পৃথিবীর পথে পথেঃ গ্রীস, এথেন্স, সাল ২০০৯ ,ভ্রমণ কাহিনী 

“If Greece is destroyed completely, an olive tree, a vine and a boat will remain. That is enough to rebuild her from the beginning” 

 

আমাদের এবারের গন্তব্য স্থল ‘গ্রীস’ এবং তার রাজধানী ‘এথেন্স’।

লন্ডন থেকে গ্রীস মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টার ফ্লাইট । চলেছি সেই পথে ।

আরিস্টটেটল, সক্রিটিস  আর  প্লেটোর দেশ গ্রীস । সেখানে  যাচ্ছি আমরা ।  গ্রীক বীর ‘আলেকজান্ডার দি গ্রেট’ কত শুনেছি আর পড়েছি তার গল্প ,  এবার স্বচক্ষে  দেখতে যাচ্ছি তার জন্ম ভূমী ।

গ্রীস ইউরোপের দক্ষীনপুর্বের একটি ভূমধ্য সাগরীয়  নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে পাহাড় বেষ্টিত একটি দেশ। প্রায় ২০০০ দ্বীপ আছে গ্রীসে। আয়েজিয়ান (Aegean)আর লনিয়ান (Lonian) সাগরের মধ্যে এই দ্বীপ গুলো। যা ফেরি দিয়ে  ঘুরে বেড়ানোর আর একটা টুরিস্ট অ্যাটরাকশানের ব্যাপার। বছরে ৩৩ মিলিয়ন টুরিস্ট এখানে আসে ভিজিট করতে।

গ্রীস এসে চোখে পড়লো বেশ কিছু  অলিভ বাগান ।অলিভ গাছ আগে দেখিনাই।   আমরা যখন টেম্পেল অব এথেনা দেখতে গেলাম সেই উঁচু পাহাড়ের উপরে তখন নিচে অলিভ গাছের বাগান দেখে ছিলাম  । তবে এই অলিভ আমাদের দেশের অলিভ থেকে পৃথক ।

গ্রীস কে বলা হয় ইউরোপে সভ্যতার প্রবেশ দ্বার । অলিভ এখানকার প্রধান অর্থকরী ফসল। স্পেন, ইটালি, মরক্কো আর তুরস্কের পরেই গ্রীসের স্থান অলিভ উৎপাদনের । ১২০ মিলিয়ন গাছ আছে আর সেখান থেকে ১.২ মিলিয়ন মেট্রিকটন অলিভ তেল  উৎপাদন হয় প্রতিবছর।

গ্রীস   আর্ট কালচারের জন্য বিখ্যাত ।সেটাই চোখে পড়লো চারদিকে এবং তাদের মিউজিয়ামের কালেকশানে।   তারা পাথর দিয়ে স্ট্যাচু বানাতে  বেশ পারদর্শি । অনেক থিয়েটার হল যেমন আছে তেমন আছে থিয়েটার গ্রুপ।  ড্যান্স করতে তারা খুব পছন্দ করে এবং সেখানে ৪০০০ ধরনের ড্যান্স আছে। তাদের লিখিত ভাষা অনেক প্রাচীন,যার প্রভাব আছে ল্যাটিন আর ইংরেজি ভাষার উপর।

গ্রীক লিখিত ভাষা ৫০০০ বছরের পুরানো ।  এখানে বেশ কিছু  মিউজিয়াম আছে। তার মধ্যে বিখ্যাত ১) Aeropolis 2)National Archaeologi মিউজিয়াম বিখ্যাত  ।

গ্রীস কে আগে বলা হতো  ‘হেলাস ‘। এটা একটি প্রাচীন গ্রীক শব্দ। বাইজেনটাইন এরা পর্যন্ত এই নামেই গ্রীস কে ডাকা হত। তারপর রোমান যখন গ্রীস শাসন করে তখন তারা “হেলেন” কে ‘গ্রাসাস’ নামে ডাকতো । তবে এখন আবার তারা অফিসিয়াল ভাবে আগের নাম “হেলেনিক রিপাবলিক” এই নামেই ডাকে। ।

