হিন্দু ধর্ম পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ধর্ম । বর্তমানে পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম ধর্মের নামও হিন্দু । ইতিহাস সম্বন্ধে সচেতন যে কোন ব্যাক্তিই জানেন মুলত সনাতন ধর্মই এখন হিন্দু ধর্ম নামে পরিচিত । যদিও এই ধর্মের লীলাভূমি দক্ষিণ এশিয়া , কিন্তু এই ধর্মটি এসেছে এশিয়া মাইনর থেকে । এশিয়া মাইনরের আর্জ্য জাতি গোষ্ঠী খাবার ও নিরাপদ আশ্রয়ের খোজে ভারতীয় উপমহাদেশে আসে, এবং সাথে করে নিয়ে আসে সনাতন ধর্ম । তারা ভারতীয় স্থায়ী জাতিগোষ্ঠীর উপর অন্যান্য হানাদার বাহিনীর মত “সনাতন ধর্ম” চাপিয়ে দেয় , যা কালের পরিবর্তনে এখন ভারতের স্থায়ী ধর্ম রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । আর্জ্য পূর্ববর্তী যুগ সম্বন্ধে খুব বেশি কিছু জানাও যায় না। হানাদার আর্জ্যদের মতে স্থায়ী জনগোষ্ঠী ছিল কুৎসিত ও বন্য প্রকিতির । যাদের অর্জ্যরা আসুর,পিশাচ ইত্যাদি নামে অভিহিত করেছে। অস্ত্র ও বুদ্ধির জোরে সুন্দর চেহারার অর্জ্যরা স্থায়ী জনগোষ্ঠীকে খুব সহজেই দাসে পরিনত করতে পেরেছিল । কোল ও দ্রাবিড় জাতিই ভারতের স্থায়ী বৃহৎ জাতি গোষ্ঠী । উত্তর ভারতে এখনও এদের বসবাস আছে ।
সনাতন বা হিন্দু ধর্ম যেভাবেই আমদানি হোক না কেন হাজার বছরের বেশি সময় ধরে ভারতীয় উপমহাদেশে এই ধর্মটি পালিত হয়ে আসছে । তাই নির্দ্বিধায় সনাতন ধর্মকে ভারতীয় উপমহাদেশের স্থায়ী ধর্ম বলা যায় । হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে প্রাচীন ও লিখিত নিদর্শন “বেদ” । যা হিন্দু ধর্মের প্রধান ধর্ম গ্রন্থ হিসাবে স্বীকৃত । প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী বেদকে অপৌরুষেয় অর্থাৎ ঈশ্বরের বাণী বলে মনে করা হয় । বিশ্বামিত্র, ভরদ্বাজ প্রমুখ বৈদিক ঋষি জ্ঞানবলে ঈশ্বরের বাণীরূপ বেদে বর্ণিত মন্ত্রগুলো প্রত্যক্ষ করেন বলে হিন্দুরা বিশ্বাস করে। এদের বলা হয় বেদদ্রষ্টা ঋষি । বেদদ্রষ্টা ঋষিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন মহিলাও ছিলেন, যেমন বিশ্ববারা, লোপামুদ্রা প্রভৃতি। অবাক করা বিষয় যে, কোন ধর্মেই মেয়েদের ধর্মীয় বিষয়ে খুব তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছে এমন দেখা যায় নি । এদিক দিয়ে হিন্দু ধর্ম একটা ব্যাতিক্রম ও প্রশংসার দাবী রাখে । বেদ কে চার ভাগে ভাগ করা যায়-ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সাম বেদ এবংঅথর্ব বেদ। বেদ মুলত চারটি দর্শন শাস্ত্রের সমষ্টি । পুরো হিন্দু ধর্মের ধারনা এই শাস্ত্রের উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে । তাই এই গ্রন্থ সমষ্টি কে ” গোঁড়া “(āstika)বলে। আর এই কারণে হিন্দু ধর্মের প্রধান ধর্ম গ্রন্থও বলা হয় বেদ কে ।
