বিশ বছর আগে এক পহেলা বৈশাখে আমার এদেশে আসা। জেএফকে এয়ারপোর্ট থেকে বাসা পর্যন্ত যেতে যেতে পুরোটা পথ গাড়িগুলোর শাঁ শাঁ করে ছুটে যাওয়া দেখি দৃশ্যত। মুলত মনের চোখ দিয়ে আমি দেখি সাদা-লাল শাড়ি আর পাঞ্জাবী ফতুয়া’য় সয়লাব আমার দেশ। হাস্যজ্বল মানুষজন সহ রিক্সাগুলোর শাঁ শাঁ করে ছুটে চলা। নতুন এই শহরে সেই বৈশাখে আমার দু’চোখ তন্নতন্ন করে খুঁজেছিল চিরচেনা বৈশাখী সাজে হাত ধরে হেঁটে যাওয়া মানব-মানবী, শিশু-কিশোর। চোখে পরেনি কোথাও কেউ।
এক একটি বৈশাখ আসে। আমি একাকি শাড়ি চুড়ি পরে ঘরময় ঘুরে বেড়াই। ভাত, মাছ, রকমারি ভর্তা বানিয়ে টেবিল সাজাই। জানালার ধারে বসে থাকি স্বামী’র কাজ থেকে ফিরে আসবার পথ চেয়ে। আমার ফরটি ওয়ান এভিনিউ, সেভেনটি ওয়ান স্ট্রীটের বাড়ির জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে বিগত বৈশাখগুলো। পিছনের কালে ফিরিয়ে নেয় আমায়। আমার ইডেন কলেজের নতুন হলের ষোল নাম্বার রুমের জানালায়। যেখানে দাঁড়িয়ে আমি দেখেছি, ভিজিটরদের রং বেরং এর পাঞ্জাবী, ফতুয়া পরে প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা। এক একজন আপু’র বৈশাখী সাজে বন্ধু কিংবা প্রেমিকের হাত ধরে বেরিয়ে যাওয়া। সে এক অসাধারন সুন্দর দৃশ্য ! আমি হৃদয় ভাসাই আশার ভেলায়, একদিন নিশ্চয়ই স্বামী’র হাত ধরে ঘুরে বেড়াবার এমন রাজকীয় বৈশাখ হবে আমার !
এলাম যখন এই যান্ত্রিক শহরে, জীবন জীবিকার তাগিদে কেমন করে বেশ কিছু বৈশাখ উড়ে গেলো আমার মাথার উপর দিয়ে, জানালায় দাঁড়িয়ে, অপেক্ষার প্রহর গুনে। অতঃপর অচেনা কিছু মানুষ বন্ধু হল চাকচিক্যের শহরে। প্রতি বৈশাখের প্রথম দিন আমরা দিনব্যাপী ছোটখাটো আয়োজন করি পরিবার সহ। মাছ, ভাত, হরেকরকম ভর্তা, খাওয়া-দাওয়া, বৈশাখী সাজ, হাসি আনন্দে মেতে থাকি পুরোটা দিন। বিস্তৃত হলো পরবাসে আমার বৈশাখ ধীরে ধীরে। শীতগুলো চলে যায় অনাদরে, অবহেলায়। বসন্ত এলে একটু একটু করে যখন গাছগুলো সবুজে ছেয়ে যেতে শুরু করে,ফুল ফোটে, আমি কেবলই প্রহর গুনি বৈশাখের পদশব্দ শুনার। কেননা, পহেলা বৈশাখ এখন আর সেই চুপটি করে এসে নিঃশব্দে চলে