আচ্ছা বলেন তো আপনার পরিবারে বা আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে এবং আপনার পরিচিতদের মধ্যে গত ২০ বছরে যত শিশু জন্ম নিয়েছে তার কত শতাংশ নরমাল ডেলিভারি হয়েছে আর কত শতাংশ সিজারিয়ান ডেলিভারি হইছে???
আমি লাস্ট কবে নরমাল ডেলিভারির কথা শুনেছি মনে পড়ে না।
আমি নিশ্চিত যে বাংলাদেশের মত এত সিজারিয়ান পৃথিবীর আর কোন দেশে হয় না।
এর কারণ কী?
২০১৭ সালের একটা স্মৃতি শেয়ার করি- পড়েন-
একটি বৃষ্টি রাত ও তিনটি নবজাতকঃ
গতকাল রাতটা আমি ভুলবো না। অদ্ভুত এক রাত!
পাসপোর্ট নিয়ে পিজা পার্টি করে বালিগাও আসছি রাত ৯ টায়। বাসায় যাব এমন সময় আম্মুর ফোন-
– শিপু, দুলুনির জমজ পোলা হইছে
– হ জানি
– একটায় অসুস্থ হইয়া পরছে। ঢাকা নিতে হইবো। ওগো তো কেউ নাই। তুই একটু যা।
– উম্মম্মম্মম্মম…আইচ্ছা
প্রতিবেশি ফুপু ফাতেমার মেয়ে দুলুনি। সিজারিয়ানের মাধ্যমে জমজ ছেলে হইছে। জামাই সাভারে।কোন পুরুষলোক নাই ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার মত। ফতি ফুপু একদম সোজা সরল মহিলা। কোন হাসপাতালে যাবে, কারে কি বলবে কিছুই জানে না। সাথে অবশ্য মাসু আপা (নানি হয় আমার) আছে। দুইটা সদ্যজাত শিশু নিয়ে তাদের ঢাকার কোন হাসপাতালে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। এই দুই শিশুর সাথেই আরেকটা মেয়ে শিশুও জন্ম নিয়েছে। তার অবস্থা আরো খারাপ। আমি এক হাজার টাকায় সিঞ্জি ভাড়া করায় অই মেয়ে শিশুর বাবা বললো যে তিনি এম্বুলেন্স আনতেছে তাদের সাথেই যেতে। পৌনে দশটায় রওনা দেই বালিগাও থেকে। সাথে সম্রাট নামে এক ছোটভাইকে নিয়ে নেই। ঝুম বৃষ্টি। অই মেয়ে বাবুর সাথে তার বাবা আর খালা যাচ্ছে। আমি আর সম্রাট সামনে বসেছি। গাড়ি একটু চলতেই ফতি ফুপু ডাক দেয়- “শিপু, তুই পিছে আয়!” পিছনে গিয়ে তার কোলের বাচ্চাটাকে আমি কোলে নেই। আর উনি হড়হড় করে বমি করেন। এই বাচ্চাটাই অসুস্থ বেশি জমজদের মধ্যে। আরেক বাচ্চা মাসু আপার কোলে। মেয়ে বাবুটা তার খালার কোলে। আমার কোলের বাচ্চা আর মেয়ে বাচ্চাটা কমন নল দিয়ে অক্সিজেন নিচ্ছে। তাই আমি বেশি নড়তেও পারি না, নলে টান লাগে। ফতিফুপু বেহুশ হয়ে সিটে শোয়া। বাচ্চাটার খালা দোয়াদরুদ পড়ছে। সবাই গরমে অস্থির। সম্রাট সামনে বসে উইনশিল্ড মুছতেছে বারবার। আমার কোলের বাচ্চাটা নড়াচড়া করে খুব। মেয়ে বাচ্চাটা হঠাত স্থির হয়ে যায়, সারা শরির নীল! খালা হাউমাউ করে কেদে ওঠে- “ও জাকির! বাবু আর নাই! আমার মানিক……” মহিলা বিলাপ করা শুরু করে। ভদ্রমহিলা এক হাতেই বাচ্চাটাকে জড়িয়ে কোলে রেখেছে। তার আরেক হাত নাই। উনি কাঁদে, আমিও কাদি, কলেমা পড়তে থাকি!!!
