শামীমের বাবা বারেক সরকার সুধির রায় বাল্যবন্ধু। এক সাথেই বেড়ে ওঠা। একসাথেই লেখা পড়া। উনিশ’শ চৌষট্টি সালের হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর তাদের বন্ধুত্ব আরো দৃঢ় হয়। কেননা, সেই ভয়াবহ দাঙ্গার সময় বারেক সরকার আপন স্বজনের মতো নয়নপুর গ্রামের হিন্দুদের; দাঙ্গাকারীদের আক্রোশের হাত থেকে আগলে রাখেন। তাদের এলাকার অন্যান্য গ্রামে এ দাঙ্গায় বেশ কিছু লোক আহত নিহত হলেও, রায় পরিবারের গায়ে একটা আচড়ও লাগতে দেননি বারেক সরকার। তারপর দাঙ্গা পরবর্তী সময়ে তাদের গ্রামের হিন্দুদের সবাই ইন্ডিয়া চলে গেলেও যাননি শুধু সুধীর রায়।
এন্ট্রাস পাশ করার পর দু’জনেরই চাকুরী হয় শহরে। সুধির বাবুর চিটাগাং আর বারেক সরকারের নারায়নগঞ্জ। কিন্তু এক দিকে গ্রামের মায়া অন্যেদিকে একে অপরকে ছেড়ে কিছুতেই শহরের চাকুরীতে যোগদান করেনি। পরে আবার দু’জনেরই চাকুরী হয় প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক হিসেবে। মাইনে দু’জনেরই ষাট টাকা করে। সুধির বাবু যোগদান করেন শামীমদের গ্রামের স্কুল নয়নপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বারেক সরকার যোগদান করেন মাইল খানেক দুরের শান্তিপুর প্রাইমারী স্কুলে। তবে বছর খানেক পরেই বারেক মাস্টার বদলী হয়ে নয়নপুর প্রাইমারী স্কুলে চলে আসেন।
শামীম যেমন বারেক মাস্টারের একমাত্র পুত্র সন্তান তেমনি মাধবীলতাও সুধির রায়ের একমাত্র কন্যা। শামীম ও লতা গ্রামের স্কুলেই পড়ে। শামীমের চেয়ে লতা তিন বছরের ছোট। দু’জন দু’জনের খেলার সাথী। এই দু’জনের মারামারি, একটু পরেই সব মিটমাট। কেননা, শামীম দিনের অধিকাংশ সময় থাকে রায় বাড়িতে। এর একটা অন্য কারণও আছে। বারেক মাস্টার নিজের ছেলেকে পড়াতে পারেন না। একটু উল্টা-পাল্টা করলেই লাগাও বেত। মার থাপ্পর। তাই রাগ করে ছেলেকে স্বামীর কাছে পড়াতে রাজী নন শামীমের মা। তিনি স্কুলের বাইরের সময়টা রায়বাবুর কাছেই ছেলের পড়াশুনার দায়িত্ব তোলে দিলেন। হাফ ছেড়ে বাঁচলেন বারেক মাস্টার ছেলেকে পড়ানো ঝামেলা থেকে। রায়বাবু সানন্দে গ্রহণ করলেন তার প্রিয় ছাত্র শামীমকে।
রমজানের চেচামেচিতে শামীমের ভাবনার সুতো কেটে যায়। রমজান ফিরে আসে। হাতে তার একটা পাটি। রমজানের হাতে পাটি দেখে শমীম বলে-
: একেবারে পাটি নিয়ে এলি যে, সারাদিনই এখানে থাকবি নাকি।
: মনে ত হয় থাকতে অইবো। টিনের চাল তাইত্যা আইগুন হইয়া রইছে। যেন রুটি ছেকার তাওয়া। বাপরে বাপ! এমন গরম বাপ-দাদা-চৌদ্দ গোষ্ঠীর আমলে দেহি নাই। আর কথা বাড়াইয়া লাভ নাই। এখন গাছ থাইক্যা নাইম্যা আসেন ‘গাছ বাবা’ বলে নিজে নিজেই উচ্চস্বরে হাসে রমজান।
শামীম নেমে এসে শীতল পাটিতে বসতে বসতে বলে-
: তুইনা বললি, তোর মাথায় শুধু গোবর। এখন দেখছি বুদ্ধিও আছে। এটা একটা ভাল কাজ করেছিস।
: তুই গোবরের কতা কইলি না। গোবরেও কিন্তু বালা সার হয়।
: খুব সুন্দর বলেছিসতো। ঠোটের কোনে হাসি ঝুলিয়ে রেখেই শামীম বলে-
: আসলে তুই হোলি ‘জাতে মাতাল, তালে ঠিক’। মাথায় যদি গোরবই থাকবে, তুই এমন মনজু হয়ে উঠলি কিভাবে? বল, কিভাবে হলি?
