২ নাম্বার জোনে পৌছার আগে আমরা মূল সড়কের হাতের বাঁ দিকে উঁচু গাছে একটা পাখির দেখা পাইলাম। দূর থেকে বুঝা যাচ্ছিলো না কি পাখি? দূরবীন দিয়ে পাখিটিকে দেখার চেষ্টা করলাম। অপরিচিত মনে হলো। নিশ্চিত হলাম পরিযায়ী ও আমার অদেখা পাখি। চিল বা ঈগল জাতীয় মনে হলো। বেশ কিছুক্ষন অপেক্ষা করলাম। পাখিটির গতিবিধি জানার চেষ্টা করলাম। অনেক সময় উঁচু গাছে বসা পাখিগুলি বেশী সময় বসে থাকে না। সেই অভিজ্ঞতাটা কাজে লাগানোর জন্য অপেক্ষা ছাড়া বিকল্প আর কোন উপায় ছিলো না। এত দূরে থাকায় ছবিও হবে না। তাই কোন ক্লিক করলাম না। এমন সময় পাখিটি উড়ে গেল। দৃষ্টি রাখলাম কোন দিকে যায়। বনটির পরিবেশ আমার অপরিচিত। তাই আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না যে, উড়ন্ত পাখিটির অবস্থান কোথায় হতে পারে। আমার সঙ্গে জীতেন ছিলো। জীতেনকে বললাম পাখিটি যে দিকে উড়ে গেল সেই দিকটা কোথায় হতে পারে? জবাব দিলো “সাহাবজি দো নাম্বার জোনপে গ্যায়া”।
আমি আর আগ্রহ দেখালাম না।
আমরা ২ নাম্বার জোনের প্রবেশ মুখে পৌছালাম। জোনের প্রবেশ মুখ থেকে সোজা ৬ ফুট চওড়া একটি মাত্র মাটির রাস্তা। দুই পাশে বিল। এই বিলের জলজ গাছগুলি একটু ভিন্ন লাগলো। এখানে তৃণ জাতীয় ঘাসের মতন লম্বা লম্বা জলজ উদ্ভিদ। তাই হাঁস জাতীয় পাখি থাকার সম্ভাবনা নেই। কারন এই বিলে এদের খাবার সংকট। লম্বা ঠোঁট জাতীয় পাখির মিলনমেলা এখানে। এরা এদের ঠোঁট জলজ ঘাসের ভিতর গুঁজে দিয়ে খাবার সংগ্রহ করতে পারে। হাঁস জাতীয় পাখির পক্ষে সম্ভব না। কারন এদের ঠোঁট ছোট। পাখির উপর (যেমন,খাদ্যাভ্যাস,বাসস্থান,প্রজনন, প্রাপ্তির মৌসুম) যতটুকু লেখা-পড়া করেছি তার সব কিছুই এই জোনের বিলে প্রমান মিললো।
আমরা সঙ্গীরা যার যার মতন ছবি তোলা শুরু করলো। আমার সঙ্গে কিসমত খোন্দকার ভাই প্রথমদিন থেকেই আঁঠার মতন লেগে ছিলেন। উনার এক কথা যা তুলবো আপনার সঙ্গে তুলবো। মাঝে মাঝে উনাকে ক্যামেরা সেটিংস বলে দিতে হয়। খুব ধীরস্থির শান্ত,ভদ্র ও মার্জিত ভাষার একজন মানুষ। বয়সে আমার থেকে ৭ বছরের বড়। তারপরও বার্ড ফটোগ্রাফী শেখার জন্য তাঁর আগ্রহ ও উৎস্বর্গ আমাকে মৃগ্ধ করে। আমিও তাঁকে খুব সম্মান ও শ্রদ্ধা করি। পেশায় প্রতিভাযশঃ একজন সাংবাদিক। এই বিলে বেগুনী বক, বড় বক, কানিবক, স্পুনবিল, প্রজাতির পাখিগুলি জায়গায় দাঁড়িয়ে খাবার খাচ্ছে। তেমন একটা ইচ্ছা হলো না ছবি তোলার। কারন সবগুলি পাখির ভাল ভাল ছবি আমরা আগেই তুলেছি । হঠাৎ চোখে পড়লো Glossy Ibis বা রঙ্গিন কাস্তেচরা বা চকচকা কাস্তেচরা। খুব একটা ভাল ছবি দেশে পাই নাই। কিসমত ভাই জানতে চাইলেন কি পাখি? আমি জবাব দিলাম। তার আগ্রহ বেড়ে গেল আমার চেয়ে দ্বিগুন। অন্য সঙ্গীদের ডেকে আনতে বললাম। তারা আমায় থেকে একটু দূরে পাখির ছবি তোলায় ব্যাস্ত ছিলো। সবাই আসলো। তাঁদেরকে চুপ করে বসতে বললাম। অপেক্ষা করলাম পাখিটি সামনে আসে কিনা।