কিন্তু শিশুটির তখনো প্রাণ আছে। এর মধ্যে মাসু আপা বমি শুরু করে!!! প্রথমে যাই পোস্তগোলা বসুন্ধরার আদ দ্বীন হসপিটালে। তারা ফিরিয়ে দেয় আমাদের। যাই মিডফোর্ডে ফিরিয়ে দেয়। তারপর যাই ঢাকা মেডিকেলে। ডাক্তার প্রথমে ভর্তি করতে চায়নি তাদের ইনকিউবেটর খালি নেই বলে। তাদের এপ্রোচে মনে হল তারা চাচ্ছে আমরা ক্লিনিকে যাই। এমন সময় দুলুনির জামাই হাজির হয়। আমি ভর্তি করিয়ে কাগজ সব বুঝিয়ে দিয়ে সম্রাটকে নিয়ে অই এম্বুলেন্সেই ব্যাক করি। ভাড়া ৪২০০/-। অই মেয়ের বাবা আমাকে অর্ধেক ভাড়া দিতে বলে। দেই। কিন্তু তার এই ছোটলোকি দেখে অবাক হয়েছি।
যাওয়ার পথেই এম্বুলেন্স থেকে কোন এক জায়গায় আমার স্যান্ডেল পরে যায়। খালি পায়েই হাটতে হয়েছে সম্রাটকে কারণ ওর স্যান্ডেল পরে আমি হেটেছি। পরে নাঃগঞ্জ এম্বুলেন্স থামিয়ে রাত ৩ টায় আমি আর সম্রাট তেহারি খাই। আমি খালি পায়ে। ৪ টায় টংগিবাড়ী নামিয়ে দেয় এম্বুলেন্স থেকে। দুজনে বসে থাকি। ফজরের আজানের পর হাটতে হাটতে সোনারং মোড়ে আসি। অনেক্ষন অপেক্ষার পর একটা সিঞ্জি পাই। বাসায় পৌছাই ৫ টায়। এক ঘুমে বিকাল তিনটা!!!
ফোন দিয়ে জানলাম মেয়ে বাবুটা মারা গেছে!!!
সপ্তাখানেকের মধ্যে জমজ দুজনও মারা যায়।
সিজারিয়ান ডেলিভারি পরবর্তী মা ও নবজাতক তুলনামূলক বেশি নাজুক থাকে। তাদের ঝুকিও বেশি থাকে। তাদের এক্সট্রা কেয়ার লাগে। কিন্তু এদেশের খুব কম হাসপাতাল ও ক্লিনিকেই ইনকিউবেটর বা NICU আছে। কিন্তু মাসাল্লাহ সবখানেই সিজার করার ব্যবস্থা আছে। এরপরে কী হবে সেই ব্যবস্থা কারো নাই।
আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে আমার কিছু কথা পরবর্তীতে পোস্ট করবো ব্লগে।
১৫টি মন্তব্য
সুপর্ণা ফাল্গুনী
অসংখ্য ধন্যবাদ খুব তাড়াতাড়ি আরেকটি সমসাময়িক বিষয়বস্তু তুলে ধরার জন্য। এই বিষয়টি সত্যিই খুব নাজুক। এদেশে এখন বলতে গেলে ৯৯% সিজারিয়ান বাচ্চা হচ্ছে। সবাই সবকিছু না জানলেও, বুঝতে না পারলেও সিজার এখন শহর থেকে গ্রামে সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে। পরবর্তী সমস্যা গুলো আরো গুরুতর যেটা যখন বুঝতে পারে তখন আর কিছুই করার থাকে না। সারাজীবন পস্তাতে হয়। আমার ডাক্তার বান্ধবী সেও একই সমস্যায় ভুগছে আর আফসোস করছে সিজার করার জন্য। ব্যাকপেইন, কোমরের সমস্যা তার উপর বাচ্চাদের রোগবালাই সবকিছুতেই অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। অফুরন্ত শুভকামনা রইলো আপনার
শিপু ভাই
আপনার জন্যও শুভকামনা
আপনার নামটা খুব সুন্দর
সুপর্ণা ফাল্গুনী
আমার নামটা ভালো লাগার জন্য ধন্যবাদ। শুভ কামনা রইলো
মনির হোসেন মমি
সিজারিয়ান সন্তান জন্ম নেয়া বেশীর ভাগই অপুষ্টিতে ভুগে। এ বিষয়ে আমাদের চেয়ে সরকার কিংবা ডাক্টারদের দায়টা বেশী হওয়ার কথা কিন্তু বাস্তবে তা উল্টো হয়। আমি নন ডাক্টার আমি ডাক্তার যা বলবে তাই শুনবো।সিজারিংয়ের ক্ষেত্রে বেশী ভাগ সময় এমনি হয়।হাসপাতাল গেলাম তো সিজারিং কনফার্ম।সরকারের দায়টা হলো নীতিমালা থাকলেও তার বাস্তবায়ন নাই।
চমৎকার লেখা।