যদিও বেদ হিন্দুদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ , কিন্তু এখানে ধর্মের ভিত্তিতে জীবন যাপন বা উপাসনা করার পদ্ধতি বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হয় নি । হিন্দুদের ধর্ম ভিত্তিক আইন ও সামাজিক রীতি নীতি পরিচালিত হয় আরেকটি গ্রন্থ “মনুসংহিতা” বা মনু স্মৃতির উপর ভিত্তি করে । যেহেতু এই পোষ্টের শিরোনাম “ব্যাবচ্ছেদ মনুসংহিতা” সেহেতু এই পোস্ট এ “মনুসংহিতা” বা মনু স্মৃতি নিয়েই আলোচনা করব ।
মনুসংহিতায়কি আছে এটা জানার আগে জানা দরকার মনুসংহিতা কি ?? এবং একজন হিন্দুর জন্যমনুসংহিতার আইনগুলি পালন আবশ্যক কিনা । আভিধানিক ভাবে মনুসংহিতাঅর্থহচ্ছে “মনু-প্রণীত মনুষ্যজাতির অবশ্যপালনীয় আচরণ-সংক্রান্তগ্রন্থ”,লক্ষ্যনিয় শুধু হিন্দু না সমগ্র মানব জাতির কথা বলা হয়েছে । এখনস্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগতে পারে এত এত গ্রন্থ থাকতে মনুসংহিতাই কেন অবশ্যপালনীয় হবে ?? এই প্রশ্নের জবাব পেতে হলে জানতে হবে মনু কে ছিলেন ।
পুরান মত অনুযায়ী মনু ব্রহ্মার দেহ থেকে তৈরি হয়েছেন । সুতরাং পৃথিবীতেভগবান ব্রহ্মার একমাত্র প্রতিনিধি ছিলেন মনু । যাকে স্বায়ম্ভুব মনু বলা হয় ।তবে এই পর্যন্ত ১৪ জন মনু ব্রহ্মার ইচ্ছায় জন্ম নিয়েছেন । এবং এদের সবাইধর্ম শাস্ত্র রচনা করেছেন । মনু(স্বায়ম্ভুব মনু) ব্রহ্মার কাছ থেকে স্মৃতিশাস্ত্র পাঠ করা শিখে তা তার শিস্যদের তা পাঠ করান। পরবর্তীতে ভৃগু নামে একজনমনুর আদেশে এই ধর্মশাস্ত্র ঋষি দের কাছে ব্যাখা করেন। যা এখন মনুসংহিতানামে পরিচিত ।বলা হয় বেদ এর পরে মনুসংহিতা সৃষ্টি হয়েছে ।এই পর্যন্ত ভগবান ব্রহ্মার পুত্র স্বায়ম্ভুব মনু সহ মোট ১৪ জন মনু জন্মগ্রহন করেছেন । তারা হলেন — ১। স্বায়দ্ভুব (ব্রহ্মা ও গায়ত্রী হতে সম্ভূত),স্বরোচিষ,উত্তম,তামস,রৈবত,চাক্ষুষ,বৈবস্বত বা সত্যব্রত ,সাবর্ণি,রোচ্য,ভৌত ,মেরূ সাবর্ণি ,ঋভু ,ঋতুধামা,বিস্বব সেন । ভগবান ব্রহ্মার পুত্র স্বায়ম্ভুব মনুর দেখানো পথ অনুসরণ করে বাকি মনুরা এই শাস্ত্র ধারন ও পরিবর্ধন করেছেন । মুলত “ভগবান ব্রহ্মার পুত্র স্বায়ম্ভুব মনু” এর বর্নিত শ্লোকগুলিই বাকি মনুরা সম্পাদনা ও টীকা বা ব্যাখ্যা যোগ করেছেন এবং কিছু কিছু আইন ও আচরণ পদ্ধতির প্রবর্তন করেছেন।
যেহেতুসরাসরি ব্রহ্মার কাছ থেকে এই শাস্ত্রের বিষয়বস্তু গ্রহন করা হয়েছে এবংবেদের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা হয়েছে সেহেতু তৎকালীন মুনি ঋষিরা এই গ্রন্থ কে “অবশ্যপালনীয় আচরণ বিধি”
হিসাবে স্বীকৃতি দেন । এবং এখনও মনুসংহিতার আইন ও আচরণবিধি পুরোপুরি ভাবে হিন্দু ধর্ম ও সমাজে পালন করা হয় ।
