বিলীয়মান অনুভূতি

নীলাঞ্জনা নীলা ২৮ আগস্ট ২০১৪, বৃহস্পতিবার, ০৯:৩৪:৫১অপরাহ্ন গল্প ৩৮ মন্তব্য
ছুঁয়ে ফেললেই কোমল তুলোর মতো উড়তে থাকা….
অনুরণিত হয় চারদিকে পাখী হয়ে মেলে পাখা…

“একটি অন্ধকার রাত তোমার জন্যে , জেনেও চলে যেতে হচ্ছে । স্বপ্ন আমায় তুমি যদি পারো ক্ষমা করো । —মনে মনে বললো রাত্রি । প্রেম , এ শব্দটা যে কেন এলো ওর জীবনে !”

—এটুকু লিখে থেমে গেলো প্রতীতি । তরুণ গল্পকারদের মধ্যে বেশ একটি পরিচিতি গড়ে উঠেছে তার । কিন্তু আজকাল আর নতূন কিছু লিখতে পারছে না । একই ঘটনা ঘুরে-ফিরে একই বিষয় । এভাবে চলতে থাকলে লেখার জগত থেকে হারিয়েই যাবে । কিন্তু চাওয়া তো অনেক উঁচুতে ওঠার । ওর নাম ছড়িয়ে পড়ুক বাংলা সাহিত্যের জগতে অন্যতম লেখিকা হিসেবে । এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ রিমাইন্ডারের মিষ্টি সুর । চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলো প্রতীতি , কাল আবর্তর জন্মদিন । কেমন জানি অপরাধবোধে ভুগছে সে । প্রিয় মানুষটির জন্মদিনে এই যে রিমাইন্ডার দিয়ে রাখা । “ধ্যৎ কি সব ভাবছি আমি ?” প্রতীতি আজ নিজে গিয়ে কেক কিনে এনেছে , আবর্তর প্রিয় ফুল হাস্নুহেনাও । এবার ভেবেছে অন্যরকমভাবে সারপ্রাইজ দেবে । এমন ভাব করবে , যেনো ভুলেই গেছে । যখন আবর্ত শুয়ে পড়বে , গিয়ে ওঠাবে ।

ঘড়িতে এখন এগারোটা । তার মানে আবর্ত ফিরে শুয়ে পড়েছে । সময়ের বাইরে খুবই কম যায় । তাই আগে মাঝে-মধ্যে বেশ মনোমালিন্য হতো । কিন্তু আবর্ত চুপ করেই থাকতো । আর এখন প্রতীতি যখন লেখায় থাকে , সেসময় একটুও বিরক্ত করে না । একটু খারাপ লাগলো । কাল জন্মদিন মানুষটার সাথে একটু কথাও হলোনা । আস্তে আস্তে পা বাড়ালো , আবর্তর রুমে গিয়ে দেখে সেখানে সে নেই । এ সময় তো বাড়ীর বাইরে থাকে না ! আর দেরী হলে ফোন করে জানিয়ে দেয় । কোথায় গেলো মানুষটা ? মনে হলো হয়তো প্রতীতিকেই চমক দিতে ছাদে নয়তো ব্যালকনিতে গেছে । কিন্তু সেখানেও নেই । অস্থিরতা যেনো বুকের ভেতর , ফোনও বন্ধ । কি করবে প্রতীতি ? কাজের মেয়েটা কিচেন পরিষ্কার করছে ।

–“টুনী সাহেব কোথায় রে ? ”

মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে টুনী বললো , “ম্যাডাম দেখিনি আমি ।”

–“কি করিস তুই , দেখিসনি মানে ? এমন রাত কখনোই করেনা । নিশ্চিত বাইরে গেছে , আর তুই বলছিস দেখিসনি !”

টুনী মাথা নীচু করে রইলো ।

–“যা তো দারোয়ানকে গিয়ে জিজ্ঞেসা করে আয় ।”

প্রচন্ড ভয়-দুশ্চিন্তা নিয়ে এদিক-ওদিক পায়চারী করতে লাগলো প্রতীতি । বহু বছর হয়ে গেছে আলাদা রুমে ঘুমোয় দুজনে । তবে কোনো দাম্পত্য কলহ থেকে নয় । লেখার জন্যেই আলাদা ঘর । আবর্ত ঘুমোবার আগে প্রতীতির কপালে ছোট্ট করে একটা আদর দিয়ে শুভরাত্রি জানিয়ে যায় । তবে ব্যস্ত থাকলে প্রতীতি ওসবের কিছুই করেনা । একটা গভীর আবেগ দুজনকেই জড়িয়ে রেখেছে , সেটা দুজনেই বুঝতে পারে ।

–“ম্যাডাম দারোয়ান ভাই সাহেবকে বাইরে যেতে দেখেনি ।”

–“কি বলিস এসব ?”

