আমি যা কিছু লিখি, অনেকেই ধরে নেন, এটা আমার সাথেই ঘটেছে। আসলে তা নয়। আমি আমার চোখে দেখা প্রতিটি ঘটনাকেই একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি, তারপর লিখি। উদ্দেশ্য থাকে সমাজের মানুষকে সচেতন করা।
কয়েক বছর আগে আমাদের এলাকায় একটি বিয়ে হলো। আমাদের পরিবারের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় আমরা আদ্যোপান্ত ঐ বিয়েতে উপস্থিত ছিলাম। আমরা ছিলাম ছেলে পক্ষ। বর যাত্রী থেকে শুরু করে বৌভাত পর্যন্ত আমি হাজির! বিয়ে পড়িয়ে বৌকে নিয়ে আসা হলো, ফুল দিয়ে খাট সাজালাম আমি। বৌ নতুন জায়গায় এসে একটু হিমশিম খাচ্ছিল। চুলের জট খুলে মাথায় তেল দিয়ে দিলাম যেন একটু আরাম পায়। পরদিন ভোর হলো। তার শাশুড়ি আমাকে বললো,
:নতুন বৌকে ডেকে বলো, ভোর হয়েছে। নতুন বৌ এত বেলা করে ঘুমোতে নেই।
অগত্যা তাকে ডেকে তুললাম। বৌ হাতমুখ ধুবে, পায়ের কাছে জুতো এনে দিলাম। আমি ভেবেছি, এতটুকু করলে সে হয়ত একটু ভরসা পাবে,কিন্তু আমি ছোট হয়ে যাব না।
এবার নাশতা খেতে বসলো, আমি পরিবেশনের দায়িত্ব পেলাম। গরম ভাত, বেগুন, আলু দিয়ে ছোট মাছের ঝোল ছিলো নাশতায়। খাবার পরিবেশন করতে গেলাম, বৌ বললো বেগুনে এলার্জি, তাই বেগুন খেতে পারবে না। আমি রান্নাঘরে গিয়ে তার শাশুড়িকে বললাম,
: বৌ বেগুন খায় না।, এলার্জি আছে।
: না খাইলে নাই! (কন্ঠে রাগ মেশানো, যেন বৌ মস্ত অন্যায় করে ফেলেছে!)
আমি হতবাক হয়ে ফিরে এলাম। অগত্যা বেগুনের টুকরোগুলো বেছে আলাদা করে তারপর তাকে বাকিটুকু খেতে দিলাম। তার শাশুড়ি কিন্তু পারতো ঝটপট একটা ডিম ভেজে দিতে। নিজে না পারলেও অন্য কাওকে দিয়ে করাতে পারত।যাই হোক, বৌ এর খাওয়া যখন মাঝ পর্যায়ে, তখন এলো তার ননদ। এসে বলতে লাগলো,
:আজ বৌ ভাত। কই, তোমার বাবা তো এখনও কিছু পাঠালো না। বৌ ভাতের সমস্ত আয়োজনতো বৌয়ের বাড়ি থেকে দেয়া হয়, তোমার বাবা কি কিছুই জানে না? (আরও চার পাঁচটা খোটা দিল বৌয়ের বাবার বাড়ি নিয়ে)
মেয়েটি খাওয়া বন্ধ করে চুপচাপ চেয়ে রইলো সবার মুখের দিকে! কী অসহায় তার অবস্থা। আর তার বীরপুরুষ বর, সে তো বৌ পেয়ে মহাখুশি, তার কি এসব দিকে কোন খেয়াল আছে? এখন যে যাই বলুক, বিয়ে তো হয়েই গেছে, মেয়েটা তো আর তাকে ছেড়ে চলে যেতে পারবে না। সুতরাং মজা নেয়াই এখন উত্তম!
