মাহবুবুল আলম
বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির এই উৎকর্ষতার যুগে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি খোলা রাখতে হলে ভেবেচিন্তে খোলা রাখতে হবে। দরজা জানালা বন্ধ থাকলে তথ্য-প্রযুক্তির সুফল থেকে আমরা বঞ্চিত হবো, তেমনি পুরোপুরি খোলা রাখাও নিরাপদ নয়। কেননা, দরজা জানালা খোলা পেয়ে তথ্যপ্রযুক্তি জগতের যাবতীয় আবর্জনা ও দূষিত গন্ধ আমাদের পরিবেশ ও প্রতিবেশকে আরও বেশি দূষিত এবং এর কু-প্রভাবে প্রভাবিত করে ফেলতে পারে। বিশেষ করে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ইন্টারনেট বা তথ্যপ্রযুক্তির মন্দ দিকগুলোর দিকে বেশি আকৃষ্ট হয়ে সমাজকে আরো মূল্যবোধের অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে, যার আলামত দিনে দিনে প্রকোট থেকে প্রকোটতর হয়ে ওঠছে। তাই আমার আজকের এ নিবন্ধে তথ্যপ্রযুক্তি যুগের সবচেয়ে ক্ষতিকারক ‘পর্নোগ্রাফি’র বিস্তার আমাদের দেশের শিক্ষার্থী ও আগামী প্রজন্মকে কীভাবে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে এ নিয়ে কিছুটা আলোচনা করতে চাই। আসুন বিশেষজ্ঞ ও মনোবিজ্ঞানীরা এ ব্যপারে কি বলছেন তা প্রথমেই-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোবিজ্ঞানী জেফরি সেটিনোভারের মতে, ”আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের বুঝতে সাহায্য করেছে, পর্নোগ্রাফির আসক্তি হেরোইনের মতোই।” বিজ্ঞান গবেষকদের দাবি, যারা অধিক মাত্রায় অশ্লীল দৃশ্য উপভোগ করেন, তাদের মগজের ধূসর পদার্থ উল্লেখযোগ্য হারে কমতে থাকে। ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরীক্ষা থেকে গবেষকরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, অবিরল যৌন দৃশ্য উপভোগ করলে মস্তিষ্কে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হতে পারে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সস্টিটিউটের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. নাসরীন ওয়াদুদ বলেন, আমাদের সমাজে অতি আধুনিক কিছু বাবা মা তাদের সন্তানদের কিশোর বয়সেই হাতে একটি স্মার্ট ফোন কিনে দিয়ে জাতে উঠতে চায়। ফলে বাচ্চারা তাদের ইচ্ছামতো বিভিন্ন সাইটগুলোতে প্রবেশ করে খেয়ালখুশিমতো পার পেয়ে যাচ্ছে। এভাবেই এক্সাইটমেন্টের জায়গা থেকে কিশোররা একটু একটু করে অনৈতিক কর্মকা- ও অপরাধের দিকে পা বাড়ায়। কিশোর-কিশোরীদের এই অতিমাত্রায় আধুনিকতা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য বিপদ বয়ে আনবে।
উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে পর্নোগ্রাফি আসক্তি হলো আসক্তির একটি প্রস্তাবিত মনোবৈজ্ঞানিক মডেল, যার সাহায্যে নেতিবাচক শারীরিক, মানসিক, সামাজিক অথবা আর্থিক পরিণতি ঘটা সত্ত্বেও, কোনো ব্যক্তির পর্নেোগ্রাফি সংশ্লিষ্ট ভোগ্যপণ্যের ব্যবহার দ্বারা তাড়িত অমোঘ যৌন ক্রিয়াকলাপকে ব্যাখ্যা করা হয়।