আবার ফোন করলো , আবারও ঘরের এদিক-ওদিক খুঁজতে লাগলো । বিশাল বাড়ীটায় এতো বেশী দমবন্ধ লাগছে । বাইরে এসে দারোয়ানকে নিজেই জিজ্ঞাসা করলো ,

–“সাহেব বাড়ীতে নেই , কি করে বলো যে সাহেব বাইরে যায়নি ? নিশ্চয়ই ঘুমিয়েছিলে ? এ সময় সাহেব কখনোই বাড়ীর বাইরে থাকে না । সবগুলোকে তাড়াবো ।”

মাথা নীচু করে দারোয়ান বললো ,

–“ম্যাডাম সাহেবকে তো বাড়ীতে ফিরতেই দেখিনি ।”

থমকে গেলো প্রতীতি । কোথায় গেলো আবর্ত ? ফোন বন্ধ কেন ? কাল একটা লেখা পাঠাতে হবে বলে খেয়াল করেনি আবর্ত যে ফেরেনি । অপরাধবোধ ঠিক না , খুউব বেশী যন্ত্রণা হচ্ছে । মনে হচ্ছে শ্বাস আটকে আসছে । ধীর পায়ে নিজের রুমে গেলো , টেবিলের ওপর লেখা কিছু কাগজ সেসব ছিঁড়লো । ল্যাপটপের সবগুলো লেখা মুঁছে ফেললো । আগে প্রতীতির যা কিছু লেখা সব আবর্তকে নিয়ে । একদিন আবর্ত বললো ,

–“তিথি আমাকে আর বিষয় হিসেবে দেখিওনা তোমার লেখায় । সাধারণ একজন মানুষ হয়েই থাকতে দাও ।”

সমস্তটি ফ্লোরে ছেঁড়া কাগজের টুকরো । সেসবের দিকে চেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো ও । এরই মধ্যে গাড়ীর হর্ণ । সেই প্রথম দিককার মতো ছুটে গেলো । আবর্ত গাড়ী থেকে নেমে আসতেই , প্রতীতি ঝাঁপিয়ে পড়লো বুকে ।

–“কোথায় ছিলে তুমি ? কেন ফোন তোলোনি আমার ? এই , এই ড্রাইভার কোথায় ?”

–“একসাথে এতোগুলো প্রশ্নের উত্তর কি দেয়া যায় ? আগে ঘরের ভেতরে চলো , এবার কি চমক আমার জন্মদিনে ? তারপর সব বলবো ।”

–“কি করে জানো আমি চমক দেবো তোমায় ? এবার কোনো চমক নেই ।”

–“আমার বৌকে আমি ভালো করেই চিনি । আরোও কিছু বলবো ?”

প্রতীতির এতো লজ্জ্বা লাগছিলো , কেমন জানি ! কিন্তু ঘরের ভেতর ঢুকেই আবর্তর বুকে মাথা রেখে কান্না শুরু করলো ।

–“আরে মেয়ে শোনো , জরুরী মিটিং ছিলো । তাই শহরের বাইরে যেতে হয়েছিলো । তোমাকে ফোনও দিয়েছিলাম , কিন্তু ধরোনি । দেখো টেক্সট ম্যাসেজও করেছিলাম । একটুকুও সময় ছিলোনা যে বাড়ী এসে তোমায় জানিয়ে যাবো । ফেরার পথে ড্রাইভার হলো অসুস্থ । ওকে ডাক্তার দেখিয়ে ওর বাড়ীতে নামিয়ে দিলাম । পরে দেখি সেল ফোনে চার্জ নেই । বুঝেছো কান্নাবতী মেয়ে ?”

–“কেন অন্য কোথাও থেকে তো ফোন করা যেতো ! সত্যি করে বলো কোথায় ছিলে তুমি ?”

–“এখনও সন্দেহ ? সাত বছর হয়ে গেছে তিথি ।”—এ কথা বলে বেশ জোরে হেসে উঠলো আবর্ত । এরপর হাসি থামিয়ে গভীর চোখে চেয়ে জানতে চাইলো , “কি লিখেছো আজ ? দাও পড়বো ।”

ঘরময় ছেঁড়া কাগজ । আবর্ত ডাকলো টুনীকে , “ঘরটা পরিষ্কার করে ফেল ।”

প্রতীতি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে , আর চেয়ে চেয়ে দেখছে । আবর্তর সাথে দূরত্ত্বটা এখন আর এক হাতও নয় । কাঁপছে প্রতীতি ।

হ্যামিল্টন , কানাডা

২৪ জুলাই , ২০১৪ ইং ।

৫৪২জন ৫৪২জন
0 Shares

৩৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