একঃ
ফোনটা বেজেই চলেছে ……
সারাদিন খাটুনির পরে অফিসের প্রিয় সুইভেল চেয়ারটায় একটু হেলান দিতেই চোখ টা একটু লেগে এসেছিল।
মরার চাকরি করি আমি ! একটুও শান্তি নাই। কোন দুঃখে যে নৌবাহিনী থেকে র্যাবে আসতে গেছিলাম ! আসলে তাড়াতাড়ি প্রমোশনের লোভে এসেছি এখানে।
এখন খুব মনে পড়ছে আমার ” অতি লোভে তাঁতি নষ্ট ” প্রবাদটার কথা …
নিজেকে গাল গাল দিতে দিতে রিসিভারটা তুলে নিলাম,
কি এমন কেস আসলো, আল্লাহই জানে !
নিশ্চয়ই জরুরী কিছু হবে। নাইলে এই সন্ধ্যা ৬টার দিকে এত জরুরী তলব হতো না আমার !
র্যাব-১০ এর হেডকোয়ার্টার নারায়ণগঞ্জে হলেও এর আন্ডারে নরসিংদীও পড়ে। নৌবাহিনীতে থাকতে বিভিন্ন কেসে আমাকে ডিজিএফআইতে রিক্রুট করা হয়েছিল। সে সময় বিভিন্ন কেসের সফলতার কারণে র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালকের পদের জন্য অফারটা পাই। অনেক চিন্তাভাবনা করে, আসলে লোভে পড়ে এখানে এসেছিলাম। কিন্তু কাজের চাপ আর ধরণে নিজের ভুলটা বুঝতে সময় বেশি একটা লাগেনি। কিন্তু কিছুই করার নেই।
নরসিংদী যেতে যেতে প্রায় সন্ধ্যা ৭টা বেজে গেলো। রাস্তার তীব্র জ্যাম কোনমতে সাইরেন বাজিয়ে, বিপরীত পাশ দিয়ে এসে আংশিকভাবে উপেক্ষা করতে পেরেছি নাইলে সাধারণ মানুষের মত গেলে ৮টার আগে বোধহয় কোনভাবেই পৌঁছাতে পারতাম না।
দুইঃ
এসপি মোতালেব হোসেন যথেষ্ট অমায়িক ভদ্রলোক। চেহারার দাঁড়ির সাইজ দেখেই বলে দিতে পারি উনি তাবলীগ করেন। আর তাবলীগের সাথে জড়িত মানুষগুলোর প্রতি আমার একটা আলাদা শ্রদ্ধাবোধ কাজ করে। এরা সর্বদা মানুষকে ভালো কাজের দিকে আহ্বান করতে ব্যস্ত। দেশে কি হচ্ছে, কারা ক্ষমতায় আসছে-যাচ্ছে কোন চিন্তা নেই। এরা কারো সাতেও নেই পাচেও নেই।
আজান হয়েছে ৫ মিনিট হয়ে গেছে।
প্রায় মিনিট দশেক পরে আবার ভেতরে আসলেন তিনি। মাথায় পুলিশের ক্যাপটার বদলে শোভা পাচ্ছে নেটের গোল টুপিটা।
একটু অসস্ত্বি বোধ করছি। কাজের কথাটা জানতে না পেরে মন উসখুস করছে। কিন্তু উনি না বলা পর্যন্ত কিছুই করতে পারছি না।
আমার মনের কথা যেন পড়তে পেরেই তিনি বললেন,
মনটাই তেতো হয়ে গেলো। নৌবাহিনীতে থাকতে যেসব চুনোপুঁটিদের পাত্তাও দিতাম না সেখানে র্যাবে এসে এইসব পাতি নেতাদেরও কথা শুনতে হয়। হায়রে আমার চাকরি !
মনটা আবারো বিষিয়ে গেলো।
ধুর ! কিসব ফালতু অপরহণ কেসের কাজ ! মনে মনে ভাবলাম।
কিন্তু জানতাম না এই কেসটার শেষ আসলে কি হবে … জানলে কোনভাবেই হেলাফেলা করতাম না !
তিনঃ
এসপির কার্যালয় থেকে আশরাফ সাহেবের বাসায় যেতে আমাদের পাক্কা ৪০ মিনিট লাগলো। প্রথমে এসপির গাড়ি, তার পরেই আমার গাড়ি। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের তীব্র জ্যাম পেরিয়ে একটু গ্রামের দিকে যেতে হয়েছে।
আশরাফ সাহেবের মেয়ে অপহৃত হওয়ার দুই দিন পরেই সপরিবারে তিনি নরসিংদী শহরের বাসা ছেড়ে তার নিজ গ্রামের বাড়িতে চলে এসেছেন। শহরে পুলিশের নিরাপত্তাকে ওনার যথেষ্ট মনে হয়নি। নিজ গ্রামে ওনার দলের কর্মীরাই দিনরাত ২৪ ঘন্টা তার বাড়ি পাহারা দেয়। সাথে স্থানীয় থানার ওসিও কয়েকজন করে পুলিশ ও আনসার পাঠিয়ে দেয়। নিজের লোকদের এই নিরাপত্তা পেয়ে উনি বেশ আশ্বস্ত।
রাত হয়ে এসেছে। আশরাফ সাহেবের বাড়ি ঘিরে কড়া নিরাপত্তা। সামনের গেটে তিনজন পুলিশ সদস্য রাইফেল হাতে পাহারা দিচ্ছে। আর পুরো বাড়ির আশেপাশে প্রায় জনা ত্রিশেক লোক হবে। সবার হাতেই বাঁশের লাঠি আর টর্চলাইট। গলায় বাঁশি ঝুলছে।
নিরাপত্তার আয়োজন দেখে বেশ হাসিই পেলো আমার। অবস্থা এমন যেন দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে !
