বৈশাখ তখন এখন

রিমি রুম্মান ১৭ এপ্রিল ২০১৫, শুক্রবার, ০৫:৫৯:৩৮অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি ৩১ মন্তব্য
88005ba9cd8f655c112bf209f62b21df-5
নিউইয়র্কে বৈশাখী মেলা

বিশ বছর আগে এক পহেলা বৈশাখে আমার এদেশে আসা। জেএফকে এয়ারপোর্ট থেকে বাসা পর্যন্ত যেতে যেতে পুরোটা পথ গাড়িগুলোর শাঁ শাঁ করে ছুটে যাওয়া দেখি দৃশ্যত। মুলত মনের চোখ দিয়ে আমি দেখি সাদা-লাল শাড়ি আর পাঞ্জাবী ফতুয়া’য় সয়লাব আমার দেশ। হাস্যজ্বল মানুষজন সহ রিক্সাগুলোর শাঁ শাঁ করে ছুটে চলা। নতুন এই শহরে সেই বৈশাখে আমার দু’চোখ তন্নতন্ন করে খুঁজেছিল চিরচেনা বৈশাখী সাজে হাত ধরে হেঁটে যাওয়া মানব-মানবী, শিশু-কিশোর। চোখে পরেনি কোথাও কেউ।

এক একটি বৈশাখ আসে। আমি একাকি শাড়ি চুড়ি পরে ঘরময় ঘুরে বেড়াই। ভাত, মাছ, রকমারি ভর্তা বানিয়ে টেবিল সাজাই। জানালার ধারে বসে থাকি স্বামী’র কাজ থেকে ফিরে আসবার পথ চেয়ে। আমার ফরটি ওয়ান এভিনিউ, সেভেনটি ওয়ান স্ট্রীটের বাড়ির জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে বিগত বৈশাখগুলো। পিছনের কালে ফিরিয়ে নেয় আমায়। আমার ইডেন কলেজের নতুন হলের ষোল নাম্বার রুমের জানালায়। যেখানে দাঁড়িয়ে আমি দেখেছি, ভিজিটরদের রং বেরং এর পাঞ্জাবী, ফতুয়া পরে প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা। এক একজন আপু’র বৈশাখী সাজে বন্ধু কিংবা প্রেমিকের হাত ধরে বেরিয়ে যাওয়া। সে এক অসাধারন সুন্দর দৃশ্য ! আমি হৃদয় ভাসাই আশার ভেলায়, একদিন নিশ্চয়ই স্বামী’র হাত ধরে ঘুরে বেড়াবার এমন রাজকীয় বৈশাখ হবে আমার !

এলাম যখন এই যান্ত্রিক শহরে, জীবন জীবিকার তাগিদে কেমন করে বেশ কিছু বৈশাখ উড়ে গেলো আমার মাথার উপর দিয়ে, জানালায় দাঁড়িয়ে, অপেক্ষার প্রহর গুনে। অতঃপর অচেনা কিছু মানুষ বন্ধু হল চাকচিক্যের শহরে। প্রতি বৈশাখের প্রথম দিন আমরা দিনব্যাপী ছোটখাটো আয়োজন করি পরিবার সহ। মাছ, ভাত, হরেকরকম ভর্তা, খাওয়া-দাওয়া, বৈশাখী সাজ, হাসি আনন্দে মেতে থাকি পুরোটা দিন। বিস্তৃত হলো পরবাসে আমার বৈশাখ ধীরে ধীরে। শীতগুলো চলে যায় অনাদরে, অবহেলায়। বসন্ত এলে একটু একটু করে যখন গাছগুলো সবুজে ছেয়ে যেতে শুরু করে,ফুল ফোটে, আমি কেবলই প্রহর গুনি বৈশাখের পদশব্দ শুনার। কেননা, পহেলা বৈশাখ এখন আর সেই চুপটি করে এসে নিঃশব্দে চলে যায় না। আগমনী গান শুনাতে শুনাতে ঢাক্‌ঢোল পিটিয়ে যেন পুরো নিউইয়র্ক শহরকে জানান দিয়ে আসে। বাঙালিরা র‍্যলী করে জ্যাক্‌সন হাইট্‌স, জ্যামাইকা সহ বিভিন্ন এলাকা ঢাক্‌ঢোল বাজিয়ে রিক্সা নিয়ে প্রদক্ষিণ করে। পাশদিয়ে হেঁটে যাওয়া ভিনদেশি’রা তাকিয়ে দেখে অবাক নয়নে। জানতে চায়। নিঃসঙ্কোচে বলি, এটি আমার বাংলা নিউ ইয়ার। ধীরে ধীরে ওরাও জানছে আমার দেশ, ভাষা, সংস্কৃতি সম্পর্কে। আমি নিশ্চিত, সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন কোন ভিনদেশিকে ব্যাখ্যা করতে হবে না এমন করে।

পহেলা বৈশাখে কোন ব্যস্ততাকে এখন আর পরোয়া করে না বাঙালী। রাস্তায়, অডিটোরিয়ামে, ভিন্ন ভিন্ন সংগঠন বৈশাখী আয়োজন করে। আয়োজন চলে পুরো বৈশাখ জুড়ে। আমরা জনারণ্যে ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠান উপভোগ করি। হাতভর্তি চুড়ি, কপালে টিপ, শাড়ি পরিহিতা বাঙ্গালী নারী, পাঞ্জাবী কিংবা ফতুয়া পরা পুরুষ, শিশু-কিশোর, এত মানুষ, এত কোলাহল আমি আর অন্য কোন সময় একসাথে দেখিনা এই প্রবাসে। একদিকে দেশীয় গান, নৃত্য চলে, অন্যদিকে হরেকরকম বাঙালী খাবারের পসরা__ যেন এক টুকরো বাংলাদেশ ! অন্তত একটি উপলক্ষে সকল ধর্মের বাংলা ভাষাভাষীরা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে এক টুকরো বাংলাদেশ হয়ে উঠা, এই প্রবাসে আমাদের অনেক বড় পাওয়া। এটি আমাদের সন্তানদের বুঝতে শেখায়__ আমার দেশ, আমার সংস্কৃতি, আমার শেকড়।

জীবন, জীবিকা আর বাস্তবতার তাগিদে দেশ থেকে আমরা দূরে আছি হয়তো। কিন্তু দেশের প্রতি ভালোবাসা, সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা এমন করেই বুকের গভীরে ধারন করে চলি আমরা প্রবাসী’রা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত যুগ যুগ ধরে। আমরা মাছে ভাতে বাঙালী বারোটি মাস। তবুও হোক না কোন এক উপলক্ষ সামনে নিয়ে সব বাংলাদেশীরা এক কাতারে দাঁড়িয়ে, এক সাথে হেসে উঠি, একসাথে আনন্দে মেতে উঠি। তাইতো প্রতি বসন্তে চাতক পাখির মত আমি প্রহর গুনি বৈশাখের অপেক্ষায়। শুভ বৈশাখ।

১০১৫জন ১০১৪জন
0 Shares

৩১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