” এ জগতে কেউ কেউ জন্মগতভাবে মহান, কেউ মহত্ত্বের লক্ষণ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন, আবার কেউ স্বর্গীয় প্রচেষ্টায় মহানুভবতা অর্জন করেন।” কথাগুলো শেক্সপিয়ার বলেছিলেন। এই তিনটি বৈশিষ্ট্যই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ১৯৭২ সালে এক সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট মহান এই নেতাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘ আপনার শক্তির উৎস কোথায় ?’ জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘ আমি আমার জনগণকে ভালোবাসি ‘। সাংবাদিক আবার প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ আপনার দুর্বল দিকটা কী ?’ বাঙালি জাতির এই স্বপ্নদ্রষ্টা উত্তর দেন, ‘ আমি আমার জনগনকে খুব বেশি ভালোবাসি ‘। সত্যিই মানুষকে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবেসেছিলেন বাংলার এই অবিসংবাদিত নেতা। তাই তো তিনি বলেছিলেন, ” আমি সব ত্যাগ করতে পারি, তোমাদের ভালোবাসা আমি ত্যাগ করতে পারিনা। ” ” কোন জেল জুলুমই কোনদিন আমাকে টলাতে পারেনি, কিন্তু মানুষের ভালোবাসা আমাকে বিব্রত করে তুলেছে “। নিজের দেশের জনগনের প্রতি এমন ভালোবাসা সারা বিশ্ব তাকিয়ে দেখেছে। তাইতো কিউবার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট বিপ্লবী ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন, ” আমি হিমালয় দেখিনি, আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি “।

আমি যুদ্ধ দেখিনি, কিন্তু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ শুনেছি। মাত্র ১৮ মিনিটের একটি ভাষণ সমগ্র দেশবাসীকে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল। যে ভাষণ শুনে অনুপ্রাণিত হয়ে দল, মত নির্বিশেষে সাধারণ জনগনের স্বতঃস্ফূর্ত যুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং স্বাধীন দেশের জন্মলাভ সারা বিশ্বে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে আজো।  পুরো বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার জন্যে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, উজ্জীবিত করেছিল ভাষণটি। বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের রেসকোর্স ময়দানে দশ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে দেয়া অবিস্মরণীয় সেই ভাষণ শুনে সেইস্থানে সেইসময়ে উপস্থিত মানুষদের অনুভূতি কেমন হয়েছিল জানিনা। তবে আমি যতবার শুনি, প্রতিবারই আমার ভেতরে দেশের প্রতি অদ্ভুত এক ভালোবাসার অনুভূতি হয়। বার বার শুনি। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম…’ এই ভাষণ কোন নির্দিষ্ট দলের নেতার ভাষণ নয়, এ আহ্বান একজন গনমানুষের নেতার আহ্বান। জনগণের অন্তর্নিহিত শক্তির উপর অপার আস্থা আর বিশ্বাস নিয়ে দেয়া ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণের পর তিনি হয়ে উঠেন বাঙালি জাতির পিতা। যেমনটি ভারতের জাতির পিতা করম চাঁদ গান্ধী, পাকিস্তানের জাতির পিতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। নেতৃত্ব দেয়ার বিরল গুণাবলী সম্পন্ন মহান এই নেতার সবচেয়ে বড় গুণ ছিল তিনি আদর্শের বাস্তবায়ন ঘটাতে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নে সবাইকে মুক্তি সংগ্রামী বানিয়েছিলেন। আশার কথা, আমাদের নতুন প্রজন্মের একটি বড় অংশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বেশ স্বচ্ছ ধারণা নিয়ে বেড়ে উঠছে। স্কুল, কলেজের পাঠ্য পুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকদের আলোচনায়ও এ বিষয়ে শিক্ষার্থীরা ব্যপক ধারণা পাচ্ছে। দেশ প্রেমের যে দৃষ্টান্ত তিনি আমাদের মাঝে রেখে গিয়েছেন, তা অনুসরণ করতে পারলে আমাদের নতুন প্রজন্ম বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে নিশ্চিত। মহান এই নেতার নেতৃত্বে দীর্ঘ সংগ্রাম এবং অনেক ত্যাগ স্বীকারের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের ঠিকানা পেয়েছে। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নাগরিক হিসেবে বিদেশ ভ্রমনের কাজে ব্যবহৃত দলিল ‘ বাংলাদেশি পাসপোর্ট ‘ আছে বলেই না আজ পৃথিবীর প্রায় সব কয়টি দেশ ভ্রমন করার, বসবাস করার সুযোগ পাচ্ছি আমরা বাংলাদেশিরা।

মাঝে মাঝে ম্যানহাটনের ইউনাইটেড নেশনস্‌ এর সামনে যখন আমার লাল সবুজের বিজয় নিশান পত্‌পত করে ওড়ে, আমি পৃথিবীর সবচাইতে বিস্ময় নিয়ে চেয়ে থাকি। পৃথিবীর সবচাইতে তীব্র বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস নিয়ে পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া ভিনদেশীদের বলতে ইচ্ছে হয়, ‘ ওই দেখো, ওটা আমার দেশের পতাকা। আমার একটি স্বাধীন দেশ আছে, বাংলাদেশ। ‘ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের সাথে সর্ববকালের সাহসী এই নেতার বলিষ্ঠ ভূমিকা প্রসঙ্গে সঠিক ও সুস্পষ্ট ইতিহাস আমাদের নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে পরিবার থেকেই। সেই সাথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার যোগ্যতা এবং শক্তি অর্জন করতে হবে আমাদের নতুন প্রজন্মকে। তাদের জানাতে হবে, বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধ সমার্থক শব্দ। এক সুত্রে গাঁথা এই তিন শব্দ আলাদা করে দেখবার সুযোগ নেই।

রিমি রুম্মান

৭১২জন ৫৭৩জন
0 Shares

১৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