এসপি আর পিছে আমার গাড়ি দেখে পুলিশ সদস্যরা বেশ তটস্থ হয়ে গেলো স্যালুট দেওয়ার জন্য।
গাড়ি থেকে নামতেই খটাশ করে স্যালুট দিলো আরেক পুলিশ সদস্য। কাঁধের র্যাংক দেখে বুঝলাম অত্র থানার একজন এসআই। হাতে ওয়্যারলেস।
গাড়ি থেকে নেমে পুরো বাড়িটার উপর চোখ বুলিয়ে নিলাম। দো-তালা আলিশান একটা বাড়ি। বাড়ির পিছনে জায়গা। আশেপাশে অনেক ফাঁকা জায়গা আছে। বাড়ির সামনে ফুলের বাগানটা চোখে পড়লো। প্রচুর গাছ-গাছালি বাড়িটার চারপাশে। রাতে একটু ভূতুড়েও লাগে এত গাছ দেখলে !
বাড়িটা দেখে ছোটবেলার দেখা স্বপ্নের কথা মনে পড়ে যায় আমার। সারাটা শৈশব শহরে কাটানো ছেলে আমি। শহরের ব্যস্ত যান্ত্রিক জীবনে ক্লান্ত হয়ে কয়েকটা দিন কাটানোর জন্য এমন পরিবেশ সর্বদাই কল্পনা করতাম আমি।
বাড়ির বাইরের মত ভেতরটাও আলিসানভাবে সাজানো। সম্পূর্ণ মোজাইক করা মেঝে।
এক চাকর এসে আমাদের একটা বিশাল রুমে নিয়ে গেলো।
কয়েক সেট সোফা রয়েছে রুমটায়। আর ঠিক মাঝ বরাবর ছাদে ঝুলছে বিশাল এক ঝাড়বাতি।
এক কোণায় সোফাতে বসে রয়েছেন দুইজন লোক।
একজন পুলিশের ইউনিফর্ম পড়া আমাদের দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট দিলো। র্যাংক দেখে বুঝলাম ইন্সপেক্টর। নেম প্লেটে লেখা, মজিদ।
এই তাহলে অত্র থানার ওসি!
চারঃ
সোফায় বসে থাকা অপরজন ষাটোর্ধ্ব সম্ভ্রান্ত চেহারার লোক। দেখলেই মনে হয়ে, এ লোক হুকুম করতে জানে কিন্তু হুকুম তামিল করতে জানে না। এমনকি আমাদের দেখে উঠেও দাঁড়াননি।
গলা শুনে আমার ধারণা যে ভুল হয়নি সেটা আবারো বুঝে গেলাম।
সোফায় বসতেই সরাসরি কাজের কথায় চলে এলেন উনি।
অকাট্য যুক্তি। এ কথার পরে আর কথা চলে না। আর কথা যত বাড়াবো ততই বাড়বে। তাই চুপ করে থাকায় শ্রেয় মনে করলাম। এর চেয়ে ওনার মাথা একটু ঠান্ডা হোক। এরপরে আআর কথা বলা যাবে।
দীর্ঘ একটা মূহুর্ত নীরবতা নেমে আসলো রুম জুড়ে। ফ্যানটা বেরসিকের মত শব্দ করে যাচ্ছিল কেবল!
একটু রেগে উঠলেন যেন আশরাফ সাহেব।
একটু কঠিন স্বরে বললাম। একটু থমকে গেলেন আশরাফ সাহেব। ওনাকে স্পষ্ট বুঝিতে দিতে চাইলাম যে উনি একজন মিলিটারি অফিসারের সাথে কথা বলছেন। কিছু বলছেন না দেখে আবার বললাম,
ইঙ্গিতটা বুঝতে পারলাম। তাই যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। আমার সাথে উঠে দাঁড়ালো সাথের দুই পুলিশ অফিসারও। পুরোটা সময় এরা কেবল শ্রোতা হয়েই উপস্থিত ছিলেন। অবশ্য এমন রূঢ় ব্যবহার করলে সহজে কেউই মুখ খুলতে চাইবে না।
বাড়ি থেকে বের হতেই এসপিকে বললাম,
পুলিশের তদন্ত রিপোর্ট পর্যালোচনা করেই কাজে নামার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় দেখলাম আশরাফ সাহেবের বেশ কিছু নিরাপত্তারক্ষী ঝিমুচ্ছে। হাসি পেলো আমার। এদের সাথে নাকি র্যাবের তুলনা !
হুহ ! ৫ জন কমান্ডো ! স্রেফ ৫ জন কমান্ডো এই পুরা বাড়ি ১০ মিনিটের মধ্যে এমনভাবে উড়িতে দিতে পারবে যে কাকপক্ষীও টের পাবে না।
( চলবে )
৪টি মন্তব্য
শিপু
দারুন ভাল লাগল
ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়
ধন্যবাদ 🙂
ইমন
শুরু ভালো হয়েছে 🙂 শুভেচ্ছা রইলো 🙂
ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়
ধন্যবাদ। আপনার জন্যও শুভকামনা রইলো 🙂