গত ক’দিন থেকেই হাত দুটো নিশপিশ করছে নতুন করে কিছু লিখতে, কিন্তু পারছিনা। লিখতে বসলেই অবধারিত ভাবেই বিশ্বজিৎ আমার চেতনায় ভর করে, কখনো মনে হয় বিশ্বজিৎ আমার খুব পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার রক্তচক্ষু আমাকে গিলে খাচ্ছে, একটু পর পর বিশ্বজিৎ আমার কানের কাছে এসে ফিস ফিস করে বলছে, “তুই আমাকে মেরেছিস, হ্যাঁ তুই তুই তুই… আমার উপর যখন হায়েনারা ঝাপিয়ে পড়েছিলো তখন ত তুই-ই আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমার মৃত্যুর দৃশ্য ক্যামেরা বন্দি করেছিলে। তুই কি তখন তোর ক্যামেরাটা ছুঁড়ে ফেলে পারতিনা আমাকে বাঁচাতে? তুই-ই আমাকে মেরেছিস, হায়েনারা যখন চাপাতি দিয়ে আমাকে কুপাচ্ছিলো তখন তুই-ত আর দশজন নীরব দর্শকের মতো আমার মৃত্যুর শেষ দৃশ্য দেখছিলে খুব কাছে দাঁড়িয়ে, তখন কি তুই পারতিনা ওই হায়েনাদের কবল থেকে আমাকে বাঁচাতে?” বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের খবরে যখন বিশ্বজিৎ হত্যার দৃশ্য দেখছিলাম তখন আনমনেই নিজের উপর ঘৃণার থু থু ছিটাচ্ছিলাম। মনে মনে এই নৃশংস হত্যার দায় নিজের কাঁধেই নিয়ে নিলাম। হ্যাঁ, আমিই ত বিশ্বজিতের হত্যাকারী। আমার মধ্যে মানবিক মূল্যবোধের জাগরণ হয়নি বলেই আজ প্রকাশ্য দিবালোকে বিশ্বজিতেরা খুন হয়ে যাচ্ছে বেজন্মাদের হাতে। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের দূর্বল হাত একত্রিত হতে পারেনি বলেই আমাদের চোখের সামনে হায়েনারা বিশ্বজিতদের তরতাজা প্রাণ এক পলকে কেড়ে নিচ্ছে। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ভোটেই যারা নির্বাচিত হচ্ছে তাদের ছত্রছায়ায় নির্বিচারে বিশ্বজিতেরা প্রাণ হারাচ্ছে। তাই আমি কি কোন ভাবেই বিশ্বজিৎ হত্যার দায় এড়াতে পারি?