বলা হয় হিন্দুদের প্রধান ধর্ম গ্রন্থ বেদ । কিন্তু বর্তমান হিন্দু সমাজে মূর্তি/প্রতিমাপূজা , উপসনার পদ্ধতি ,ব্রতাচারণ,বিবাহেরনিয়মাবলী,শ্রাদ্ধবিধি,খাদ্যাখাদ্য বিধি,বর্ণাশ্রম বিধি,সম্পত্তি বন্টন তথাধর্মীয় আঙ্গিকে জীবন ধারনের সব পদ্ধতি গুলো ‘মনুসংহিতা’ বা ‘মনুস্মৃতি’ তেযে ২৬৮৪ টি শ্লোক বর্ণিত আছে তার উপর ভিত্তি করে পালিত হয় । তাই বলা যায়হিন্দু ধর্মের লিখিত সংবিধান ‘মনুসংহিতা’ । মানুষের জীবনের এমনকোন কিছু নেই যা এই শাস্ত্রে আলোচিত হয়নি । একজন হিন্দু জন্ম থেকে মৃত্যুপর্যন্ত কি কি করবে বা করবেনা তার সবই এই গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে । মুসলিমরাযেমন কুরআন কে পুরনাংগ জীবন বিধান বলে তেমনি হিন্দুদের জীবন বিধান ‘মনুসংহিতা’ বা ‘মনুস্মৃতি’ । বেদ হিন্দুদের আদি গ্রন্থ এবং এই গ্রন্থেরকৃতজ্ঞতা স্বীকার করেই ‘মনুসংহিতা’ বা ‘মনুস্মৃতি’ রচিত হয়েছে । তবে জীবনযাপনের নিয়মাবলী বেদে উপেক্ষিত হলেও ‘মনুসংহিতা’ বা ‘মনুস্মৃতি’ তে তারপুর্নাংগ বিকাশ ঘটেছে ।
যদিও হিন্দু ধর্মের কোন কোন শাখা যেমন মতুয়া সম্প্রদায়,সত্য ধর্ম ইত্যাদি ‘মনুসংহিতা’ বা ‘মনুস্মৃতি এর নিয়মকানুন উপেক্ষা করে , কিন্তু মৌলিক হিন্দু ধর্মীয় আচরণবিধি পালিত হয় ‘মনুসংহিতা’র উপর ভিত্তি করে।
(এই পোস্ট এর বিষয়বস্তু বিভিন্ন ব্লগ,উইকিপিডিয়া ও বাংলায় প্রকাশিত ভবানী চরণ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত
‘মনুসংহিতা’ প্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে । তথ্যগত কোন ভুল থাকলে ক্ষমাপ্রার্থী)
চলবে …………।
১২টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
অত্যন্ত গুরুত্ব পূর্ণ লেখা ।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মের সাথে মিল লক্ষ করা যায় , কিছুটা ভিন্ন পদ্ধতি হলেও কুরআন নাজিলের সাথে মনুসংহিতার মিল দেখা যাচ্ছে ।
যারা বিভিন্ন ধর্ম ধর্ম সম্পর্কে জানতে চান – তাঁদের কাছে এই লেখার গুরুত্ব থাকবে অবশ্যই।
লেখাটি আরো বিস্তৃত ভাবে দেয়ার জন্য অনুরোধ রইল।
"বাইরনিক শুভ্র"
আমি মূলত হিন্দু সমাজে ‘মনুসংহিতা’র প্রভাব নিয়ে লিখতে চাই । সব কিছু নিয়ে বিস্তৃত লিখতে গেলে প্রসঙ্গ পাল্টে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে । তবে ‘মনুসংহিতা’র বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিস্তৃত ভাবে লিখতে পারব বলে আশাকরি ।
লীলাবতী
জানলাম । ধন্যবাদ শেয়ার করার জন্য । আরো লিখুন প্লিজ।
"বাইরনিক শুভ্র"
আশাকরি লিখতে পারব । 🙂
শিশির কনা
এ বিষয়ে আগ্রহ আমার খুব । শুভ্র ভাই এটি কন্টিনিউ করবেন আশাকরি ।
"বাইরনিক শুভ্র"
ইচ্ছা আছে । এখন ছাগুর উৎপাত না হলেই হয় ।
ছাইরাছ হেলাল
আপনি এখানে না লিখলে হয়ত পড়া হত না ।
আরো লিখুন ।
"বাইরনিক শুভ্র"
পড়ার জন্য ধন্যবাদ ।
খসড়া
ধর্ম নিয়ে লেখা দেখলে এখন শংকা জাগে মনে, কে যে কোথা থেকে চিতকার করবে জাত গেল জাত গেল বলে।
এমন বিষদ বিশ্লেষন আসলে আগে দেখা হয়নি।ভাল লাগল বিশ্লেষন। লেখা চলুক।
"বাইরনিক শুভ্র"
ভয় পাই ছাগু আক্রমনের । তবে লেখা চলবে ।
আহমেদ সায়েম
ভালো লেগেছে। কিছু টাইপো আছে।
পড়ছি। লিখতে থাকুন।
"বাইরনিক শুভ্র"
ধন্যবাদ । আপনাকে ব্লগে স্বাগতম । 🙂