মানুষ কি আদৌ সৃষ্টির সেরা জীব!

রিতু জাহান ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, শুক্রবার, ০১:১৫:০০অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি ১৯ মন্তব্য

পৃথিবীতে মানুষকে সৃষ্টির সেরা বলা হয়েছে প্রতিবার প্রতিটি যায়গাতে। আল-কোরআন থেকে শুরু করে প্রতিটি হাদিসেই একই কথা। প্রতিটা ধর্মেও এক কথা।

সৃষ্টিকর্তার তার সৃষ্টির সকল কিছু থেকে মানুষকেই তার সৃষ্টির সেরা বলেছে।

এ পৃথিবীর রূপ রস সবই তার এই মানুষের জন্যই। মানুষের জন্যই সৃষ্টি এই সবুজ সুন্দর এক পৃথিবী। সৃষ্টির এক শৃঙ্খলা বেঁধে দিয়েছেন তিনি প্রকৃতিতে।

মানুষকে তিনি সৃষ্টি করেছেন মন নামক এক অনুভূতি দিয়ে। যেনো সে পৃথিবীর তাবৎ সৃস্টির সুষ্ঠু ব্যাবহার করতে পারে। যেখানে সুখ আছে, আনন্দ আছে। কষ্ট আছে আছে, দুঃখ আছে। আর সে দুঃখ বয়ে নিয়ে বেড়ানোর এক অসীম ক্ষমতা আছে।

পৃথিবীতে মানুষ যদি সৃষ্টির সেরা হয় তবে মা সে সৃষ্টির সেরা অনুভূতির নাম। মা এক অন্যরকম ভালবাসা, মায়া মমতার নাম।

তবুও কি মনুষ্য প্রজাতি মায়ের অনুভূতি সব থেকে শক্তিশালী?

আজ কয়েকদিন ধরে এ কথাটা আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। কেনো যেনো ইদানিং আমি এটা মানতে পারছি না যে মানুষই সৃষ্টির সেরা।

এর ব্যাখ্যা অনেক।

আমি কোনো লেখক নই। বা কোনো দার্ষনিকও নই। আমি শুধু আমার অনুভূতিরই প্রকাশ করতে পারি।

সেদিন কয়েকটি ভিডিও দেখার পর আমি আসলে আর মানুষের সাথে অন্য প্রাণীর মাতৃত্বের তুলনা করতে পারছি না।

সেদিন একটা ভিডিওতে দেখলাম একটা মা হরিণী তার শাবককে বাঁচানোর জন্য নিজে কুমিরের সামনে চলে গেলো। ভিডিওটা আমি কয়েকবার দেখেছি। ফেসবুকেও দেখেছি। বার বার রিভিউ করে দেখেছি।

অপরদিকে মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে দেখি মানব শিশু পথে প্রান্তরে ডাস্টবিনে। সামান্য আনন্দপেতে অবৈধ মাতৃত্বের স্বাদ নিচ্ছে অনিচ্ছায়। গলা টিপে মেরে ফেলে ছুঁড়ে ফেলছে ডাস্টবিনে। শেয়াল কুকুর ছিঁড়ে খাচ্ছে সে সব মানব শিশু। অথবা ছুঁরি কাঁচির এলোপাথাড়ি আঁচড়ে টুকরো টুকরো জচ্ছে মানব ভ্রুণ মায়েরই পেটে। অথবা কোনো এতিমখানায় ছুঁড়ে ফেলছে এমন সব অবৈধ সন্তান। কোনো সৃষ্টিই অবৈধ হতে পারে না। শুধু স্বীকৃতিটাই বৈধ ও অবৈধ বলে ধরে নেই আমরা। যাদের আসলে বৈধ বৈবাহিক কোনো স্বীকৃতি নেই। আবার অবশ্য প্রচন্ড অর্থ কষ্টেও বাচ্চা এতিমখানায় চলে যায়। এটা আলাদা বিষয়। কিন্তু ব্যাপারটা ঐ মাতৃত্বের প্রশ্নেই। যে তার সন্তানকে নিজের কাছে আগলে রাখতে পারলো না। আবার দেখছি অহরহ শিশুর শরীর ছিঁড়ে খাচ্ছে অন্য পুরুষ সেও মানব!

