ভালবাসার সাত রঙ – ৩

মামুন ২ ডিসেম্বর ২০১৪, মঙ্গলবার, ০২:৩১:০৩অপরাহ্ন গল্প ১০ মন্তব্য

৩.

মোর বীণা উঠে কোন সুরে বাজি…

লাবনি পয়েন্টের সাথেই হোটেল কল্লোল। এর রিসেপশন থেকে বের হয়ে এলাম।

ছুটির দিনের এক অলস বিকেল।

‘ও’ ফোন করেছে। দেখা করতে যাচ্ছি। সাধারণত এমনটি কদাচিৎ হয়। আমার প্রয়োজনে আমিই ওকে ডাকি। ও ধরা দেয় না। দূরে দূরে থাকে।

আজ নিজে যেচে আমাকে ডাকল!

‘তোমায় আমি ডেকেছিলেম ছুটির নিমন্ত্রণে’!!

ওর নিমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করা আমার পক্ষে কি সম্ভব?

চারিদিকে মোটামুটি ভীড়। এখন সিজন না হলেও কক্সবাজার সারা বছরই ইদানিং জমজমাট থাকে। ফুচকার দোকানটি পার হয়ে যাবার সময় ছোট একটি পরিবার চোখে পড়ল। স্বামী- স্ত্রী এবং দু’টি বাচ্চা। বাচ্চা দুটি ফ্রিসবি নিয়ে বালির উপরে দুরন্তপনায় ব্যস্ত। আর মা বাবা দুজন চোখে সীমাহীন মায়া নিয়ে তাই দেখছে। হৃদয়ের ভালোবাসা ওদের দৃষ্টি থেকে উপচে পড়ছে…আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম।

এবং বুকের ভিতর একটু বেদনা জেগে উঠল।

এই বেদনার উৎস কি? বোঝার চেষ্টায় হাঁটতে হাঁটতে কখন যে মানুষের ভীড় ছাড়িয়ে চলে এলাম বুঝতে পারিনি। সমুদ্রের গর্জন এবং ঢেউ এর তীরে এসে ভেঙ্গে পড়া আর ভালবাসার নোনা স্বাদের বাতাস আমাকে নেশাবিহীন অবস্থায়ই এক ঘোরের ভিতর নিয়ে গেলো।

আমার ফেভারিট কালারের শাড়ী পরা কেউ একজন তট রেখা ধরে একাকী হেঁটে চলেছে। এখনো অনেকটা দূরে। তাই দূর থেকে শুধু আকাশী রং এ আবৃতা এক নারী নীলাকাশের নীচে নীলাম্বরী হয়ে নীল জলের পটভুমিতে আঁকা ছবির মতো চোখে ধরা দিলো।

শুধু শুধু মন খারাপ হল। আজকাল কঠিন সৌন্দর্য আমাকে বেদনাক্রান্ত করে তোলে। ঐ নারী যদি আমার “ও’ হতো! এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। এরকম ড্রেসে সে কখনোই এই পাবলিক প্লেসে আসবে না। ওর চিরাচরিত সেই নীল জীন্স ও সাদা শার্ট এর বাইরে সে যাবে না। একটা নাম না জানা পাখীর কর্কশ চীৎকারে বাস্তবে ফিরে এলাম।

এবং মেয়েটিকে আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখলাম… আরো একটু কাছে আসতেই বিস্ফারিত দৃষ্টিতে ‘ও’কে আবিষ্কার করলাম। সেই তিল… চেনা প্রিয় মুখ… যা আমাকে রাতের পর রাত জাগিয়ে রেখেছে!… দিনের অসহ্য ঘন্টাগুলোতে বেদনাকে জাগিয়ে তুলেছে! হাসিমুখে এগিয়ে আসা আমার প্রিয়তমা কি এক রহস্য মদিরতায় ভিতরে ভিতরে জ্বলে উঠার অপেক্ষায়।

আমার বিস্ময়টুকু সে বেশ উপভোগ করল। নীরবে… কথা না বলে ঝাউ গাছগুলোর একটু সামনে বালিয়াড়ির মতো দেখে সেখানে বসলাম। দুজনে… পাশাপাশি। এরকম রোমান্টিক পরিবেশে মনে হল ‘ও’কে নিয়ে এই প্রথম। আগেও ওকে নিয়ে এখানে অনেক হেঁটেছি। কিন্তু সেই ‘ও’ আর আজকের ‘ও’র মাঝে অনেক ব্যবধান মনে হচ্ছে।

