জ্ঞানের কান্ডারী শিক্ষক...
জ্ঞানের কান্ডারী শিক্ষক…

পল্লব স্যার – স্যার কলেজে আমাদের জীববিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন। স্যার ক্লাশে আসতেন, খুব সুন্দর করে বোঝাতেন। আমার খুব ভালো লাগতো স্যারের ক্লাশ। পল্লব স্যারও আমাকে বাসায় পড়াতে আসতেন ক্লাশ শেষ করে বিকেল পাঁচটার সময়। স্যারের বাসা ছিলো সিলেট শহরে। রোজ সকালে কলেজে আসতেন আর বিকেলে আমাকে পড়িয়ে সন্ধ্যার পাহাড়িকা ট্রেন ধরে সিলেট যেতেন। ওহ বলে নেই সাধু বুড়া আবার স্যারের নাম দিয়েছিলো “গাছ স্যার।” আগেও বলেছি সাধু বুড়ার এসব নাম শুনে কোনো স্যারই রাগ করতেন না। যাক বাসায় এলে অনেক গল্প করতাম স্যারের সাথে। শুধু যে বইয়ের বোটানি-জ্যুওলোজি এসব নয়। পৃথিবীর অসংখ্য প্রজাতি সম্পর্কে আমার জানার আগ্রহ খুব বেশী ছিলো। স্যার একঘন্টার জন্য পড়াতে এসে এমনও হয়েছে ২/৩ ঘন্টা পড়িয়েছেন। অনেক জ্ঞানী ছিলেন স্যার। কিন্তু কেউই বুঝতে পারেনি।

যাক একবার কি হলো স্যার আমায় বললেন, “নীলাঞ্জনা সামনের সপ্তাহে তিনদিন আমি আসবো না, ঢাকা যাবো। এসে পরীক্ষা নেবো।” শুনে খুব খুশী মনে মনে। স্যারকে আমার জমানো টাকা দেবো একটা ওয়াকম্যান কিনে আনার জন্যে। বললাম স্যার আমি টাকা জমিয়েছিলাম, কিন্তু ঢাকায় কেউ যাচ্ছেনা। আপনি কি আমার জন্যে ওয়াকম্যান কিনে আনবেন? জমানো আটশ’ টাকা দিলাম। তারপর অপেক্ষা তিনদিন পর স্যার এলেন ওয়াকম্যান নিয়ে। কি যে খুশী! আমার এই ওয়াকম্যান দেখে বন্ধু বললো এটা নাকি আটশ’ না, নয়শ’ টাকা। স্যার অবশ্য পরে স্বীকার করলেন, কিন্তু কিছুতেই আর একশ’ টাকা নিলেন না।

স্যারের চরিত্রের একটা দিক উনি সৃষ্টিকর্তা মানেন না। কিন্তু কাউকে প্রেশারও দেননা না মানার জন্যে। স্যার ধর্মগ্রন্থ নিয়ে বাজে সমালোচনা করতেন না। শুধু বলতেন সৃষ্টিকর্তা যদি থাকেন তাহলে কেন তাকে তুষ্ট করতে হবে? কেন তুষ্ট না করলে তিনি আমাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করবেন না? সেসময় রাষ্ট্রপতি ছিলো এরশাদ। স্যার বললেন, “এরশাদ আর সৃষ্টিকর্তার মধ্যে তাহলে পার্থক্য কি? দুজনেই স্বৈরাচারী।” আজ চিন্তা করি এই কথা যদি এখন উনি বলতেন, তাহলে কি হতো সে কি আর বলতে হয়! শুনেছি স্যার রিটায়ার্টমেন্টে চলে গেছেন। খুব অসুস্থ নাকি। স্যার ছিলেন ব্রহ্মচারী, বিয়ে করেননি। স্যার মামনি-বাপির সাথে গল্পে গল্পে বলেছিলেন উনি আর উনার বাবা থাকেন। অসম্ভব পিতৃভক্ত একজন মানুষ, ঠিক আমার বাপিরই মতোন। ইন্টারের রেজাল্টের পর স্যার বলেছিলেন যা আমার মন বলে, সেটা নিয়েই যেনো পড়ি। কে কি বললো তা নিয়ে যেনো না ভাবি।  খুব ভালো লেগেছিলো স্যারের এ কথাটা। খুউব ভালো।

সুনীল স্যার – আমাদের কলেজের ইংরেজীর শিক্ষক। স্যারকে দেখে বোঝাই যেতো না কি জ্ঞান ধারণ করে আছেন উনি। অসম্ভব সহজ-সরল মনের মানুষ, আর খুব সাধারণ উনার চলাফেরা। প্রথম যেদিন স্যারের ক্লাশ করি, ভেবেছিলাম মফঃস্বল শহরের কলেজে এমন আর কি ধরণের শিক্ষক পাওয়া যাবে! কিন্তু ক্লাশ শুরুর সাথে সাথেই এই ভুল ভাঙ্গলো। উনি পাঠ্যবইকে এমন ভাবে সরিয়ে রাখতেন, গল্প করতেন। আর হেসে হেসে ক্লাশ নিতেন। গ্রামার মুখস্থ করতে হয়নি, এমনভাবেই পড়াতেন। স্যারের পড়ানোটা বাপির মতো। একদিন বললাম স্যার আমাদের বাসায় আসবেন? আসলে বাপি-মামনির সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো, তাই। স্যার টিউশনি করাতেন না। উনি বাসায় এলেন, বাপি-মামনির কাছে বললেন স্যার আমাকে পড়াতে চান। তাও সপ্তাহে শুধু শুক্রবারে কলেজ ছুটির দিন। স্যারকে টাকা দেয়াই যেতোনা। শেষে জোর করে দেয়া হলো তাও মাসে ৫০০৳। যাক সাধু বুড়া এই স্যারের নাম দিয়েছিলো “সাইকেল স্যার।” স্যার বাইসাইকেল চালিয়ে আসতেন।

