অশোক পরপর কেমন মনমরা হয়ে রইল । প্রকৃতিতে কেমন একটা উতলা হাওয়া বইছিল । পাখির মিষ্টি সুর অশোকের মনকে আর ও বেশী ভারাক্রান্ত করে তুলল।
এদিকে রুবি বি এস সি অনার্স নিয়ে ভালো কলেজে ভর্তি হয়ে গেল । আগের থেকে রুবি খুব সুন্দরী লাগছিল । সবই বড়লোক প্রফেসরের দৌলতে বলা যেতে পারে । প্রফেসর রুবির বাড়িতে যাতায়াত সুরু করে দিল । রুবি একাই বাবা মার সন্তান । মধ্যবিত্ত পরিবারে মানুষ । বাবা মা মেয়ের প্রফেসর পাত্র পেয়ে বাধা দেওয়ার বা কোনরকম খোঁজ খবর নেওয়ার কোন প্রয়োজন মনে করল না।
রাত দশটা বারোটা অবধি রুবির ঘরে পড়াশোনা চলত ভালোই হাসি ঠাট্টা আরও কত কিছু!
আসলে একটা কথা আছে যুবতি কুমারী নারী একা একটি খোলা আলমারি । কারো কারো না কঠোর দায়িত্বে থাকা বাধ্যতামূলক।
কিছুদিন কাটতে না কাটতে রুবি প্রেগন্যান্ট হল। প্রফেসর রুবিকে আ্যবোরসানের কথা বললেন ও দশটা বাহানা দেখিয়ে বললেন পড়াশোনা বা ক্যারিয়ার গড়তে এটা করা প্রয়োজন কিন্তু রুবির বাবা মা কিছুতেই রাজী হলেন না । অবশেষে প্রফেসর সূর্যবাবু বাধ্যগত রুবিকে বিয়ে করলেন ।
কথা ছিল বিয়ের রুবির পড়াশোনার ক্যারিয়ারের যাবতীয় দায়িত্ব নেবেন কিন্তু ভাগ্যে অণ্যকিছুর ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছিল।
রুবি বিয়ের কিছুমাস পর প্রফেসরের আর এক রূপ দেখতে পেল। প্রফেসর লোকটি আসলে এক নারী আসক্ত কীট । বাচ্চা মেয়ে ষোল থেকে চব্বিশ বছরের মেয়েদেরকেই বেশী পছন্দ করেন ।
আর একটা কথা আপনাদের জানা দরকার প্রফেসর সূর্যবাবু কিন্তু খুবই সুদর্শন এবং ভদ্র। উনার এতো সুন্দর ব্যবহার আপনি বাইরে থেকে দেখলে বুঝতে ই পারবেন না যে উনি এমন করতে পারেন । তবে জানি না মেয়েরা ঠিক কি দেখতে পেত লোকটার ভেতরে ? খুব বেশী কামুক সেক্সি প্রকৃতির এটা অকপটে বলা যেতে পারে!
প্রফেসর পঁাচ ছয়টা করে মেয়ে বছরে টার্গেটে রাখতেন । বাচ্চা মেয়েদের নিজের শিকারে নিয়ে এসে উপভোগের বস্তু বানানোটা ওই লোকটার এক বিকৃত নেশায় পরিণত হয়ে গেছিল।
রুবিকে বিয়ে করলেও রুবিকে নিয়ে ভালোমত সংসার করার তঁার কোনরকম ইচ্ছা ছিল না । কথায় আছে না দশটা ঘাটের জলে স্বাদ যে একবার পায় সে কি আর এক ঘাটে বসেবসে জল খাওয়া পছন্দ করে ?
