নামটা শুনেই কেমন লাগছে , তাই না ? প্লেনের আবার বাড়ী হয় নাকি ? অনেক অসম্ভবের মধ্যে অনেক কিছুই সম্ভব হয় । আমার একটা সমস্যা আছে , যা অনেকেরই বিরক্তি ধরিয়ে দেয় । কথার মধ্যে থেকে অন্য কথায় প্যাঁচাল পারা । এখন যেমন বলতে যাচ্ছি । অনেক ছোটবেলা থেকেই বেড়াতে গেলে বিভিন্ন দিকে চোখ চাইতো । এজন্য হোঁচট কম খাইনি , সাথে বাপির বকাও । কেন যেদিকে পা ফেলছি , সেদিকে দেখছি না । যাক পড়তে পড়তেও আশ্রয়টুকু আমায় জড়িয়ে নিতো । কতো কিছু যে দেখা হয়ে যেতো ওটুকুর মধ্যে । মনে আছে একদিন চায়ের পাতায় ছোট্ট একটা নীল রং-এর পোকা দেখেছিলাম । আজও জানিনা ওটার নাম । কিন্তু ঠিক মনে আছে । অনেক সুন্দর ছিলো । বেড়াতে যাওয়া মানেই আনন্দ । তখনও স্কুলে ভর্তি হইনি , অথচ মনে আছে বেড়িয়ে যখন বাপি-মামনির সাথে বাসার দিকে ফিরতাম । চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসতো । অন্ধকারের ভেতর সাধু বুড়ার হাতে হারিকেন আর বাপির হাতে টর্চ লাইট মাটির সরু পথটায় যখন পড়তো , সারাটি চা’ বাগান যেনো সেজে উঠতো । যখন আর চাইতে পারতাম না , দাঁড়িয়ে পড়তাম নিশ্চিন্তে । কারণ জানি , বাপি এবার ঠিক কোলে নেবে । হতোও তাই । বাপির ঘাড়ে মাথা রেখেই ঘুম । নাদুস-নুদুস ছিলাম…মানে ভারী বাচ্চা । সকালে চোখ মেলে দেখতাম আরে কি করে বিছানায় !
এবার আসি প্লেন বাড়ীর কথায় । শমশেরনগর থেকে বাসে করে সিলেট যাবার পথটা একসময় আমার মুখস্থ ছিলো । অনেকের চোখে যা পড়েনি , আমার চোখে পড়তোই পড়তো । যদিও এখন জানতে চাইলে কিছুই বলতে পারবোনা । প্রথম যখন বাসে করে সিলেট যাই আমি আর কুমকুম আপু । মৌলভীবাজার পার হলেই শেরপুর । ঠিক তারপরেই একটা বাড়ী , যেটা চোখে না পড়ে যায়না কারো । জানিনা বাড়ীর মালিক কে । তবে ওটার নাম দিয়েছিলাম (হয়তো এ নামেই পরিচিত ছিলো) প্লেন বাড়ী । ভেবে পাইনি প্রথমে বাড়ীর ছাদে একটা প্লেন কেন ? পড়ে বুঝেছি লন্ডনী মালিক । সিলেটী মানেই তো লন্ডনী । আমি আর কুমকুম আপু হাসতে হাসতে শেষ । বললাম শোনো আমি তো কানাডা যাবোই , তখন বাড়ীর ছাদে একটা জলপ্রপাত বানাবো । ওটার