সমস্যাপ্রবণ ইন্টারনেট পর্নোগ্রাফি দেখা বলতে বোঝায় এমন কোন উপায়ে পর্নোগ্রাফি দেখা যেটি একজন ব্যক্তির জন্য ব্যক্তিগত বা সামাজিক দিক থেকে ক্ষতিকর এবং সমাজের অন্যান্য সদস্যদের সাথে মিথস্ক্রিয়ার জন্য বরাদ্দকৃত মূল্যবান সময় সেটি দেখার পেছনে ব্যয়িত হয়। আসক্ত ব্যক্তিরা হয়ত বিষণ্নতা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, চাকরি হারানো, বেকারত্ব অথবা তাদের সামাজিক জীবনের উপর পর্নোগ্রাফির কুপ্রভাবের কারণে আর্থিক সংকটসহ নানাবিধ অসুবিধায় ভুগতে পারেন।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মোহিত কামাল এর মতে, “একজন মানুষের ভেতর তিন ধরনের শক্তি কাজ করে। উৎস, আকাঙ্খা ও চাহিদা। সেক্ষেত্রে পর্নোগ্রাফির প্রতি আসক্তি সময়ের আগেই শিশুর যৌন চাহিদা বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে তাদের মনস্তত্ত্বের প্রেষণা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।” বিজ্ঞানীগণ দাবি করেন যে, অতিমাত্রায় পর্নোগ্রাফি দেখা অস্বাস্থ্যকর হতে পারে, যদি ব্যক্তিগত ও সামাজিক কারণে কোন ব্যক্তির জন্য এটি সমস্যার কারণ হয়ে ওঠে, যার মধ্যে অন্যান্যদের সাথে যোগাযোগ বিনিময়ের পরিবর্তে পর্নোগ্রাফি দেখার পেছনে অতিমাত্রায় সময় ব্যয় করা অন্তর্ভূক্ত। ব্যক্তিবিশেষ তাদের অতিরিক্ত পর্নোগ্রাফি দেখার ফলে নিজ সামাজিক জীবনে অবনতিস্বরূপ মানসিক অবসাদ, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, পেশাজীবনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, নিম্নমূখী উৎপাদনশীলতা, অথবা অর্থনৈতিক সমস্যার স্বীকার হতে পারেন। পর্নোগ্রাফিতে অতিমাত্রায় আসক্তগণ অধিকহারে একাকিত্ব অনুভব করেন এবং যৌন অভিজ্ঞতাবিহীন পর্ন ভোক্তারা পর্নোগ্রাফিতে প্রদর্শিত ব্যক্তিবর্গের সাথে নিজেদের শরীর ও যৌন ক্ষমতার তুলনা করে আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভোগেন। হ্যালিফ্যাক্সে ইস্টওয়াইন্ড হেলথ এসোসিয়েটসের দুজন সাইকোথেরাপিস্ট তাদের ডাক্তারি অভিজ্ঞতা থেকে বলেন যে, প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিরা অতিরিক্ত পর্নোগ্রাফি দেখার কারণে নিজ সঙ্গীদের সঙ্গে তাদের আবেগজনিত বিচ্ছেদ ঘটতে থাকে, এমন কি যদি সেই ব্যক্তিগণ আবেগী ঘনিষ্ঠতা কামনা করে থাকেন তারপরও। ২০১৪ সালের American Psychological Association (APA) -র একটি প্রতিবেদনে, কারস্টেন ওয়ার বলেন, “এটি পরিষ্কার নয় যে পর্নোগ্রাফি সেই তথাকথিত প্রবাদের মুরগি নাকি ডিম। কোন ব্যক্তি কি একারণেই এর দিকে ঝুকেন যে তিনি তার সম্পর্কের প্রতি সন্তুষ্ট নন? নাকি নারীরা নিজেরাই যৌনতার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন যখন তারা আবিষ্কার করেন তাদের সঙ্গী প্রাপ্তবয়স্ক চলচ্চিত্র তারকাদের সঙ্গেই তাদের উপযুক্ত সময়গুলো কাটাচ্ছে?