চুপচাপ অনেকক্ষণ কাটালাম। সমদ্রের ঢেউ এবং দূরে যতদূর চোখ যায় আমরা অর্থহীন দেখার চেষ্টায় সময়ক্ষেপন করলাম। মাঝে মাঝে কয়েকবার চোরা দৃষ্টিতে ওকে দেখছিলাম। সেও মনে হয় এটা অনুভব করল। বাতাসে আমার এবং ওর চুলগুলো নিয়ন্ত্রণহীন উড়ছিল। কয়েকবার ওর অবাধ্য চুল আমার মুখের উপর হাল্কাভাবে ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেলো। ও কখনো পারফিউম ইউজ করেনা। ও নিজেই তো এক তাজা পারফিউম! আমার মন-প্রাণকে সতেজ করে দেয়া ভালবাসার আবেশ এনে দেয়া সুগন্ধি এক নারী! হ্যা আজ ওকে বড্ড বেশী নারী মনে হচ্ছে। এটাকি ওর গেটাপ পরিবর্তন করাতে? না এর ভিতরে আরো গভীর কিছু একটা রয়ে গেছে।

– এভাবে চোরের মতো দেখছ কেন? – ওর কথায় নীল জলরাশির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে ওর দিকে তাকালাম। কিন্তু কয়েক পলক তাকিয়েই ওর ধারালো সৌন্দর্য সহ্য করতে না পেরে দৃষ্টি আপনা থেকে নত হয়ে এলো। আসলে ও কি বলেছে আমার কানে তা কিছুই যায়নি। আমি শুধু কিছু শব্দ শুনলাম। তাই আবারও আমাকে ওর বলতে হল,

– এদিকে তাকাও, চোরের মত আমাকে দেখছিলে কেন?

: চোর না হয়ে উপায় আছে? তুমি কি কখনো ভালভাবে দেখতে দাও?

আমার এই কথায় কিছুটা অবাক হল সে, ওর চোখে বেদনাও কি জেগে উঠল একপলকের জন্য? বসা থেকে সোজা উঠে দাঁড়ালো। আমি একটু ভয় পেলাম। এখন কি জানি কি করে বসে। ওর আকাশী শাড়ী ওকে সম্পুর্ণ ঢেকে দিতে পারেনি। পাতলা শাড়ী ভেদ করে ওর সুন্দর নাভী একটা পর্দার আড়াল থেকে দেখার মত করে আমার চোখে পড়ল। আমি মুগ্ধতার গলা টিপে ধরে উঠে দাঁড়ালাম। ওর সাদা ব্লাউজের নীচে থাকা হৃদয় মনে হয় দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছিল। বুকের উঠানামা দেখেই আমি টের পেলাম। আমার নিজেরও কি তা হচ্ছিল না! আমার চোখে ওর পুর্ণ দৃষ্টি মেলে বলল,

– আমি বিড়াল প্রেমিক পছন্দ করি না। আমার সামনে কেউ সারাজীবন মিউ মিউ করুক সেটাও চাইনা।

: বুঝলাম না?

– ভালোবাস আমাকে?

একটা ঢোক গিলে বললাম,

: হ্যা!

– আমাকে ছুঁতে চাও? আদর করতে চাও?

কি বলব আমি? আমি তো সেটা চাই… তবে এভাবে না। মানে ও আমাকে এই কথাটা এভাবে সরাসরি বলবে তা ভাবিনি কখনো। ভালবাসার একটা পর্যায়ে শরীর কেন চলে আসে? তবে কি আমার ভালোবাসা শুধুই শরীরকেন্দ্রিক? হঠাৎ একটা তীব্র না পাওয়ার বেদনা কোথা থেকে এসে আমাকে টলিয়ে দিয়ে যেতে চাইলো। আমি এক মুহুর্তের জন্য নিজেকে হারিয়ে ফেলি। আমি কে, কোথায় আছি তা বিস্মৃত হই। আমার নীরবতাকে সে আমার দুর্বলতা ভেবে বসে। কাঁধের উপর থেকে শাড়ির আঁচল ফেলে দেয়। আমার অবাক চোখের সামনে আমার হাতটি ধরে ওর বুকের ওপর ধরে রাখে। বলে,

