পড়তে শেখার পর থেকেই মোটামুটি ছাপার অক্ষরে যাই পাই গোগ্রাসে গিলি। হোক সেটা ছোট বোনের গার্হস্থ্য অর্থনীতির বই কিংবা হোকনা আ ব্রিফ হিস্টরি অফ টাইম, বই হলেই হলো।
আমার বাবা, মফস্বলের স্বল্পশিক্ষিত ছোটখাট ব্যাবসায়ী। আমি তার একমাত্র ছেলে, কার্যোপলক্ষ্যে রাজধানীতে যেতেন তিনি, আজো যান। কিন্ত সেই নব্বইয়ের দশকের শুরুর মতোই আজো তার মন টেকেনা সেখানে। দ্রুত ফিরবার তারা তাকে প্রোয়জনীয় অনেক কিছুই কিনতে বা নিয়ে নিতে ভুলিয়ে দেয়। কিন্ত একটা জিনিস ভুলায়না কখনো – সেটা হচ্ছে প্রিয় পুত্রের জন্য নেয়া বই। কতশত বই, রুশ সাহিত্যের অনুবাদ, সাইন্স ফিকশন, ইতিহাস, এমনকি উনি আমাকে মোটর সাইকেল ডায়েরী পর্যন্ত এনে দিয়েছিলেন। সেই যে কিশোর টি বইয়ের জানালায় তাকিয়ে বিশ্ব দেখার শুরু, চলছে আজো। উনি অসম্ভব ধর্মভীরু মানুষ ,আজ পর্যন্ত উনাকে কোন ওয়াক্তের নামাজ কাজা হতে দেখিনি। মজার ব্যাপার হচ্ছে অবিশ্বাস বিষয়ে পড়া আমার প্রথম বই ”ভুত ভগবান শয়তান বনাম ডঃ কোভুর” উনার কিনে দেওয়া। তখন ক্লাস টেনে পড়ি।
তারপরের জন, চপল ভাই- এলাকার বড় ভাই, বর্তমানে ঢাকায় জজ কোর্টে প্র্যাকটিস করেন। তার ছিল বইয়ের বিশাল সংগ্রহ। এক কিশোরের সামনে উনি খুলে দিলেন এক আশ্চর্য মায়ার জগত। টানে সবাইকে বাধনে জড়ায় না। উনার নিয়ম ছিলো বই নেয়া যাবেনা, উনার রুমে বইসা পড়তে হবে। উনি মাঝে মাঝে রুমের তালা খুলে রেখে বলতেন বাইরে যাইতাছি পড়া শেষ হইলে রুম তালা দিয়া রাইখা যাইস। এবং সেলফে তালা দিয়া রাইখা যাইতেন , দুইটা পড়ার জন্য একটা বই থাকতো হাতে আরেকটা জামার ভেতরে লুকানো :p এবং ভাইয়ের বইয়ের সংগ্রহ ছিলো বিচিত্র, মাসুদ রানা তিন গোয়েন্দা থেকে এস্ট্রোলজী নিউমারলজী সব। উনার কাছেই আমার কামু, কাফকা এদের চেনা। হাতে ”দ্য আউটসাইডার” তুলে দিয়ে বলেছিলেন – পড়,পরে কাজে দিবে।
এবং জুয়েল ভাই – আমাদের গ্রামের স্কুলের থেকে বোর্ড স্ট্যান্ড করা ছাত্র। বর্তমানে এনটিভির অনলাইন হেড। এই লোকের কথা না বললে অন্যায় হবে, এজন্য যে উনিই আমাকে শিখিয়েছেন বইয়ের কোন বড়দের ছোটদের হয়না, মানসিক পরিপক্কতার বেশকম হয়। উনার ও ছিলো বিশাল বইয়ের সংগ্রহ। দুপুরের রোদ মাথায় করে কতদিন মাইল তিনেক হেটে উনাদের বাড়ি গেছি বইয়ের জন্য।
বই পড়ার অভ্যাস অনেক ঝামেলা থেকেও বাচিয়েছে, অনেকবার। তখন এয়ারফোর্স এ জব করি, ইন্সপেকশন প্যারেডের দিন বেস কমান্ডার আসছেন রুম ইন্সপেকশনে। যথারীতি ব্যারাকের সবচেয়ে অগোছালো রুম আমার দরজা থিকাই চোখ লাল কইরা রুমে ঢুকলেন স্যার ….. এবং টেবিলের সামনে আসার পর উনি একবার টেবিলের দিকে একবার আমার দিকে তাকায়ে চুপচাপ চলে গেসিলেন এবং পরে পিওন পাঠায়ে ডাইকা নিয়া বিকালে প্রায় আধাঘন্টা গল্প করছেন। টেবিলের উপরে আধাখোলা ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট আর বেডের উপ্রে উল্টানো ছিলো কম্প্যানি অফ উইমেন।
আইরনি ইজ – স্যারের কাছ থেকে আনা কারেনিনা পড়তে নিছিলাম আর ফিরত দেই নাই।
বই কিনতে কিনতে বইয়ের দোকানদার মামাদের সাথে খাতির হইয়া যাইত। যেমন ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমার সামনের স্টল ওয়ালা মামা। নতুন মাসুদ রানা আসলেই উনি এককপি আলাদা করে রেখে দিতেন , সব কপি ফুরায়া গেলেও অইটা কাউকে দিতেন না। উল্টোদিকে যশোরের রেলওয়ে বুকস্টলের মামা, আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরী আইনা দিব বইলা পঞ্চাশ টাকা অগ্রীম নিছে – বইও আইনা দেয় নাই, টাকাও না , দুনিয়া নিষ্ঠুর জায়গা ।
এখন বই পড়ি কম্পিউটার স্ক্রিনে। পাতা উল্টানোর বদলে এরো তে ক্লিক করে, কিন্ত দুপুর বেলা খাওয়ার পরে কাত হয়ে বইয়ের পাতা উল্টানোর মতো মজা দুনিয়ার আর কোন কাজে আছে ?
