গেটের কাছে গেট মানি নিয়ে বার্গেনিংটা এখন মৃদুলের কাছে অসহ্য ঠেকছে। গলা উচিয়ে পিউকে একবার ডাকতে চায় মৃদুল। কিন্তু কি যেন ভেবে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। এ বাড়িতে অন্যান্য বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখেছে গেট মানি নিয়ে ছেলেপেলেরা সমস্যা সৃষ্টি করলে বড় মামা এগিয়ে গিয়ে ধমক লাগিয়েছে। ছেলে ছোকরাদের হাত থেকে বরযাত্রীদের ছুটিয়ে এনে তোয়াজ করে বসিয়েছে। কিন্তু আজ তিনি একেবারেই বোবা সেজে বসে আছেন। গেটের ধারে কাছেও যাচ্ছেন না। মৃদুল যখন এসব ভাবছে হঠাৎ করেই কোথা থেকে যেন ওয়াহিদ মোল্লা এসে প্যান্ডেলে ঢুকে। তার মনটাও কেমন জানি পাতলা কষ্টের চাদরে ঢাকা। সারা প্যান্ডেল ঘুরে এসে ওয়াহিদ মোল্লা বলেন-
: কি রে মৃদুল সব কিছু ঠিক ঠাক আছে ত?
: জ্বী মামা, সব কিছুই ঠিক আছে। কথাটা বলেই তাকে আবার অন্য মনস্কতায় পেয়ে বসে। গেটের কাছের চিল্লাচিল্লি, উচ্চগ্রামে হাসাহাসি, ইতরামী ও অসভ্যতা এখন মৃদুলের কাছে সকল সীমা অতিক্রম করেছে যেনো। তার কাছে মনে হচ্ছে পিউকে কাছে পেয়ে বর পক্ষের ছেলে ছোকরাদের বিশেষ করে ঐ ধামরা ভীমটার উশৃংখলতা আরো বেড়ে গেছে। তাদের সাথে রুচিহীন সাজ সেজে, সৌদি আরব থেকে আনা স্বর্ণালঙ্কার লাগিয়ে সাদিয়া ভাবী ও যোগ দিয়েছে। এসব দেখে মৃদুলে রাগ সপ্তমে চড়তে থাকে। মহিলাটার যে কোন কান্ড জ্ঞান নেই তা তা আচরনেই বেশ ফুটে উঠছে। মৃদুল নিজে নিজেই বলে ওঠে; এই সব মহিলাদের সাথে মানুষ ঘর করে কি ভাবে। অসহ্য।
ওয়াহিদ মোল্লা আবার প্যান্ডেল ঘুরে এসে মৃদুলের সামনে দাড়িয়ে বলেন-
: যা তো মৃদুল। তুই গিয়ে গেইটের ঝামেলাটা মিটাইয়া দিয়া আয়। এ সব হইহুল্লোর, চেচামেচি আর ভল্লাগে না। যা তো মামা একটু আগা।
: কেন মামা, আমি যাব কেন। আপনি মুরব্বী, তা ছাড়া এতদিন তো দেখে এসেছি, আপনিই এই সব ঝামেলা সামলাতেন।
: কীসের কী। অহন কী আর পোলাপাইনে কোন মুরব্বী টুরব্বী মানে নাকি। তা আইজ আমার ঐ দিকে যাইতে মন চায় না।
: না মামা। আমি গেলে ও কাজ হবে না। ওদেরটা ওরা যেভাবে পাড়–ক আদায় করুক। তবে…
: তবে কিরে ভাগনা। ক হুনি।
পিউকে এদিকে ডেকে নিয়ে আসলে ভাল হয়। পিউকে পেয়ে ওরা আরো বেশী বাড়াবাড়ি করছে।
মামা আড় চোখে মৃদুলের দিকে তাকায়। তার ঠোটের কোণে মৃদু হাসি ঝুলে পড়ে। ওয়াহিদ মোল্লাও কিছুটা মজা করার ভঙ্গিতে বলেন-
পিউ ঐ খানে থাকলে তোর অসুবিধা কি?