কিছুক্ষণ পর বৌয়ের বাবা চাল, ডাল, মসলা, খাশি, আরও অনেক কিছু এমনকি রান্নার লাকড়ি সমেত পাঠিয়ে দিল। এসব পাবার পর তারা বৌকে কিন্তু কোন কৃতজ্ঞতা জানালো না। কোন লজ্জাও বোধ করলো না, বরং মহানন্দে সেগুলো ভোগের জন্য উঠে পরে লেগে গেলো।
বেলা হয়ে এলো। মধ্য দুপুরে সূর্য মাথার ওপর, বৌয়ের মাথার ওপর কটুক্তিপূর্ণ একটি নতুন বাড়ি। এবার এলেন ফুপু শাশুড়ি। তিনি এসে বললেন,
: বৌয়ের বাবা বোধহয় ফার্নিচার, টিভি, ফ্রীজ এসব পাঠাতে ভুলে গেছে। আজকের মধ্যেই বোধহয় পাঠাবে, তাই না?
বর মুচকি মুচকি হাসে। আড়ালে বোনদেরকে ডেকে শিখিয়ে দেয় কি কি বলে বৌকে খোঁচা দিতে হবে!
আমি তেমন কেউ না হলেও ছেলে পক্ষের আমন্ত্রিত হওয়ায় ছেলে পক্ষই ধরা চলে। এসময় লজ্জায় মাথা নত হচ্ছিল আমার। আমাদের এলাকায় এসে সে মেয়েটি জানলো, বাংলাদেশে এখনও এমন মধ্যযুগীয় বর্বর পরিবার রয়ে গেছে! অথচ এদের কি নেই? খাট, সোফা, টিভি,ফ্রীজ কোনকিছুরই অভাব নেই। তাহলে কেন নতুন বৌটাকে এভাবে বিব্রত করা? এইতো গতকাল মেয়েটা তার চিরচেনা ঘর,বাড়ি, বাবা,মা সবাইকে ছেড়ে এসেছে। আর আজই তাকে এভাবে হেয় করা হচ্ছে!
এক বছর পর…
এই বৌ তার বরসহ ঢাকা শহরে থাকে। শশুড় বাড়িতে বেড়াতে আসে বছরে একবার। কারও জন্য তার কোন টান নেই। যতটুকু দায়িত্ব শুধু ততটুকুই পালন করে, ঈদে সবাইকে জামা কাপড় দেয়। এক্ষেত্রে আমরা কিন্তু বৌটাকেই দোষ দিব, পারলে ধুয়ে দিব। কিন্তু যদি তার প্রতি আচরণগুলো এমন না হতো, যদি শশুড় বাড়ির লোকেরা তার প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করতো, তবে বৌয়ের দিক থেকেও একটা সুন্দর বোঝাপড়ার নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হতে পারত।
বৌ কোন রোবট নয়, বরং আর সবার মতই রক্ত, মাংসের একটা মানুষ। তাকে তার মা বাবার কাছ থেকে এনে একটু সম্মান, একটু যত্ন আর ভালোবাসা দিয়ে দেখুন, ঠকবেন না। বরং বৃদ্ধ বয়সে তাকেই হয়ত কখনো লাঠি, কখনো ছাতা আবার কখনো ছায়া হিসেবে পাবেন। বৌকে আশ্রিতা না ভেবে নিজ পরিবারের সদস্য ভাবলে আপনাদের গর্বিত ছেলে পক্ষের সম্মান কমবে না, বরং পরিবারে তৈরি হবে একজন নির্ভরযোগ্য সদস্য।
২৪টি মন্তব্য
ইঞ্জা
সত্যি আমরা কখনো যেন মানুষ হবোনা, সেই বর্বর জংলিই যেন রয়ে গেছি, এইসব থেকে যে কখন বের হবো তা আল্লাহই জানেন।
নীরা সাদীয়া
মানসিকতার পরিবর্তন হলেই কেবল এর থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব।
ইঞ্জা
দুঃখজনক হলেও সত্য আমরা কখনোই বদলাবোনা। 🙄
নীরা সাদীয়া
