কালী গন্ধাক রিভারে ওয়াটার র্যাফটিইং
পৃথিবীর পথে পথেঃ নেপালঃ অন্নপুর্না মাউন্টেন ট্রেকিং , মর্ত্যের স্বর্গ , সাল ২০০৮
নেপাল
“নেপাল,যেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু আট টি মাউন্টেন এখানেই আছে”
‘নেপাল দেখা একটা আকাঙ্ক্ষার স্বপ্নের নাম এবং হিমালয়ের লুকানো মিসটৃি’
ছোটবেলায় গ্লোবাল মানচিত্রে হিমালয় দেখে মনে মনে স্বপ্ন আঁকতাম আহারে যদি যেতে পারতাম! ভাবতাম কেন এই স্থান টি সাদা সাদা করে রাখা । উঁচু নিচু সব পর্বতের ছবি আর নাম দিয়ে পুর্ন ।কি এর রহস্য ! যদি ভেদ করতে পারতাম !
সেই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করতে আজ আমরা চলেছি নেপালের পথে । বিধাতার কাছে প্রথমেই কৃতজ্ঞতা জানায় দেখতে যাওয়ার সুযোগ পাওয়ার জন্য। । শুরু করতে যাচ্ছি নেপাল বা হিমালয় কন্যার রহস্য উন্মোচন অভিযানে ।
এক নেপাল দেখে হিমালয় আবিষ্কার সম্ভব নয়। যারা হিমালয় ভালবাসে এর আনাচ কানাচ খুঁজে বেড়ায় তারা কিন্তু অনেকেই এখানেই থেকে যায়। চলতে চলতে এমন অনেক ওয়েস্টার্ন বিদেশী দেখলাম যারা হিমালয়কে ভালবেসে এখানেই বিয়ে করে থেকে গেছে। সংসার পেতেছে।তাদের মতোই সাদামাটা জীবন যাপন করছে ।
কাতার এয়ার লাইনের একটা বইং বিমান অপেক্ষা করছিল লন্ডনের হিথরো এয়ার পোর্টে । দুবাই এসে চেঞ্জ করে আর একটা প্লেনে সোজা এসে নামলাম স্বপ্নের দেশ নেপালের ‘ত্রিভুবন ইন্টারন্যাসান্যাল এয়ার পোর্টে’ । যাওয়ার আগে ‘লোনলি প্ল্যানেট’ পড়ে সব ঠিক করে রেখেছিলাম কি কি দেখবো আর কি কি করার আছে ১২ দিনের লম্বা সময়ে ।
আগে থেকেই হোটেল ঠিক করা ছিল আর বলা ছিল পিক আপ সার্ভিসের কথা । চেকিং শেষে বাইরে আসলাম। পুরো পরিবেশেই আলাদা । চার দিকে পাহাড় আর পাহাড় । পাহাড়ের মাঝেই এয়ারপোর্ট।
এভারেস্ট ভ্রমণ
খুব সকালে এভারেস্ট ট্যুর আরম্ভ করলাম । কারন বেলা হলে সেখানে মেঘ জমে মেঘের ঝড় আরম্ভ হয় যা বিপদজনক প্লেন চলার জন্য। তাই তখন থেকেই আরম্ভ হয়ে গেলো ট্যুর । সব কিছু বলে রেখে ছিলাম স্থানীয় টুরিস্ট এজেন্সির ম্যানেজারকে যিনি একজন নেপালি ভদ্রলোক । তাই তিনিই সব অরগানাইজ করে দিলেন । ‘বুদ্ধা এয়ারলাইন্স’ অর্থাৎ একেবারে ছোটো একটা টুরিস্ট বহন কারি প্লেন মাত্র ২০ জন যাত্রী নিয়ে উড়ে, তাতে চেপে বসলাম ।উদ্দেশ্য প্লেন থেকে এভারেস্টের চুড়া দেখা । তার সাথে আরও যত উঁচু পর্বত আছে সেগুলো দেখা। কিছুক্ষণ পরেই উপরে উঠতে লাগলো আর আমরা দেখতে লাগলাম নিচের পাহাড় ঘেরা নেপাল। । কত নদী দেখা যাচ্ছে দুই পাহাড়ের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া । তারপর একেবারে সাদা মেঘ ফুঁড়ে বের হয়ে আসলো ‘এভারেস্ট’ আর সব পর্বতের চূড়া যা বরফে ঢাকা । সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য সামনে এলো । প্লেন চালক বর্ণনা দিতে থাকলো কোন টা কি পর্বত । অনেকক্ষণ ঘুরাঘুরি করে সব দেখার পর আমরা নিচে ল্যান্ড করলাম । খুব কাছ থেকে এভারেস্ট দেখে ফিরে এলাম।
