হাঁটতে শেখার পর সন্তান যখন মায়ের হাত ধরে হাঁটে, তখন তার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদক্ষেপের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে মায়ের গতি মন্থর হয়ে আসে। ধীরে ধীরে শিশু বড় হয়, হাঁটার গতি বাড়ে,কিন্তু মায়ের গতি যে ধীর হয়ে গেছিল মাঝে, তা আর দ্রুত হয় না। মায়ের সাথে হাঁটতে গিয়ে বিরক্ত হই। মা বলে,”অপু, একটু ধীরে হাঁট না, বাবা।”
মার সাথে দোকানে গিয়েও কম বিরক্ত হই না, কিন্তু আমাকে নিয়ে বের হতে মার আগ্রহের সীমা নেই। আরো বিরক্তিকর তার করা দামদর। দেখবেন, কিছু কিছু বদ দোকানদার প্রায়ই বলে,”২ টাকায় দিবো,নিবেন?” তখন সাধারণত আমরা তাদের ignore করে চলে যাই, মা সেটা করে না। মা ২টাকার নোট ব্যাগ থেকে বের করে দোকানদারের সামনে এগিয়ে ধরে, এতে দোকানদার বিব্রত হয়। তারপর শুরু হয় মার টেপরেকর্ডার। ঐ সময়টা অবশ্য বেশ উপভোগ করি।
ছুটির দিনে মা বারবার ডাকে টুকিটাকি কাজের জন্য। ফেসবুক থেকে উঠে ডাক শুনতে কার না বিরক্তি লাগে? আশেপাশে কিসব ঘটছে, সব কিছু সম্পর্কে আপ টু ডেট থাকার জন্য ফেসবুকের থেকে better কি কিছু আছে? যাই হোক, মাকে বলি,”একবারে সব বলতে পারো না? একবার বলো-‘ ফ্যান অন কর’, আরেকবার বলো-‘ফ্যানটার স্পীড কমিয়ে দে’।” অসহায় ভঙ্গিতে হাসে মা। পরে মনে হয়, কেনো যে এমন করি মার সাথে? আমাকে দেখার জন্যই তো বারবার মার এসব ডাকাডাকি।
যেসব ছুটির দিনে বাইরে কোথাও যাই, তখন বাবা বলে, “একটা দিনও কি বাসায় থাকতে চাস না? তোর মা ঘরে একা একা।”
আমি বলি,” তো আপনি আছেন কি করতে?” বাবা তখন দুঃখী ভঙ্গিতে কিছু বলবেন। আমিও উলটো কিছু বলবো, তারপরের কাহিনী থাক। পরে বুঝি, দুজনই আমার সঙ্গ কামনা করেন। সব ঘরেই হয়ত একই কাহিনী। তারা ভাবেন, তাদের অবহেলা করছি। কিন্তু ব্যস্তজীবনে অবহেলা করার সময়টুকুও আজ নেই-তারা বোঝেন না । যেই ছুটির দিন কোন বিয়ের দাওয়াত বা কোন প্রোগ্রাম থাকে, ঐদিনই মার মুখ মলিন। প্রথম প্রথম বারবার ফোন দিতো কোথায় আছি জানার জন্য। এখন কিছুটা কমেছে(হয়ত বিরক্ত হই বলে)। বুঝি সবই ভালবাসার অভিব্যক্তি, কিন্তু জীবন তো যান্ত্রিক।
শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছে। শাহবাগ নতুন ইতিহাস গড়ছে। এতো মানুষ একসাথে কিভাবে? অবাক লাগে! শিশু থেকে বুড়ো সবাই…
বড় বড় কবি সাহিত্যিক, নেতারা যোগ দিচ্ছেন। প্রায়ই দৌড় দেই অফিস শেষে। এ যেন অন্যরকম ভাল লাগা। শাহবাগ আমায় টানে চুম্বকের মতো।
ফ্রান্সফেরত জেরিন মির্জাও আন্দোলনের সাথে একাত্ত্বতা ঘোষণা করে বলেন,”একাত্তরে ৮বছরের বালিকা থেকে শুরু করে বৃদ্ধনারী পর্যন্ত বর্বরতার শিকার হয়েছে। আজ যদি আমি এই আন্দোলন সমর্থন না করি, নারীত্বের অবমাননা হবে।একাত্তরে যে অমানবিক ঘটনাগুলো ঘটেছে সেগুলোকে ছোট করে অন্য ইস্যুগুলোকে নিয়ে যদি কথা বলি, তাহলে আমার থেকে বড় নাস্তিক হয়ত কেউ হবে না। উনি সবই দেখছেন উপর থেকে। এতো মানুষের সাথে অবিচার করবেন না, যদি উনি থেকে থাকেন। আমার বিশ্বাস,উনি এত্ত মানুষকে নিরাশ করবেন না ।” জেরিন মির্জার “যদি উনি থেকে থাকেন”কথা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে গেলো। একে তো মহিলা ফ্রান্সফেরত,তার উপর আবার এমন উক্তি!!! এসব নারীবাদী মহিলাগুলো একটা না একটা ক্যাচাল বাঁধাবেই। ঐ কথাটা না বললেই কি নয়???