এদিকে, সৃষ্টির সেরা জীব একজন মনুষ্য মা হিসেবে আমি কি সে মা হরিণীর পাশাপাশি যেতে পেরেছি?

প্রশ্নটা কিন্তু আমার নিজের জন্যই। অন্য কারো জন্য না। কারণ, এ প্রশ্নটা আজ আমাকে কয়েকদিন থেকে ঘুমাতে দিচ্ছে না।

আমি মূলত তিন সন্তানের মা। বিয়ের দুই বছর পরে প্রথম মা হওয়ার অনুভূতি। আমার প্রথম সন্তান জীনেতা। ওকে দশ মাস পেটে রেখে প্রতিটা মুহূর্ত আমি ওর সাথে কথা বলেছি। ওকে উপলব্ধি করেছি। কিন্তু যখন পৃথিবীতে এলো সবার প্রচন্ড অবহেলায় ও টিকতে পারলো না এ পৃথিবীর সৃষ্টির মধ্যে।

এ ক্ষেত্রে অনেকটা দোষ কি আমার ছিলো না! না, কোনো হসপিটাল না কোনো ট্রিটমেন্ট এর সুযোগ।

ও ওর মায়ের হাতের একটুকু স্পর্শ ছাড়াই চলে গেলো। ওর তুলতুলে ফর্সা শরীরটাকে বাপের বাড়ি কবর দিয়ে চলে আসলাম দিব্যি সংসার করতে দূরে অন্য শহরে।

আমি ঠিকঠাক সংসার করতে লাগলাম। কষ্ট সহ্য করারও এক আশ্চার্যরকম ক্ষমতাও দিয়ে দিয়েছে সৃষ্টিকর্তা মানুষকে।

তাই হয়তো জীবনের নিয়মে সবই চলতে লাগলো আমার। অনেক সাধনায় এক সময় মেমন এলো। মেমনকে আমি এক মুহূর্ত কারো কাছে দিতাম না। বলতে গেলে চোখের আড়াল করতাম না। মেমনও এক মুহূর্ত মাকে ছাড়া থাকে না। ঘুমাতেও পারতো না আমাকে ছাড়া। কিন্তু, সেই আমি আমার এতোটুকু মেমনকে এমনভাবে কাউন্সিল করলাম যে ছেলে আমার ক্যাডেট কলেজে একা একেবারে একা থাকতে শিখে গেলো। একেবারে অপরিচিত একটা যায়গা। নানান জনের নানান মন্তব্য। যে সব মন্তব্য মা হিসেবে নেয়া আমার কষ্ট। তবু তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য তাকে দূরে রাখলাম।

ছোটো ছেলে রিয়ান খুব ভোরে একদম ঘুম থেকে উঠতে পারে না। তবু মনেপ্রাণে চাইতাম রিয়ানও চলে যাক ক্যাডেট কলেজে। তারমানে সন্তানের আনন্দে থাকা আমার কাছে কিছুই না!!

পরিবারের সবাই মনে করে আমি খুব ভালো একজন মা। অথচ আমি কি সত্যিই একজন ভালো মা?

সন্তান যেনো খুব ভালো একটা ভবিষ্যৎ পায় সে জন্য তাদের কোল থেকে ছুঁড়ে ফেলেছি সময়ের আগেই। এক নিয়মে বেঁধে রেখেছি তাদের। আকাশটাকে খুলে দিয়েছি ঠিকই কিন্তু বলেও দিয়েছি এতোটুকু তুমি এখন উড়তে পারবে। তোমার পাখায় ঠিক এখন এতোটুকু জোর আছে।

বর্তমানে মনুষ্য জীবনে প্রতিযোগিতা জীবনের প্রধান ব্যাপার বলে বিবেচিত। এ এক কঠিন জীবন দর্শন। আর বর্তমানে এমন সব কঠিন নিরানন্দ জীবন দর্শনের ফলে মানুষের আনন্দানুভূতি মরে গেছে। মানুষ হয়ে গেছে সৃষ্টির সব থেকে জঘন্যতম নিদর্শন।

চারিদিকে মৃত্যুর মিছিল। দর্শকদের আহাজারি। দুই একবেলা উফফ ! আহ ! ব্যাস, তার পর সব আগের মতোই।