ক্যাবেল কারে ত্রিশূলী রিভার ক্রস
এসেই ট্যাক্সি যোগে পোখারার পথে। যাওয়ার পথে পড়ে ক্যাবেল কারে করে এডভেঞ্চার করা। ত্রিশূলী রিভার, ২.৩ কি: মি: উঁচু উঁচু মাউন্টেন মানাস্লু, হিমাচুলি, আর অর্নাপুর্না হিমালয় রেঞ্জ দেখতে দেখতে উঠতে লাগলো আমাদের ক্যাবেল কারটি । সে এক অতি মনোরম দৃশ্য। ত্রিশূলী রিভার টি খুবই খরস্রোতা । ওপারে ‘মনোকামনা’ হিন্দু মন্দির যা কিনা ৩৩৮৯ ফুট উপরে ।
পোখারাঃ
পোখারায় বেশ কিছু দেখার জিনিস আছে। সেখানে দুই দিন এক রাত ছিলাম। ফিওয়া লেক বোট ট্রিপ, দুইতলা উঁচুতে ওয়ার্ল্ড পিস প্যাগোডা, মাউনটেন মিউজিয়াম, বেগনাস লেক, ডেভিড ওয়াটার ফলস , গুপ্তেসসরী মহাদেভ কেভ আর স্যারনকোট ।
স্যারনকোট,যেখানে ট্যাক্সি যোগে অনেক উঁচু পাহাড়ে উঠে গোঁ গোঁ শব্দে উঁচু পর্বত থেকে অনেক অনেক নদী নালার পানি সংগ্রহ করে দ্রুত বেগে নেমে আসা একটি নদী যার নাম “সেটি” তা দেখা । সত্যি সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য । যার পানি বরফের মতো সাদা রঙের।
অন্নপুর্না মাউন্টেন ট্রেকিং
বিকালে আমাদের ম্যানেজারের ঠিক করা নেপালি গাইড ‘শঙ্কর ‘এসে হাজির সে আমরাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে অরনাপুর্না ট্র্যেকিং । এই টুর টাই আমাদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়। একটা ট্যাক্সি নিয়ে শুরু হল যাত্রা।
পোখারা থেকে ৩৪ কিঃ মিঃ পাহাড়ি পথ যা কিনা ক্রমান্বয়ে উঁচু হচ্ছে এবং মোট সাতটি পাহাড় পাড়ি দিতে দিতে এসে পড়লাম ধামপাশ তার পর পেদি ।পেদি থেকে ২.৯ কিমি দূরত্বে ধামপাশ । এখানে খরস্রোতা মদীখোলা নদী চারদিক থেকে পানি যোগাড় করে চলছে । একটু চওড়া হয়েছে বটে কিন্তু তার বোয়ে চলার শব্দ খুব জোরালো । পেদি থেকে ট্যাক্সি বিদায় হল ।এবার হাঁটার পালা। প্রথমেই একটা ঝুলন্ত ব্রিজ পার হলাম যার নাম নয়াপুল এর নিচে খরস্রোতা মোদী খোলা নদী। দৃশ্য পট দেখার মতো। ধামপাশ ১৭৭০ মিটার উঁচু সমুদ্র পৃষ্ট থেকে।
আমাদের ট্র্যেকিং রুটঃ ধামপাশ -নয়াপুল – সায়লি বাজার -পেদি – পোথানা- লান্দ্রুক ভিলেজ – ঘানধ্রুক ( Ghandruk) ।ধামপাশ থেকে পেদি ৩৫ কিমি আর পেদি থেকে ঘানধ্রুক ৩৫ কিমি । সব টুকু পথ আমাদের হেঁটে হেঁটে যেতে হবে যা আবার খাড়া উঁচু । সারা দিন হাঁটা রাতে টি হাউসে রাত্রি যাপন। মোট দুই রাত দুই দিন লাগবে ।
নয়াপুলের পর “বিরেথআন্তি” (Birethanti) অরনাপুর্না কনসারভেসন এরিয়া। টিকিট করে পারমিসান নিতে হয় প্রবেশ করার জন্য। এ এক পৃথিবীর বুকে স্বর্গ । এমন একটা স্থান যা একজন মানুষের মনে সারা জীবনে জন্য দাগ কেটে থাকবে।