পর্নোগ্রাফি বিষয়ে আইন কি বলে তাও জেনে নেয়া জরুরী। পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২ বাংলাদেশের একটি আইন যার মাধ্যমে পর্নোগ্রাফি বহন, বিনিময়, মুঠোফোনের মাধ্যমে ব্যবহার করা, বিক্রি প্রভৃতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রথমে আইনটি প্রস্তাব আকারে (বিল) মন্ত্রী পরিষদ কর্তৃক অনুমোদিত হয়। নবম জাতীয় সংসদের ১ম অধিবেশন চলাকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ২৯শে জানুয়ারি তারিখে বিলটি উত্থাপন করেন। বিলটি পরীক্ষা করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। অতঃপর ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১২ খ্রিস্টাব্দ তারিখে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২ অনুমোদন লাভ করে। এই আইনে পর্নোগ্রাফীর সংজ্ঞার্থ প্রদান করা হয়েছে। বলা হয়েছে, যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কোনো অশ্লীল সংলাপ, অভিনয়, অঙ্গভঙ্গি, নগ্ন বা অর্ধনগ্ন নৃত্য-চলচ্চিত্র, ভিডিও চিত্র, অডিও ভিজয়াল চিত্র, স্থির চিত্র, অঙ্কিত চিত্রাবলী, বা অন্য কোনো উপায়ে ধারণকৃত ও প্রদর্শনযোগ্য বিষয় যার কোনো শৈল্পিক মূল্য নেই তা পর্নোগ্রাফি হিসেবে বিবেচিত হবে। অধিকন্তু, যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী অশ্লীল বই, পত্র-পত্রিকা, ভাস্কর্য, কল্প-মূর্তি, মূর্তি, কার্টুন বা প্রচারপত্র পর্নোগ্রাফি হিসেবে বিবেচিত হবে। এসবের নিগেটিভ বা সফট ভার্সনও পর্নোগ্রাফি হিসেবে গণ্য হবে।
প্রিয় পাঠক এপর্যায়ে চলুন আলোচ্য বিষয়ের গভীরে যাওয়া যাক। আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে, তথ্য-প্রযুক্তির ভয়ঙ্কর নিষিদ্ধ জগতের প্রতি কিশোর-কিশোরী কিংবা স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীদের আসক্তির বিষয়টি এখন আর কোনো লুকনোর মধ্যে থাকছে না। এটি এখন খুবই উদ্বেগের বিষয়। কেননা, এখন সারাদেশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কিশোর ও তরুণরা ক্রমেই আসক্ত হয়ে পড়েছে তথ্য-প্রযুক্তির নিষিদ্ধ কনটেন্ট এর প্রতি। সোজা কথায় বলতে গেলে দেশের উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েরা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অবাধ সুযোগ নিয়ে দেখছে পর্নোগ্রাফির মতো নিষিদ্ধ কন্টেন্ট। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে আমাদের দেশের সত্তর থেকে আশি শতাংশ কিংবা তারও বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী পর্নোগ্রাফি দেখে থাকে। এই ষাট শতাংশের মধ্যে অনেকেই নিয়মিত দেখে থাকে টু এক্স বা থ্রি এক্স রেটেড ছবি। সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা গেছে শিক্ষার্থীদের এই আসক্তি কমছে না বরং দিনে দিনে আরও বেড়েই চলেছে, কেননা, পাঁচ দশ বছর আগেও অনেকেই সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে এসব দেখত। এখন আর সেটার দরকার পড়ে না। কারণ এখন দেশের সিংগভাগ শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে থাকা স্মার্টফোনেই পেয়ে যাচ্ছে পছন্দের পর্নোগ্রাফি। যা ব্লু টুথ, ইউএসবি ড্রাইভসহ নানা ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে পৌঁছে যাচ্ছে এক বন্ধু থেকে আর এক বন্ধুর কাছে। তাছাড়া দেশের বেশির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ে