নাম দেবো কানাডা ফলস । সবাই জানবে আমি কানাডায় থাকি । কুমকুম আপু বললো , “আমি তো আমেরিকায় যাবো , স্ট্যাচ্যু অব লিবার্টি ছাদের মাথায় থাকবে । সবাই বলবে আমেরিকার কুমকুম ।” বাসের মধ্যে কতো হিজিবিজি গল্প হায়রে । কে কি ভাবলো , কে আমাদের হাসি দেখলো ওসব দেখার সময় কই আমাদের ? তো সেই প্লেন বাড়ী নিয়ে অনেক রকমের বিদ্রূপাত্মক কথার ফুলঝুরি । হাসির জন্যে বিষয় লাগতো না তখন । প্লেন বাড়ী বললেই হাসি । আমাদের বান্ধবী রীতাকে বলতাম তোদের বাড়ীর ছাদে ব্রান্ডেনবার্গ গেট বানাতে বলিস দাদাকে । কারণ ওর বড়ো ভাই থাকতেন জার্মানীতে । ওহ এসব নাম কিভাবে পেয়েছি ? আরে আমার যে ভ্রমণ কাহিনী খুউব প্রিয় । কানাডায় আসিনি যখন , সেই ১৯৯৩ সালেই টরেন্টো আর মন্ট্রিলের অনেক অনেক পথ জানা হয়ে গিয়েছিলো । আমার বান্ধবী রুমার বোন ঝুমাদি সাক্ষ্মী ।
যাক প্লেন বাড়ীটার কথা আজ কেন লিখলাম ? কাজ থেকে ফিরছি , ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে ছিলাম বাসের অপেক্ষায় । দেখলাম বাস যতোক্ষণে আসবে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে এখানেই আমার ফুনারেল হবে । যা ঠান্ডা । হাঁটা শুরু করলাম । হঠাৎ দেখি একটা ছাদের উপর প্লেনের মতো । দেখেই এমন হাসি পেলো , যে ওখানেই মুখে হাত চেপে হেসে নিলাম । দু’-একজন মানুষ আমায় পাগল ভেবে চেয়ে চেয়ে দেখে গেলো । হাসি আর কাশি দুটোই শুরু হলো এবার একসাথে । স্মৃতি নাকি শুধু কাঁদায় , কে বলেছে ? অনেক হাসায়…এমনই হাসাতে পারে যে চলতি জীবনের জটিলতাকে দূর করিয়েও দিতে পারে । স্মৃতির অসীম ক্ষমতা , আর তাইতো প্লেন বাড়ীর পরে সিলেটের কাছাকাছি একটা প্লেন গেটও আছে আর অনেক পেছনে বাড়ী সেটাও মনে আছে । তবে প্লেনবাড়ীটার জন্যে কষ্ট হয় । ১৯৯৩-১৯৯৭ সাল , এ কয়টি বছর দেখেছি ওটাকে । শেষের দিকে যখন অনার্স প্রায় শেষের পথে । বাসায় ফেরার সময় বাসে বসেই দেখলাম প্লেনবাড়ীটার রঙ ক্ষয়ে গেছে । হয়তো আর্থিক সেই অহঙ্কারে ভরা বাড়ীটা , লন্ডনী পরিচিতির পতাকা তোলা বাড়ীটাতে কেউ আর থাকেনা । নয়তো আমার ধারণা ভুল । কি জানি !