আমাদের প্রতিবেশী অনেক গ্রীক পরিবার  আছে লন্ডনে ।তাদের কাছে তাদের দেশের  গল্প  শুনেছি ।    সেখান থেকেও এই দেশ টি দেখার একটা আগ্রহ ছিল।

প্লেন যখন নিচে নাম ছিল  তখন  প্লেন থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিলো এর ল্যান্ড স্কেপ।এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে আমাদের হোটেল যেতে যেতে  যা লক্ষ্য  করলাম তা  হল  গাছপালা, রাস্তা ঘাট , বিল্ডিং আর মানুষজন। বাংলাদেশের ‘ করবি’  আর ‘ জবা ‘ এখানে কমন একটা ফুল গাছ। এথেন্সে আধুনিক সব বিল্ডিং কিন্তু আইল্যান্ড গুলোতে ভিলা টাইপের সামনে পেছনে বাগান সহ আলাদা আলাদা বাড়ি। তখন সেখানে অলিম্পিক হওয়ার কথা ।তাই সরকার প্রচুর টাকা খরচ করে মেট্রো,ট্রাম সহ যোগাযোগ ব্যাবস্থার অনেক উন্নতি করছিল । গ্রীসের মানুষ ফ্যামিলি অরিয়েন্টেড ।

খ্রিস্টান ধর্ম আসার আগে গ্রীসে  অন্য ধর্ম ছিল। অনেক ধরনের দেব দেবতার পূজা করতো ।  তাদের দেব দেবতাদের  মধ্যে  আবার মানুষের মতোই লোভ লালসা, ক্রোধ এবং হিংসা  ছিল।

পরের দিন প্রথমেই ট্যাক্সি নিয়ে দেখতে গেলাম সেই বিখ্যাত ‘এথেন্স অ্যাক্রপলিস ওপেন মিউজিয়াম’   (  Athens Acropolis) ।

এটা অনেক উঁচু একটা হিলের উপর। উঠতে উঠতে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলাম । উঁচু এই পাহাড়  থেকে পুরো এথেন্স দেখা যাচ্ছিলো ।এই উঁচু হিলে মন্দির করার উদ্দেশ্য উপর থেকে সমস্ত গ্রীস তাদের দেবদেবী দেখতে পারবে এবং তা  প্রটেক্ট করবে ।   এখানে এসে এদের প্রাচীন দেব দেবীদের মন্দির আর দেব দেবী কিছু কিছু দেখতে পেলাম।একজন গাইড সব কিছু দেখিয়ে দিলো কোন  মন্দিরটি কার আর দেবতার পরিচয়।

১) গডেস অফ এথেনা,   তৈরি হয়েছিল ৪২৭  BC ( The Parthenon)  ২) The Erechtheion ৪২১BC, গ্রীক দেবতা হেরএস ( Heroes ) এর উপাসনার জন্য , ৩) দেবতা এথেনা ন্যায়িকে  (The Temple of Athena Nike) এর জন্য ৪২৭ BC তে । একটা থিয়েটার গ্যালারি যেখানে ছিল ১৬,০০০ বসার সিট ,কিন্তু এখন ঠিক ঠাক আছে ২০ টি সারি । আর একটা টেম্পল The Asclepieion ৪২০ BC তে তৈরি দেবতা Medicine Asclepius এবং তার মেয়ে Hygieia এর জন্য।

টেম্পল গুলো এমন এক স্থানে তৈরি যেখান থেকে অনেক দূর পর্যন্ত এথেন্স শহর দেখা যায়। দেখতে গিয়ে এতো এতো  সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হবে ভাবতে পারিনি । সব কিছু দেখার পর নিচে নেমে আর একটা প্রাচীন গ্রীক দেবতা অলিম্পিয়ান জিয়াস টেম্পল  দেখতে গেলাম ।আমাদের গাইড এর  পরিচয় এবং কেমন করে তা ধ্বংস হয়েছিল তার  ইতিহাস দিলো।