বিশ্বজিৎ হত্যায় দায়ে আমি আমার মনকে গ্রেফতার করলেও আবার নিজেই ওকালতি করে মনকে জামিনে ছাড়িয়ে আনি। কারণ আজ মনকে বন্দি করে রাখার দিন নয়, আজ মনকে মুক্ত করে রাখতে হবে, আজ মুক্ত হবার দিন। একজন বিশ্বজিৎ যদি এই পৃথিবীতে জন্মও না নিতো তবে পৃথিবীর কোন ক্ষতি হতো না, একজন বিশ্বজিৎ যদি চলেও যায় তবুও এই পৃথিবীর কিচ্ছু হবে না। একজন বিশ্বজিতের জন্য কোন কিছুই আটকে থাকবে না, থাকেওনি কখনো তাহলে আমি কেন আমার মনকে বন্দি করে রাখবো? কেন বিবেকের দংশনে নিজেই নিজের মনকে ছিন্ন ভিন্ন করবো? আজকের এই কুয়াশাচ্ছন্ন শীতল সন্ধ্যাটা মধ্য রাতের কোলে মাথা রাখতেই শুরু হয়ে যাবে আমাদের মহান বিজয় দিবসের নানান রকম আয়োজন। সরকারী ও বেসকারী ব্যবস্থাপনায় জমজমাট আয়োজনে অনেক কিছুই থাকবে, থাকবে বিজয়ের উল্লাস মিছিল। ব্যানার ফেস্টুন, নানান রকম বেলুন আর নানান রঙের আলোকসজ্জায় আলোকিত মুখোরিত হবে সারাদেশ। আমি কেন নিজেকে এই বিজয়োল্লাস থেকে বঞ্চিত করবো? খুব ভোরে পত্রিকার পাতা উল্টাতেই দেখবো মূল কাগজের সমান ভারী ক্রোড়পত্র। বিজয় দিবসের জয়গানে ভরপুর বর্ণিল ক্রোড়পত্রটি পড়ার আনন্দ থেকে কেন বঞ্চিত হবো একজন বিশ্বজিতের জন্য? বিশ্বজিৎ কে? তা আমাকে ভুলে যেতে হবে। বিশ্বজিতকে ভুলে টিভির রিমোটটা হাতে তুলতে হবে তারপর গোগ্রাসে চোখ আর কান দিয়ে গিলবো নানান চ্যানেলের রকমারী আয়োজন, নাচ গান নাটক যা আছে সব, সব। বিশ্বজিতকে ভুলে টক শোর দিকে মনোযোগ দেবো। একজন বিশ্বজিতের মরে যাওয়ায় দেশের উন্নয়ন ব্যহত হয়না, টেলিভিশনের টক শো দেখে নতুন করে আবার জেনে নেবো দেশ কতটুকু এগিয়ে গেলো। আমাদের আর পেছনে তাকানোর দিন নেই এবার শুধু এগিয়ে যাওয়া।

এগিয়ে যেতে যেতেও অনেক কিছুই রয়ে যায় তেমনি ভাবে অনেক কিছু রয়ে যাওয়ার মধ্যে একটি হলো কথা! সাধারণ মানুষ কোন কিছু বললে সেটা হয় কথা আর কোন বিখ্যাত মানুষ যদি কিছু বলে সেটা বেশির ভাগ সময় হয়ে যায় বাণী। গত কয়েক বছরে যারাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন তারাই একসময় বাণী বিশারদ হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। বি.এন.পি’র সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আলতাফ হোসেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা কালীন সময়ে লঞ্চ ডুবিতে শতাধিক মানুষ মৃত্যু বরণ করলে তিনি তার দায়িত্ব আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়ে বলেছিলেন “আল্লাহর মাল আল্লায়‌ নিসে”। সে সময় তার এই অমর বাণী বাংলাদেশের বাণীর টপচার্টের শীর্ষপদ আঁকড়ে ধরে রেখেছিলো বহুদিন। সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের “উই আর লুকিং ফর শত্রুস” বাণীটাও বেশ কিছুদিন জিন্দা ছিলো স্বগৌরবে। সন্ত্রাসীকে ১০০ হাত মাটির নীচ থেকে টেনে বের করতে না পারলেও আওয়ামীলীগের সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী নাসিমের “সন্ত্রাসী ১০০ হাত মাটির নিচ থেকে খুজে বের করা হবে।” এমন বাণী দিয়েও বাণীর ভান্ডার সমৃদ্ধ করেছিলেন। পূর্বসূরীদের ধারাবাহিকতায় বর্তমান স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী টুকু টুক করেই একটা বাণী প্রসব করেছিলেন সেই বাণীটা শুনে আমি হাসবো না কাঁদবো ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি আমার অবস্থা থাক দেখি তার বাণীটা শুনে আপনাদের কি অবস্থা হয় তার বিখ্যাত বাণীটি হলো “বঙ্গবন্ধু জন্মের সাথে সাথেই না কেদেঁ জয়বাংলা বলে উঠেছেন।” এবার আপনারাই সিদ্ধান্ত নিন, আপনি হাসবেন না কাঁদবেন। বর্তমান সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের “এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা” বাণীটি ঠিক অতটা সমৃদ্ধ না হলেও বাণী সংগ্রাহকের দৃষ্টি ঠিকই আকর্ষিত করতে পেরেছিলো তবে তার ৪৮ ঘন্টার বাণীটি ৪৮দিনের বেশি টিকেছিলো সবার মুখে মুখে। আর বর্তমান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর নানান বাণী বর্তমান টপচার্ট দখল করে আছে তা বলা বাহুল্য।