আমরা এক ঘন্টার মতন অপেক্ষা করলাম। কাস্তেচরা খাবারে ব্যাস্ত। হঠাৎ দেখি মোটামুটি কাছে বড় বকের সঙ্গে কাস্তেচরা খাবার খাচ্ছে। যার যার মতন কাস্তেচরার ছবি তুললাম। দেশের চেয়ে ভাল মানের ছবি হওয়ায় আমি খুশীতে বাকবাকুম। আমার পাঠক ভাইদের রঙ্গিন কাস্তেচরা বা চকচকা কাস্তেচরার ছবি দেখার জন্য দিলাম।
Glossy Ibis বা রঙ্গিন কাস্তেচরা বা চকচকা কাস্তেচরা।
Glossy Ibis বা রঙ্গিন কাস্তেচরা বা চকচকা কাস্তেচরা।
কাস্তেচরার ছবি তুলে সামনে দিকে অগ্রসর হলাম। হাতের বাঁদিকে বিলের উপর গাছে Night heron বা নিশবকপাখির দেখা পেলাম। এরা মূলত নিশিচর পাখি। রাতের বেলায় পানিতে দাঁড়িয়ে মাছ শিকার করে। দিনে উঁচু গাছের ডালে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। মাঝে মাঝে খাবারের জন্য পানিতে নামে। তবে রাতেই শিকার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। নিশিবক আমাদের দেশীয় আবাসিক পাখি। বহুবার তুলেছি ঢাকার চিড়িয়াখানার লেকে ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পুকুড় পাড়ে। তারপরও ভাল মানের ছবি জন্য পাখিটিকে ফোকাস করে ক্লিক করলাম। সবাই নিশি বকের ছবি তুলে সামনে দিকে অগ্রসর হলাম। পাঠক বন্ধুদের নিশিবকের ছবিটি দেখার অনুরোধ রইলো।
Night heron বা নিশবক।
ঘড়ির কাঁটায় তখন বেলা ৩ট। দুপুরের আহারের জন্য আমরা জোনের ভিতর থেকে বের হলাম। কেন্টিনে এসে দুপুরের খাবার খেলাম। খাবারের আয়োজন করে আগেই পাঠিয়েছিলো ট্যুর অপারেটর সুজিত বেরা। পরেটা, সব্জি ভাঁজি, কলা ও জুস দিয়ে আহার শেষ করলাম। এক কাপ চা পান করে আবারো ভিতরে ঢুকলাম। কিছুদূর যাবার পর সেই পাখিটি নজরে পড়লো। এবার বেশ খানিকটা কাছে। দূরবীন দিয়ে দেখে নিলাম। পাখিটি দেখার পর উত্তেজনা বেড়ে গেল। আমার ১৬ বছরের ফটোগ্রাফী জীবনে এই পাখি প্রথম দেখলাম। আইডি বা পরিচয় জানি না। গাছে ডালে বসে ছিল। আকাশ ব্যাকগ্রাউন্ড হওয়ায় মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিছুই করার নেই। আমরা সবাই ছবি তুললাম। আমি সবাইকে বললাম,যদি পাখিটা উড়াল দিতো তবে ভাল একটা ব্যাকগ্রাউন্ড সহ ফ্রেম পেতাম।