রমজান পাশ কাটিয়ে বলে-
: সব ব্যবস্থা কইরা আইলাম।
: কথার জবাব দিলি না এরই মধ্যে আবার কি ব্যবস্থা করে এলি তুই।
: একটু পরেই দেখবি। ঘটনা যহন ঘটব।
না দেরি নয়। এক্ষনি বলবি কি ঘটনা।
: আরে পাগল। তুই দেখসনি, কিন্তু আলেয়াকে দেখেই আমি দৌড় দিয়েছিলাম। একটু দেহা কইরা আইলাম; আর তর লাইগ্যাও একটা ব্যবস্থা কইরা আইলাম।
: আমার জন্য ব্যবস্থা মানে। শামীমের কৌতুহল বাড়ে।
: কইলামতো এই একটু অপেক্ষা কর।
: অপেক্ষা করতে পারবনা। যা বলার এখনই বল। নাইলে তোর কান ছিড়ে ফেলবো হারামজাদা।
: কান আর ছিরতে হইব না, কইতাছি, কইতাছি-
: আলেয়ারে পাঠাইছি লতাদের বাড়িতে। কইছি, তুই আর আমি এইখানে আছি। আলেয়া যেন লতাকে নিয়া তাড়াতাড়ি এই জাগায় চইল্লা আসে। কি কাজটা ঠিক করি নাই?
: এটা মোটেও ঠিক করিসনি। চেহারায় কেমন বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে শামীম বলে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সেখুবই পুলকিত।
: ক্যান ঠিক করি নাই, ক।
: কতদিন দেখা নেই বেচারী সাথে। কি না কি ভেবে বসে।
: কিছুই মনে করব না। তুই বাড়িত না থাকতে এক দুই দিনের জন্য লতা বাড়িতে আইলেঐ আমার কাছে তর এই কথা, সেই কথা জিগাইত। জিগাইতো তুই এখন দেখতে কেমন হইছত, ছোট বেলার কতা তর মনে আছেনি এসব। একবার তো বলেই ফেল্ল- রমজান দা! তোমার বন্ধুরে ঢাকা একটা খরব পাঠাওনা, বলই আমি আসছি। তারে দেখতে ভীষণ মন চায়। আমি হেইদিন বুঝছি তার কতা।
: তো আমাকে খবর দিলি না!