পাঠদান করা হয়ে থাকে। তাই শিক্ষার্থীরা মা-বাবা বা অভিভাবককে বুঝিয়ে বা কোন কোন ক্ষেত্রে ফুসলিয়ে ফাসলিয়ে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, বা ট্যাব কিনে নিয়ে লেখা পড়ার আড়ালে ঘরে বসেই রাত জেগে এসব দেখে যাচ্ছে। এভাবেই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির চোরা¯্রােতে নিমজ্জিত হচ্ছে দিন দিন। এই বিষয়টি আমাদের সমাজে অবক্ষয় ছড়াচ্ছে এটা আজ অনস্বীকার্য জেনেও কিন্তু এর প্রতিরোধে আমরা তেমন কিছুই করতে পারছি না আমরা। এর ফলে দেশে ক্রমাগতভাবে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। পর্নোগ্রাফির আসক্তিতে নৈতিকতার এতটাই অবক্ষয় ঘটেছে যে, প্রায় প্রতিদিনই স্কুলশিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীর ধর্ষিত হওয়া বা মাদ্রাসায় শিক্ষক কর্তৃক ধর্ষণ বা বলৎকারে খবর থাকছে পত্রিকার পাতায়।
বর্তমান সময়ে পর্নোগ্রাফির আসক্তি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর মধ্যে ভয়াবহ বিস্তার লাভ করেছে। অধিকাংশ দেশী-বিদেশী পর্নোগ্রাফি দেখেছে এবং সুযোগ পেলেই দেখে। তাদের বেশিরভাগই মোবাইলে অন নেটে এসব দেখে। যাদের নিজেদের স্মার্ট মোবাইল ফোন নেই তারা বন্ধুদের সঙ্গে পথে আসা যাওয়া, আড্ডা দেয়া বা খেলার ফাঁকে এসব দেখেন। শুধু তাই নয়, শেয়ার ইট, ব্লু টুথ ছাড়াও নানাভাবে তারা এগুলো একে অন্যের সঙ্গে শেয়ার করে। শুধু ভিডিও নয় অডিওতেও ছড়িয়ে পড়েছে অন্ধকারাচ্ছন্ন এই নীল জগত। কানে হেডফোন লাগিয়ে ইউটিউবেই শিক্ষার্থীরা অডিও আকারে শুনছে চটি নামে পরিচিত অশ্লীল গল্প। আকর্ষণ বাড়াতে আবেদনময়ী নারী কণ্ঠে পাঠ করা হচ্ছে যৌনতার গল্প। ঘরের সন্তানটি সবার সামনে বসেই কৌশলে শুনতে সেই কাহিনী। কেউ যাতে বুঝতে না পারে সেজন্য ইউটিউব চ্যানেলে ভাসছে অন্যকোন শিক্ষামূলক বা ফুটবল ও ক্রিকেট খেলার ছবি, অন্যদিকে অডিওতে চলছে অশ্লীল গল্প পাঠ। কানে হেডফোন লাগিয়ে শোনার কারণে কাছে এসেও কেউ দেখে মনে করবে আসলে ছেলে বা মেয়েটি হয়ত শিক্ষামূলক ভিডিও বা খেলা দেখছে। এটির বিস্তার এখন কেবল স্কুল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, এটি ভয়াভহ রূপে ছড়িয়ে পড়েছে লেখা-পড়া বন্ধ বখে যাওয়া ছেলে মেয়ে, এমনকি পরিবারের কর্তাকর্তীদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়েছে পর্নোগ্রাফির ভয়ানক ছোবল। পরিনতিতে দেখো দিয়েছে পরকীয়া, বাড়ছে বিবাহবিচ্ছেদ, ভেঙে তছনচ হয়ে যাচ্ছে অনেকেরই সাজানো সংসার।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিভিন্ন সমীক্ষায় জানা যায়, হাতের মুঠোয় থাকা স্মার্টফোনের সুবাদে পর্নোগ্রাফি হয়েছে আরও বেশি সহজলভ্য। প্রযুক্তির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের কারণে অনলাইনে প্রবেশ করলেই দেখা যাচ্ছে দেশ-বিদেশের নানা ধারার পর্নোগ্রাফি। কিশোর মানসে ভীষণভাবে প্রভাব ফেলছে বিকৃত বাজে কনটেন্ট এর দৃশ্য। এই আসক্তি শিশুদের মাঝে উস্কে দিচ্ছে যৌন সহিংসতা, বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা। মনোযোগের অভাব ঘটছে পড়াশোনায়। ঘটছে সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়। লুপ্ত হচ্ছে বিবেকবোধ। দৈনন্দিন অন্য কাজের প্রতি বেড়ে যাচ্ছে অনাগ্রহ।
