মণি মেয়েটির বয়স ছিল ১১ বছর। গ্রামের একটা স্কুলে ৫ম শ্রেণীতে পড়তো সে। পড়তে ভাল লাগে না তার, শুধু ছুটে বেড়াতে মন চায় তার। একান্নবর্তী পরিবারে তার মা-বাবা, ভাই-বোনের পাশাপাশি থাকতো তার ২ চাচা ও তাদের ছেলেমেয়েরা। এদের মধ্যে তার ৩ জন চাচাতো ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে অনেক আগেই।
সেদিন আকাশ ছিল মেঘলা, থেকে থেকে বৃষ্টিতে প্রকৃতির ওপরের অংশ পরিষ্কার আর নিচের অংশে ধরণী কালো কাদাময়। বৃষ্টির কারণে হাফ স্কুল হলো। কাদার দরিয়া পেরিয়ে বাড়িতে আসে মণি। বই-খাতা রেখে দৌড় দেয় চাচাতো ভাই কলিমের বউয়ের কাছে যায়। সকালে কাঁচা আম পেড়ে রেখেছিল কলিম ভাই, এতোক্ষণে আচার বানিয়ে ফেলার কথা ভাবির। কিন্তু বিধি ছিল সেদিন বাম, ভাবিকে পেলনা মণি ঘরে। বৃষ্টিতে ভাবি সেই যে বেড়িয়েছে, তখনো আসেনি।
বিছানায় শুয়ে ছিল কলিম ভাই, মণি তাকেই জিজ্ঞেস করে ভাবি কোথায়? কলিমের মনে দুষ্টুবুদ্ধি খেলে যায়। বৃষ্টিতে কেউ আওয়াজ শুনবে না, আশেপাশেও কেউ নেই, এইতো সুবর্ণ সুযোগ। শয়তান চাচাতো ভাই কলিম মণির প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আচমকা জাপটে ধরে মণিকে। মুখ চেপে, হাত-পা বেঁধে তাকে ধর্ষণ করে জানোয়ারটা। প্রচন্ড ব্যথায়-কষ্টে মণি চিৎকার করতে থাকে, কিন্তু মুখ বাঁধা থাকায় সেটা চাপা গোঙ্গানীর মতো শোনায় আর বৃষ্টির শব্দে সেই আহাজারি মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়তে থাকে। নিষ্ঠুর প্রকৃতি তবু তার উল্লাস থামায় না।
এতো নোংরামীর পরেও থামে না কলিম, মণির মুখ বন্ধ রাখার জন্য নানারকম ভয়-ভীতি দেখায়। ১১ বছরের বাচচা মেয়েটা এসব তোয়াক্কা না করে বাঁধন খোলার সাথে সাথেই ব্যথায় ও ভয়ে গগনবিদারী চিৎকারে সবাইকে বিপদের আলামত দেয়। ভাবিও তখন এসে পড়েছে, আর পরিবারের আরো কিছু সদস্য বিপদের গন্ধ পেয়ে ছুটে আসে এবং সব বুঝতে পারে। বাচচা মেয়েটা ধর্ষণ কি বোঝে না, যা ঘটেছে সবই কেঁদে কেঁদে বলে দেয়।
রাগে-দুঃখে মণির বাবা নালিশ দেয় এলাকার ইমাম সাহেবের কাছে। সালিশ বসে যথারীতি।। লম্পট কলিম নির্লজ্জের মতো বলে, মণি নাকি তাকে কু-ইশারা করতো প্রায়ই। সেদিন তাকে একা ঘরে পেয়ে মণিই নাকি তাকে এই বাজে কাজ করার জন্য প্রলুব্ধ করে । মণির মা সেই সময় ঘরে ঢুকে এই দৃশ্য দেখে কাহিনী রটিয়েছে যে মণিকে কলিম জোর করে ধর্ষণ করেছে। এমনকি কলিমের বউও সেটাকে সমর্থন দিয়ে স্বাক্ষী দেয়, না দিলে যে তার স্বামী তাকে তালাক দেবে। তালাক দিলে সে বাচচা নিয়ে কই যাবে, কি করবে? একবারও সে অসহায় মেয়েটার কথা ভাবে না অথবা ভাবলেও পাত্তা দেয়না হয়তো। তার মতো অসহায়-পরনির্ভরশীল নারীর জন্য স্বামীই সব, স্বামী যতো বড় লম্পটই হোক না কেন।
শেষমেষ ইমাম সাহেব রায় দেয় যেনো কলিম মণিকে বিয়ে করে। কিন্তু তাতে কলিমের বউ বেঁকে বসে। সে বেঁচে থাকতে এটা হতে দেবে না, কলিমের আপত্তি নেই যদিও। অবশেষে ৩০,০০০ টাকা ক্ষতিপূরণে মিটমাট হয় এই ঘটনা। কারণ কোর্টে মামলা চালাতে গেলে অনেক ঝামেলা আর টাকা খরচ হবে। আর তাতে এই ঘটনা আরো অনেক মানুষ জেনে যাবে। যা গেছে তা তো আর ফিরে পাবার নয়, শুধু শুধু জ্বালা বাড়িয়ে কি লাভ?