: খবরের লাইগ্যা গেছিলাম ত চাচী আম্মার কাছে। চাচী আম্মারে জিগাইতেই কইল তর নাহি কিয়ের পরীক্ষা। তগ ইনিবারসিটির পরীক্ষার ত আবার ঠিক-ঠিকানা নাই। সারা বছর খালী পরীক্ষা আর পরীক্ষা।
: এটা কোন যুক্তি হলো। তুই আমাকে খবর দিয়ে দেখতি আসতে পারি কিনা। তাকে দেখতেতো আমারও মন চায়। কতদিন হয়ে গেল ওকে দেখি না। একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শামীম আবার বলে Ñ
: ছোট বেলায় মা ও কাকি এমন কি সুধীর স্যার ও বাবা কথায় কথায় বলতো, ধর্ম-টর্ম এতশত বোঝিনা বাপু শামীম ও লতা বড় হলে ওদের দু’জনের সাথে দু’জনের আমার বিয়ে দেব। বাবা বলতো তোমার যেমন ছেলে নাই, আমারও তেমন মেয়ে নাই। দুইজনকে আমরা বদলা বদলী করে ফেলবো। তখন অত বোঝিনি, কিন্তু এখন সেসব দিনের কথা মনে হলেই গায়ে কেমন শিহরণ জাগে।
: এইটা কি তর সত্য কথা! ঢাকা ইনিবারসিটিত পড়স, কত মেয়ের সাথে বুঝি তর লাইন ফাইন হইছে।
: না এসবে খেয়াল নেই। এক নম্বর হলো লেখাপড়া, তারপর রাজনীতি। এসব কিছু করতে করতেই সময় পাই না, লাইন টাইন মারবো কখন। তবে…একটু থামে শামীম। তারপর বলে-
: কাজের ফাঁকে বা ক্লাশে কোন মেয়ের দিকে চোখ পড়লেই মাধবী লতার চেহারার আদলটি ভেসে ওঠে আমার চোখে। তাই ওসব নিয়ে আর তেমন ভাবি না। ‘আমার ঘরে বাস করে কানাই তুমি জাননা’ গুনগুনিয়ে গানের কলিটি গায়। রমজান কথা কেড়ে নিয়ে বলে-
: এত গুরুতত্ত্বের কতা বুঝিনা, আসলে ক হেরে তর মনে আছেনি?
: শুধু মনেই নেই বলছিস কেন। আরো কিছু আছে। কিন্তু…
: কিন্তু কি?
: ওরা হিন্দু আমরা মুসলমান। আমাদের গ্রামে আর সমাজেতো এমন অসম সম্পর্ক নিয়ে অনেক কথা হবে।
: খেতাপুড়ি তোর সামাজ আর গেরামের। তুই ঠিক আছত কি না হেইডা আগে ক।
: শামীম এ প্রশ্নের কোনো উত্তার দেয়না, শুধু ম্লান হাসে।
রমজান খুব উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে-
শামীম ছোড বেলার একটা কতা কি তর মন আছে?
: কোন কথা?
: আমরা ছোড বেলায় যহন ঘর-সংসার খেলতাম-কি সুন্দর লতা তরে বাইছা নিত, আর আমারে নিত আলেয়া। মন নাই তর হেই কতা?
: খুব মনে আছে। একা হলে সেব স্মৃতি চোখে ভেসে ওঠে। আর তখন একা একাই হাসি।
: একদিনের একটা ঘটনার কতা মনে আছে?
: কোন ঘটনার কথা বল।
: এক পূজার দিন লতা একটা সুন্দর জামা পইড়া আমাগর লগে খেলতে আইছিল, কি নিয়া তগ দুইজনের মধ্যে কতা কাটাকাটি। আর তুই মেরে দিলি এক চড়। এমন জোরে মারলি তর পাঁচ আঙ্গুলের দাগ লতার ধবধবে সাদা গালে বইসা গেছিল। আর লতা তর দিকে কতক্ষণ আক্রোশের চোহে চাইয়া থাইক্যা যেই কইল-‘তুমি একটা কুত্তা’ আর অমনি তুই তারে পাকা ঘাটলা থাইক্যা ধাক্কা মইরা পানিত ফালাইয়া দিছলি। আর সে যহন ডুইবা যাইতাছিল তুই আর আমি এক সাথে লাফ দিয়া পানিতে ঝাঁপাইয়া পইয়া তারে উঠাইয়া আনছিলাম। লতা অনেক পানি খাইয়া ফালাইছিল। মন আছে তর সেই কতা?
: কেন মনে থাকবেনা। ঢের মনে আছে। কমা, সেমি কোলন, দাড়ি সব মনে আছে আমি সেদিন সেখান থেকে এক দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম। তুই গেলি আমার পিছু পিছু। লুকিয়ে থাকলাম গিয়ে আমাদের গোলাঘরে। বিকালে আমরা সবাই গোমতির তীরে দলবেঁধে বিসর্জন দেখতে গেলাম, কিন্তু গিয়ে দেখি সেখানে লতা নেই। বিসর্জন হয়ে গেলে, কাকি মাও তাড়াহুড়ো করে চলে যাচ্ছিলেন। আমি সাহস করে কাকি মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম-
: কাকি মা, লতা আসে নাই?