একটি বেসরকারি গবেষণায় উঠে এসেছে, রাজধানীতে স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের প্রায় ৭৭ ভাগ কোনো না কোনো ভাবে পর্নোগ্রাফি দেখছে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, বিকৃত যৌন শিক্ষার মধ্যে দিয়ে বেড়ে ওঠা এসব শিশু-কিশোর পরিবার ও রাষ্ট্রের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের সচেতনতার পাশাপাশি সরকারকে কঠোর হবার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, ১৬ থেকে ১৯ বছর বয়সী প্রতি একশ’ ছেলেমেয়ের মধ্যে ৬৬ জনই যৌন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। মনোচিকিৎসকরা মনে করেন, এভাবে ছেলেমেয়েদের মধ্যে পর্নো আসক্তি বাড়তে থাকলে আগামী দুই দশকের মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধ আর ধর্মীয় অনুশাসন বলে কিছু থাকবে না। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক এক জরিপে উঠে এসেছে দেশের ৭৭ শতাংশ কিশোর-কিশোরী পর্নো দেখে। আর এগুলো দেখতে তারা ব্যবহার করছে মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ও ট্যাবের মতো সহজলভ্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস। এছাড়া আজকাল শহর বা গ্রামের অনেক অগ্রসর এলাকার ঘরে ঘরে ব্রডব্যান্ড আর ওয়াইফাই সহজলভ্য হওয়াতে এর বিস্তার বেড়েছে অনেক বেশি।
পর্নো সাইটের প্রতি শিক্ষার্থীদের আসক্তির অন্যতম কারণ হচ্ছে, পারিবারিক শৃঙ্খলা। বাবা-মা তার সন্তানের যতœ ঠিকমতো নিচ্ছে না বলেই শিশুটি সময় কাটাতে গিয়ে পর্নোগ্রাফিতে ঝুঁকছে। পর্নোগ্রাফির মোহজালে সারা পৃথিবী আক্রান্ত হলেও বাংদেশে এর ক্রমবিস্তার সমাজের বুদ্ধিভিত্তিক বিবেককে ভীষণ ভাবিয়ে তোলেছে। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয়টি হচ্ছে বড়দের সঙ্গে ছোটরাও প্রবেশ করছে তথ্য-প্রযুক্তি বা ইন্টারনেটের এই নীল জগতে। আইন ও সমাজের চোখে তা নিষিদ্ধ হলেও এই নিষিদ্ধনীল ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ছায়া সংস্কৃতিতে হয়েছে।
আমাদের দেশে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণে পর্নোগ্রাফি আইন ২০১২ বলবৎ এবং প্রতিরোধে নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও আসছে না কাঙ্খিত সাফল্য। কারণ, ইন্টারনেটে অশ্লীল দৃশ্যনির্ভর কোন কনটেন্ট মুছে ফেলা হলেও আসছে নতুন নামে। আবার পশ্চিমা অনেক পর্নো সাইট আছে যেগুলো চলছে বৈধতা নিয়ে। তাই সরকার চাইলেও বন্ধ করতে পারছে না এসব অনাকাক্সিক্ষত সাইট। অন্যদিকে ইউটিউবে ছেড়ে দেয়া দেশীয় বিভিন্ন ওয়েব সিরিজ বা নাটকের নামেও ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন অশ্লীল কনটেন্ট। সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির কৌশলে এসব ওয়েব সিরিজ ও নাটকে অশালীন সংলাপ এবং অঙ্গভঙ্গিযুক্ত কনটেন্ট সহজেই টানছে ছোট-বড় সবাইকে। অথচ পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ ২০১২ অনুসারে এসব বাজে কনটেন্ট নির্মাতার জন্য রয়েছে শাস্তির বিধান। বিশিষ্টজনরা বলছেন, পর্নোগ্রাফির ভাইরাস থেকে মুক্ত হতে হলে আইনটির যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি প্রয়োজন সামাজিক ও পারিবারিক সচেতনতা। দূর করতে হবে শিক্ষা ব্যবস্থায় যৌন শিক্ষার অভাবজনিত ত্রুটি। শিক্ষাদানের সঙ্গে বাড়াতে হবে সাংস্কৃতিক চর্চা। সব মিলিয়ে পর্নোগ্রাফি থেকে নতুন প্রজন্মকে রক্ষায় প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ।