নয়াপুল থেকে এক ঘণ্টার রাস্তা। প্রথম ৯০ মিনিট তেমন কষ্ট লাগেনি।আমরা হাঁটছি সমান্তরাল ভাবে মোদীখোলা নদীর সাথে সাথে নদী চলার কুলু কুলু শব্দের গান শুনতে শুনতে। পথে একটা ছোটো খাটো কিন্তু লম্বা ঝর্না পড়লো। তারপর পড়ন্ত সব্ধ্যা বেলায় রাত কাটানো আর ডিনারের জন্য টি হাউস উঠা। কাঠের একটা দুইতলায় লজিং হাউস । পরিষ্কার বেড আর লেপ । রুমের সঙ্গে লাগা কাঠের ঝুলন্ত বারান্দা। যেখান থেকে সেই মোদীখোলা নদীর উঁচু পর্বত থেকে এঁকে বেঁকে লম্বা হয়ে নেমে আসার অপরূপ দৃশ্য পুরোটাই দেখা যাচ্ছে।যা জীবনে ভোলার মতো নয়। রাতের খাবারের পর সারা দিনের হাঁটার ক্লান্তি দূর করতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালে তাদের হাতে বানানো পাহাড়ি ব্রেকফাস্ট খেয়ে আবার রওনা। একবার নদীতে নেমে একটা বিরাট বুলডারের (বিরাট পাথর ) উপর বসে চারদিক দেখার অভিজ্ঞতা নিলাম। পানি খুব কম কিন্তু খুব স্রোত। এদিক ওদিক পাহাড় থেকে সরু সরু পানির ধারা এসে মিলেছে । সময় টা ছিল আগস্ট তাই বর্ষার পানি এখনো চারদিক থেকে আসছে। কি ভাবে নদীর সৃষ্টি হয় তা হাতে নাতে দেখছি। চলা আরম্ভ হল দুই হাতে দুইটা ট্রেকিং ইস্টিক দিয়ে।
এইবার উঠাটা বেশ কষ্টদায়ক কারন যতই উপরে উঠছি ততই পাহাড়ি খাড়া পথ। এইবার একটা ছোটো নালা কিন্তু খুবই খরস্রোতা তা পার হতে হবে, কিন্তু ব্রিজ যেটা ছিল তা ভেঙ্গে গেছে পানির তোড়ে। কয়েকটা গাছের গুড়ি দিয়ে অস্থায়ী পুল বা ব্রীজ বানানো হয়েছে কোনো হাতল ছাড়া । পার হওয়া বিপদ জনক ,কারন একটু পা পিছলে গেলে পানির তোড়ে কোথায় যে যাবো তার ঠিক নাই।তার উপরে সামনেই ল্যান্ড স্লাইডের ভয়ংকর দৃশ্য। শঙ্কর ওদিকে তাকাতে বারন করলো। দূর থেকেই আমরা বিরাট বিরাট বুলডার পড়ার বিকট শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম । এতোই ভয়ঙ্কর দৃশ্য যা দেখলে আত্তা রাম খাঁচা ছাড়া হবে। না তকিয়ে পার হলাম বটে কিন্তু পার হয়ে যা দেখলাম তা রীতিমত ভয়ঙ্কর। ধড়াম ধড়াম শব্দে বিরাট বিরাট পাথর পাহাড়ের ধার থেকে পড়ছে নিচে।মনে হচ্ছে বোমা বিস্ফোরণ । বর্ষার পানিতে পাহাড়ের গা বেয়ে একটা নুতুন পানির ধারার সৃষ্টি হচ্ছে।এটা নাকি একেবারে নুতুন ,আগের বছরেও ছিলনা।কাছের বাড়ি ঘর গুলোর ছাদের স্লেট সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পানির তোড় থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। এটাই হলো হিমালয় ।সুন্দর কিন্তু ভয়ঙ্কর । এবং সর্বদা পরিবর্তনশীল এক জিওগ্রাফি ।
উপর থেকে নেমে আসা মদীখোলা নদী