এর মধ্যেও আন্দোলন চলছে। বলতে গেলে রেগুলার যাওয়ার চেষ্টাটা করি। শুক্রবারেও যাবো। মাকে বললাম,”মা,শাহবাগ যাচ্ছি।” দেখলাম,মার মুখ চকচক করছে,মলিন নয়। বুঝতে পারলাম,মা কি ভাবছে। ভাবছে, আমার ছেলে কাপুরুষ নয়(মায়েরা খুব অল্পেই নিজের ছেলেদের সুপুরুষ ভেবে থাকেন,যদিও ঐদিন ব্যাপারটা মনে ধরল),বুকের পাটা আছে। মা বললেন,”শুনলাম, খাবার নিয়ে যাচ্ছে সবাই সবার জন্য। আগে বলবি না? পিঠাজাতীয় কিছু একটা বানিয়ে দিতাম। ফ্রিজে চকোলেটের প্যাকেট আছে, ওটা নিয়ে যাস।”(হয়ত প্রতিটি মায়ের গল্প একই)
দেশের জন্য হয়ত কখনো কিছু করার সুযোগ হবে না,হলেও করব কিনা জানি না। মানুষমাত্রই স্বার্থপর,নিজের জন্য ভাবার সময় যেখানে সল্প,সেখানে দেশকে নিয়ে ভাবাটা যেন কল্পনা। কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে,এই আন্দোলনকে সমর্থন না করা মানে মায়ের অবমাননা। মা, তোমাকে ভালবাসি,তাই পারলাম না আন্দোলন থেকে নিজেকে আলাদা রাখতে। আজ ম্যাক্সিম গোরকির মতো আমিও লিখলাম “মা”। (গল্পটির সব চরিত্র কাল্পনিক)
[বিঃ দ্রঃ লেখাটি লিখেছি,ফেব্রুয়ারী ২০১৩ তে, শাহবাগ আমাদের একটি চেতনাকে জাগ্রত করেছিলো। কোন নেতার আহ্বানে আমরা সেখানে যাইনি, আমরা গিয়েছি, নিজের ভিতরকার আশা আকাঙ্ক্ষা প্রানের আহ্বানে।
যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি মানুষ ঘৃনা প্রকাশের একটি স্থান হিসেবে শাহবাগ কে বেছে নিয়েছিলো।এই বিচারের দাবী বাঙ্গালীর অস্তিত্তের দাবি। এটি হতেই হবে।
সবাইকে বিজয় মাসের শুভেচ্ছা —– ]
( সামনে পরীক্ষা। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন। আমি হয়ত সবার উত্তর সময়মত দিতে পারব না। সেজন্য আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি। কিন্তু যখনই বসব, উত্তর দিয়ে দেব। সবার জন্য রইল শুভকামনা।)
২৮টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
‘ মা ‘ শব্দটাতে একটি আচ্ছন্নতা,নির্ভরতা।
একাত্তর আমি দেখেছি
দেশের অধিকাংশ বাড়ির মা এরা অপেক্ষায় ছিলেন সাহস নিয়ে,মমতা নিয়ে,খাবার নিয়ে, মুক্তিপাগল বীরদের জন্য
অপেক্ষা করেছেন আশ্রয়হীনদের সাহায্যের জন্য।
ভালো লিখেছেন।
একটি চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল শাহবাগে
নষ্ট করে দিলো তা কতিপয় কুচক্রী।
পরীক্ষা ভালো হোক হবু ডাক্তারের।
শুভ কামনা।
কৃন্তনিকা
পড়ার জন্য ধন্যবাদ। 🙂
আপনার জন্যও শুভকামনা…
বনলতা সেন
ভাল হোক আপনার পরীক্ষা এই কামনা করি। শাহবাগের কথা মনে করালেন?
যে মন নিয়ে আমরা সেখানে গিয়েছিলাম ফিরে আসার সময় সেই মনটি আর সাথে ছিল না।
বিজয়ের শুভেচ্ছা আপনাকেও।
কৃন্তনিকা
শাহবাগের দিনগুলো খুব ভাবায় আমাকে আজো…
তবে এখনো আশায় আছি বিচারের…
পড়ার জন্য ধন্যবাদ। 🙂
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
হায়রে মা জগতের সকল ধকল যেনো তাকেই সইতে হয়। -{@
কৃন্তনিকা
হুম…
পড়ার জন্য ধন্যবাদ। 🙂
লীলাবতী
ভালো লিখেছেন আপু। জগতের সব মা শুধুই মা। ভালোবাসি মা তোমাকে।
পরীক্ষা ভালো হবেই আপনার।সবাই দোয়া করছি।
কৃন্তনিকা
পড়ার জন্য ধন্যবাদ। 🙂
শুভকামনা রইল লীলাবতীর জন্য…
খেয়ালী মেয়ে
মায়ের সাথে কোন কিছুরই তুলনা চলে না–মা সেতো মা…
বিজয় মাসের শুভেচ্ছা রইলো..