: না মামা আমার কোন অসুবিধা নেই। মামার হাতে ধরা পড়ে যাওয়ার আগেই মৃদুল প্রসঙ্গান্তরে চলে যেতে যেতে বলে-
: মামা একটা কথা বলি।
: ক। কি কইতে চাছ।
: আপনি আবার কিছু মনে করবেন নাতো?
: না কিছুই মনে করুমনা। ক।
মৃদুল নিজে নিজে একটু গুছিয়ে নেয়।
আর গুছিয়ে নেয়ার কাজটা করতে চায় তার বড় মামার বর্তমান শান্ত মুর্তি দেখে। যে ওয়াহিদ মোল্লা সব সময় রেগে মেগে থাকে। প্রয়োজনীয় কথা বলতেও তার সাথে কেউ সাহস করে না। সেই ওয়াহিদ মোল্লা এবং এখনকার ওয়াহেদ মোল্লার সাথে কিছুতেই মিলনো যাচ্ছে না। যেন ঢেউহীন, স্রোতহীন কেমন এক শান্ত নদী। তা তলে কী নাসিমার জন্য এমন একটা বেমানান লোকের বিয়ে ঠিক করে ওনি এ মূহুর্তে কোনো অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হচ্ছেন? তার ভাবনার জালটা ওয়াহেদ মোল্লাই ছিনিয়ে দিয়ে বলে-
: কি রে কি কতা কইতে চাইছলি ক ।
: না মামা, বলছিলাম কি আপনারা যে নাসিমার জন্য এই বরটা ঠিক করলেন ওর সাথে কী নাসিমাকে মানাবে?
: ক্যান। মানাইব না ক্যান। মেয়ে সুন্দর অইলে ছেলে সুন্দর না অইলেও অয়। আর তুই কি জানছ ছেলেদের অবস্থা। তাগ অইলো গিয়া পীরের বংশ। ছেলের পৌঢ় দাদা আছিল চাইর পাছ জিলার মইধ্যে নামকারা পীর। আর জমি জমা অর্থ সম্পত্তিও অঢেল। ছেলে অইল গিয়া কুমিল্লার খুব বড় কনটেকদার। ছেলে না হয় অইল একটু ময়লা। এতে ত কোনু সমস্যা নাই।
:ছেলের গায়ের রং কালো এটা তো কোনো সমস্যা ছিলনা। ছেলের চেহারাও তো কেমন গরিলা মার্কা। মামা বেয়াদপী নেবে না। এ সব টাকা পয়সা, নাম ডাকই কী সব। মেয়েদের পছন্দ অপছন্দের বিষয় আছে না। আপনারা কী এই বিয়েতে নাসিমার মত আছে কি নেই তা জানতে চেয়েছেন?
: তুই কী কইতে চাছ পোলা পছন্দ অয় নাই নাসিমার।
: আমি তো তেমনই শুনলাম।
: আমাদের বংশে কোন মইয়ার মত নিয়া বিয়ার সম্মন্ধ ঠিক হয় না। মুরব্বীরাই তা করে। এই জায়গায়ও আমরা এইডাঐ করছি। ছেলে দেখতে একটু ময়লা নাই লে ত সবঐ আছে। বংশ নাম ডাক অর্থ সম্মত্তি সবঐ ত আছে।
: এ সবই কী একটা মেয়ের জীবনে সব কিছু মামা?