এবার আসে আরেক নির্যাতন মণির ওপর পরিবার ও সমাজের কাছ থেকে। একমাসে মণি বড় হয়ে যায়। তার পড়াশোনা,খেলাধুলা, স্বাভাবিক কাজ-কর্ম সব ওলট-পালট হয়ে যায়। তার সাথে সবাই এমন ব্যবহার করে যেনো সে অস্পৃশ্য একটি বস্তু, বিশাল পাপী। মণিকে স্বান্তনা দেয়ার মতো বা তার পক্ষে কথা বলার কেউ থাকে না। সে যে কতো বড় পাপ করেছে সেটা তার পরিবার ও সমাজের মানুষ তাকে বুঝিয়ে দেয় তাদের হাব-ভাবে,কথায়-বার্তায় প্রতিটা মুহুর্তে। মা-বাবা পর্যন্ত তাকে দেখতে পারেনা। মণি মরে গেলেই যে তাদের জ্বালা জুড়াতো সেটা মণি কেন বোঝে না? মণির জন্য তার মা-বাবা, ভাই-বোন সমাজের কাউকে মুখ দেখাতে পারে না।
কিন্তু ধর্ষক কলিম দিব্যি ঘুরে বেড়ায়, কেউ কিছু বলে না। বরং কলিমের বন্ধুরা কলিমের কাছে এই ঘটনার বিবরণ ব্যাপক মজা নিয়ে শোনে এবং তারা যে এই পাশবিক সুখ ভোগ করতে পারেনি সেজন্য খুব আফসোস করে। ওদিকে কলিমের বউ স্বামীর মন যেনো আর কোনো নারীর শরীরের প্রতি আকৃষ্ট না হয় সেজন্য আদর-যত্ন, সাজ-গোজ বাড়িয়ে দেয় স্বামী ভুলানোর জন্য, বাচচাদের শিখিয়ে দেয় অনেক মন ভোলানো কথা। মণিকে সে সতীনের মতো ঘৃণা করে।
মাত্র ১১ বছরের মেয়েটি কদিনেই সব বুঝে ফেলে। মাঝ দুপুরে শান্ত-শীতল পুকুরের অস্বচ্ছ পানিতে ঝাপ দিয়ে সে সবাইকে মুক্তি দেয়। সমাজ এখন বলে, “আহারে, মেয়েটা কি ফুটফুটে আছিল। কিন্তু পাপ যে বাপকেও ছাড়ে না।“
কলিমের কোনো অনুভূতিই নাই। সে যা চেয়েছিল তা আগেই পেয়েছে, এখন কার কি হল তাতে তার কিচ্ছু আসে যায় না।
কলিমের বউও ভাবে, সতীনটা মরে তাকে বাঁচিয়েছে।
মণির পরিবারকে এখন আর সমাজের মানুষদের কটু কথা সইতে হয় না। তবে মনের গভীরে তাদের একটা চিনচিনে ব্যথা দোলা দেয় মণির অনেক পুরোনো স্মৃতি ভেবে।
মণি একটি পাপের নাম হয়ে মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায় আর কলিম আজো সেই দিনের মতো সুযোগ খুঁজে বেড়ায়।
২৪টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
এভাবেই ঘটনাগুলো হয়ে যায় । পাপ না করেও শাস্তিভোগ করে নারী । শুধু নারী হবার অপরাধে । আর পাপি ঘুড়ে বেড়ায় মুখ উচু করে ।
আমাদের সিস্টেম এটি করে রেখেছে । সবাই আমরা এটিকেই নিয়ম ভেবে বসে আছি ।
এই নিয়ম আরো কত যুগ চলবে জানিনা ।
লেখককে ধন্যবাদ এমন এক্টি সুন্দর পোস্ট দেয়ার জন্য ।
প্রতিবাদি হতে হবে সবাইকে ।
ফাহিমা কানিজ লাভা
প্রতিবাদি হতে হবে সবাইকে।
মিসু
বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম । এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে । বাস্তবতাকে নিপুন ভাবে তুলে এনেছেন লেখায় ।
ফাহিমা কানিজ লাভা
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।
খসড়া