আমরা চাইলেই পাল্টাতে পারি।
ইঞ্জা
পারি তো অবশ্যই কিন্তু আমাদের নেচারই তো খারাপ, যেমন আমার বিয়ের সময় আমি আকদের আংটি ছাড়া আর কিছুই নিইনি তা আত্মীয় স্বজনরা সবাই জানতো, এরপরও আমার এক ফুফু আপনার ভাবীর সামনে খাটের নিচে চেক করে বলে, কই ইঞ্জিনিয়ারের শ্বশুর বাড়ি থেকে যা পাঠিয়েছে তা কি খাটের তলে নাকি, বুঝুন অবস্থা।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
আপু খুব সুন্দর বলেছেন। মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি ঢুকেই যেসব বিষয়ের সম্মুখীন হয় তার সব ই ছোট পরিসরে বলে দিলেন। বেশীরভাগ পরিবারেই এখনো এসব মান্ধাতার আমলের নিষ্ঠুর আচরণ গুলো করা হয় নববধূর সাথে। পরবর্তীতে বৌরাও নিজেকে শ্বশুরবাড়ির সাথে খাপ খাওয়াতে চায়না, দূরত্ব সৃষ্টি করে চলে। শুভ কামনা রইলো
নীরা সাদীয়া
ঠিক বলেছেন। এটাই সমস্যার মূল। এখানেই সমস্যার গোড়াপত্তন হয়।
ফয়জুল মহী
বেশ ভাল লাগলো
নীরা সাদীয়া
ধন্যবাদ।
বন্যা লিপি
লেখাটা আপনার ফেসবুক ওয়ালে আগে পড়লাম। এরকম চিরায়ত আচরন, নতুন পরিবারে যুক্ত হওয়া একটা অন্য পরিবারের মেয়ের সাথে হয়েই আসছে যুগ যুগ ধরে। আমার নিজেরও এরকম বহু অভিজ্ঞতা আছে।
প্রেক্ষাপট বদলালেও ভাবার্থ বদলায়না।
খুব কম পরিবারই আছে এসবের ঊর্ধ্বে।
আপনার জন্য শুভ কামনা নিরন্তর।
নীরা সাদীয়া
ঠিক বলেছেন। আমাদের মানসিকতা পাল্টাতে হবে।
সাদিয়া শারমীন
আপু খুব সত্যি কথা লিখলেন। প্রতিটি মেয়েকেই কেন যেন এসবের সম্মুখিন হতে হয়। আমরা আধুনিক হলেও চিন্তা ভাবনা এবং মব মানসিকতায় সেই প্রাচীনই রয়ে গেলাম!
নীরা সাদীয়া
ঠিক বলেছেন। ঐসব মানসিকতার যেন কোন উন্নতি নেই।
সুরাইয়া নার্গিস
চমৎকার লিখছেন আপু।
বাস্তবতা এমনি, এমন পরিবার আমিও দেখেছি।
তবে আমার পরিবারে আমি এমনটা দেখি নাই এক বোনের বিয়ে দিয়েছি। আব্বু খুশি হয়ে তার শ্বশুড় বাড়ীতে বিয়ের পরদিন তিন ট্রাক ভরে ফার্নিচার পাঠালেন।
সাথে সাথে আপার শ্বশুড় ফোন দিলেন, বেয়াই আমরা কি মাটিতে ঘুমাই সব ফেরত পাঠিয়েছি।
আপনার মেয়ে আমার ঘরের ফার্নিচার আমার ঘরের শোভা আর কিছু চাই না।
আমার ভাইয়ের বিয়েতে আমরা কিছু নেই নাই বরং ভাবীকে সব অলংকার দিয়ে এনেছি, ভাবীর যখন বেবী হলো সেই খরচ দিয়েছি।
আমাদের কাছে আত্মীয় বড়, তবে আমাদের চারপাশে এমন নির্যাতিত অনেক পরিবার দেখি কষ্ট হয় প্রতিবাদ করি।
মেয়েদের একটু সম্মান,ভালোবাসা দেওয়া উচিত,কারন আপনার মেয়েটাও কার অন্যের বাড়ি যাবে।