মৃত্যুকে মানুষ খুব সহজেই ভুলে যায়। তারপর আবারো আগের মতোই মৃত্যুকূপ খুলে বসে তারা। মানুষ মৃত্যু চায় না অথচ মানুষই মৃত্যুর রচয়িতা। ভয়কে যারা মারে তারাই জাগিয়ে রাখে ভয়। মৃত্যুর ভয়। অসুস্থ প্রতিযোগিতা আজ মানুষকে মানসিক শৃঙ্খলায় বেঁধে রাখে না। কিন্তু এই মানসিক শৃঙ্খলাই জীবনের পক্ষে কল্যাণকর। আর সময়ের চিন্তা সময়ে করাই মানসিক শৃঙ্খলা রক্ষার উপায়। এটা সৃষ্টির সত্য। কিন্তু মানুষ যখন এ সত্য থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে তখন আর তাকে সেরা বলা যায় না। মানুষ সেরা কারণ, মানুষ তার মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু মানুষ আজ না বেঁচে, বেঁচে থাকার চিন্তা করে কাল। অথচ সে জানেই না সৃষ্টিকর্তা তার জীবন শৃঙ্খলে কি রেখেছে কতোটুকু রেখেছে। সৃষ্টির শৃঙ্খলে মৃত্যু স্বাভাবিক, বেঁচে থাকাই অস্বাভাবিক। কিন্তু যতোক্ষণ বেঁচে আছি ততোক্ষণ তো বাঁচার মতো করেই বেঁচে থাকি! কিন্তু এটা না করে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতে গিয়ে মৃত্যুর খেলায় ব্যাস্ত তাদের চেতন ও অবচেতন মনেই। অথচ প্রত্যেকেই উদ্বেগজনকভাবে সমস্যার সমাধান চায়। স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চায় তাও শতোবছর আয়ুর পরেই। অস্বাভাবিক মৃত্যু যেনো না আসে সে চিন্তা করে কিন্তু প্রতিযোগিতাও চাই অর্থের।

কি অদ্ভুত না এই মৃত্যুর খেলা! যেখান থেকে আমি আর কোনো দিন কখনোই ফিরে আসব না। আমার শরীর তার শরীর পঁচে গলে শেষ হয়ে যাবে। পৃথিবীর কোনো শক্তিই আর তা ফিরাতে পারবে না আগের মতো। অথচ মানুষই মৃত্যুর অপেক্ষা করে, মৃত্যুকে আহ্বান করে প্রতিমুহূর্তে। মানুষ মনে করে তার খুঁড়ে রাখা মৃত্যুকূপে সে নিজে পড়বে না। অন্য কেউ পড়লে তার তো আসলে কিছু যায় আসে না। সে শুধু নির্বাক হয়ে দেখবে। সে আফসোস করবে তার সামান্য আর্থিক ক্ষতিতে। কিন্তু সেও মরবে কোনো না কোনো ঘাতে বা অপঘাতে জীবনের নিয়মে সৃষ্টির নিয়মে তাকে মৃত্যুর স্বাদ তো পেতেই হবে।

আমরা প্রচলিত নীতি বাণীর সমর্থন করি। কিন্তু তা কখনোই মেনে চলি না। কারণ, আমাদের নৈতিক সাহস নেই। আমরা মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। টাকার লোভ, অর্থ, প্রযুক্তি আমাদের মনকে অনিয়ন্ত্রিত করে রেখেছে। যা সামনে আসলে আমরা আর আমরা থাকি না।

যারা পারে এ সংখ্যাও খুবই কম। সমাজে যদি দুই একজন এমন মানুষ থাকে যার মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ দেখানোর সাহস আছে, সমাজ তাকে ভয় করে। সমাজ সাথে সাথে তার গলা টিপে ধরে।

মানুষ কখনোই সৃষ্টির সেরা হতেই পারে না। মানুষকে সৃষ্টির সেরা হতে হলে তার মস্তিষ্কককে আরো উন্নত আরো উঁচুতে নিতে হবে। তাকে আজকের জন্য বাঁচতে হবে। মনকে মানসিক শৃঙ্খলে বাঁধতে হবে। তৃপ্তির স্বাধ পেতে হবে। থামতে জানতে হবে। কিন্তু আর তা কতোটুকুই বা সম্ভব!

,,রিতু,,, কুড়িগ্রাম।

২২.০২.১৯.

৮৮৬জন ৮৮৫জন
0 Shares

১৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