একঃ 

ফোনটা বেজেই চলেছে  ……

সারাদিন খাটুনির পরে অফিসের প্রিয় সুইভেল চেয়ারটায় একটু হেলান দিতেই চোখ টা একটু লেগে এসেছিল।

মরার চাকরি করি আমি ! একটুও শান্তি নাই। কোন দুঃখে যে নৌবাহিনী থেকে র‍্যাবে আসতে গেছিলাম ! আসলে তাড়াতাড়ি প্রমোশনের লোভে এসেছি এখানে।

এখন খুব মনে পড়ছে আমার ” অতি লোভে তাঁতি নষ্ট ” প্রবাদটার কথা …

নিজেকে গাল গাল দিতে দিতে রিসিভারটা তুলে নিলাম,

  • ” হ্যালো। “
  • – হ্যালো। র‍্যাব-১০ এর কমান্ডার আব্দুল্লাহ বলছেন ?
  • – জ্বি।
  • – আমি নরসিংদীর এসপি মোতালেব হোসেন বলছিলাম।
  • – বলেন আপনার জন্য কি করতে পারি ?
  • – একটা কেস এসেছে।
  • – কি কেস ?
  • – আপনি একটু আমার অফিসে আসেন। সামনাসামনিই বলি।
  • – ঠিক আছে।

কি এমন কেস আসলো, আল্লাহই জানে !

নিশ্চয়ই জরুরী কিছু হবে। নাইলে এই সন্ধ্যা ৬টার দিকে এত জরুরী তলব হতো না আমার !

র‍্যাব-১০ এর হেডকোয়ার্টার নারায়ণগঞ্জে হলেও এর আন্ডারে নরসিংদীও পড়ে। নৌবাহিনীতে থাকতে বিভিন্ন কেসে আমাকে ডিজিএফআইতে রিক্রুট করা হয়েছিল। সে সময় বিভিন্ন কেসের সফলতার কারণে র‍্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালকের পদের জন্য অফারটা পাই।   অনেক চিন্তাভাবনা করে, আসলে লোভে পড়ে এখানে এসেছিলাম। কিন্তু কাজের চাপ আর ধরণে নিজের ভুলটা বুঝতে সময় বেশি একটা লাগেনি। কিন্তু কিছুই করার নেই।

নরসিংদী যেতে যেতে প্রায় সন্ধ্যা ৭টা বেজে গেলো। রাস্তার তীব্র জ্যাম কোনমতে সাইরেন বাজিয়ে, বিপরীত পাশ দিয়ে এসে আংশিকভাবে উপেক্ষা করতে পেরেছি নাইলে সাধারণ মানুষের মত গেলে ৮টার আগে বোধহয় কোনভাবেই পৌঁছাতে পারতাম না।

দুইঃ

এসপি মোতালেব হোসেন যথেষ্ট অমায়িক ভদ্রলোক। চেহারার দাঁড়ির সাইজ দেখেই বলে দিতে পারি উনি তাবলীগ করেন। আর তাবলীগের সাথে জড়িত মানুষগুলোর প্রতি আমার একটা আলাদা শ্রদ্ধাবোধ কাজ করে। এরা সর্বদা মানুষকে ভালো কাজের দিকে আহ্বান করতে ব্যস্ত। দেশে কি হচ্ছে, কারা ক্ষমতায় আসছে-যাচ্ছে কোন চিন্তা নেই। এরা কারো সাতেও নেই পাচেও নেই।

  • ” বসুন আপনি। আমি একটু মাগরিবের নামাযটা পড়ে আসছি। ” ভেতরে যেতেই বললেন এসপি মোতালেব।

আজান হয়েছে ৫ মিনিট হয়ে গেছে।

  • ” ঠিক আছে। আমি বসছি। “
  • – আপনি নামায পড়বেন না ?
  • – জ্বি আমি নিয়মিত পড়তে পারি না।
  • – কি যে বলেন ? নামায তো ফরজ।
  • – আসলে কাজের চাপে ব্যস্ত থাকি তো !
  • – কোন সমস্যা নেই। চাইলে এখানেই পড়ে নিতে পারেন।
  • – ঠিক আছে।