: কাকি মা হতাশ হয়ে বললেন-
: না বাবা, লতাতো আসে নাই। ওর ভীষণ জ্বর। জ্বরে যেন গা পুড়ে যাচ্ছে। তাই আমি তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছি। তোমার মাকে বল সন্ধ্যার পর একবার আমাদের বাড়ি এসে লতাকে যেন দেখে যায়। আমি গেলাম। এসো কিন্তু।
: কাকিমা’র আচরণ দেখে সেদিন আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। তা হলে লতা কি বাড়িতে গিয়ে চড়মারা ও পনিতে ফেলে দেয়ার বিষয়ে কিছুই বলেনি। এরপর ওর জন্য আমার খুব মায়া হয়েছিল। কেমন মায়া হয়েছিল এখন তা তোকে বোঝাতে পারবো না। তাই বাড়ি এসে তাড়াহুরো করে মাকে নিয়ে সন্ধ্যার পর পরই লতাদের বাড়িতে যাই।
গিয়ে দেখি জ্বরে লতা কাঁপছে। কপালে তার পানি পট্টি। আমাকে দেখে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিল। আমি ভাবলাম এই সেরেছে। এই বুঝি লতা মাকে ও কাকিমাকে চড় মারা ও পানিতে ফেলে দেয়ার কথা বলে দেবে। কিন্তু আশ্চর্য সে এসবের কিছু বলল না; শুধু কেঁদেই যাচ্ছিল। শেষে মা তাকে একটু আদর করে দিতেই কান্না শেষ। এ দৃশ্য দেখে আমার মনে হলো, লতা বুঝি বলছে, চাচি আপনার দুষ্টু ছেলেটা আমাকেতো মারলই মারল; তার ওপর ধাক্কা দিয়ে দিঘিতে ফেলে দিয়ে আমার এ অবস্থা করেছে। আপনি এর বিচার করেন।’
এসব কথার পর শামীম ও রমজান দু’জনের চোখের পাতাই নিমিষে ভিজে ওঠে কেমন।
দিঘির অপর পাড় থেকে মায়ের ডাক ভেসে আসতেই রমজান আবার চলে যেতে উদ্যত হয়। শামীম জিজ্ঞেস করে-
: কিরে চলে যাচ্ছিস নাকি?
: না না। পাগল নাকি তরে ফালাইয়া আমি চইল্লা যামু। তুই যতদিন বাড়ি আসত আমার আর কোন কাজ নাই। একমাত্র কাজ হইল তর লগে লগে থাহা।
: এখনও আহেনা ক্যান? স্বগোতুক্তি করে রমজান । তুই ব। আমি আইতাছি।
রমজান চলে যায়। শমীম রমজানের চলে যাওয়া দেখে। শামীম বেকার হলেও বেকার নয়। নয় বখাটেও। তার অনেক কাজ। গ্রামের সব মানুষ কোন সমস্যায় পড়লেই শামীমের কাছে ছুটে আছে। সে নিজের মনে করে সবার কাজই করে দেয়। সে গ্রামের উঠতি বয়সের ছেলেদের নিয়ে গঠন করেছে একটি স্বেচ্ছাসেবী যুব সংগঠন। সংগঠনটির নাম…পাখিটাখির নামে একটা কিছু হবে। রমজান সেটার প্রেসিডেন্ট। যুব সংগঠন করার সময় শামীমকে এ সংগঠনের সাথে যুক্ত রাখতে এমন কোন চেষ্টা নেই যা রমজান করেনি। কিন্তু লেখাপড়ার চাপে সংগঠনের কাজ করতে পারবেনা বলেই এর সাথে যুক্ত হয়নি সে। এই কাজটি করতে যেয়ে রমজান এখন সবার প্রিয় পাত্র। তাই তাকে সবাই মান্যগণ্য করে। জীবন যাপনে খুবই সহজ সরল। মানুষের ভাল ছাড়া কোনো খারাপ করেছে তা কেউ বলতে পারবেনা। তবে…খারাপ কাজর মধ্যে একটা কাজ সে করে, আর সেটা হলো আলেয়ার সাথে বাড়াবাড়ি রকমের সম্পর্ক। এনিয়ে গ্রামের মানুষ ফিসফাস করলেও সামনে কিছু বলে না। এ কাজটি ছাড়া সব কাজ তার মানুষের কল্যাণে। এ জন্যই রমজানকে শামীমের বেশ ভাল লাগে। ভাবনা মুলতবি রেখে শামীম আবার স্মৃতির পাতা উল্টায়-