: এই সব কিছু না, কি কছ। স্বামীর ঘরে গেলে দেখবি একদিন সব ঠিক অইয়া গেছে।
মামার সাথে এ মুহুর্তে আর কোনো তর্কে যেতে চায় না মৃদুল। কোন কথায় আবার রেগে মেগে গিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ঠিক নেই।
মামা ভাগনার মধ্যে এখন নিঃসীম নিরবতা। দুজনই গেটের দিকে তাকিয়ে আছে। গ্রামের অতিথি যাদেরকে দাওয়াত করা হয়েছে এরই মধ্যে অনেকেই প্যান্ডেলে এসে বসতে শুরু করেছে। ওয়াহেদ মোল্লা এখনো তাকিয়ে আছে গেটের দিকেই। মৃদুল চোখ ফিরিয়ে রেখেছে প্যান্ডেলের দিকে। গেটের কাছের এ সব বেলাল্লাপনা অসহ্য লাগছে তার কাছে। এর মধ্যেই ওয়াহেদ মোল্লা বলে ওঠেন-
: দেখ মৃদুল! আমিনের বউয়ের কান্ড দেখ। বেটি ছেলে ছোকরাদের লগে কেমন আতাআতি করতাছে। বউ একটা আনছে আমিনের মা। কথাটা শেষ করেই ওয়াহেদ মোল্লা এমনই একটা মুচকী হাসি দিয়েছে, তা দেখে মৃদুল তার হাসি আর চেপে রাখতে পারে না। দুই মামা ভাগনাই এক সাথে কতক্ষণ মুখ চেপে হাসে।
গেটের ঝামেলা মিটিয়ে ছেলে পেলেরা বরকে নিয়ে প্যান্ডেলে এনে বসায়। বর দেখে আনেকেই বিরূপ মন্তব্য করছে। এক মুরব্বী গোছের লোক ঠোঁটকাটার মত সবার সামনে বলেই ফেলে।
: এ ত দেহি কাউয়ার মুখে কমলা।
ওয়াহেদ মোল্লার দিকে নজর পরতেই। লোকটা মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ওয়াহেদ মোল্লা মানুষের বিরূপ মন্তব্যের মুখে প্যান্ডেল থেকে বেরিয়ে যায়।
নাসিমার জন্য মৃদুলের মনের আকাশে কিছু কষ্টের মেঘ উড়াউড়ি করে। মেয়েটা কেন এতদিন তাকে সব কথা খুলে বলেনি। সেই ছেলে বেলার খেলার সাথী। কয়েক ঘন্টার মধ্যে চলে যাবে ঐ অসহ্য লোকটার বগল বন্দি হয়ে। নাসিমার বরের দিকে তাকায় মৃদুল। অন্যান্যদের সাথে সে হাসি মশকরায় মশগুল। কি কথায় যেন নাসিমার বর বিশাল শরীরটা দোলিয়ে হাসছে।
‘এ ত দেহি কাউয়ার মুখে কমলা’ যে লোকটা এ কথা বলছিল মৃদুল সে লোকটির দিকে তাকায় একবার। লোকটা তো একটা অপ্রিয় সত্য কথাই বলেছে। যে কথাটা শুনে বড় মামা বিব্রত হয়ে চলে গেছে এখান থেকে। মৃদুলেরও এখন এখান থেকে চলে যেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু সে যেতে পারছেনা। কেন যেতে পারছেনা তা ও জানেনা মৃদুল।
তখনই কে যেন মৃদুলের পাশে বসে তার সাথে কথা বলা শুরু করে।
: তুই ঐ বেচারা ভদ্র লোককে দেখার পর থেকে প্রতিদ্ধন্ধির মতো এমন নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখচিস কেন? মৃদুল বলে-
: আমি ওকে প্রতিদ্ধন্ধি ভাবতে যাব কোন দুঃখে।
: না তোর অবস্থা দেখে তো তা ই মনে হচ্ছে। আর নাসিমার বর যদি দেখতে সুন্দর না হয় তাতে তোর সমস্যা কী?
: না, আমার কোনো সমস্যা নেই। শুধু এমন একটা সুন্দরী মেয়ের সাথে এমন একটা বর কিছুতেই মিলাতে পারছি না।
: তুই মিলাতেই বা যাস কোন দুঃখে।
: কেন মেলালে তোর অসুবিধা কি?