প্রায় মিনিট দশেক পরে আবার ভেতরে আসলেন তিনি। মাথায় পুলিশের ক্যাপটার বদলে শোভা পাচ্ছে নেটের গোল টুপিটা।

  • ” কিছু খাবেন ? চা-কফি ? “
  • – অত প্রয়োজন নেই।
  • – চা হলে চলবে ?
  • – অবশ্যই। খুব চলবে।

একটু অসস্ত্বি বোধ করছি। কাজের কথাটা জানতে না পেরে মন উসখুস করছে। কিন্তু উনি না বলা পর্যন্ত কিছুই করতে পারছি না।

আমার মনের কথা যেন পড়তে পেরেই তিনি বললেন,

  • ” আপনার কাজটা আসলে খুব জটিল না। এখানকার আশরাফ সাহেবের নাম শুনেছেন ? “
  • – জ্বি না।
  • – উনি এখানকার অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি। আগে প্রায় ১৭ নরসিংদী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। এখন পৌরসভা হওয়ার পরে সেটার চেয়ারম্যান।
  • – ও আচ্ছা।

মনটাই তেতো হয়ে গেলো। নৌবাহিনীতে থাকতে যেসব চুনোপুঁটিদের পাত্তাও দিতাম না সেখানে র‍্যাবে এসে এইসব পাতি নেতাদেরও কথা শুনতে হয়। হায়রে আমার চাকরি !

মনটা আবারো বিষিয়ে গেলো।

  • – ওনার বড় মেয়েটা অপহৃত হয়েছে। সেজন্যই আপনাকে ডাকা।
  • – ও কিন্তু এটা তো পুলিশের কাজ।
  • – হ্যা। কিন্তু পুলিশ গত ৫দিন ধরেও কাজ করে কোন হদীস বের করতে পারেনি। এদিকে আশরাফ সাহেবের অবস্থা খারাপ। উনি ফোন দিলেন এই এলাকার মন্ত্রীকে। উনি নাকি আবার আপনার কিভাবে আত্ত্বীয় হয়। উনিই বললেন আপনার কথা।
  • – বুঝেছি।
  • – চা-নাস্তা করেই আমরা রওনা দেবো ওনার বাসার উদ্দেশ্যে !
  • – ঠিক আছে।

ধুর ! কিসব ফালতু অপরহণ কেসের কাজ ! মনে মনে ভাবলাম।

কিন্তু জানতাম না এই কেসটার শেষ আসলে কি হবে … জানলে কোনভাবেই হেলাফেলা করতাম না !

তিনঃ

এসপির কার্যালয় থেকে আশরাফ সাহেবের বাসায় যেতে আমাদের পাক্কা ৪০ মিনিট লাগলো। প্রথমে এসপির গাড়ি, তার পরেই আমার গাড়ি। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের তীব্র জ্যাম পেরিয়ে একটু গ্রামের দিকে যেতে হয়েছে।

আশরাফ সাহেবের মেয়ে অপহৃত হওয়ার দুই দিন পরেই সপরিবারে তিনি নরসিংদী শহরের বাসা ছেড়ে তার নিজ গ্রামের বাড়িতে চলে এসেছেন। শহরে পুলিশের নিরাপত্তাকে ওনার যথেষ্ট মনে হয়নি। নিজ গ্রামে ওনার দলের কর্মীরাই দিনরাত ২৪ ঘন্টা তার বাড়ি পাহারা দেয়। সাথে স্থানীয় থানার ওসিও কয়েকজন করে পুলিশ ও আনসার পাঠিয়ে দেয়। নিজের লোকদের এই নিরাপত্তা পেয়ে উনি বেশ আশ্বস্ত।

রাত হয়ে এসেছে। আশরাফ সাহেবের বাড়ি ঘিরে কড়া নিরাপত্তা। সামনের গেটে তিনজন পুলিশ সদস্য রাইফেল হাতে পাহারা দিচ্ছে। আর পুরো বাড়ির আশেপাশে প্রায় জনা ত্রিশেক লোক হবে। সবার হাতেই বাঁশের লাঠি আর টর্চলাইট। গলায় বাঁশি ঝুলছে।

নিরাপত্তার আয়োজন দেখে বেশ হাসিই পেলো আমার। অবস্থা এমন যেন দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে !

এসপি আর পিছে আমার গাড়ি দেখে পুলিশ সদস্যরা বেশ তটস্থ হয়ে গেলো স্যালুট দেওয়ার জন্য।

গাড়ি থেকে নামতেই খটাশ করে স্যালুট দিলো আরেক পুলিশ সদস্য। কাঁধের র‍্যাংক দেখে বুঝলাম অত্র থানার একজন এসআই। হাতে ওয়্যারলেস।

গাড়ি থেকে নেমে পুরো বাড়িটার উপর চোখ বুলিয়ে নিলাম। দো-তালা আলিশান একটা বাড়ি। বাড়ির পিছনে জায়গা। আশেপাশে অনেক ফাঁকা জায়গা আছে। বাড়ির সামনে ফুলের বাগানটা চোখে পড়লো। প্রচুর গাছ-গাছালি বাড়িটার চারপাশে। রাতে একটু ভূতুড়েও লাগে এত গাছ দেখলে !

বাড়িটা দেখে ছোটবেলার দেখা স্বপ্নের কথা মনে পড়ে যায় আমার। সারাটা শৈশব শহরে কাটানো ছেলে আমি। শহরের ব্যস্ত যান্ত্রিক জীবনে ক্লান্ত হয়ে কয়েকটা দিন কাটানোর জন্য এমন পরিবেশ সর্বদাই কল্পনা করতাম আমি।

বাড়ির বাইরের মত ভেতরটাও আলিসানভাবে সাজানো। সম্পূর্ণ মোজাইক করা মেঝে।

এক চাকর এসে আমাদের একটা বিশাল রুমে নিয়ে গেলো।

কয়েক সেট সোফা রয়েছে রুমটায়। আর ঠিক মাঝ বরাবর ছাদে ঝুলছে বিশাল এক ঝাড়বাতি।

এক কোণায় সোফাতে বসে রয়েছেন দুইজন লোক।

একজন পুলিশের ইউনিফর্ম পড়া আমাদের দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট দিলো। র‍্যাংক দেখে বুঝলাম ইন্সপেক্টর। নেম প্লেটে লেখা, মজিদ।

এই তাহলে অত্র থানার ওসি!

চারঃ

সোফায় বসে থাকা অপরজন ষাটোর্ধ্ব সম্ভ্রান্ত চেহারার লোক। দেখলেই মনে হয়ে, এ লোক হুকুম করতে জানে কিন্তু হুকুম তামিল করতে জানে না। এমনকি আমাদের দেখে উঠেও দাঁড়াননি।

  • ” বসুন আপনারা। ” – বললেন আশরাফ সাহেব।

গলা শুনে আমার ধারণা যে ভুল হয়নি সেটা আবারো বুঝে গেলাম।

সোফায় বসতেই সরাসরি কাজের কথায় চলে এলেন উনি।

  • – দেখুন জনাব, আমার মেয়েকে যেভাবেই হোক আপনার উদ্ধার করতে হবে।
  • – আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।
  • – চেষ্টা নয়, আমি গ্যারান্টি চাই।
  • – পৃথিবীর কারো পক্ষে এটা সম্ভব নয়।
  • – কেন নয় ? সরকার এত টাকা খরচ করে আপনাদের তৈরি করেছে আর আপনারা এই সামান্য ব্যাপারে গ্যারান্টি দিতে পারেন না ?

অকাট্য যুক্তি। এ কথার পরে আর কথা চলে না। আর কথা যত বাড়াবো ততই বাড়বে। তাই চুপ করে থাকায় শ্রেয় মনে করলাম। এর চেয়ে ওনার মাথা একটু ঠান্ডা হোক। এরপরে আআর কথা বলা যাবে।
দীর্ঘ একটা মূহুর্ত নীরবতা নেমে আসলো রুম জুড়ে। ফ্যানটা বেরসিকের মত শব্দ করে যাচ্ছিল কেবল!