আমাদের কিছু সময় চলে গেছে
জলের তোড়ে
সবুজের ভীড়ে
আলোর ঝিলিকে
ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে ।
আমাদের না বলা কথা থেকে গেছে
মৌণতার নূপুরে
ভোরের শিশিরে
পথের আগাছায়
ফুলেল উপমায় ।
আমাদের অনেক কিছুই বদলে গেছে
কিছু থেমে গেছে
কিছু জমে আছে
আমাদের নীরবতায়
আর প্রাণোচ্ছ্বলতায় । (কবিতাটি লেখা হয়েছে ৮ আগষ্ট , ২০১৪ ইং তারিখে)
হ্যামিল্টন , কানাডা
১-লা নভেম্বর , ২০১৪ ইং ।
পরিচিতি :
কুমকুম আপু – আমার বড়ো বোন , বন্ধু , অভিভাবক…
রীতা/রুমা – বন্ধু
৩৪টি মন্তব্য
মোঃ মজিবর রহমান
কবিতা খুব সুন্দর।
নীলাঞ্জনা নীলা
কবিতাটা আসলে নিজের পুরোনো সময়ের ভাবনা থেকে লেখা…অসংখ্য ধন্যবাদ…
মোঃ মজিবর রহমান
আমিই ১ম
নীলাঞ্জনা নীলা
তাহলে তো পুরষ্কার পাওনা…আরোও অসংখ্য ধন্যবাদ…ইনফিনিটি…
মোঃ মজিবর রহমান
হুম আপু।
ছাইরাছ হেলাল
আপনার এই স্মৃতিপরায়নতা আমার খুব পছন্দের।
নীরবতায় থেমে থাকে না ,জমেও থাকবেনা এই প্রাণের প্রাণোচ্ছলতা।
কবিতাটি বেশি ভাল লাগল।
নীলাঞ্জনা নীলা
প্রতিটি মানুষের জীবনেই কিন্তু অজস্র ঘটনা…আলাদা করে কবিতা-গল্প যে লেখা হয় , তা কোনো না কোনো মানুষের জীবন থেকেই উঠে আসে…আমিও খুব ভালোবাসি নিজের এসব ছোট ছোট কারণ ছাড়া লিখতে…পড়তে কেমন লাগে সকলের সেটা জানি মন্তব্য থেকে…তুমিও লেখো জীবনের কাহিনী…ভালো লাগবে আমার…
মরুভূমির জলদস্যু
গুলশান ২ এ একটা প্লেন রেস্টুরেন্ট ছিলো। -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
তাই নাকি ? এখনও কি আছে ?
মরুভূমির জলদস্যু
না নেই, ওয়ান্ডার ল্যান্ড পার্কের ভিতরে ছিলো এটি, পার্কের সাথে এটিরও সলিলসমাধি হয়েছে।
নীলাঞ্জনা নীলা
ভালোই হয়েছে…আমার এসব ভালো লাগে না…
জিসান শা ইকরাম
প্লেন বাড়ি নিয়ে কত কথা , কত ঠাট্টা।
ছাত্র জীবনের উচ্ছাস:)
এমন ভাবে বললেন যে, দেখা গেলো কেনাডার কোন পথের পাশে বসেই আপনি একমনে হাসছেন।
ভালো থাকুন প্রবাসে।
নীলাঞ্জনা নীলা
আপনার মন্তব্যে ভালো না থেকে কি পারি ? আপনাকে একটা কথা বলি…আপনার নাত্নী আমাকে লিখতে বলেছে এ কথাগুলো…
“নানা বেশী ঢং কইরো না…খবর আছে কিন্তু…নাত্নীর মাথা গরম কইরো না…বুঝছো ?”
জিসান শা ইকরাম
হা হা হা হা , তুই যে গুন্ডা, সব সময় আল্লাহ আল্লাহ করি, কখন সাইক্লোন আসে 🙂
নীলাঞ্জনা নীলা
হিহিহিহিহি…আঁমিঁ হঁইঁলাঁমঁ শাঁকঁচুঁণ্নীঁ…তাঁইঁ সাঁবঁধাঁনঁ
জিসান শা ইকরাম
সাবধান হইয়াই তো আপনি আপনি বলি।
শুন্য শুন্যালয়
ফেলে আসা দিনের গল্প শুধু কস্ট দেয়না, আনন্দও দেয়। সত্যি আপু। আপনার গুছিয়ে লেখাটাও ভালো লেগেছে। লেখার শেষে এভাবে কুমকুম আপু আর রীতা/রুমার পরিচয় করে দেয়াটা আমি আগে দেখিনি কারো লেখায় 🙂