কৃন্তনিকা
হুম, মায়ের কোন তুলনা নেই।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ। 🙂
শুন্য শুন্যালয়
ধীরে ধীরে শিশু বড় হয়, হাঁটার গতি বাড়ে,কিন্তু মায়ের গতি যে ধীর হয়ে গেছিল মাঝে, তা আর দ্রুত হয় না…খুব সুন্দর বললেন তো!!! মা বাবার অবস্থান কিংবা সন্তানের জন্য উদ্বেগ আসলে ঠিক ওই জায়গায় না গেলে পুরোপুরি বোঝা সম্ভব হয়না। যখন বুঝতে পারি তখন শুধুই আক্ষেপ থাকে। ভালো লেগেছে গল্প। বিজয়ের শুভেচ্ছা আপনাকেও।
কৃন্তনিকা
ভাল লেগেছে জেনে ভাল লাগলো।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ। 🙂
ভাল থাকবেন।
নুসরাত মৌরিন
সবার মায়েদের গল্পগুলোই মনে হয় এক।আমি আমার মাকে নিয়ে গিয়েছিলাম প্রজন্ম চত্তরে।
শাহবাগ-একটা প্রিয়তম স্বপ্নের নাম।আমার ক্ষুদ্র জীবনে এত ভাল আমি কখনোই ছিলাম না ওই দিনগুলোর মত।সারা বাংলা জুড়ে লক্ষ্য লক্ষ্য “আমি” এবং আমরা একাকার হয়ে গিয়েছিলাম।
এত আহতও কখনো হয়নি,যেমনটা হয়েছিলাম শাহবাগ নিয়ে রাজনীতি আর আন্দোলনটা শতধা বিভক্ত হতে দেখে।
স্বপ্ন আর বিশ্বাসের বাতিঘরটা ভেঙ্গেচূড়ে যেতে দেখে নিজেকে খুব বেশি প্রতারিত মনে হয়েছিল…। 🙁
কিন্তু সবকিছুর পরও আমরাই আমাদের শক্তি।সময়ে আবার আমরা এক হবো…হয়ত…। 🙂
কৃন্তনিকা
পড়ার জন্য ধন্যবাদ। 🙂
কি আছে সামনে জানি না।
তবে শাহবাগের দিনগুলো আসবে কিনা সেটাও জানি না। তবে দিনগুলো কখনো ভুলবো না।
আমাদের সবার স্বপ্নভঙ্গও ভুলবো না।
হয়ত এক হবো… সেই আশাই আছে এখন, আশা ছাড়া আর কিছু নেই… 🙁
স্বপ্ন
শিরোনামটা যথার্থ হয়েছে আপু।পরীক্ষার জন্য দোয়া করি।আপু ডাক্তার হয়ে যেনো সোনেলার ব্লগারদের অর্ধেক ফিতে চিকিৎসা করতে পারেন :p
কৃন্তনিকা
পড়ার জন্য ধন্যবাদ। 🙂
আর সবাইকে ফ্রীতে দিলেও স্বপ্নর জন্য কোন ফ্রী নেই… 😛
স্বপ্ন
কেন আমার জন্য ফ্রি নেই কেনো? আমি কি করেছি আপু ;( বেশি কাঁদাবেন না, চোখের পানিতে আপনার পোষ্টের লেখা মুছে গেলে আপনি দায়ী 😀
কৃন্তনিকা
আচ্ছা, হয়েছে, হয়েছে… আর কাঁদতে হবে না।
লেখার পোস্ট মুছে গেলে তো বিপদ… :@
নওশিন মিশু
শুভ কামনা রইলো… -{@
কৃন্তনিকা
পড়ার জন্য ধন্যবাদ 🙂
ছাইরাছ হেলাল
অবশ্যই আপনার মঙ্গল কামনা করি।
তবে শাহবাগে আমি হতাশ আশা ভঙ্গে।প্রতারিত মনে হয় নিজেকে।
কৃন্তনিকা
আমরা সবাই তো আশাহত হয়েছি। চোখের সামনে প্রাণের আন্দোলনকে দমে যেতে দেখেছি…
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
আপনার জন্যও শুভকামনা।
মেহেরী তাজ
আপনাকেও বিজয় মাসের শুভেচ্ছা আপু।
কৃন্তনিকা
পড়ার জন্য ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন। 🙂
প্রহেলিকা
আপনার গল্প আগেও পড়েছি, লেখায় একধরনের মাদকতা রয়েছে, দক্ষ হাত আপনার, এমন করে লিখতে পারলে আর কি চাই জীবনে! শুভেচ্ছা জানবেন।
কৃন্তনিকা
পড়ার জন্য ধন্যবাদ। 🙂 মন ভালো করে দিলেন কথা দিয়ে… 😀
ভালো থাকবেন।
শিশির কনা
নববর্ষের শুভেচ্ছা আপু -{@
কৃন্তনিকা
দেরীতে হলেও আপনাকে শুভেচ্ছা…