টেম্পেল  অব ওলিম্পিয়ান জিয়াস

এটি এথেন্সের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত গ্রীক দের প্রাচীন কালের দেবতা অলিম্পাস জেয়াস এর জন্য তৈরি । কিন্তু ৫ম শতাব্দীর ভূমিকম্পে সম্পুর্ন ভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

যীশুর জন্মের আগে ১৭৪-১৩২ BC তে প্রথম তৈরি হয় । 115 x 110 মিটার আয়তনের গ্রীক মিথলজির যত দেবতা   ছিল  তাদের মধ্যে রাজা বা সবচেয়ে  ক্ষমতাধারী ছিল এই জিয়াস দেবতা  এখানে তার স্ট্যাচু ছিল এবং তার  অর্চনা বা পূজা করা হত। ৬ষ্ঠ শতাব্দী AD তে এই স্ট্যাচুটি হারিয়ে যায় সমসাময়িক দ্বন্দ্ব চলাকালীন অবস্থায় ।

এখন গ্রীক রা  খ্রিস্টান ধর্ম পালন করে কিন্তু তা অর্থাডকস খ্রিসটিয়ানীটি ।অনেক আচার আচরণ ডিফারেন্ট ব্রিটেনের খ্রিস্তিয়ানিটি থেকে।ব্রিটেনে প্রধান উৎসব ‘বড়ো দিন’ কিন্তু গ্রীক দের বড়ো উৎসব ‘ইস্টার’। তাদের চার্চও পৃথক। ধর্মে তারা আগুনে ব্যাবহার করে। যা ব্রিটিশ করেনা।     গাইডের কাছ থেকে আদ্যোপান্ত জেনে নিলাম । এখন সেখানে দাঁড়িয়ে আছে মাত্র কয়েকটি পিলার ।  সেদিনের মতো তাই দেখে হোটেলে ফিরলাম।

পরের দিন যাওয়ার পালা আইল্যান্ড হপিং।  ফেরি আর ছোটো ছোটো বোট ব্যাবহার করে আইল্যান্ড গুলো দেখে বেড়ালাম। ঘন নীল সমুদ্রের পানি। আইল্যান্ড গুলো ভূমিকম্পের মাধ্যমে তৈরি । প্রত্যেক টি আইল্যান্ড ভিলা আর ফুলের গাছ পালা দিয়ে সুন্দর করে সাজানো। অনেক আইল্যান্ড থাকলেও  এর মধ্যে মাত্র ২০০ টি আইল্যান্ডে মানুষ বসবাস করে।  আমরা তিনটি আইল্যান্ড এক দিনে দেখে ফিরে আসলাম।

মেডিটেরিয়ান সমুদ্র দেখছিলাম আর ভাবছিলাম এই সেই সমুদ্র যেখান দিয়ে গ্রীক,  রোমান,  পারস্য আর তুরস্ক কত যুদ্ধ অভিযান চালিয়েছিল দেশ দখল আর সাম্রাজ্য বিস্তার করার জন্য। তুরস্ক ভিজিটের সময়   ‘হেলেনিস্ক পিরিয়ড’,’ট্রয় অব হেলেন’ , ‘গ্রিসিও রোমান’ এগুলো সাইট চোখে পড়েছিল তাদের রেখে যাওয়া অনেক রুইন তুরস্কে ,মিশরে, আর ইটালিতে দেখেছিলাম ।

তুরস্ক কোনো সময়  গ্রীসের দখলে আবার কোনো সময়  ইটালির দখলে ছিল ‘ওটোম্যান পিরিয়ডের’ আগে।

অনেক অভিজ্ঞতা নিয়ে সেই গ্রীস দেখে ফিরে আসলাম লন্ডনের পথে ।

লেখকঃ হুসনুন নাহার নার্গিস, লন্ডন ।  ভ্রমণ কাহিনী

 

 

 

 

 

 

৫১৩জন ৫১৩জন
0 Shares

৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