এইপারে এসে আবার খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠা আর চার দিকের সিনারি দেখা । উঁচু হওয়ার জন্য উপর থেকে বহু দূর পর্যন্ত নিচ দেখা যাচ্ছে। ঢালু বেয়ে কত যে নালা বের হয়েছে। পাহাড়ের গায়ে ছোটো ভিলেজ ।একটু সমান জায়গা থাকলেই সেখানে ফসল ফলাচ্ছে ,আর ঘরের পাশে মোষের খোঁয়াড় । চারদিকে ঘাসের অভাব নাই।মুরগি ছাগল এগুলোও অনেক দেখলাম।
তারপর আরও উঁচু পর্বতের শেষ মাথা যা ২০০০ মিটার উঁচু সেখানে অনেক কষ্টে উঠে একটা সুন্দর মোটেল শঙ্কর আমাদের নিয়ে আসলো।এটাই সেই ‘গনদ্ধুরক ‘(Gondhuruk) যার বারান্দা থেকে মাছ পুছারি, আর অর্নাপুর্নার বরফে ঢাকা চূড়া স্পষ্ট দেখতে পেলাম। এতো বেশি উঁচু আমাদের কিছুটা অল্টিচিউড সমস্যা হয়েছিল। যাই হোক রাতের ডিনার শেষ হল । এতোই ক্লান্ত ছিলাম একটা ভালো ঘুমের দরকার ছিল।
পুরো অর্নপুর্না কন্সারভেসান এলাকাটি ৭৬২৯ স্কয়ার কিমি। নেপালের মধ্যেখানে অবস্থান ।উত্তরে তিব্বত । ল্যাসবুক, মিয়াগদি,কাস্কি, মুস্তাং এবং ম্যান্যাং ডিসট্রিকট নিয়ে গঠিত এই গান্ধারী প্রদেশ। যে পর্বত গুলো এখানে আছে তা হল অর্নপুর্না,ধবলগিরি, মাছপুছারি এবং গঙ্গাপুর্না।
প্রায় ১০,০০০ মানুষ এখানে বসবাস করে । চাষ বাস,গরু পালন, আর টুরিস্ট দের জন্য লজিং ব্যাবসা হল পেশা । মোট ১,০০০ টি হাউস এখানে আছে।
চার দিকে ঘন জঙ্গল তাতে রোডডেনদ্রোণ,আলপাইন আর ধাপে ধাপে ফসল । অনেক রকমের পাখপাখালি আর রেপটাইল আছে। যে সমস্ত ইথিনিক গ্রুপ আছে তারা হল গুরুং,মাগাব,ম্যানাজ,লবা এবং থাকলি ।কিছু লোক তিব্বতীয় বার্মা প্রজাতির। যেতে যেতে ছোটো ছোটো মন্দির চোখে পড়লো সেখানে তারা হিন্দু আর বৌদ্ধ এক সঙ্গেই পূজা পালন করে। মৃত ব্যাক্তির ছাই একটা ছোটো পাত্রে নিজ এলাকায় পাহারের গর্তে রাখা দেখলাম । তাদের বিশ্বাস প্রকৃতি আর মানুষ হারমনির সাথে বাস করা উচিৎ । তাদের নিজস্ব নাচগান, আর ফোক মিউজিকের একটা রিচ কালচার আছে।
গানধ্রুক থেকে এবার নিচে নামার পালা।আমার ডান চোখের নিচে একটা আঘাতের দাগ আছে ।সেটা অন্নপূর্ণা ট্রেকিং এর স্মৃতি । পড়ে যাওয়ার স্মৃতি ।
যেহেতু ঢালু তাই সময় লাগলো কম। অপরূপ প্রাকিতিক দৃশ্যে এবং এদের কালচার দেখা, সাথে অন্নপুর্নার পর্বত ট্রেকিং এই তিনের সমন্বয় এবং এই মেমোরি একজন মানুষের জীবনে সারা জীবনের জন্য দাগ কেটে থাকবে।
লেখকঃ হুসনুন নাহার নার্গিস ,লন্ডন
২টি মন্তব্য
হালিমা আক্তার
ছবি গুলো দেখে গেলাম। সময় করে পড়ে নিবো।
কামাল উদ্দিন
যার জীবনে এ্যডভ্যান্চার নাই সেটা হলো নিরস জীবন, আপনার এমন এ্যডভেন্চারপূর্ণ জীবন দেখে সত্যিই হিংসে হয়। পাহাড় ট্রাকিং কিযে দূর্দান্ত সেটা আমি অল্প স্বল্প জানি। কারণ বান্দরবানের পাহাড়গুলো এক সময় আমি চষে বেড়িয়েছি। এখন আর সময় পাইনা, তাছাড়া পাহাড়গুলোতে এখন দস্যুদের উপদ্রব প্রকট………..শুভ কামনা জানবেন আপু।