শিপু ভাই
ধন্যবাদ প্রিয় মমি ভাই
আরজু মুক্তা
এই কথা কে কাকে বোঝাবে? ডাক্তার চায় টাকা। রোগি চায় ঝামেলামুক্ত তাড়াতাড়ি সমস্যা কাটানোর। ফলাফল, চোখের সামনে। অথচ, সমস্যা না হলে সিজার করা নিষিদ্ধ।
ভালো একটা বিষয় নিয়ে লিখলেন।
শুভ কামনা
শিপু ভাই
এর অবসান জরুরী
জিসান শা ইকরাম
সিজারিয়ান ছাড়া সন্তান হতে পারে, এই কথা ভবিষ্যতে কেউ আর বিশ্বাস নাও করতে পারে।
হাসপাতাল, ক্লিনিকে যাওয়া মানেই সিজারিয়ান মাস্ট। গাইনির ডাক্তার এমন এক ভয়ের কথা রোগীর গার্জিয়ানদের মনে ঢুকিয়ে দেন, যাতে সিজারিয়ান করতে বাধ্য হয়।
প্রায় সমস্ত ক্লিনিকেই আজকাল সিজারিয়ান এর ব্যবস্থা থাকে। এরপরের জটিলতার সামান্য ব্যবস্থা নেই। সরকারী হাসপাতালের কিছুই ভালো থাকেনা বিধায় বেসরকারি হাসপাতালে যেতে হয়।
দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা চরম খারাপ অবস্থার মধ্যে আছে।
পরের লেখার অপেক্ষায়।
শুভ কামনা।
শিপু ভাই
ধন্যবাদ মামা
মোঃ মজিবর রহমান
শিপু ভাই, এই জন্য দায়ী আমাদের দেশের সরকারের স্বাস্থনীতি না থাকা। আর জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রন রাখার একটি বড় কৌশল সিজার করা। দুইটি সিজার হলে আর বাচ্চা নিতে পারবে না কারণ পরবর্তী সিজার বেচে থাকার জন্য ঝুকিপুর্ণ।
সিজার করা কত ঝুকি সারাজীবন তা মা-বোনেরা জানে।
অসাধারণ একটি পোষ্ট শিপু ভাই।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আমাদের নাজুক একটা খাত স্বাস্হ্য
কোটি কোটি বাজেট কামের কাম কিছু নাই। সারাজীবন একই হালে কাটে। এ থেকে উত্তরণের জন্য অবশ্যই গন্যমান্যরা সদর হবেন।
শুভ কামনা
রোকসানা খন্দকার রুকু
সদয় হবেন
সঞ্জয় কুমার
এসব সেক্টরেও নিরপেক্ষ অডিট টিম দরকার,
ন্যাচারাল ব্যাপারটা ওনারা টাকার জন্য জটিল বানিয়ে ফেলছেন।
হালিমা আক্তার
আমাদের জীবনের সব স্বাভাবিকই অস্বাভাবিকে পরিনত হয়েছে।এটাও তেমন একটা বিষয়। সবকিছু শর্টকাট। আর চিকিৎসা ব্যবসায়ীদের দরকার টাকা। দুইয়ে মিলে একাকার। ভালো মন্দ বোঝার সাধ্য কার। শুভ কামনা।
সাবিনা ইয়াসমিন
উক্ত দুই রকম ভাবেই মা হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। নিজস্ব অভিজ্ঞতায় যা বুঝেছি নরমাল ডেলিভারিতে মায়ের যাতনা সন্তান প্রসবের আগ পর্যন্ত সহ্য করতে হয়, আর সিজারিয়ান এর বেলায় উলটো।
অনেক ক্ষেত্রে সিজারিয়ান শিশু জন্মদানে প্রলুব্ধ করার জন্য ডাক্তার তো অবশ্যই দায়ী, সাথে সন্তান সম্ভবা মায়েরাও দায়ী।
ডাক্তাররা নিজের সামান্য স্বার্থের জন্য গর্ভবতী/ তাদের পরিবারের মনে ভীতিকর অবস্থা তৈরী করে দেয়। আর অনাগত সন্তানের মায়েরা সেই ভয়কে এড়িয়ে যেতে ব্যর্থ হোন। হবু মায়েদের বোঝা/ বোঝানো উচিত মা হওয়া সহজ কাজ নয়। শিশু প্রসবের সাময়িক কষ্টটাই যদি তারা নিতে না পারে তাহলে সন্তানকে বড় করা, তাকে প্রতিষ্ঠিত করার হ্যাপা সামলাবে কীভাবে!
নিয়মিত ব্লগে আসুন শিপু ভাই। এমন আলোচনা মুলক পোস্ট ব্লগে খুব বেশি আসে না। আপনারা নিয়মিত লিখলে আমরাও কিছু বলার সুযোগ পাই।
ভালো থাকুন, শুভ কামনা 🌹🌹