সে যাইহোক রুবি কলেজ যাচ্ছিল পরীক্ষা দিচ্ছিল সবই মোটামুটি ভালো চলছিল হঠাৎ একটা ঘটনাই রুবির জীবনটাকে তছনছ করে দিল ।
প্রফেসর বাথরুমে স্নান করছিলেন রুবি খাবার রেডি করছিল হঠাৎ একটা ফোনকল এলো প্রফেসরের মোবাইলে । রুবি ধরে হ্যালো বলতেই কেটে গেল । প্রফেসরের ল্যাপটপ খুলে চ্যাট ওপেন করতেই রুবির তো চক্ষুশুল যত কলেজের মেয়েগুলির ডার্টি চ্যাটিং আর ডার্টি পিক ।
প্রফেসর ও সেই সময় সামনে দঁাড়িয়ে । রুবি কিছু বলার আগেই প্রফেসর রেগে আগুন হয়ে মেঝেতে রুবিকে মারতে শুরু করল । রুবি চিৎকার করতে লাগল । হাত পা আছড়াতে লাগল । কিন্তু কেউ এলো না বঁাচাতে আর বিশ্বাস করলও না যে প্রফেসর এরকম কাজ করতে পারে।
সেইদিন থেকে রুবির কলেজ যাওয়া শপিং যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছিল । সে একপ্রকার জেলখানার কারাগারে বন্দী জীবনযাপন করতে শুরু করল । প্রফেসরের অনুমতি বিনা তঁার এক কদম বাইরে পা রাখার ক্ষমতা ছিল না ।
রুবি নিজেকে খুব অসহায় মনে করল । বাবা মা কে খুলে বলতে উল্টে রুবিকেই দোষ দিয়ে দু চার কথা শুনিয়ে বলল আমাদের জামাই এরকম হতে পারে না ।
রুবি একসময় কলেজের সেরা সুন্দরী মেয়ে ছিল । যার জন্য কত ডাক্তার ইঞ্জিনীয়ার পাগল হয়ে যেত সেই রুবির দুর্দশা সত্যি খুব দুঃখজনক ।
রুবির বাচ্চা হল । অন্নপ্রাশন হল । সংসার ক্রমে ক্রমে রুবিকে ডিপ্রেশনের রুগী বানিয়ে দিচ্ছিল । রুবি একাকীত্ত্বের যন্ত্রণা শুধু ছেলের সাথেই শেয়ার করত। ছেলেটাই তঁার জীবনের একমাত্র অবলম্বন হয়ে গেছিল।
প্রফেসর বাড়ী ফিরত রাত এগারোটা বারোটাতে । কোন কিছু জিজ্ঞাসা করলেই মারধোর অশান্তি । নিজে অণ্য নারীতে আসক্ত উল্টে রুবিকে বিনাদোষে সন্দেহ করে মারধর করত।
রুবি সবই মুখ বুজে মেনে নিচ্ছিল । ছেলেটাও আস্তে আস্তে বড় হচ্ছিল । রুবি এবার স্বামীর কাছে আবদার করল কিছু কাজ করার বাড়িতে একা বসে থাকে ভালো লাগে না একটা পার্ট টাইম জব যদি——-
মুখ থেকে বেরোলো অমনি প্রফেসর চুলের গুছি ধরে মারতে আরম্ভ !সেদিন থেকে রুবি আর একটি কথাও বলেনি নিজের ব্যাপারে । কেমন বাকশূণ্য পাথরে পরিণত হয়ে গেছিল।
প্রফেসর শিউলি মিলি শেলী আরও অনেক সন্ধ্যেতে টিউশান পড়াতেন । আর তঁাদের জন্য দামী দামী গিফট কিনতেই প্রফেসরের অর্ধেক বেতন খরচ হয়ে যেত।
রুবির প্রতি কোনরকম যত্ন নিতেন না । পরনের দুটি তিনটি পোশাকে আর দু তিনটে তেই তঁাদের সারা বছর চলে যেত । ঠিক একটি বাচ্চার ধাইমা হিসেবেই তঁার জীবনযাপন চলতে লাগল!
একদিন বছরের শুরুতে ছেলে জন্য জামা কিনতে বাজারের কোন এক দোকানে বসে । হঠাৎ অশোকের সংগে দেখা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে হনহন করে ।
রুবি -অশোক না তুই এখানে?
অশোক- আরে রুবি কেমন আছিস বল?
রুবি- আমি ভালো আছি । তোর খবর কি বিয়ে থা করেছিস ?
অশোক- নারে !তোদের এখানে জব পেলাম তাই এখানেই বিয়ে টা সেরে নেব ভাবছি?
রুবি-কি বলছিস তুই এখনও বিয়ে করিস নি দেখ আমার ছেলে কত বড় হয়ে গেল?
অশোক রুবিকে এই অবস্থায় এইরকম দেখে খুবই হতাশ। রুবির আগের মত হাসিমুখ নেই । সৌন্দর্য নেই । চোখে মুখে কালি পড়ে গেছে । পরিহিত শাড়িটাও খুব পুরোনো । রুবিকে দেখে অশোকের খুব কষ্ট হল । অশোক বলতে যাচ্ছিল প্রফেসর সূর্য কোথায়?
রুবি নারে উনার সময় হ নি?
কথাটার ভিতর বেদনা ঝরে পড়ছিল । অশোকের কোনকিছু আর বুঝতে বাকী রইল না !
অশোক এবার রুবির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল রুবি তুই সত্যি করে বলতো তুই কি সত্যি সুখী!
রুবি আর চোখের জল আটকাতে পারল না অশোকের সামনে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। রুবির মন আর থামতে চাইল না । হু হু করে সব বলতে শুরু করল ।
অশোক শুনে হতবাক ।
অশোক -তোর বাবা মা কিছু বলে না কেন?
রুবি- কেউ ই বিশ্বাস করতে পারছে না যে—–
অশোক – তুই কি সারাজীবন এরকম থাকবি?
রুবি- কপাল ! বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে!
অশোক- তুই বি এস সি নিয়ে পড়ছিলি । তা তুই চাকরী কেন করছিস না !
রুবি – আমাকে চাকরী করতে বারণ করেছে রে ? যদি আমি পালিয়ে যাই সেই ভয়ে!