এসব উপলদ্ধি এসেছে যখন বন্ধু তখনই কলম ধরেছেন। এবার প্লিজ নেমে আসুন চেয়ার থেকে পথে। আমরাই পারব এর প্রতিরোধ করতে।সচেতন করি প্রত্যেককে। আর এটা বোঝাই কখনই একজন ধর্ষকের সাথে ধর্ষিতার বিয়ে নয়। এই বিয়ে আরও মারাত্মক অপমানের কষ্টের।
ফাহিমা কানিজ লাভা
সেটাই মানুষ বোঝে না। ধর্ষণকারীর সাথে বিয়ে কখনোই কাম্য হতে পারে না, এদের জন্য শুধু ঘৃণা।
এই মেঘ এই রোদ্দুর
উফ ভাল লাগে না কিছুই
ফাহিমা কানিজ লাভা
🙁
মর্তুজা হাসান সৈকত
নিত্যনৈমত্যিক ব্যাপারে পরিনত হয়েছে এসব । এমন কারোই কাম্য নয় । লেখার প্রেক্ষাপট বাস্তবতাকে ধারন করতে চেয়েছে তবে কাহিনীর বিন্যাস ও বর্ননায় আবেগকে আরও সংযত, মার্জিত এবং ফ্লোটা আরও বাড়াতে পারলে গল্পের পর্যায়ভুক্ত হতো ।
ফাহিমা কানিজ লাভা
এইটুকুন লিখতে বারোটা বেজে যায় ভাই, আমাকে দিয়ে গল্প হবে না। ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য। 🙂
কৃন্তনিকা
সমাজটা এমন। ধর্ষিতাকে ধর্মহীন করে ছেঁড়ে দেয়, ধর্ষকের কিছু হয় না…
এই সমাজের উন্নতির জন্য নারীপুরুষ নির্বিশেষে সবার মানসিক উন্নতি দরকার, সেটা কবে হবে-কে জানে?
ফাহিমা কানিজ লাভা
আমরা সবাই যেদিন একসাথে এই বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শিখব, সেদিন এসব বন্ধ হয়ে যাবে।
ছাইরাছ হেলাল
ধর্ষকামিতা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনার নামান্তর মাত্র ।
কঠিন সচেতনতা প্রয়োজন ।
ফাহিমা কানিজ লাভা
কঠিন সচেতনতা প্রয়োজন – একমত।
নীলাঞ্জনা নীলা
সচেতনতা ব্যাতিত এ থেকে মুক্তি নেই আমাদের। পাল্টাতে হবে দৃষ্টি ভঙ্গি । সুন্দর উপস্থাপনা।
ফাহিমা কানিজ লাভা
ধন্যবাদ আপু। দৃষ্টি ভঙ্গির পরিবর্তন অতি জরুরি।
ব্লগার সজীব
লেখার বলিষ্ঠতায় মুগ্ধ হলাম আপু। আমরা যেন আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে এসব অন্যায় , বইশম্যকে চিনিয়ে দিতে পারো।
ফাহিমা কানিজ লাভা
ধন্যবাদ ভাই। আমরা মুখ না খুললে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়বে, তাই আমাদের স্বার্থেই আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে।
আদিব আদ্নান
এ পতনের শেষ ঠিকানা এখনও অজানা ।
ফাহিমা কানিজ লাভা
🙁 🙁
লীলাবতী
মেয়েরা মানুষ নয়। খেলনা জাতীয় কিছু একটা। এদের আলাদা কোন সত্তা নেই। পুরুষরা শুধু এদের ভোগ করবে। ভোগ্য পন্য বলা যায়। যৌন হয়রানীতে পরেনি এমন মেয়ে আছে কিনা সন্দেহ আছে। সেই ছোটবেলা থেকে আত্মীয়দের দিয়ে শুরু। বড় বেলায় সবার কাছে।
অনেক ভালো লিখেছেন আপু। ধন্যবাদ আপনাকে।
ফাহিমা কানিজ লাভা
ধন্যবাদ কষ্ট করে পড়ার জন্য ও সুচিন্তিত মতামত প্রদানের জন্য।
বনলতা সেন
একটি ব্লেড থাকা উচিৎ সবার কাছে ।
আপনার শেষ লেখাটিতে মন্তব্য করতে পারছি না কেন ?
ফাহিমা কানিজ লাভা
বড় কথা, একটা বিবেক থাকা উচিত নাহলে কিছুতেই এসব ঠিক হবে না। এই বিবেক গড়ার জন্য অনেক আয়োজন দরকার। পরে কখনো সেকথা হবে।