আগের পোস্ট > শোণিত ধারায় শানিত চেতনা
এমনিভাবে বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাতে এ অঞ্চলের জাতিত্ববোধ বিবর্তন লাভ করেছিল তখন জাতিসত্বা তথা সভ্যতার অন্যতম বাহন ভাষার ক্ষেত্রে চলছিল ভাঙ্গা গড়ার আরেক খেলা। আমাদের আদি অধিবাসীদের ভাষা ছিল অষ্ট্রিক। কুড়ি, পন, গণ্ডা, গুটি ইত্যাদি শব্দ যার উদাহরন।এদিকে আর্য ভাষার আদি পরিশিলীত রূপ সংস্কৃতি তখন সাধারণ জনগোষ্ঠীর ব্যাবহারে ভেঙ্গে গিয়ে বিভিন্ন প্রকৃতির ভাষার রূপ পেয়েছে।যেমন শৌরসেনি, মাগধী,আধমাগধী, পৈশাচী ইত্যাদি। এদেরই মাগধী প্রকৃত ভাষা আদি অস্ট্রীক ভাষার সঙ্গে মিশে যখন কেবল বাংলা ভাষার রূপ নিচ্ছিল অখনই অপরিনত নবজাতক বাঙলা শব্দ নিয়ে আমাদের সাহিত্যের প্রথম প্রথিকৃত কিছু বৌদ্ধ বাউল সাধক আজ থেকে হাজার বছর আগে রচনা করে বসলেন চর্যাপদনামে কিছু অসাধারন গীতি কবিতা। বাঙলা সাহিত্যের প্রথম স্রষ্টারা যেমন তাদের দরিদ্র সমাজে অবহেলিত তেমনি তাদের কবিতাগুলিও ছিল ব্যাতিক্রমি। রাজভাষা সংস্কৃত তখন রাজকিয় পৃষ্ঠপোষকতায়তৎকালীন রাজা ও দেবদেবীদের গুনকীর্তনে ব্যাস্ত।আর নিঃস্ব বাউলের ঘরে জন্মলাভকারী বাংলা সাহিত্য প্রথমেই বলল মাটি, মানুষ আর প্রকৃতির কথা।
“টালত মোর ঘর নাই পড়বেশ
হাড়িত খাত নাহি নিতি আবেশী
বেঙ্গ সংসার বঢিল জাঅ
দুধ কি বেন্টে সামায়।“
অর্থাৎ “ টিলার উপর আমার ঘর। আমার কোন প্রতিবেশী নেই। হারিতে আমার ভাত নেই,আমি প্রতিদিন উপবাসী থাকি। ব্যাঙের মত প্রতিদিন আমার সংসার বেড়েই চলেছে, যে দুধ দোহানো হয়েছে তা আবার ফিরে যাচ্ছে গাভির বাটে।“ দারিদ্রের কি করুন চিত্র।
“উঁচা উঁচা পাবত তাই বসই শবরী বালী,
মোরঙ্গা পীচ্চ পরহিন শবরীগিবত গঞ্জরী মালী
উমত সবর পাগল নাকর গুলি গুহাড়া তৌহোরী
নিভঘরণী নামে সহজ সুন্দরী
নানা উরুবর মৌনলরে গঅনত লাগেলী ডালী।”
কবি নিজের স্ত্রী সম্পর্কে বলেছেন “উঁচু উঁচু যেখনে পাহাড়, সেখানে বাস করে শবরী বালিকা। তার পরনে মইয়ূরের বহু বর্ণ গুঞ্জা ফুলের মালা।“ আর নিজের উদ্দ্যেশে কবি বলেছেন” হে অস্থির পাগল শবর, তুমি গোল বাঁধিও না, এ তোমার স্ত্রী, এর নাম সহজ সুন্দরী। অসংখ্য গাছে ফুল ধরেছে আর আকাশে ছেয়ে গেছে তাদের ডাল।“ প্রকৃতি আর প্রেমের কি চমৎকার বর্ননা।
কিন্তু বাংলা ভাষার এই প্রচন্ড সম্ভাবনাকে মেনে নেয়নি তৎকালীন প্রতাপশালী অভিজাত সংস্কৃত ভাষা ভাষীরা। বাঙলা ভাষায় সাহিত্য রচনা তো দুরের কথা কোন প্রকার লিখনীও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল তখন। বাঙলা ভাষা বিকাশের ধারায় এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে বার বার। পরবর্তিতে তাই দেখে মোঘল আমলে ফরাসী, ইংরেজী আমলে ইংরেজি আর পাকিস্তান আমলে উর্দুভাষার চোখ রাঙ্গানির ফলে বাঙলা কখন্ব শাসক বা অভিজাত শ্রেনির ভাষা হতে পারেনি।
কুঁড়ে ঘরে জন্ম নেয়া বাঙলা ভাষা এদেশের লক্ষকোটি সাধারন মানুষের ভাষা হিসেবেই রয়ে গেছে যুগের পর যুগ। তবে ইতিহাস সাক্ষি, সেই সংস্কৃত যেমন আজ বেঁচে নেই, তেমনি অপরাপর তাবৎ তাথাকথিত রাজকীয় ভাষাও টিকে নেই এদেশের মাটিতে। টিকে আছে এদেশের মাটি ও মানুষের হৃদয় থেকে আবহমান কালের উৎসারিত ভাষা বাংলা। বলা বাহুল্য এর কারন একটি আর তা হল এদেশের মাটিতে হাজার বছরের প্রবাহিত শণিতধারা থেকে জন্ম নিয়েছে বাংলা ভাষা আর অন্যগুলি ভিনদেশী শাসকচক্রের ভিনদেশী ভাষা।