অনেক কিছুই বলা বাহুল্য, তারপরও আমরা বলে ফেলি। কেউ কেউ সাত পাঁচ না ভেবে বেহিসেবে কথা বলতে গিয়ে বেকায়দাতেও পড়ে যান। যেমনটি পড়েছেন বর্তমান সরকারদলীয় আওয়ামীলীগের এক প্রবীণ মন্ত্রী। আওয়ামীলীগের সেই প্রবীণ মন্ত্রী দলের বাহাদুরী জাহির করতে গিয়ে বেফাঁস মন্তব্যে বলেছিলেন, “বিরোধী দলের আন্দোলনকারীদের প্রতিহত করতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট।” আজ বিশ্বজিৎ হত্যায় ছাত্রলীগের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় নিশ্চয় বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ বিব্রতকর অবস্থায় আছে। বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ কেবল বিব্রতবোধ করলেও এই নৃশংস হত্যায় পুরো দেশ আজ কলঙ্কিত। কেবল মাত্র সন্দেহের ভিত্তিতে যদি কাউকে হত্যা করা হয় তাহলে সারা দেশের মানুষকে হত্যা করা উচিত কেননা আমরা কেউই সন্দেহের ঊর্ধ্বে নই। একটা সময় শুনেছি খ্রিষ্টান মিশনারী থেকে কাউকে খ্রিষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করা হলে তার পাছায় খ্রিষ্টান ধর্মের সিল মেরে দেয়া হতো যাতে ভবিষ্যতে সে যদি খৃষ্টান ধর্মের অনুসারী বলে নিজেকে অস্বীকার করে তাহলে তার পাছায় অঙ্কিত সিল প্রমাণ করবে যে সে একজন খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী। নও খৃষ্টান ব্যক্তির মৃত্যুর পর তাকে খৃষ্টান রীতি অনুসারে সমাহিত করা হয় কিন্তু বর্তমান সময়ে কোন সাধারণ মানুষের গায়ে লেখা থাকেনা কি তার নাম, কি তার ঠিকানা, কি তার জাত বা ধর্ম কিংবা তার রাজনৈতিক মতাদর্শ কি। যেমনটি থাকেনি বিশ্বজিৎ নামের হতভাগার গায়ে, যে কারণে সে তার জীবন দিয়ে সিল ছাপ্পরের খেসারত দিয়ে গেলো!

বিশ্বজিৎ চলে গেলেও আমরা থেকে গেছি। আমার গায়েও কোন সিল ছাপ্পর নেই। আমি বা আমরা জানিনা আগামী কাল কার সন্দেহের বলি হতে যাচ্ছি। যাহোক, আমার আজকের লেখাটা আর খুব বেশি টানবো না, তবে লেখাটি শেষ করার আগে খুব ব্যক্তিগত ভাবে আমি কয়েকজনের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। গত ক’দিন থেকে আমাকে আমার প্রিয়জনদের মধ্যে যারা আমার লেখা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েন বা আমার লেখার প্রতীক্ষায় থাকেন তাদের কয়েকজন আমাকে বেশ তাগাদা দিচ্ছিলেন আমাদের মহান বিজয় দিবস নিয়ে যেন ভালো মানের একটা লেখা তাদেরকে উপহার দিই। তাই আমার প্রিয়জনদের চাওয়া পূর্ণ করতে লিখতে বসছিলাম কিন্তু আমি কোন ভাবেই বিজয় দিবসকে উপলক্ষ্য করে মান সম্পন্ন কোন লেখা আমার প্রিয় জনদের উপহার দিতে পারিনি, সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছি আমার প্রিয়জনদের চাওয়া পূর্ণ করতে। আমি কোন ভাবেই আমার মাথা থেকে বিশ্বজিতকে সরাতে পারছিলাম না। যা-ই লিখি না কেন সব লেখার মধ্যে ঘুরে ফিরে বিশ্বজিৎ চলে আসে তাই আমার এই লেখাটাও কোন ভাবেই গুছিয়ে লিখতে পারলাম না, খুব এলো মেলো হয়ে গেলো। বিজয়ের গানে মুখরিত হয়ে আরো একটা লেখা শেষ করতে পারলাম না বিবেকের তাড়নায়, কারণ আমার বিবেক বার বার বিশ্বজিতের কাছে ছুটে চলে যাচ্ছিলো সঙ্গত কারণেই।