-নাও, যা ইচ্ছে তাই করো।

আমি একটা বিস্ফোরনোম্মুখ আগ্নেয়গিরিতে পরিণত হই। মুহুর্তের ভিতরে মনে হয় ফেটে চৌচির হয়ে যাব। একটা অপার্থিব অনুভুতি আমাকে তীব্রভাবে ঊত্তপ্ত করে… আমি আমার ভিতরে নতুন এক ‘আমার’ উপস্থিতি টের পাই। আশ্চর্যজনক ভাবে আমি ক্রমে শীতল হই… আমার ভিতরের জড়তা,নমনীয়তা ঝেড়ে ফেলে আমি বিড়াল থেকে চিতায় পরিণত হই। ওর শরীরের নরম ও কোমল আগুন আমাকে পোড়াতে পারেনা। আমার মনের ভিতরে কোনো সাপ জাগে না। আমি হাত সরিয়ে নেই আলতো করে।

দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছি।

সময় স্থির… সবকিছু নীরব! ভালবাসার স্বরূপ উদ্ঘাটনে ব্যস্ত দুই হৃদয় হঠাৎ করে নিজেদেরকে ফিরে পায়। ওর ঠোঁটের তিল আমাকে আকর্ষণ করে। আমি দুহাতে ওর মুখ ধরে নিজের কাছে টানি… ও চোখ বন্ধ করে অতৃপ্ত ঠোঁট একটু মেলে ধরে। কিন্তু আমি ওর কপালে হাল্কা করে চুমো দেই। ও অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়।

একটু হাসে।

আমি ওর কোমর ধরে পাশাপাশি হাঁটতে থাকি। নিজেকে খুব নির্ভার মনে হয়। ও যখন ওর বুকে আমার হাত তুলে নিয়ে গেলো, আমি ঠিক সেই সময়েই নিজের ভিতর থেকে নিজকে উত্তরণে ব্যস্ত ছিলাম। আমার সুনীলের সেই কবিতাটির ঐ লাইনগুলো মনে পড়ছিল,

… বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে

বরুনা বলেছিল,

যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালোবাসবে

সেদিন আমার বুকেও এ-রকম আতরের গন্ধ হবে!…

আজ আমি আমার বরুনার বুকে মাংসের গন্ধের পরিবর্তে সেই আতরের গন্ধই পেয়েছি!

আজ সে যে কোনো নারী না হয়ে আমার ‘ও’ হয়েই আমার কাছে ধরা দিয়েছে। সত্যিকারের শরীরহীন ভালবাসার জন্যই এটা সম্ভব হয়েছে।

জীবনটা ছেলেখেলা নয়। দুটো হাত এক হবার আগে সারাজীবন হাতে হাত রেখে চলার মতো ভালোবাসা অর্জন করে নিতে হয়। অনাগত দিনগুলোর জন্য একে অপরের প্রতি আত্মবিশ্বাস- দুজনের পারষ্পরিক বোঝাপড়া আগেই বুঝে নিয়ে তবেই পথ চলার শুরুটা করা ভালো।

এই গল্প আমার আর ‘ও’র। আমাদের সবার।

আমরা যারা সংসার নামের এই রঙ্গমঞ্চে ‘আমি’ এবং ‘তুমি’র ভুমিকায় অভিনয় করছি তাঁদের সবার।

শেষ কথাঃ

শেষ বিকেলের আলোয় বেলাভুমিতে দুটো ছায়া হাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। অনেক দীর্ঘ সেই ছায়া! একটু আগে ভালবাসা নামের অদৃশ্য এক শক্তি ওদেরকে অনেক কাছে এনে দিয়েছে। এতোটা কাছে, মনে হয়না কখনো আর ওরা দূরে চলে যেতে পারবে। লাল কাঁকড়াদের ফেলে আসা ট্রেইল ধরে ওরা দুজন জীবনকে রাঙানোর জন্য সামনের দিকে এগিয়ে যায়। রঙিন এই ভূবনে টিকে থাকতে অনেক রঙের প্রয়োজন যে!

আচ্ছা ভালবাসার রং কি?

(শেষ)

৫৪১জন ৫৪১জন
0 Shares

১০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