অশোক- তুই এক কাজ কর আমার ফোন নাম্বার রাখ । আর আগের সপ্তাহে আমার সংগে দেখা করে সব কাগজপত্র নিয়ে আসিস । আমি বায়োডাটা বানিয়ে নেব আর আমি তোর একটা কাজের চেষ্টা করছি । সব হয়ে গেলে পর জানাব ।
রুবি -ঠিক আছে।
রুবি তো অশোককে দেখে চিনতেই পারে নি । অশোক আগের থেকে অনেক গম্ভীর ও অনেক দায়িত্বশীল হয়ে গেছে।
সব বদলে গেলেও অশোকের ভিতরটা কিন্তু আগের মত থেকে গেছে।
সেই তাকানো সেই বসা সেই চোখ মুখের সারল্য সব একরকমই আছে। অশোকের ম্যানিব্যাগে রুবির ছবিটা এখনও মজুত!
কিছুদিন পর অশোক রুবির জন্য একটা জব যোগাড় করে দেয় । রুবি ও অশোকের কথায় প্রফেসরকে ডিভোর্স দেয় ও জব টা করতে শুরু করে । রুবি এখন সম্পূর্ণ মুক্ত । ভালোই দিন কাটছিল তঁার ।
অশোক এবার রুবিকে বিয়ের প্রোপোজাল দিলে রুবি প্রত্যাখ্যান করে এই ভেবে যে তঁার জন্য অশোকের জীবনটা যেন না নষ্ট হয় !
অশোক – রুবি তুই আমাকে বিয়ে না করলে আমি কোনদিন ই বিয়ে করব না
রুবি – তবে তাই হোক অশোক । বিয়ে প্রথাটির প্রতি আমার ঘৃণা ধরে গেছে । এইরকম বন্ধুত্ত্বের এক সংগে বঁাচাটাই আমার কাছে স্বর্গসুখ?
অশোক – বিয়ে না করলেও তোর বাচ্চাকে আমি আমার বাচ্চা হিসেবেই মানুষ করব কথা দিলাম!
এইভাবে দুজন একসংগে সুখে সংসার করতে শুরু করল । রুবি আবার আগের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেল । বিয়ে না করেও যে সুখে সংসার করা বা একসংগে থাকা যায় তঁার চূড়ান্ত উদাহরন অশোক ও রুবি।
গাছের পাতাগুলো যেন আবার সবুজ হয়ে চারিদিকে ভরে গেল ।
আপনারাই বলুন হাজার রুবি এভাবেই ভুলের শিকার কেন হয়?
আসল রত্ন চিনতে মেয়েদের অনেক সময় লাগে?
—————–সমাপ্ত——————
অরুণিমা মন্ডল দাস
কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ
১০ জুলাই, ২০১৬
৯টি মন্তব্য
মোঃ মজিবর রহমান
আপনারাই বলুন হাজার রুবি এভাবেই ভুলের শিকার কেন হয়?
আসল রত্ন চিনতে মেয়েদের অনেক সময় লাগে?
বলার কিছুই নায় দিদি।
আবু খায়ের আনিছ
আসলে একটা কথা আছে যুবতি কুমারী নারী একা একটি খোলা আলমারি । কারো কারো না কঠোর দায়িত্বে থাকা বাধ্যতামূলক।
মধু খাইলে চিনি আর মিষ্টি লাগে না।
কত ভন্ড প্রেমিক এই দুনিয়ায় বাস করে। উত্তর কোথায়? নাই
ইঞ্জা
খোলা আলমারিটাকে খোলা ছাড়তে নেই এ অবশ্য অনেক পিতা মাতাই বুঝেননা, মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার আগে খুব করে খবরাখবর নেওয়া উচিত, উপরের চেহেরা দেখেই ভিতরের মানুষটাকে চেনা যায়না সুতরাং সাধু সাবধান।
জিসান শা ইকরাম
আসল রত্ন চিনতে মেয়েরা সব সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা, অথবা বলা যায়- বাবা মা এর সিদ্ধান্ত মেয়েরা মেনে নেয় অনেকটা বাধ্য হয়ে।
যাক শেষ পর্যন্ত রুবি ভাল আছে এটা ভেবেই ভাল লাগছে।
নীলাঞ্জনা নীলা
সঙ মানে সঙ সাজা, আর সার মানে শূণ্য। সত্যি বলতে কি আমি এমন সংসার পছন্দ করি, যেখানে দুজনেই সমান স্বাধীনতা পায়। আত্মসম্মান ধরে রাখতে গেলে, অন্যকেও সেটা দিতে হয়। তবুও রুবী যে ভালো আছে, সেটাই অনেক।
ব্লগার সজীব
রুবী শেষ পর্যন্ত সঠিক গন্তব্য পেলো এটি দেখে ভাল লাগলো।
শুন্য শুন্যালয়
ভালো হয়েছে গল্প। অনেক রুবী বেরই হতে পারেনা জেলখানা থেকে।
মেহেরী তাজ
একটা সুন্দর সমাপ্তি।
ভালো হয়েছে আপু।
শামীম আনোয়ার আল- বেপারী
ভাল গল্প