  • ” আচ্ছা যাই হোক। আপনি আমার মেয়েকে উদ্ধারের জন্য চেষ্টা করবেন কবে থেকে ? ” – আবার কথা শুরু করে নীরবতা ভাঙলেন আশরাফ সাহেব।
  • – জ্বি আজ থেকেই।
  • – তাহলে শুরু করছেন না কেন ?
  • – এসপি সাহেব আপনার সাথে দেখা করার জন্য নিয়ে এলেন। নাহলে এতক্ষণে শুরু করতাম।
  • – কিভাবে করতেন এটা জানতে পারি ?
  • – সর্বপ্রথম আপনার শত্রুদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতাম। এরপরে তাদের মোটিভ ইত্যাদি পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিবো আরকি।
  • – আমার শত্রু অনেক। তবে তাদের মধ্যে কেবল তিনজন আছে যারা একাজ করার সাহস রাখে।
  • – কে কে ?
  • – এসব কথা আমি পুলিশকে আগেই বলেছি। তারা এ ব্যাপারে তদন্ত করেছে। আমার লোকজনও খোঁজ খবর নিয়েছে। সুতরাং এ রাস্তায় গিয়ে কোন লাভ নেই।
  • – পুলিশ আর আপনার লোকদের তদন্ত আর আমাদের তদন্ত আলাদা।

 

  • ” আমার লোকদের কি আপনার দুধের শিশু মনে হয় ? “

একটু রেগে উঠলেন যেন আশরাফ সাহেব।

  • – ঠিক তা নয়। তবে আমাদের তুলনায় অর্ডিনারী।
  • – মোটেও না। আমি আপনাকে চ্যালেঞ্জ দিতে পারি। আমার ৩০ জনের সাথে আপনার ফোর্সের ৩০ জন পারবে না।
  • – সে কথা বাদ দেই। কাজের কথা বলেন।

একটু কঠিন স্বরে বললাম। একটু থমকে গেলেন আশরাফ সাহেব। ওনাকে স্পষ্ট বুঝিতে দিতে চাইলাম যে উনি একজন মিলিটারি অফিসারের সাথে কথা বলছেন। কিছু বলছেন না দেখে আবার বললাম,

  •  আপনার কাদেরকে সন্দেহ হয় ?
  • – সেটা এসপি থেকেই জেনে নিবেন। আমি আবার রিপিট করতে পারবো না।
  • – আচ্ছা ওই তিনজন বাদে আর কারো সম্ভাবনা আছে ? আপনার পরিবারের কেউ ? আত্ত্বীয়-স্বজন ?
  • – নাহ।
  • – আচ্ছা ওই তিনজনের ব্যাপারে খোঁজ খবর নিয়ে যখন কিছুই পাননি তখন আপনার কাকে সন্দেহ হয়েছে ?
  • – কাউকে না। আমি আপনাকে ডেকেছি এইজন্যই কারণ আমি এখন সন্দেহও করার মত কাউকে পাচ্ছি না।
  • – ঠিক আছে।
  • – আমার কথা শেষ।

ইঙ্গিতটা বুঝতে পারলাম। তাই যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। আমার সাথে উঠে দাঁড়ালো সাথের দুই পুলিশ অফিসারও। পুরোটা সময় এরা কেবল শ্রোতা হয়েই উপস্থিত ছিলেন। অবশ্য এমন রূঢ় ব্যবহার করলে সহজে কেউই মুখ খুলতে চাইবে না।

বাড়ি থেকে বের হতেই এসপিকে বললাম,

  • ” এমন রূঢ় ব্যবহার! “
  • – আসলে মেয়ের কোন খোঁজ নেই তাই এই অবস্থা।
  • – যাই হোক, আপনাদের তদন্তের সব রিপোর্ট আমাকে দিবেন।
  • ” সেটা কাল সকালেই পৌঁছে যাবে, স্যার। ” – জবাবটা দিলেন ওসি মজিদ।
  • – ঠিক আছে।

পুলিশের তদন্ত রিপোর্ট পর্যালোচনা করেই কাজে নামার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় দেখলাম আশরাফ সাহেবের বেশ কিছু নিরাপত্তারক্ষী ঝিমুচ্ছে। হাসি পেলো আমার। এদের সাথে নাকি র‍্যাবের তুলনা !

হুহ ! ৫ জন কমান্ডো ! স্রেফ ৫ জন কমান্ডো এই পুরা বাড়ি ১০ মিনিটের মধ্যে এমনভাবে উড়িতে দিতে পারবে যে কাকপক্ষীও টের পাবে না।

( চলবে )

৬৫৩জন ৬৫৩জন
0 Shares

৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