যায় না। আগমনী গান শুনাতে শুনাতে ঢাক্ঢোল পিটিয়ে যেন পুরো নিউইয়র্ক শহরকে জানান দিয়ে আসে। বাঙালিরা র্যলী করে জ্যাক্সন হাইট্স, জ্যামাইকা সহ বিভিন্ন এলাকা ঢাক্ঢোল বাজিয়ে রিক্সা নিয়ে প্রদক্ষিণ করে। পাশদিয়ে হেঁটে যাওয়া ভিনদেশি’রা তাকিয়ে দেখে অবাক নয়নে। জানতে চায়। নিঃসঙ্কোচে বলি, এটি আমার বাংলা নিউ ইয়ার। ধীরে ধীরে ওরাও জানছে আমার দেশ, ভাষা, সংস্কৃতি সম্পর্কে। আমি নিশ্চিত, সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন কোন ভিনদেশিকে ব্যাখ্যা করতে হবে না এমন করে।
পহেলা বৈশাখে কোন ব্যস্ততাকে এখন আর পরোয়া করে না বাঙালী। রাস্তায়, অডিটোরিয়ামে, ভিন্ন ভিন্ন সংগঠন বৈশাখী আয়োজন করে। আয়োজন চলে পুরো বৈশাখ জুড়ে। আমরা জনারণ্যে ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠান উপভোগ করি। হাতভর্তি চুড়ি, কপালে টিপ, শাড়ি পরিহিতা বাঙ্গালী নারী, পাঞ্জাবী কিংবা ফতুয়া পরা পুরুষ, শিশু-কিশোর, এত মানুষ, এত কোলাহল আমি আর অন্য কোন সময় একসাথে দেখিনা এই প্রবাসে। একদিকে দেশীয় গান, নৃত্য চলে, অন্যদিকে হরেকরকম বাঙালী খাবারের পসরা__ যেন এক টুকরো বাংলাদেশ ! অন্তত একটি উপলক্ষে সকল ধর্মের বাংলা ভাষাভাষীরা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে এক টুকরো বাংলাদেশ হয়ে উঠা, এই প্রবাসে আমাদের অনেক বড় পাওয়া। এটি আমাদের সন্তানদের বুঝতে শেখায়__ আমার দেশ, আমার সংস্কৃতি, আমার শেকড়।
জীবন, জীবিকা আর বাস্তবতার তাগিদে দেশ থেকে আমরা দূরে আছি হয়তো। কিন্তু দেশের প্রতি ভালোবাসা, সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা এমন করেই বুকের গভীরে ধারন করে চলি আমরা প্রবাসী’রা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত যুগ যুগ ধরে। আমরা মাছে ভাতে বাঙালী বারোটি মাস। তবুও হোক না কোন এক উপলক্ষ সামনে নিয়ে সব বাংলাদেশীরা এক কাতারে দাঁড়িয়ে, এক সাথে হেসে উঠি, একসাথে আনন্দে মেতে উঠি। তাইতো প্রতি বসন্তে চাতক পাখির মত আমি প্রহর গুনি বৈশাখের অপেক্ষায়। শুভ বৈশাখ।
৩১টি মন্তব্য
মারজানা ফেরদৌস রুবা
শুভ নববর্ষ!
