কিছু কিছু মৃত্যুর জন্যে মানুষ প্রস্তুত থাকে। অপেক্ষায় থাকে। জীবনের পড়ন্তবেলায় নিজের শরীরই যখন যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠে, তখন সম্ভবত বেঁচে থাকা অর্থহীন লাগে। সমস্ত জীবনের কর্ম, সঞ্চয়, অর্জন এবং প্রিয় মানুষদের ছেড়ে কে চায় অনন্তের পথে একাকি চলে যেতে ? বেদনা ভারাক্রান্ত মনে তবুও মানুষ অপেক্ষায় থাকে চলে যাবার পথের, সময়ের।
আমার বাবাও এমন অপেক্ষায় ছিলেন। বাবার সাথে ফোনে শেষের দিকে হওয়া কথাগুলো এমন হাহাকারের ইঙ্গিত দিয়েছিল। জানতাম বাবার শরীর ভালো নেই। তবুও নির্বোধের মত চিরকালের নিয়মে জিজ্ঞেস করতাম, ‘ আব্বা, কেমন আছেন ? ‘ জড়িয়ে আসা কণ্ঠে বলতেন, ‘এই সময়ে যেমন থাকার কথা, তেমন। শরীরের যন্ত্রণায় রাতে ঘুম আসে না।’ আমি ফোনের এইপাশে স্তব্ধ হয়ে থাকতাম ক্ষণিক। জগতের কোন কন্যা যখন এমন পরিস্থিতিতে পড়বে, জানবে নিজের প্রাণপ্রিয় বাবার শেষ সময়ে কিছুই করার ক্ষমতা নেই তার হাতে, তখন কতটা বেদনা বিধুর স্তব্ধতা তাকে পেয়ে বসবে সে কেবল সে-ই জানে। বাবা একটু দম নিয়ে আবারো ধীর স্থিরভাবে বললেন, ‘ অনেক কষ্ট রে মা, অনেক কষ্ট। এখন শুধু অপেক্ষা কত তাড়াতাড়ি যামু।’
আমার মনটা বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেলো। ভেতরে হাজারো বিষণ্ণতা থাকুক, ঘর সংসার, প্রাত্যহিক কাজ কর্ম, স্বামী, সন্তান সকলের সবকিছু ঠিকঠাক থাকা চাই! সেদিন ছিল তপ্ত রোদ। বছরের প্রথম সমুদ্রে যাবার মত উষ্ণ দিন। বিষণ্ণতা বুকে চেপে, মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে যেতে হয় আমাকেও। সবাই তখন বড় বড় ঢেউয়ের অপেক্ষায়, ধুপ ধাপ ঝাঁপিয়ে পড়বার অপেক্ষায়। ঢেউ আসে। সকলে আনন্দে উচ্ছসিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সমুদ্রের ফেনায়িত জলে। আমি বালিয়াড়িতে বসে আঙ্গুল দিয়ে বড় বড় হরফে লিখে চলেছি বাবা, বাবা, বাবা… । গর্জনরত সমুদ্রের বিশাল ঢেউ এসে মুছে দিয়ে যায় সেইসব অক্ষর, শব্দ। আমি আবার লিখি বাবা, বাবা, বাবা…। শব্দগুলোর উপর ছায়া ফেলে উড়ে যায় এক ঝাঁক পাখি। কপালের উপর হাত রেখে সূর্যের কিরণকে এড়িয়ে সেইদিকে তাকাই। অচিন পাখিদের নিঃশব্দে বলি, ‘ তোমাদেরও কি বাবা হারানোর আশংকায় মনখারাপ হয় ? আপনালয়ে ফিরে যাবার জন্যে বুকের ভেতরে হাহাকার লাগে ?’ জানি উত্তরের অভিপ্রায়ে এ প্রশ্ন নয়। ঘাড় নামিয়ে আনি। ততোক্ষণে মুছে গেছে বালিয়াড়ির বুকে গভীর মমতায় লেখা শব্দগুলো। চোখে তখন জলের রেখা।
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
১০টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
খুবই কষ্টের এক অনুভুতি এমন অপেক্ষায় থাকা।
বাবা হারানোর কষ্ট বয়ে চলেছি সেই ১৯৯২ সন হতে,
প্রতি মুহুর্তে অনুভব করি জগতের সবচেয়ে বড় ছায়াটি নেই এখন আর আমার কাছে।
অন্য জগতে চলে যাওয়া আমাদের সবার বাবারা ভালো থাকুক,
রিমি রুম্মান
আমীন।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
খুব কষ্টের এ অনুভুতি।ঠিক আমি এমনি ভেবেছিলাম-হয়তো এ দেখাই শেষ দেখা।তাই হয়েছিল।ভাল থাকুক ওপাড়ে সকল বাবারা এই কামনা স্রষ্টার নিকট।আমীন।
রিমি রুম্মান
আমীন।
মাহমুদ আল মেহেদী
বাবারা যত দিন বেঁচে থাকেন এমন ভাবে রাখেন সন্তানদের যেন কোন কিছুরই আভাববোধ হয় না। বাবা নামটা স্বাধারনের ভিতর সত্যিই অস্বাধারন ।
রিমি রুম্মান
বাবারা বেঁচে থাকাকালীন সময়ে আমরা তা অনুধাবন করতে পারি না। হারিয়ে গেলেই বুঝি কী হারয়েছি।
মোঃ মজিবর রহমান
অনুভুতি শেয়ার করাও কষ্টের আপু। আপনি সুন্দর ভাবে বাবার সাথে বিভিন্ন সময়ের অনুভুতি আমাদের মাঝে শেয়ার করে আমার মাঝেও উপলদ্ধি করালেন।
সবার বাবা-মা বেহেস্ত এ নসিব করুন আল্লাহ। সেই দয়া আল্লাহর নিকট করি।
সাবিনা ইয়াসমিন
বাবার প্রতি ভালোবাসা লিখে প্রকাশ করা যায় না। আর যিনি তার বাবাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলেন সেই কষ্টানুভুতি ব্যাখ্যাতিত হয়। আপনার বাবার আত্মা শান্তিতে থাকুক রাব্বুল আলামীনের কাছে এই প্রার্থনা করি।
ভালো থাকবেন আপু। ভালোবাসা অবিরত ❤❤❤❤
রিতু জাহান
বাবারা ভালো থাকুক ওপারে এপারে সব খানে।
তৌহিদ
সবার বাবা ভালো থাকুক।