সিংহরাজ পাখিটির সঙ্গে ২০১৫ সালে প্রথম পরিচয় হয় কাপ্তাই ফরেস্টের বড়ছড়ায়। আমরা বেশ কয়েকজন ফটোগ্রাফার পাখির ছবি তোলার জন্য ঢাকা থেকে কাপ্তাইয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হই। বড়ছড়ায় প্রবেশ মুখে আনসার ক্যাম্প। ক্যাম্পের প্রবেশ মুখে আনসারদের সতর্কবাণী ছিলো বন্যহাতীর উপদ্রব সম্পর্কে। আমরা যাওয়ার কয়েকদিন আগে বন্যহাতীর তাড়ায় স্থানীয় একজন মারা যান। খবরটা শুনেই গা শিরশির করে ওঠে। তারপরও শত ভয় ও বাধা উপেক্ষা করে বড়ছড়ায় নেমে পড়ি। পায়ের গোড়ালী পর্যন্ত ঝরনার স্বচ্ছ পানি প্রথমেই দেহ ও মন সজীব করে তুললো। স্বচ্ছ পানির নিচে পাথর ও বালুর উপর দিয়ে হাঁটছি। লেকের দুই ধারে উঁচু পাহাড় ও সবুজ বনের গাছ-গাছালিতে ভরপুর। এ যেন প্রকৃতির এক অপরূপ সৌন্দর্যে নয়নাভিরাম দৃশ্য! চোখে না দেখলে বুঝানো খুবই কষ্টকর। লেক ধরে কিছুদুর হাঁটার পর নজরে এলো সিংহরাজ পাখি। প্রথম দেখা ও প্রথম ছবি তোলা। পরবর্তী সময়ে সাতছড়ি ফরেস্ট ও লাউয়া ছড়াতেও এদের দেখা মেলে এবং ছবিও তুলেছি।
সিংহরাজ Dicrurus পরিবারের অন্তর্ভূক্ত ছোট থেকে মাঝারী আকারের পতঙ্গভুক পাখি। বিশ্বে এই গোত্রের ২৩ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। বাংলাদেশে ৭ প্রজাতির এখন পর্যন্ত দেখা গেছে। এদের দৈর্ঘ্য ৩২-৩৫ সে.মি. পর্যন্ত হয়ে থাকে। ওজন ১১৮-১২০ গ্রাম। সিংহরাজ আজব আকৃতির একটি পাখি। এদের লেজ অনেক লম্বাকৃতির। লেজের মাথা ব্যাডমিন্টন খেলার র্যাকেটের মতো। যখন পখিটি উড়ে তখন লেজ ঘুড়ির লেজের মত ঘূর্ণন গতিতে পাক খায়। মাথায় ঝুঁটি থাকে। গায়ের রং মিচমিচে কালো। কপালের স্পষ্ট ঝুঁটির পালকগুলি বাঁকা হয়ে ঘাড়ের পিছন পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকে। লেজ বৃহাদাকার দৈর্ঘের হয়। লেজের শেষ ভাগ সামান্য চেরা থাকে। দেহের তুলনায় লেজ বড় হওয়ায় মাঝে মাঝে এদের লেজ ভেঙ্গে যেতে দেখা যায় বা খসে পড়ে। চোখ বাদামী বর্ণের ও লালচে রঙের হয়। ঠোঁট কালো ও পায়ের পাতাসহ পা কালো বর্ণের। পুরুষ ও মেয়ে পাখির চেহারায় ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহতলের শেষভাগ সাদা ও ঝুঁটি ছোট হয়। লেজে ফিতা থাকে না।
সিংহরাজ সাধারনত সবুজ বন,বাঁশঝাড় ও সুন্দরবন বা গরাণবনে বিচরণ করে। এরা একাকী বা জোড়ায় চলাফেরা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। বনের ঝোপের নিচে উড়ে উড়ে নিজেরাই শিকার করে খাদ্য সংগ্রহ করে। এরা বিভিন্ন পাখির সুর নকল করতে খুবই পারদর্শী। সময় বুঝে বা শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পেতে এরা এই অভিনব কায়দাটি প্রয়োগ করে। এমনিতেও এদের কণ্ঠ খুবই মধুর! খুব ভোরে সূর্য ওঠার আগেই এরা বিভিন্ন সুরে ডাকতে থাকে। তখন দল বেঁধে গাছে বিচরণ করে ফুলের মধু খাওয়ার জন্য।