সবাইকে ক্যামেরায় ফ্লাইট ছবির সেটিংস করে রাখতে বললাম। বলতে না বলতে পাখিটি উড়াল দিলো। যে,যেভাবে পারলো উড়ন্ত পাখির ছবি তুললো। আমি অনুমানের উপর শাটার চেপে ধরলাম। হাইস্পীড শাটার ছিলো। প্রতি সেকেন্ডে ৯টি ছবি উঠে। মনের একটা আশা ছিল যে, এই ৯টি ছবির মধ্যে যে কোন একটা ছবি ফ্রেম বন্দী হলেই কাজ হবে। পরে মনিটরে প্রিভিউতে দেখতে পেলাম একটি শট মনের মতন হয়েছে। রুমে এসে পাখিটির আইডি বের করে জানলাম এটা Egyptian Vulture বা ধলা শকুন বা সোয়েট শকুন। পাঠক বন্ধুদের কাছে পাখিটির ছবি ও পরিচয় তুলে ধরলাম।
Egyptian Vulture বা ধলা শকুন বা সোয়েট শকুন
*
Egyptian Vulture বা ধলা শকুন বা সোয়েট শকুনNeophorn গোত্রের Neophorn Percnopterusপরিবারের অন্তর্ভুক্ত ৬১ সেঃমিঃ দৈর্ঘ্যের বড় আকারের মাংসাশী পাখি। সারা বিশ্বে একটি প্রজাতি। ঠোঁট সরু ও লম্বা। নাকের ছ্যাদা সরু। মাথার পাশ,চাঁদি,থুতনি,গলা ও ঘাড় পালকহীন। ডানা বেশ খানিকটা লম্বা ও লেজ খাঁটো। ডানার মধ্যে মাঝখানটা কালো। দেহের পালকের রং মরচে রঙ্গের। ঠোঁট হলুদ। চোখ লালচে-হলুদ। পা ও পায়ের পাতা কালচে হলুদ।
ধলা শকুন বনের ধার,লোকালয়, ভাগার ও কসাইখানায় বিচরন করে। একা কিংবা জোড়ায় থাকে। মৃত কোন পশুর দেহ বা খাবারের উচ্ছিষ্ট বেশী থাকলে ছোট বা বড় দলে দেখা যায়। মৃত প্রানীর খোঁজে আকাশে উড়ে ও বনের ভিতর উঁচু গাছে বসে থাকে। এদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে মরা প্রাণী, পচা মাংস ও বড় বড় মাছ। এরা আবর্জনার স্তুপ থেকেও খাবার সংগ্রহ করে। জীবন্ত কোন প্রাণী শিকার করে খায় না। মৃত প্রানীই এদের ভরসা।ফেব্রুয়ারী থেকে এপ্রিল মাস প্রজননকাল। প্রজননকালে উঁচু গাছের ডালে ডাল-পালা দিয়ে মাচার মতন বাসা বানায়। নিজেদের বানানো বাসায় মেয়ে পাখি দুুটি ইট-লাল রঙের ডিম পাড়ে।
এরা বাংলাদেশে অনিয়মিত পাখি। ইউরোপ,আমেরিকা,ভারত,মিশর,শ্রীলংকা,ইরান,আফিগানিস্তান, ও আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যে নিয়মিত দেখা যায়।
অভিজ্ঞতা থেকে জানি এরা খাবারের সময় হুঁশ জ্ঞান থাকে না। খাবার খেতে খেতে আগাতে থাকে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এরা ঘুরে ঘুরে খাবার খায় না। এক জায়গা থেকে শুরু করে সোজা সেই জায়গায় খেতে খেতে আগাতে থাকে। ওরা যখন খাবার খাচ্ছিলো তখন ওদের মুখ ছিলো আমাদের দিকে। তাই আমি নিশ্চিত ছিলাম ওরা খাবার খেতে খেতে আমাদের দিকেই আসবে। যদি চুপ করে বসে থাকা যায়। সেই অভিজ্ঞতাটা কাজে লাগিয়ে তুললাম।
ধন্যবাদ ভাইজান। শুভ কামনা রইলো।
১৪টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
Egyptian Vulture!! আহা আহা!!