: অসুবিধা আছে। এখন ওদের জীবন, ওদের নিয়ে থাকতে দে। তোর না ভাবলে ও চলবে।
: আরে যা। মৃদুল রেগে যায়।
: তুইও যা।
কথা বলা থেমে যায়। মৃদুল বুঝতে পারে এতক্ষণ সে নিজের সাথে কথা বলছিল।
প্যান্ডেলের ভেতরে ব্যস্ততা বাড়ে। বিয়ে পড়ানো আয়োজন চলছে। কাজি এসে গেছে। মৃদুল আর প্যান্ডেলে ভিতর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। তার ভেতর কেমন একটা অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। পিউ আরো কয়েকটি মেয়ে এসে প্যান্ডেলে ঢুকে বরকে সরবত খাওয়াতে। মৃদুলের কাছে পিউ’র এ আদিখ্যেতা ভাল লাগে না। সে বেরিয়ে যায় প্যান্ডেল থেকে। [চলবে…]
১৭টি মন্তব্য
তৌহিদ
গ্রামের বিয়েবাড়ির প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠেছে লেখায়। পড়ছিলাম একমনে আর নিজেকে কল্পনা করছিলাম সেখানে। এখনো এরকম আছে যে বিয়ের সময় নারীর পছন্দ অপছন্দ জিজ্ঞেস করা হয়না। যেন গছিয়ে দিতে পারলেই শান্তি।
বিয়ের গেটের মজাটা যাই বলেন গ্রামের আর শহরের মধ্যে বিস্তর ফারাক। তবে গ্রামেরটারই মজা অন্যরকম ভাই। আমার ভালো লাগে।
ভালো লাগলো পড়ে। ভালো থাকবেন ভাইজান। শুভকামনা।
মাহবুবুল আলম
তৌহিদ ভাই!
উপন্যাসটি ভাল লাগার জন্য ধন্যবাদ!
আপনিও ভাল থাকবেন।
শুভকামনা!!
নুর হোসেন
আপনি খুব সহিষ্ণু লেখক, যত্ন করে সাজিয়ে লিখেন, ভাল লাগলো।
মাহবুবুল আলম
অনেক অনেক ধন্যবাদ!
জিসান শা ইকরাম
চমৎকার ভাবে এগিয়ে চলছে উপন্যাস,
পরের পর্বের জন্য অপেক্ষায় রইলাম।
মাহবুবুল আলম
জিসান ভাই
জিসান ভাই!
অনেক অনেক ধন্যবাদ শুভেচ্ছা জানবেন!
এস.জেড বাবু
মৃদুলের ভেতর দ্বৈত স্বত্ত্বা কাজ করছিলো-
আর আমার ভেতর দ্বৈত চিন্তা –
কে হচ্ছে মৃদুলের ঠিকানা
চমৎকার লাগছে পর্বটা-
মাহবুবুল আলম
এস.জেড বাবু !
এটি একটি ত্রিভূজ প্রেমের গল্প। সম্পূর্ণটা
পড়লে আশা করি ভাল লাগবে! শুভেচ্ছা জানবেন!
কামাল উদ্দিন
………..এমন অলিখিত নিয়ম এখনো অনেকেই মেনে চলে, যদিও এখন তা সংখ্যায় অনেক কমে গেছে।
মাহবুবুল আলম
ঠিক বলেছেন! বিয়েশাদীর ক্ষেত্রে এখনো মেয়েদের মতামতকে প্রাধান্য দেয়া হয় না। যা খুবই দুঃখজনক।
অনেক ধন্যবাদ!
কামাল উদ্দিন
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ ভাই
সুরাইয়া পারভিন
উফফ মোটেও ভালো হচ্ছে না । বিয়েটা কি ঐ লোকটার সাথেই হবে?
মাহবুবুল আলম
আপনার সাসপেন্স এর সাথে আমিও শামিল।
ধন্যবাদ ভাল থাকবেন।
মনির হোসেন মমি
বিয়ে শেষ না হওয়া পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না।কী হয়। চলুক লেখা।
মাহবুবুল আলম
জ্বি মমি ভাই। শেষ পর্যন্ত সাসপেন্সই থাকবে। ভাল থাকবেন। শুভ কামনা।
প্রদীপ চক্রবর্তী
বেশ এগিয়ে যাচ্ছে দাদা।
শুভকামনা রইলো।
মাহবুবুল আলম
অনেক অনেক ধন্যবাদ! ভাল থাকবেন।