মা যখন আকুতি করলেন, “তোর আব্বা মারা গেছে প্রায় দু’বছর হয়, একবার দেশে আয়, ঘুরে যা “… আমি গেলাম না। ক’মাস বাদে হুট করেই দেশে গিয়ে হাজির। মা’য়ের আকস্মাৎ মৃত্যু সংবাদে এ যাওয়া। দাদার বাড়িতে দোয়া পড়ানো হচ্ছে, গরীবদের খাওয়ানো হচ্ছে। উঠোনে বিশাল শামিয়ানা টানানো হলো। ভোর থেকেই বাড়িময় কোলাহল, লোকে লোকারণ্য। দূর দূরান্ত থেকে আমার ফুফু, ফুফাতো ভাই বোনেরা এলো। অন্য স্বজনরা এলো। থম্থমে পরিবেশ।
ফুফু আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বললো, ” তোর মা কত যত্ন করে তোদের বড় করল, ক্যামনে এই আদরের সন্তানগুলিরে রাইখা একলা চইলা গেল”। কেউ কেউ বললো, “মন খারাপ কইরো না, তোমার মা আল্লাহ্র নেক বান্দা ছিল। রোগে ভুগে নাই, রোগশয্যায় কাউরে কষ্ট দেয় নাই। আল্লাহ্র কাছে শুক্রিয়া জানাও “! আমি ফ্যলফ্যল করে চেয়ে থাকি। সান্তনার বাণী শুনি। স্বজনদের বিচিত্র এই সহানুভূতির কোন উত্তর খুঁজে পাই না। বাড়ির পিছনের বাগানে গিয়ে একলা বসে থাকি। সারি সারি নারিকেল, সুপারির গাছ। শোঁশোঁ শব্দে উত্তুরে বাতাস বয়। মনে পড়ে, জায়গাটা পরিত্যক্ত পুকুর ছিল। বাবা শখ করে মাটি ফেলে ভরাট করে এই গাছগুলো লাগিয়েছিল নিজ হাতে। গাছগুলো বড় হলো, মন জুড়ানো বাগান হলো। প্রতি শুক্রবারে ভোরের ট্রেনে গ্রামে এসে সারাদিন কাটাতো বাবা। ঠিক এইখানে এমন করে বসে থাকতো, উত্তুরে শীতল বাতাসে।
এখান থেকে একতলা বাড়িটি অস্পষ্ট দেখা যায়, যেখানে একদল স্বজন আমার মা কেমন ভাল মানুষ ছিলেন, কবে কাকে কেমন করে সাহায্য করেছিলেন, সেইসব আলোচনায় মগ্ন। মৃত্যুর পর একজন মানুষকে নিয়ে কতো আয়োজন ! অথচ জীবিত থাকার সময়টাতে আমরা তাঁকে নিয়ে এমন করে ভাবিনা, এমন করে ভালবাসি না। এখন আর মৃত মানুষটিকে নিয়ে কোন আক্ষেপ নেই, অযাচিত আশা নেই, চাওয়া নেই। আছে কেবলই ভালোবাসা !
দিনভর দোয়া পড়ানো হলো, গরীব খাওয়ানো চললো। সন্ধ্যায় আমরা তিনটি এতিম ভাইবোন বাবা-মা’র কবরের পাশে ক্ষণিক নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকলাম। অতঃপর শহরে ফিরে এলাম। বাবার বাড়ি। অনেক কষ্টে শিষ্টে বানানো চারতলা বাড়িটি যেন অশ্রুসজল হয়ে বিষণ্ণ, এক্লা দাঁড়িয়ে। আমার জন্ম, বেড়ে উঠা স্মৃতিময় বাড়ি। আলমিরায় মায়ের শাড়িগুলো ভাঁজে ভাঁজে সাজানো। মা যেমন করে গুছিয়ে রেখেছিলেন, ঠিক তেমনই আছে তখনো। সেখানে মায়ের গায়ের মিষ্টি গন্ধ, আমার চিরচেনা সেই মিষ্টি গন্ধ ! মায়ের আকুতি কানে বেজে উঠলো__ “একবার আয়, এসে ঘুরে যা, মন হালকা হবে “। সে-ই তো এলাম ! মন হালকা হয়নি, ভারী হয়ে আছে। খু-উ-ব ভারী। এতো ভারী যে, শ্বাস নিতে পারি না !