পঞ্চম শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষায় শামীম মেধা তালিকায় বৃত্তি পেল। সরকার বাড়ি ও রায় বাড়ি দুই বাড়িতেই যেন আনন্দ উছলে পড়ে। সরকার বাড়িতে আনন্দ নিজেদের একমাত্র পুত্র সন্তান মেধা তালিকায় বৃত্তি পেয়েছে। আর অন্যদিকে রায় বাড়িতে আনন্দ বন্ধুর ছেলেকে নিজের তত্ত্বাবধানে পড়িয়ে এমন ফলাফল করাতে পেরেছে রায় বাবু।
আনন্দের পাশাপাশি হতাশাও ভর করলো শামীমের মনে। গ্রামের স্কুলে আর তার থাকা হবে না। সরকার বাড়িতে বাজতে থাকলো বিদায়ের করুন সুর। সে সুর গিয়ে আছড়ে পড়লো রায় বাড়িতেও। আনন্দ কলরোল শৈশবের সব স্মৃতি পেছনে ফেলে শামীমকে চলে যেতে হলো। কেননা, তাদের আশেপাশে হাইস্কুল নেই। বাড়ি থেকে প্রায় পাঁচ মাইল দূরে আনন্দময়ী হাই স্কুলে শামীম ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হলো। সেখানে থাকে সে স্কুল বডিংয়ে। কিছুতেই সে মন বসাতে পারেনা পড়া লেখায়। বার বারই কেবল মা-বাবা, বন্ধুবান্ধব সহপাটি, স্কুল, গ্রামের ঝোপঝার, দিঘির কাকচক্ষু শীতল জল, দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ রমজানদের সাথে সারাবেলা ঘুরে বেড়ানো স্মৃতি মনের মধ্যে ভেসে বেড়ায়। সব চেয়ে বেশী মনে পড়ে মাধবী লতার কথা।
: কৈশোরে এসে, শমীম বুঝতে পারে, লতার জন্য তার মনের ভেতর সুক্ষ্ম একটা ব্যথার অনুভুতি। যে ব্যথার কথা বিশ্লেষণ করা যায়না ভাষায়। শুধু মনের গহনে পোষণ করা যায়। মনটা সারাক্ষণ এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়। বাড়ি চলে আসতে মন চায়। সবচেয়ে বেশি বেশি মনে পড়ে সে যেদিন চলে আসে এর আগের দিনের কথা। রাতের শামীম যখন স্যারের কাছে বিদায় নিতে যায় সে দিনের সেই হৃদয়বিদারক স্মৃতির কথা। সবার চোখেই অশ্রু, সবার চোখেই কান্না। আর সব চেয়ে আশ্চর্যজনক কান্ড ঘটিয়েছে লতা। সে তার নিজের ঘরে গিয়ে সেই যে খিল লাগিয়ে বসে আছে; কারো অনুরোধেই সে আর দরজা খুলছে না। খুলছেই না। শেষে বারেক মাস্টার ও শামীমের মা গিয়ে ডাকার পরে দরজা খোলে লতা। কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে লাল করে ফেলেছে। দু’জন তাকে বুকে টেনে নেয়ার পর কান্না থামে। কিন্তু শমীমের সাথে কোন কথাই সেদিন বলেনি সে। শামীম যে ইচ্ছে করে চলে যাচ্ছেনা, সে কথা লতা কিছুতেই বুঝতে চায় না। তাই শামীমের প্রতি তার এ রাগ।