আপনার দেশের জন্য এই হাহাকার আমি ভীষনরকম উপলব্দি করি।
হ্যাঁ, দিনদিন ১লা বৈশাখ আরো বেশি সার্বজনীন হয়ে উঠেছে।
রিমি রুম্মান
প্রবাসের পহেলা বৈশাখ এখন আর ঘরে রান্না বান্না করে টেবিল সাজিয়ে একাকি শাড়ী চুরি পরে একজনের অপেক্ষা নয়।
জিসান শা ইকরাম
প্রবাসে বসে বাংলাকে ধারন করে আছেন গভীর ভাবে।
ধীরে ধীরে একসময় প্রবাসের সবাই জেনে যাবে আমাদের বাংলাকে,আমাদের দেশকে।
আমাদের পরবর্তি প্রজন্মুও যেন বাংলাকে এমনি ভাবে লালন করে,এই প্রত্যাশা করি।
অত্যন্ত ভালো লেগেছে আপনার এই লেখাটি।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন। শুভেচ্ছা…
খেয়ালী মেয়ে
সময় অনেক কিছু কেড়ে নেয়, আবার সময়ে অনেক কিছু অনেক জাকজমকপূর্ণ হয়ে উঠে…
দেশের প্রতি ভালোবাসা, সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা এই বিষয়গুলো প্রবাসীদের মধ্যে আমি গভীরভাবে দেখেছি খুব কাছ থেকে….যার জন্য প্রবাসীদের এই ভালোবাসা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারি….আপনার জন্য অনেক শুভকামনা রইলো…শুভ হোক নববর্ষ…
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন। বৈশাখী শুভেচ্ছা।
মোঃ মজিবর রহমান
বাংলা থাক আত্মার গহীনে
বাঙ্গালিত্ত্ব থাক আমাদের বেশ ভুষায়
চলনে -বলনে।
রিমি রুম্মান
প্রবাসে এই বাঙালিত্ব নজরকাড়া । এটি একটি ভাল লক্ষন।
সীমান্ত উন্মাদ
বাংলাই হোক আমার শেষ ঠিকানা। দেরিতে হলেও বৈশাখী শুভেচ্ছা জানাচ্ছি আপু। আর শুভকামনা যথারীতি থাকে নিরন্তর।
রিমি রুম্মান
পুরো বৈশাখ জুড়েই বৈশাখী শুভেচ্ছা সহসাই রীতি হয়ে যাবে, আমার বিশ্বাস !
স্বপ্ন নীলা
অন্তত একটি উপলক্ষে সকল ধর্মের বাংলা ভাষাভাষীরা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে এক টুকরো বাংলাদেশ হয়ে উঠা, এই প্রবাসে আমাদের অনেক বড় পাওয়া। এটি আমাদের সন্তানদের বুঝতে শেখায়__ আমার দেশ, আমার সংস্কৃতি, আমার শেকড়।’’————-ঠিক তাই, শুভকামনা রইল
রিমি রুম্মান
শুভকামনা আপনাকেও। ভাল থাকুন।
নীলাঞ্জনা নীলা
আপনি এত কোমল সুন্দর করে উপস্থাপন করেন কিভাবে?মুগ্ধ হয়ে যাই আপনার লেখা পড়ে।
রিমি রুম্মান
এমন মন্তব্যে লিখতে ভীষণ উৎসাহিত হই, বিশ্বাস করুন…
ব্লগার সজীব
বাংলা বর্ষবরণ নিয়ে অত্যন্ত সুন্দর একটি লেখা পড়ে মন ভালো হয়ে গেলো আপু।কিছু ফটো দিলে পোষ্টটি আরো ভালো হতো। শুভ নববর্ষ আপু।
রিমি রুম্মান
ফটো দিতে আমারও খুব মন চাইছিল। প্রবাসের সুন্দর কিছু বৈশাখী ছবিও তুলেছিলাম। অসতর্কতা বশত দেয়া হলনা ।
ব্লগার সজীব
একটি ফটোতেই বুঝলাম নিউইয়র্কে কত জমজমাট ভাবে পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হয় 🙂
স্বপ্ন নীলা
আপু ! আমার মনে হচ্ছে তোমাকে দৌড়ে যেয়ে জড়িয়ে ধরি — তুমি এত সুন্দর করে লিখেছো যে মনে হচ্ছে আমি দেখতে পাচ্ছি —– ছবিটা দেখে প্রাণ জুড়িয়ে গেল, মনের কোনে আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল —
তোমরা বাংলার ঐতিহ্যকে তুলে ধর — তোমাদের নিকট হতে সন্তানেরা — এভাবেই চলতেই থাকবে
রিমি রুম্মান
জীবন, জীবিকা আর বাস্তবতার তাগিদে দেশ থেকে আমরা দূরে আছি হয়তো। কিন্তু দেশের প্রতি ভালোবাসা, সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা এমন করেই বুকের গভীরে ধারন করে চলি আমরা প্রবাসী’রা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত যুগ যুগ ধরে। আমরা মাছে ভাতে বাঙালী বারোটি মাস। তবুও হোক না কোন এক উপলক্ষ সামনে নিয়ে সব বাংলাদেশীরা এক কাতারে দাঁড়িয়ে, এক সাথে হেসে উঠি, একসাথে আনন্দে মেতে উঠি। শুভকামনা তোমায়…
নীলাঞ্জনা নীলা
কানাডার যে স্থানে আমি আছি,বাংগালী খুব কম।বর্ষবরণের দিনে সেখানে কিছুই হয়নি।পরে অবশ্য আমরা বাঙ্গালীরা মিলিত হয়ে নতুন বছরকে বরন করলাম।তবে টরেন্ট তে বেশ ধুম ধামের সাথে উদযাপিত হয়।আমরা আমাদের ঐতিহ্যকে ধারন করবো।দিয়ে যাবো আমাদের সন্তানদের।আবার পড়লাম আপনার লেখা।ছবি দেখে খুবই ভালো লাগছে 🙂
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্কের যে স্থানে আমি আছি, এটি একটুকরো বাংলাদেশ। বৈশাখে অনেক আনন্দ হয়। পুরো বৈশাখ জুড়ে ছুটির দিনগুলোতে মেলা হয়।
শুন্য শুন্যালয়
আপাতত ঈর্ষা ছাড়া কিছু মন্তব্য নেই। আমার এখানে অনেক ফ্যামিলি মিলে গেট টুগেদার করে, যদিও আমি এখনো জয়েন করতে পারিনি। মেলাও হয়েছে আগে শুনেছি। ছবিটা দেখে খুব ভালো লাগলো। পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকিনা কেন, বাঙ্গালীত্ব কি আর ছাড়া যাবে!! উইশ একদিন পৃথিবীর সব প্রান্তেই বাংলার এই বর্ষবরণ জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। খুব ভালো লেখা।
রিমি রুম্মান
এখানে প্রতিটি উৎসবই খুব ঘটা করে পালিত হয়। পহেলা বৈশাখ যেহেতু সকল ধর্মের বাঙালিরা পালন করে, সেহেতু এটি আরও বেশি আনন্দের হয়। এতে আমাদের সন্তান’রাও বুঝতে শিখেছে বাংলা সংস্কৃতি।
কৃন্তনিকা
জেনে ভালো লাগলো যে প্রবাসের বাঙ্গালীরা বাঙ্গালীপনাকে ধরে রাখতে পেরেছে…
বৈশাখের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক সর্বত্র…
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন। শুভকামনা নিরন্তর।
ছাইরাছ হেলাল
প্রবাস জীবনেও এত্ত কিছু ধারণ করে আছেন জেনে ভাল লাগল।
রিমি রুম্মান
এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা, যারা এদেশে জন্ম এবং বেড়ে উঠা, তাদের বাংলা সংস্কৃতিকে ধারন করা … উৎসব পালন করা দেখে আমি নিজেও অবাক হই। অথচ কয়েক বছর আগেও এতটা চোখে পরেনি।
ইমন
লেখাটা খুব ভালো লাগলো 🙂
রিমি রুম্মান
জেনে ভাল লাগলো। শুভকামনা জানবেন।
লীলাবতী
কত উজ্জ্বল ভাবে পালন করলেন নববর্ষের অনুষ্ঠান।এত মানুষ আসেন অনুষ্ঠানে এটি আমার ধারনায় ছিল না।
রিমি রুম্মান
নববর্ষের উৎসবটি এখন প্রবাসে এমন এক পর্যায়ে এসেছে যে, সবাই সেইদিন ছুটি নিয়ে হলেও পালন করেন দিনটি নানাভাবে।