মায়ের আকুতি শুনিনি, এই অতৃপ্তি সমস্ত দিন আমায় কাঁদালো।
রাতেও ঘুম এলো না। বাতাসে বাইরের ল্যাম্পপোস্টের আলো আর বিদ্যুতের তারের নড়াচড়া পর্দার ফাঁক ফোঁকর গলিয়ে ঘরের মেঝেতে আঁকিবুঁকি ছায়া ফেলে চললো রাতভর। এই ঘরে আমার মা সারারাত জেগে প্রার্থনা করতো আমাদের মঙ্গল কামনায়। এই খাট, এই চেয়ার, দক্ষিণের জানালা…। এখানে বসে ফজরের নামাজ শেষে কোরআন তেলওয়াত করতো, পৃথিবীর কোন অশুভ, অমঙ্গলই যেন আমাদের তিন ভাইবোনকে স্পর্শ করতে না পারে। আমি অন্ধকারে সেই আশ্রয়টুকু খুঁজে ফিরি। নিভৃতে কাঁদি। প্রার্থনা করি।
উত্তাল সাগরেও একসময় ভাটার টান হয়। অবিশ্রান্ত বৃষ্টিও একসময় থামে।
নিজেকে প্রবোধ দেই, জীবন তো মৃত্যুরই প্রতিশব্দ ।
আমি ফিরে আসি বাস্তবের পৃথিবীতে। হিমেল বাতাস আর অচেনা আকাশের সামনে।
জীবন চলে জীবনের নিয়মে, আর সময় এমন করেই খেলে যায় জীবন নিয়ে কাল, মহাকাল।
অন্যলোকে ভালো থাকো মা।
দেখা হবে আবার আমাদের অদেখা এক পৃথিবীতে।
ক্ষণিকের এই জীবন নিয়ে আমাদের কতোই না অহংকার, তাই না ?
শুভকামনা সকলকে…
পৃথিবীর তাবৎ মায়েদের জন্যে ভালোবাসা …
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
২৬টি মন্তব্য
ইকবাল কবীর
ক্ষনিকের এই জীবন নিয়ে কত আয়োজন আমাদের তা হিসেব করে শেষ করা যাবে না, ভাল থেকে আরো ভাল থাকার জন্য আমরা প্রতিনিয়ত সামনে এগিয়ে যাই তারপর এক সময় পিছনে ফিরে দেখি সব ফাকা। ভাল লেগেছে আপনার লিখা পড়ে। মায়ের কথা মনে পড়ে গেল।
রিমি রুম্মান
শুভকামনা রইল।
ভাল থাকবেন প্রিয়জনদের নিয়ে।
জিসান শা ইকরাম
মায়ের অভাব কোনোকিছু দিয়েই পুরন হয়না
মা নেই এমন চিন্তা করলেই বুকের ভিতর কেমন এক শূন্যতা এসে গ্রাস করে।
আজকের মা দিবসে আপনার এই লেখা ভিন্ন মাত্রা এনে দিয়েছে।
আপনার আব্বা মা কে আল্লাহ্ বেহেশত নসীব করুক……… আমীন।
পৃথিবীর তাবৎ মায়েদের প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা -{@
রিমি রুম্মান
মা দিবসে সকল মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা।
ব্লগার সজীব
এমন লেখা আপনাকেই মানায় আপু। মা দিবসে আপনাকেও শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা। পৃথিবীর সকল মা ভালো থাকুক।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুক আমাদের সকলের মা।
ভাল থাকুন আপনিও।
শুভকামনা…
মৌনতা রিতু
মা যেখানেই থাক ভাল থাক।
মা আমার মা। বাসায় গেলে নানা অজুহাতেই অকারনেই ডাকি, ওমা ওমা মা ওমা। আমার মা প্রতিবারই উত্তর দেয়। জানে সে বিনা কারনেই ডেকে যাচ্ছি তাকে।
রিমি রুম্মান
অসুস্থ হলেই মা বলে ডাকতে থাকি।
ব্যথা পেলেই মা গো বলে ডেকে উঠি।
মা যে কত বড় আশ্রয়, নির্ভরতার মানুষ এটি বলে শেষ করা যাবে না।
ভাল থাকুন। অনেক ভাল।
সঞ্জয় কুমার
লেখাটি পড়ে মনটা অনেক খারাপ হয়ে গেল ।
মৃত্যুর পর মানুষ যেটা দেখায় এটা ভালবাসা নয় সহানুভূতি করুণা ।
যে ভালবাসা মরার পর দেখায় । তার চার ভাগের একভাগও জীবিত থাকতে দেখালে মানুষটা হয়তো আরও কিছুদিন বেশী বাঁচতো ।
রিমি রুম্মান