টিভি পর্দায় বিশ্বজিৎ হত্যার দৃশ্য দেখার পর দু তিন দিন রাস্তায় পথ চলতে এমনও মনে হয়েছে এই বুঝি কেউ আমার উপর হামলে পড়বে, এই বুঝি কেউ আমাকে ডাক দিয়েই ধরে নিয়ে যাবে, এই বুঝি  হায়েনার দল চাপতি, রড ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আমার দিকে তেড়ে আসবে, পাশে থাকবে টিভির ক্যামেরা। টিভির ক্যামেরায় আমার মৃত্যু দৃশ্য ধারণ করা হবে কিন্তু কেউই আমাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসবেনা। খুব চেষ্টা করছি বিশ্বজিতকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে। কোন একসময় হয়তো এমনিতেই সব চলে যাবে, সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কারণ আমি বাঙ্গালী আর বাঙ্গালীরা এমনই। আর কিছুক্ষণ পরেই শুরু হবে বিজয় মিছিল, মন মরা মন নিয়ে বসে থেকে কি লাভ, চেষ্টা করবো খুব স্বাভাবিক ভাবে সব কিছু মেনে নিয়ে আমিও সেই বিজয় মিছিলের আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠতে, তাই লেখাটি এখানেই শেষ করছি আর শেষ করতে করতে আপনাদের জন্য একটা জোকস রেখে গেলাম লেখার শেষ অংশে, বিজয়ের আনন্দে মেতে উঠুন সবাই। সবাইকে জানাই মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা, সেই সাথে বাঙ্গালীর শ্রেষ্ঠ সন্তান সকল মুক্তিযোদ্ধাদের পদতলে লাখো সালাম আর বিনম্র শ্রদ্ধা।

সুধীনাথের বাড়িতে পুলিশ রেইড করেছে। অভিযোগ, তার বাড়িতে জাল টাকা তৈরি হয়। পুলিশ সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজে একটাও জাল টাকা পেলোনা, কিন্তু জাল টাকা তৈরীর সরঞ্জাম পেলো। তাই বাড়িতে জাল টাকা তৈরীর যন্ত্র রাখার অপরাধে পুলিশ সুধীনাথকে গ্রেফতার করলো। সুধীনাথ পুলিশকে প্রশ্ন করলো আপনারা ত আমার বাড়িতে কোন জাল টাকা পাননি তাহলে আমাকে গ্রেফতার করলেন কেন? উত্তরে পুলিশ কর্মকর্তা বললেন জাল টাকা পাওয়া যায়নি বটে কিন্তু জাল টাকা তৈরীর যন্ত্র পাওয়া গেছে এরই ভিত্তিতে আপনাকে গ্রেফতার করা হলো। সুধীনাথ তখন উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে বললেন তাহলে আমাকে একটা ধর্ষণ মামলায়ও গ্রেফতার করুন। পুলিশ তখন পাল্টা প্রশ্ন করলো, “কেন? আপনি কি কোন ধর্ষণ করেছেন?” তখন সুধীনাথ বললেন “না, ধর্ষণ করিনি তবে ধর্ষণ করার যন্ত্র ত আমার কাছে আছে।”

জবরুল আলম সুমন
সিলেট।
১৫ই ডিসেম্বর, ২০১২ খৃষ্টাব্দ।

৭৪৩জন ৭৪৩জন
0 Shares

৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