তবে বকের এত কাছে কী করে গেলেন!!
শামীম চৌধুরী
অভিজ্ঞতা থেকে জানি এরা খাবারের সময় হুঁশ জ্ঞান থাকে না। খাবার খেতে খেতে আগাতে থাকে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এরা ঘুরে ঘুরে খাবার খায় না। এক জায়গা থেকে শুরু করে সোজা সেই জায়গায় খেতে খেতে আগাতে থাকে। ওরা যখন খাবার খাচ্ছিলো তখন ওদের মুখ ছিলো আমাদের দিকে। তাই আমি নিশ্চিত ছিলাম ওরা খাবার খেতে খেতে আমাদের দিকেই আসবে। যদি চুপ করে বসে থাকা যায়। সেই অভিজ্ঞতাটা কাজে লাগিয়ে তুললাম।
ধন্যবাদ ভাইজান। শুভ কামনা রইলো।
আলমগীর সরকার লিটন
শকুনের ছবিটা খুব সুন্দর লাগল আমাদের দেশে এই ধলা শকুন দেখা যায় শামীম দা
শামীম চৌধুরী
নাহ দাদাভাই।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
চকচকে কাস্তেচোরার রঙটা দারুন। নিশিবক দেখে তো পুরাই টাস্কি খাইলাম। শোয়েট শকুনের উড়ন্ত ছবিটা দারুন ভাইয়া। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন শুভকামনা অবিরাম
শামীম চৌধুরী
অনেক ধন্যবাদ দিদিভাই।
শুভ কামনা রইলো।
রোকসানা খন্দকার রুকু।
শকুন তো আক্রমনাত্মক হয়।কাছে গেলেন ক্যামনে।
শুভ কামনা।
শামীম চৌধুরী
কাছে যেতে পারিনি। তবে সব জীব-জন্তু মানুষকে প্রথম দর্শনেই ভয় পায়। তার জীবন রক্ষার জন্য নিরুপায় হয়ে আক্রমন করে। এটাই বিধাতা শিখিয়েছেন।
সুপায়ন বড়ুয়া
ভাই আমার মামাকে দেখতে গিয়ে
পান অনেক পাখি
মনটা মোদের ভরে যায়
ধলা বকে আর নিশি বক পাখি
শুভ কামনা।
শামীম চৌধুরী
আপনার ছন্দেভরা মন্তব্য খুব ভাল লাগে। শুভ কামনা রইলো।
তৌহিদ
আজ তিনটি পাখি সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করলাম। কাস্তেচরা নিশবক, সোয়েট শকুনের ছবিগুলি দুর্দান্ত তুলেছেন ভাইজান।
উড়ন্ত পাখির ছবি তোলার জন্য অভিজ্ঞতা এবং শ্রম দুটোরই প্রয়োজন বলেই জানি। সেক্ষেত্রে আপনি সফল মানুষ অবশ্যই।
শুভকামনা রইলো ভাই।
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ তৌহিদ। তোমার মন্তব্যে অনুপ্ররনা পাই।
আরজু মুক্তা
নিশবকের ছবিটা দারুণ। আল্লাহ কতো কিছু দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে এই পৃথিবী!
শামীম চৌধুরী
সব সৃষ্টিই সুন্দর।