। দরকার তার ভিতরের “আমি”টাকে বের করে আনা। কে করবে সেই কাজ?? আমরা তো দুকলম লিখেই ভাবছি দায়িত্ব পালন শেষ।
মোঃ মজিবর রহমান
আপনার বাস্তব লেখা দারুন হউএছে।
এরকম অনেক বাস্যব কাহিনী আমি দেখেছি
যা সমাজে উভয়ের বিপরীতমুখী।
আপনাকে শুভেচ্ছা অবিরত।
হিজবিজবিজ
ধন্যবাদ
শুন্য শুন্যালয়
শিরোনামটাই অসাধারন হয়েছে। কুন্ঠা নারীদের এমনই যে, প্রকাশ করলে যেন নিজেরই অপমান হয়। কি আমাদের মানসিকতা!! একবার বাজারে ঘুরেই একটাকে চড় মেরেছিলাম, কেউ তার দিকে নয়, আমার দিকে হাসিহাসি মুখে তাকিয়ে ছিলো। কি ঘেন্না!!
আপনাকে আমার শ্রদ্ধা হিজবিজহিজ। সোনেলাকে সোনালী করে তুলুন। স্বাগতম -{@
হিজবিজবিজ
হ্যা সমস্যা এখানেই, মানসিকতায়…
ধন্যবাদ পড়ার জন্য ।
স্বপ্ন
বাস্তব কথা লিখলেন আপু।এ থেকে মুক্তি পাবার সম্ভাবনা খুব কম।আমাদের অবচেতন মন হয়ত এই ব্যবস্থাকেই সমর্থন করে।
হিজবিজবিজ আবার কেমন নাম? 🙂 আমি তো উচ্চারনই করতে পারছিনা।
হিজবিজবিজ
লেখা পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
সুকুমার রায়ের হ য ব র ল পড়ুন পেয়ে যাবেন কেমন নাম।। 😀