অর্থ,সম্পদ সারাজীবন থাকবে না, কিন্তু এই ছেলের বউ আপনার শেষ জীবনের ভরসা তার প্রতি হৃদয়বান হওক।
ভালো থ্কবেন আপু।
নীরা সাদীয়া
আপনার ভাবীর ডেলিভারিতে খরচ আপনাদেরই তথা আপনার ভাইয়েরই দেয়ার কথা। কারণ মেয়ের বাবার বাড়ির এখানে আর কোন দায়িত্ব থাকে না। যাই হোক, আপনারা ভাবীর সাথে সুন্দর ব্যবহার করেছেন জেনে ভালো লাগলো।
আসলে একটা মেয়েকেই সবার আগে নিজের মূল্যটা বুঝতে হবে। তবেই সে আরেকজন মেয়েকে সম্মান দিতে পারবে।
তৌহিদ
আমাদের সমাজ থেকে এসব চিন্তাভাবনার বীজ সহজে যাবে বলে মনে হয়না। পুরুষ শাসিত সমাজব্যবস্থায় একজন নারীকেই সব কিছুর মুখাপেক্ষী হতে হয়।
ভালো লিখেছেন আপু। শুভকামনা জানবেন।
নীরা সাদীয়া
নারীকে আগে নারীর মূল্য বুঝতে হবে। তাহলে পুরুষও বুঝতে পারবে।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
আমরা কি কখনো যৌতুক নামের জঘণ্য, নিষ্ঠুর, নির্যাতনমূলক অভিশাপ থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো ? আমি কিন্তু খুব হতাশ এ ব্যাপারে। আপনার সঙ্গে একমত —- “বৌ কোন রোবট নয়, বরং আর সবার মতই রক্ত, মাংসের একটা মানুষ। তাকে তার মা বাবার কাছ থেকে এনে একটু সম্মান, একটু যত্ন আর ভালোবাসা দিয়ে দেখুন, ঠকবেন না। বরং বৃদ্ধ বয়সে তাকেই হয়ত কখনো লাঠি, কখনো ছাতা আবার কখনো ছায়া হিসেবে পাবেন। বৌকে আশ্রিতা না ভেবে নিজ পরিবারের সদস্য ভাবলে আপনাদের গর্বিত ছেলে পক্ষের সম্মান কমবে না, বরং পরিবারে তৈরি হবে একজন নির্ভরযোগ্য সদস্য”।
সমাজের নিষ্ঠুর আচরণ নিয়ে লেখার জন্য আপনাকে অভিনন্দন এবং শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
নীরা সাদীয়া
এটাই অনেকে বুঝতে চায় না। ধন্যবাদ আপনাকে।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
আমি একটা মেয়ের বাপ তো এখন থেকেই অনেক কিছুই বুঝতে শিখছি। ধন্যবাদ , ভালো থাকবেন।
আরজু মুক্তা
আমরা বৌ মেয়ে আলাদা করি। কখনোই ভাবিনা, ও একটা সুন্দর পরিবেশ ছেড়ে অচেনা জায়গায় এসেছে।
নীরা সাদীয়া
এটা ভাবা দরকার। তাহলেই বদলাবে পরিস্থিতি।
খাদিজাতুল কুবরা
আপু আপনার লেখাটি আমাদের চারপাশের নির্মম বাস্তবতায় চিত্রিত।
খুব সুন্দর ফুটিয়ে তুলেছেন।
মেয়েরা শশুর বাড়িতে মেয়েদের দ্বারাই বেশি অসম্মানিত হয়।
মেয়েদের মর্যাদা আমাদের মেয়েদের দিক থেকে শুরু হওয়া উচিত বলে আম মনে করি।
নীরা সাদীয়া
তাতো ঠিক। কিন্তু তারা এই জোরটা পায় কোথা থেকে? তারা ছেলে পক্ষ বলে…
এক্ষেত্রে ছেলেটির উচিত নিজের বৌকে এসব থেকে রক্ষা করা।
শুভ কামনা আপু। ভালো থাকবেন।