বস্তুতঃ বাংলাদেশ, বাঙালিজাতি ও বংলা ভাষার উপর যুগে যুগে বৈদেশিক আক্রমনের মুখেও আমাদের টিকে থাকবার ইতিহাস। একটি জাতীসত্বার বিশ্লেষনের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো নৃতাত্তিক, ভাষাভিত্তিক ও ভৌগোলিক।আমরা যেমন বিভিন্ন ঘাতপ্রতিঘাতে বাঙ্গালী জাতি ও বাংলা ভাষার ক্রমাগত সংগ্রাম ও সমৃদ্ধ লক্ষ করি তেমনি ভৌগোলিক দিক থেকেও বাংলাকে এক নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রামী জননীর ভূমিকায় প্রত্যক্ষ করি।
১৯টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
বাঙ্গালী,বাংলা ভাষা বিকাশের ইতিহাস খুব সংক্ষেপে এবং সহজে উপস্থাপন করলেন।
বাংলা আসলেই কখনো কোন শাসককুলের আনুকূল্য পায়নি।
তারপরেও তা সাধারনের ভাষা হয়ে বিশ্বের কাছে উজ্জ্বল অবস্থান বজায় রেখেছে।
এমন লেখার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।
খসড়া
ধন্যবাদ, ভাই আপনার উৎসাহই লেখার সাহস জোগায়।
স্বপ্ন নীলা
কুঁড়ে ঘরে জন্ম নেয়া বাঙলা ভাষা এদেশের লক্ষকোটি সাধারন মানুষের ভাষা হিসেবেই রয়ে গেছে যুগের পর যুগ। তবে ইতিহাস সাক্ষি, সেই সংস্কৃত যেমন আজ বেঁচে নেই, তেমনি অপরাপর তাবৎ তাথাকথিত রাজকীয় ভাষাও টিকে নেই এদেশের মাটিতে। টিকে আছে এদেশের মাটি ও মানুষের হৃদয় থেকে আবহমান কালের উৎসারিত ভাষা বাংলা। ’’—————- মনে গেঁথে গেল–১০০ ভাগ সহমত । ভালবাসি এই ভাষাকে, আমার মায়ের ভাষাকে
খসড়া
ধন্যবাদ পড়বার জন্য।
বনলতা সেন
ইহা কী? আমার মাথা ঘুরান্টি দেয়।
আপনি আপনি না।
খসড়া
আসলেই আমি আমি না, কিন্তু, কে আমি?
নওশিন মিশু
চমৎকার ভাবে শেকড়ের সন্ধান দিলেন, ধন্যবাদ…. 🙂
খসড়া
পড়েছেন এতেই আমি কৃতজ্ঞ।
মোঃ মজিবর রহমান
বাংলা তাঁর স্বভাবগত ভাবেই টিকে থাকবে তাঁর থাকবে তাঁর ইতিহাস।
আপনি সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন।
শুভেচ্ছা অবিরত।
খসড়া
মন্তব্য ভাল লাগল।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
পরিশুদ্ধ বাংলা ভাষার অনেক ঘাত প্রতিঘাত জানলাম আপনার পোষ্টে।এইতো এগিয়ে এসেছেন আরো জানতে চাই আপনার কাছ থেকে “ঝুলিতে যা আছে উজার করে দিন। -{@
খসড়া
দিতে চেষ্টা করছি। ভাল থাকুন ভাই।
খেয়ালী মেয়ে
বাংলা মোদের অহংকার–আর কুঁড়ে ঘরে জন্ম নেয়া এই বাংলায় ভাষায় কথা বলে যে শান্তি অনুভব করি, ভীনদেশী আর কোন ভাষা যতই বলা হোক না কেনো মাধুর্য্যতা নেই তাতে..
খসড়া
কুঁড়ে ঘরে জন্ম নেয়া ঘুটে কুড়ানী দাসী আমার মা।
লীলাবতী
আপু জানলাম অনেক কিছু।এমন পোষ্ট দেয়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
খসড়া
ধন্যবাদ লীলাবতী।
প্রজন্ম ৭১
আমাদের উৎস সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম।এত সহজ ভাবে উপস্থাপন করা কঠিন।আপনি সে কঠিন কাজটিই করলেন অত্যন্ত নিপুণতায়।ধন্যবাদ আপু।আপনি আমাদের কিন্তু বঞ্চিত করছেন এমন লেখা থেকে,আরো চাই 🙂
খসড়া
ধন্যবাদ, পড়েছন ভাল লেগেছে কিছু জেনেছেন এটাই পাওয়া।
শুন্য শুন্যালয়
বাংলা ভাষার উৎপত্তি এবং মাটির ভেতর গেঁথে যাওয়া, খুব সুন্দর সহজ করে বর্ণনা। সহজ সুন্দরী, বেশ লাগলো নামটা।