জীবিত মানুষটিকে ভালোবাসা জরুরী। কিন্তু এই কাজটিই আমরা বুঝি মৃত্যুর পর। তবে এ নিয়ে আমাদের ভাই বোনদের আক্ষেপ নেই। কেননা, আমরা মা’কে কখনো কষ্ট দিয়ে কথা বলিনি। ভাল থাকুক আমাদের সকলের মা।
লীলাবতী
এমন মায়া দিয়ে লেখেন যে চোখে পানি এসে গেলো। মা এর জন্য কেমন এক হাহাকার, কেমন এক কষ্ট জমাট বেঁধে গেলো আপু। আপনার মা বাবা জান্নাতে স্থান পাক। আপনি সহ পৃথিবীর সকল মায়েরা ভাল থাকুক।
রিমি রুম্মান
বাবাকে হারিয়েছি ছয় বছর আগে। আর মাকে চার বছর আগে। তবুও সবকিছু কত জীবন্ত ! যেন চোখ বুজলেই দেখি তাঁদের। যেন এখনো মায়ের গায়ের মিষ্টি গন্ধ পাই সে কাঁথাটিতে, যেটি মা বানিয়ে রেখেছিল আমার জন্যে। যেটি গায়ে দিয়ে আজও আমি ঘুমাই।
ভাল থাকুন আপনি। ভাল থাকুক আমাদের সকলের মা।
নাসির সারওয়ার
কত সহজে কঠিন কথা বলা।
সব মায়েদের জন্য শুভেচ্ছা।।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুক, সুস্থ থাকুন।
ভাল থাকুক আমাদের মায়েরা।
খসড়া
চমৎকার ঝরঝরে লেখা। খুব উপভোগ করলাম।
রিমি রুম্মান
মা দিবসের শুভেচ্ছা।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
আপনার আব্বা মা কে আল্লাহ্ বেহেশত নসীব করুক আমীন -{@পৃথিবীর যোগ বিয়োগের পিতা মাথার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা -{@
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন আপনিও।
ভাল থাকুক আমাদের সকলের মা।
মোঃ মজিবর রহমান
মা অপারেতে চলে গেছে
রেখে গেছে তাঁকে আল্লাহ বেহেস্ত নসিব করুন আমিন।
মুহাম্মদ আরিফ হোসেইন
আলহামদুলিল্লাহ্!
আমার মা এখনো আছে। জগতের শ্রেষ্ঠ সম্পদ আমার এখনো আছে।
দীপংকর চন্দ
মন ছুঁয়ে গেল অনুভূতির প্রকাশ।
//উত্তাল সাগরেও একসময় ভাটার টান হয়। অবিশ্রান্ত বৃষ্টিও একসময় থামে।
নিজেকে প্রবোধ দেই, জীবন তো মৃত্যুরই প্রতিশব্দ ।//
যাঁঁরা মা, এবং ভবিষ্যতে যাঁঁরা মা হবেন, সকলের জন্য শ্রদ্ধা এবং শুভকামনা।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
‘মা’ নেই মানে এক অপূরণীয় শূন্যতা এসে ভর করে। দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ আশ্রয়স্থল মা।
ছায়াদানকারী এক বটবৃক্ষের নাম ‘মা’
পৃথিবীর সকল মায়ের প্রতি রইলো শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা (3
আমার মায়ের জন্য দোয়া করবেন।
অপার্থিব
হৃদয় ছুঁয়ে গেল লেখাটি। ভাল থাকুক পৃথিবীর সকল মা।
নীলাঞ্জনা নীলা
“মা”হীন মেয়েদের জীবন যেনো শূণ্যতায় ভরা। অনুভব করি সেই সব সন্তানদের যন্ত্রণা যাদের বাবা-মা নেই।
রিমি আপু কিছু বলার নেই।
ভালো রেখো নিজেকে। -{@
সালমা আক্তার মনি
আমিতো মাকে হারিয়েছি ছোট বেলাতেই, মা না থাকার কষ্ট আমি বুঝি রিমি আপু। পৃথিবীর কোন পূর্নতা দিয়ে এ শুন্যতা পূরণ হয়না।
সকল মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা নিরন্তর।
ইনজা
“অন্যলোকে ভালো থেকো মা” মনটা হু হু করে উঠলো, মাকে কোন ভাষায় বিশ্লেষণ করা যায়না মা এমনই, মার কথা বলে শেষই করা যায়না।
মার জন্য আল্লাহর দরবারে দুহাত তুলে দোয়া যেন তিনি মাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন, আমীন।