এদের খাদ্য তালিকায় উঁই পোকা, মথ, গুবরে পোকা, ফড়িং, পঙ্গপাল, ফুলের মধু ও ছোট পাখির অগ্রাধিকার বেশী। এরা ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই মাসে প্রজনন করে। প্রজনন কালে বড় গাছের ডালে পাতা ঘাস দিয়ে ছোট বাটির মত বাসা বানায়। নিজেদের তৈরী বাসায় ৩-৪টি ডিম দেয়। পুরুষ ও মেয়েপাখি মিলিতভাবে ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায়। বাচ্চাদের লালন পালন ও আহারের ব্যবস্থা উভয়েই সম্মিলিতভাবে করে। সিংহরাজ আমাদের দেশে সুলভ আবাসিক পাখি। চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা বিভাগের সুন্দরবনে পাওয়া যায়। এ ছাড়াও ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান, চীন, ইন্দোনেশিয়াসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এদের বিচরণ আছে।
বাংলা নাম: সিংহরাজ
ইংরেজি নাম: Greater Racket-tailed Drongo
বৈজ্ঞানিক নাম: Dicrurus Paradiseus
ছবিগুলো সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান থেকে তোলা।
৯টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
পাখিদের মধ্যেও সিংহরাজ আছে!
পাখিটি সম্পর্কে জানলাম, আমাদের দক্ষিন বাংলায় এই পাখি নেই।
সুন্দর উপস্থাপনা।
শুভ কামনা।
অনন্য অর্ণব
সিংহরাজ দেখি একদম চুপচাপ, শান্তশিষ্ট স্বভাবের। ভালোই তো।
সুরাইয়া পারভিন
সিংহরাজ পাখি,,,,বাহ্ দারুণ।প্রথম জানলাম সিংহরাজ সম্পর্কে।
চমৎকার পোস্ট
ছাইরাছ হেলাল
পাখি আবার সিংহরাজ কেমনে হয়!
আপনি বললেই হবে নাকি!
কত অজানারে!
মনির হোসেন মমি
এর আঞ্চলিক বেদে নাম হেজা ? খুব ভাল লাগল সিংহরাজের পরিচয় পেয়ে।
এস.জেড বাবু
এরা বিভিন্ন পাখির সুর নকল করতে খুবই পারদর্শী।
বেশ গুণী পাখি মনে হলো।
এই প্রথম জানলাম উড়ন্ত সিংহরাজ সম্পর্কে।
ছবিগুলি দেখে ভালো লাগল, ঢাকা থেকে কাপ্তাই যাওয়া সার্থক হয়েছে আপনার।
হালিম নজরুল
ধন্যবাদ শামীম ভাই।আপনার সৌজন্যে অনেককিছু জানা হচ্ছে।
সাবিনা ইয়াসমিন
অন্যদের পোষ্টেও যেতে হবে ভাইজান। বিশেষ করে স্টিকি পোস্টে যাওয়া সকল ব্লগারের দায়ীত্ব। কারন ঐ পোস্ট গুলো কতৃপক্ষের দেয়া বার্তা। সেখানে রেসপন্স না করা মানে হলো ব্লগ কতৃপক্ষকে অবমাননা করা।
শামীম চৌধুরী
আপু সালাম
আমি গত কয়েকমাস ধরে খুব ব্যাস্ত। সময় পেলেই ডু মারি ব্লগে। একেবারে যেন হারিয়ে না যাই তাই মাঝে মাঝে কষ্ট হলেও কিছু লেখা দেই ব্লগে। আর কয়েকটা দিন সময় দিন আপু। আগের মতন আবার নিয়মিত হয়ে যাবো।
ধন্যবাদ আপনাকে।