২৪টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
পড়লাম বই পড়া সমাচার।
মাসুদ রানা পড়ার মত আর কোন বই পড়ে মজা পাইনাই এখন পর্যন্ত।
বেশুশ হইয়া ঐ একটা বই ই পড়তাম, কিসের নাওয়া আর কিসের খাওয়া।
কম্প্যানি ওফ উওম্যান আশাকরি কোন কাজে লাগে না 🙂
বই নিয়ে ফেরত না দেয়া মনে হয় একটা রীতি।
আমার একটা আলমিরা বোঝাই বই, ইন্টার পড়ার সময় গায়েব হইয়া গেছে।
বিএম কলেজে ছাত্রাবাসে থাকার সময়–
কি ছিলোনা সেখানে ? দস্যু বনহুর থেকে শুরু করে মা,ওয়ার এন্ড পীস, হাদিস, কম্যুনিস্ট দের সব মতবাদ 🙁
ভালো লেগেছে স্মৃতি রোমান্থন ।
সাইদ মিলটন
মাসুদ রানা পড়ার মত আর কোন বই পড়ে মজা পাইনাই এখন পর্যন্ত।
– আমিও না দাদা, এখনো নাওয়া খাওয়া বাদ্দিয়া পড়ি 😀
কম্প্যানি ওফ উওম্যান আশাকরি কোন কাজে লাগে না
– দাদা :D) :D)
ছাইরাছ হেলাল
আপনি খুব দুষ্ট !
সাইদ মিলটন
😀 😀
আমার একটা স্মৃতিচারণ সিরিজ আছে পিচ্চি বান্দর নামে , খারান ঐডা এই ব্লগেও দিমু :D)
মামুন
”দ্য আউটসাইডার” পড়েছি।
এ পর্যন্ত অনেক কিছুই পড়েছি। সব কিছুতেই মজা পেয়েছি, স্রেফ ভার্সিটির আমার সাবজেক্টের বইগুলো ছাড়া।
অনেক ধন্যবাদ সুন্দর পোষ্টটির জন্য। -{@
সাইদ মিলটন
আপনাকেও ধন্যবাদ পড়ার জন্য ভাই -{@
ছাইরাছ হেলাল
আমি পড়তে পছন্দ করি, এখনো পড়ি আর পড়ি ,প্রায় সর্বভুক শ্রেনীর পাঠক। শুয়ে নয়, টেবিল-চেয়ারে বসে পড়ি,নোট রাখি,হার্ড ও সফট।
একটি ঘটনা না বলে পারছি না। একবার দেশের বাইরে চলে যাবার ভাবনা থেকে আমার সংগ্রহের সব বই বিলিয়ে
দিয়েছিলাম। যাওয়া হয়নি। কিছু বই আর সংগ্রহ করতে পারিনি।তবে এখন বেশ ভারী সংগ্রহ মোটামুটি।
সাইদ মিলটন
আমি নোট নিতে পারিনা , ইনফ্যাক্ট পড়ার সময় আর কিছুই করতে পারিনা 🙁
ইভেন কেউ কথা কইলেও প্রচন্ড বিরক্তি লাগে 🙁
দেশে আসলে পড়তে দিয়েন আপনের সংগ্রহ থেকে (রিফান্ডেবল)
ব্লগার সজীব
পড়লাম আপনার বই পড়ার ইতিহাস। আমারটা একদম মেরে মেরে। যা পড়াশুনা এখন করি ব্লগে :p
সাইদ মিলটন
ব্লগ্নিং করতে গেলে অবশ্যই পড়াশোনা করতে হয় , নিজের জন্যই করতে হয় আপনিও নিশ্চই ব্যতিক্রম না 😀
খেয়ালী মেয়ে
আমার কাছেও কম্পিউটারে বই পড়তে ভাল লাগে না…
পাতা উল্টিয়েই বই পড়ে মজা 🙂
সাইদ মিলটন
হ্যাঁ দুনিয়ায় না পড়া বইয়ের ঘ্রাণের মতো সুন্দর আর কি আছে 😀
শুন্য শুন্যালয়
বই বই বই, কই গেলি তুই? এখন চোক্ষে Murtagh ছাড়া আর কিচ্ছু চোক্ষে দেখিনা।
অনলাইনে এখন আঙ্গুল হইছে কার্সার। বোনের ভয়ে পরীক্ষার আগে বিজ্ঞানের বই এর ভিত্রে বই পড়ার মজা ছিল সবচেয়ে বেশি।
আপনার পিচ্চি বান্দর সিরিজের অপেক্ষায় থাকলাম।
সাইদ মিলটন
“My mind is the only sanctuary that has not been stolen from me” :p
আম্মো পড়ার বইয়ের মইধ্যে লুকায়ে কত পড়ছি বনহুর আর রানা 😀 উই অল আর সেম 😀
শুন্য শুন্যালয়
Mind!!!!!! সে আবার কি জিনিস?