আমাদের অনেক কিছুই বদলে গেছে
কিছু থেমে গেছে
কিছু জমে আছে
আমাদের নীরবতায়
আর প্রাণোচ্ছ্বলতায় ।……………লাইন কএকটি ছুঁয়ে গেলো। আপনার মাইক্রোস্কোপ চোখ নিয়ে এগিয়ে যান। আমরাও দেখি, যা দেখতে পাইনা।
নীলাঞ্জনা নীলা
বাহ মাইক্রোস্কোপ চোখ ! হুম বাই ফোকাল চোখ আমার… :D)
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
খুব মজা পেলাম।
নীলাঞ্জনা নীলা
আরে আমার অবস্থা সেদিন আরো খারাপ ছিলো…মানুষ-জন চেয়েই যাচ্ছিলো…দেশ হলে নির্ঘাত পাগলী বলে ঢিল ছুঁড়তো… 😀
ব্লগার সজীব
সব কিছুর এত নিখুত বর্ননা, শেষের কবিতা-অসাধারন বলতেই হয় নীলাদি। সোনেলায় বেশ কিছু সোনার মানুষের মধ্যে আপনি একজন। যাদের লেখা পড়ার জন্যই এখানে আসি রোজ।
নীলাঞ্জনা নীলা
ও মা এ আমাকে কোথায় নিয়ে গেলে ভাই ? খুউব সাধারণ আমি সত্য…একটুও না ভেবে , না চিন্তা করে লিখি…কোনো লেখা এডিট এ জীবনে কখনোই করিনি…
এমন মন্তব্য পেলে অহঙ্কারী হয়ে যাবো কিন্তু ! :p 😀
মেহেরী তাজ
তাহলে আমি একটা বাড়ি বানায়া ছাদে জেন্ত বাঘ ছেরে রাখবো তাইলে মানুষ বলবে বাংলাদেশী তাজ। অহ হো আমি তো এমনিতেই বাংলাদেশী। 😀
ভালো লেগেছে।
নীলাঞ্জনা নীলা
হাহাহাহাহা…দারুণ আইডিয়া… (y)
বন্য
স্মৃতিচারণ খুব ভালো লেগেছে সব চেয়ে বেশি ভালো লাগলো শমশের নগর নামটা শুনে, অনেক কাল যাবৎ নামটা শুনতে শুনতে প্রেমে পরে গেছি এই শমশের নগরের, একদিন যাবো যেতে হবেই। সেই পথে না হয় আপনার প্লেনবাড়িটিও দেখে নিবো।
নীলাঞ্জনা নীলা
শমশেরনগর আর নাকি সেই রকম নেই…আমার শমশেরনগর চা’ বাগান অনেক সুন্দর ছিলো…কখনো তবুও ঘুরতে গেলে আমায় জানালে বলে দেবো কোথায় কি ছিলো…ছিলো বলছি এ কারণে , কি জানি এখন হয়তো নেই…আর প্লেন বাড়ীটা মৌলভীবাজার থেকে বাসে করে সিলেট যাবার পথে পড়ে…
লীলাবতী
দিদি এত ভালো লেখেন কিভাবে ?
নীলাঞ্জনা নীলা
আমি কিন্তু পড়ি লীলাবতী নামের মেয়েটির লেখা…ভালো যে কে কাকে বলে ! -{@
সঞ্জয় কুমার
আপনার আনকমন বাড়ির ফ্রন্ট ভিউটা দারুণ লেগেছে । ছবিটা সংগ্রহে রেখেছি ।
নীলাঞ্জনা নীলা
ছবিটা গুগল থেকে নিয়েছি…প্লেন বাড়ীর কোনো ছবি আমার কাছে নেই…
সঞ্জয় কুমার
আসল ছবিটা পেলে মন্দ হত না ।
নীলাঞ্জনা নীলা
সেইতো…আসলে অনেক ছবি-ই স্মৃতিতে বন্দী থেকে গেছে…
নুসরাত মৌরিন
কি মজার!! প্লেনবাড়ী!!নামটা বেশ।
তার চেয়ে বেশি মজা লেগেছে আপনার স্মৃতিকথা। 🙂
নীলাঞ্জনা নীলা
এমন অনেক নামই দিতাম…আমার ঝুলিতে এমন অনেক রকম নাম থাকতো…কম দুষ্টু ছিলাম না…তবে এখনও আছি…কেউ জানেনা… :p \|/