বডিংয়ে যাওয়ার পর থেকেই, শামীম তার শারীরিক, মানসিক অবস্থায় কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করছে। গলার স্বর কেমন পুরুষালী পুরুষালী মোটামোটা মনে হচ্ছে। নাকের তলদেশে ঈদের বাঁকা চাঁদের মতো গোফ ওঠার লক্ষন স্পষ্ট। মাধবীলতার জন্যও মনের ভেতর এক অন্য রকম বাড়াবাড়ি। ফাঁক পেলেই তার বিবাগী মনটা এক দৌড়ে চলে যায় মাধবীলতার কাছে। একটু আদর সোহাগ নিয়ে আবার ফিরে আসে। কিন্তু মাধবীলতার জন্য তার এ ব্যাকুলতা ও চঞ্চলতার হেতুটি কখনো স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করতে পারছে না। আবার কখনো লতার কথা মনে হলেই ভেতরটায় কি যে তোলপাড়, কেমন এক অন্য রকমের অনুভুতি হয় তা বলে বোঝানা যায় না। সে দিন থেকেই শামীম বোঝতে পারে যৌবন এসে তার শরীরে পা রেখেছে।
____ পরের পর্বে সমাপ্ত
৬টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
হিন্দু মুসলমানরা আগে এমন ভাবেই মিলেমিশে ছিলেন,
৭৫ এর পর ধীরে ধীরে দুরত্ব তৈরি হয়।
শামিম এর স্মৃতি পড়লাম,
সমাপ্তি পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
মাহবুবুল আলম
“হিন্দু মুসলমানরা আগে এমন ভাবেই মিলেমিশে ছিলেন,
৭৫ এর পর ধীরে ধীরে দুরত্ব তৈরি হয়।”ঠিক বলেছেন। ৭৫’এর পর আমাদের অন্য এক আঁধার নেমে আসে।
ধন্যবাদ ও নিরন্তর শুভেচ্ছা!
এস.জেড বাবু
কিছু এলাকায় হিন্দু মুসলমানের মধ্যে এখনও ভাল সম্পর্ক দেখা যায়। তেমন কিছু এলাকা আমাদের আশেপাশে।
আগের পর্বটা পড়েছিলাম, এই পর্বটা বেশ যত্ন নিয়ে লিখেছেন। শেষ পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
মাহবুবুল আলম
“কিছু এলাকায় হিন্দু মুসলমানের মধ্যে এখনও ভাল সম্পর্ক দেখা যায়। তেমন কিছু এলাকা আমাদের আশেপাশে।”
তা আছে, তবে াাগের মতো নেই। সবার বেুকেই কেমন সাম্প্রদায়িকতার দীর্ঘশ্বাস!
ধন্যবাদ ভাল থাকবেন।
নিতাই বাবু
আমি যা বলতে চাই, তা হলো, সম্মানিত জিসান শা ইকরাম দাদার সুরে। দেশ স্বাধীন হবার আগে আমাদের অনেক মুসলমান শুভাকাঙ্ক্ষী ছিল। বাড়িতে আসতো, বসতো, কথা বলতো। দেশ স্বাধীন হবার পর তাঁরাই আবার একসময় বাড়ি দখলের পাঁয়তারা শুরু করে দিলো। সেই থেকে আর রেহাই পাইনি। বাধ্য হয়ে নামমাত্র মূল্যে বাড়ি বিক্রি করে শহরে আসতে বাধ্য হয়েছি। যা এখন পর্যন্ত শহরে বাস্তহারাদের মতো করে থাকছি।
যাইহোক, আপনার আগের পর্বটাও পড়ে বলে মনে হয়। মন্তব্যও করেছিলাম বোধহয়! এই পর্বটাও শুরু থেকে পড়েছি, কিন্তু সময়ের ব্যবধানে মন্তব্য করতে পারিনি। যা এখন করলাম। লেখা অনেক বড় হলেও, পুরো লেখা পড়েছি। ভালো লেগেছে, শ্রদ্ধেয় কবি দাদা। শুভকামনা সবসময়।
মাহবুবুল আলম
ঠিক বলেছেন । সুধির স্যারের মতো আমার ও কয়েকজন স্যার ছিল। এখন তাদের আর খবর জানি না। হয়তো ইন্ডিয়া চলে গেছেন। ৭৫ এর পরতো চরম নিরাপত্তা সংকটে ছিল সনাতনধর্মী ভাই বোনেরা।