সাইদ মিলটন
সে এক অদ্ভুতুড়ে জিনিস 🙂
কখনো সে রূপ নারায়ণ কূলে শূন্যের ভেতর ঢেউ তোলে
কখনোবা বা আয়ুধ তুলে নিয়ে হয় সর্বসংহারী – পাঞ্চজন্য, দেবদত্তের মিলিত নির্ঘোষে কখনো সে ঘোষণা করে কুরুক্ষেত্র 🙂
হয়তোবা সে মহালয়াতেই বাঁজায় বিসর্জনের সুর 🙂
মরুভূমির জলদস্যু
বইয়ের ব্যাপারে আমিও প্রায় সর্বভূক।
প্রচুর বই হারিয়েছে অন্যকে পড়তে দিয়ে, অনেকের কাছে চেয়েও ফেরত পাইনি, সে তার নিজের বক সেল্ফে সাজিয়ে রেখেছে।
সাইদ মিলটন
সবাই মার্ক টোয়েন 😀
নুসরাত মৌরিন
প্রযুক্তি যতই আগাক পাতা উলটে বই পড়ার আনন্দ সে কখনোই দিতে পারবে না।
পৃথিবীতে বই এর মত ভাল সঙ্গী আর কিছুই নাই।আমার বই ও আমি ওই ভাইয়াটার মত সেলফে তালা দিয়ে রাখি।পড়তে দিই,তবে এক-দুই সপ্তাহ্র বেশি রাখতে দিই না কাউকে।ইতি মধ্যে দুই তিনশো বই জমা করে ফেলেছি।এর মধ্যে কয়েকটা কারো কারো কাছ থেকে এনে আর ফেরত দিই নাই। 😀
আমার ভাইদের কল্যানে মাসুদ রানা আমারো অনেক পড়া হইছে কিন্তু কেন জানি ছেলেদের মত মেয়েরা মাসুদ রানার এত পাগল ভক্ত হয় না। আমিও হই নাই !! :p
বই পড়ার গল্পগুলো শুনতে ভাল লাগে।আরো লিখুন। 🙂
সাইদ মিলটন
হ্যাঁ কাগজের বইয়ের পাতা উলটে পড়ার মতো মজা আর কিছুতেই নেই 🙂
সাব্বাস আপনিই পারবেন আপনার বইয়ের কালেকশন বড় করতে 😀
মাসুদ রানা আসলে একটু বেশীই পুরুষালী :p
শিশির কনা
পাতা উল্টিয়ে বই পড়ার মজাই আলাদা ভাইয়া।নষ্টালজিক হয়ে গেলাম।
সাইদ মিলটন
হুম বইয়ের পাতা উলটে পড়ার মতো মজা আর কিছুতেই নেই 🙂
নওশিন মিশু
আমার জন্য শ্রেষ্ঠ বিনোদন হচ্ছে বই পড়া (Except text book)। আম্মুকে ফাঁকি দিয়ে খাটের নিচে শুয়ে গল্পের বই পড়ার ইতিহাসও আছে আমার। পড়ার দিক থেকে আপনি বেশ ধনী মনুষ ….. 🙂
সাইদ মিলটন
লিখেন সেই কাহিনী , প্লিজ প্লিজ প্লিজ 😀
নাহ আমি বেশী ধনী না নিম্নবিত্ত 🙁
কত বই পড়ার বাকী 🙁 🙁