সেই ইন্টারে পড়া অবস্থাতেই অনেক বিলুপ্ত উপন্যাস সম্পর্কে জেনেছিলাম। আর বেশ কিছু লেখকের গল্প যাঁরা মৃত্যুর পর সুলেখক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। স্যার আমাকে কয়েকটি বইয়ের নাম দিয়েছিলেন সেই সময়, বলেছিলেন কিনে নিতে। যদিও ওসব বই আমি ঢাকায় তন্ন তন্ন করেও খুঁজে পাইনি। একটা বই শুধু পেয়েছিলাম তাও কলকাতায় কলেজ স্ট্রীটে। ওসব বইয়ের নাম মনে নেই। স্যার আমায় অনেক মেধাবী ভাবতেন। আর তাই গল্পও করতেন ইংরেজীতে। একদিন বললাম স্যার একটা কথা বলবো? স্যার বললেন, “বলো।” বললাম যেদিন প্রথম আপনাকে ক্লাশে দেখি ভেবেছি আপনি কি আর ভালো করে শেখাবেন ইংরেজী! স্যার হেসে বললেন, “নীলাঞ্জনা আমি ঠিকই তো ভালো করে শেখাতে পারিনা। পারলে কি আর পরীক্ষায় আমার ছাত্ররা ফেল করে? বরং তোমাদের থেকে শিখি আমি।”

ইন্টারের রেজাল্টের পর স্যার বাসায় এলেন। অনেকক্ষণ মাথা নুয়ে ছিলেন। তারপর আমায় বললেন, “রেজাল্ট কিছু না। তুমি কাকে, কতোটুকু শেখাতে পারো এটাই বড়ো কথা। তোমার শেখা থেকেই শিখবে অন্যেরা। কথাটা মনে রেখো।” হুম আমি মনে রেখেছি। স্যারের সাথে আমার শেষ দেখা হয় সুজা মেমোরিয়াল কলেজে শিক্ষকতা শুরু করি যখন। চাকরী পাবার পর কলেজে গিয়েছিলাম, তখন স্যারকে প্রণাম করেছিলাম। খুব খুশী স্যার আমিও যে কলেজের শিক্ষক হয়েছি। সেদিন আমি আরেকটি কাজও করেছিলাম আমাদের পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক বাসিত স্যারকে বলেছিলাম, স্যার আপনি আর আমি এখন দুজনেই দুই ভিন্ন কলেজের শিক্ষক। শুধু সময় এবং বিষয়ের হিসেবে পার্থক্য আপনি পদার্থবিজ্ঞানের সিনিয়র লেকচারার আর আমি বাংলার জুনিয়র লেকচারার। সেদিন পল্লব স্যার, সুনীল স্যার ছিলেন রুমে। এতো বেশী খুশী হয়েছিলেন আমার ওই কথায়। যখন রুম থেকে বেড়িয়ে আসি সুনীল স্যার এলেন আমায় বললেন, “এই সত্যি বলার সততা ধরে রেখো। হুম যারা তোমার সত্যি নিতে পারবে না, মনে রেখো তারাই তোমার শত্রু।”

**বাসিত স্যার আমাকে বিভিন্নভাবে ছোট করতেন। জানিনা কেন জানি আমাকে দেখতেই পারতেন না। পরে বিশ্বজিৎ স্যার এসে আমাকে বললেন বাসিত স্যার এমন করেন কারণ উনার কাছে আলাদাভাবে পদার্থবিজ্ঞান পড়িনা তাই। তখন জেনে মাথায় আগুণ জ্বললো। হঠাৎ একদিন দেখি বাসিত স্যার আমাদের বাসায় আমাকে পড়াতে এসেছেন। সত্যি বলতে কি স্যার পড়াতেই পারতেন না। তারপর স্যারকে বললাম আমি কিছুই বুঝছিনা স্যার। যাক স্যার আমার এ সত্যি নিতে পারেননি। ওহ বলতে ভুলে গেছি, সাধু বুড়া এই স্যারের নাম দিয়েছিলো, “থুম্বা স্যার।” যাক প্রাক্টিক্যাল পরীক্ষায় তিনি এমনই নাম্বার দিলেন, তার চেয়ে ভালো হতো ফেল করিয়ে দিলে। পরীক্ষার রেজাল্টের পর বাপিকে এই বাসিত স্যার এসে বললেন, “দাদা নীলাঞ্জনারে দিয়া কিছু হইতো নায়। কমলগঞ্জেই পাস কোর্সে ভর্তি করি দিলাইন। ডিগ্রী পাশ করতে পারবোনি এইটাই আমি বুজরাম নায়। কুনু রকমে পাশ করলে ভালা পাত্র পাইবা বিয়া দেওয়ার লাগি।” বাপি সেদিন বলেছিলো, “স্যার আমার মেয়ে আপনারে কিতার লাগি পছন্দ করে না অখন বুঝছি।”

ক্রমশ

হ্যামিল্টন, কানাডা
১৯ অক্টোবর, ২০১৬ ইং।

বিশ্বজিৎ স্যার – যাঁদের কাছে ঋণী এ জীবন : দশম ভাগ

৪৭২জন ৪৭২জন

২২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