এই আলোচনায় সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য বিষয় হলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে পর্নোছবির আসক্তি। ইন্টারনেটে পর্নোসাইটের অনিয়ন্ত্রণ খুব সহজেই শিশুদের ঠেলে দিচ্ছে অন্ধকার জগতের দিকে। ফলে দীর্ঘ মেয়াদে এই শিশু-কিশোররাই জড়িয়ে পড়ছে বড় বড় অপরাধের সঙ্গে। তা হলে এথেকে পরিত্রানের কী কোনো পথ নেই, এ এক কথায় এপ্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব নয়, তবে সামজিক সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে এর নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই সম্ভব। যেমন পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রকৃতিবিষয়ক ক্লাব গঠন, অভিনয় ক্লাব গড়াসহ সাংস্কৃতিক চর্চা বাড়াতে হবে। স্কুল-কলেজের ক্যাম্পাসে সম্পূর্ণভাবে ফেসবুক বা ইউটিউব বন্ধ রাখতে হবে। এছাড়া সাইবার অপরাধকারীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। সাইবার অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত হলে তখন যে কেউ এ ধরনের অপরাধ করার বিষয়ে অনেক বেশি সংযত হবে। সর্বোপরি মা-বাবা অভিভাবককে তার সন্তান বা পেষ্যের প্রতি হতে হবে অধিক মনোযোগী, বিশেষ করে আধুনিকায় গা ভাসিয়ে দিয়ে অপ্রাপ্তবয়ষ্ক সন্তানদের হাতে স্মার্টফোন, ট্যাব বা লেপটপ তুলে দেয়া উচিৎ নয়। এটি একটি সম্মিলিত সামাজিক সমস্যা তাই সমস্যা সমাধানে সম্মিল্লিতভাবেই সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
৫টি মন্তব্য
সাবিনা ইয়াসমিন
অনেক দিন পর লেখা নিয়ে এলেন অধ্যাপক সাহেব। পুরোটা পড়ে মতামত রাখবো। আশা করছি আপনি এবার নিয়মিত হবেন। ব্যাস্ততা কমেছে?
তৌহিদ
চমৎকার একটি বিষয় নিয়ে লিখলেন। আমার মতে পর্নোগ্রাফী প্রতিরোধ অসম্ভব তবে নিজেদের সামজিক সচেতনতাই পারে এটি রুখতে। আইন করে এসব বন্ধ হবেনা। এদেশে বন্ধ করবেন তাহলে অন্যদেশ এসব কন্টেন্ট ইন্টারনেটে চালু রাখলে সমস্যা থেকেই যায়। ইন্টারনেটভিত্তিক এসব কন্টেন্ট – ইউটিউব , গুগোল, সব ধরনের এপস, মেমরি কার্ড, এন্ড্রয়েড মোবাইল সব দেশ থেকে তাহলে পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে হবে!! যা সম্ভব নয়।
তাই সামাজিক এবং পারিবারিক সচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই।
জিসান শা ইকরাম
কিশোরদের এই আসক্তি পরবর্তীতে মারাত্মক প্রভাব ফেলে,
স্মার্ট ফোন থ্রী জি নেটওয়ার্ক যখন চালু হয় দেশে তখন এ নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলাম্, লেখাটিতে আশঙ্কা করেছিলাম যে এই থ্রি জি স্পিড এর বিরূপ ব্যবহার শিশু কিশোরদের নষ্ট করে দেবে।
আমাদের দেশে যে কোনো কিছু থেকে আমরা খারাপটাই গ্রহন করি। ভালোটা আর নেই না।
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পোষ্ট দেয়ার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে ভাই।
শুভ কামনা।
মনির হোসেন মমি
এ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ পোষ্ট এটি।আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আগে যাই ছিলো এখন এ অবাদ তথ্যের সময়ে এর ভয়াবহতাকে কন্ট্রোল করা অনেকটা কষ্টকর।বেশী প্রয়োজন এখন অভিভাবকদের নজরধারী ।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
অত্যন্ত সময়োপযুগি একটি পোস্ট।
আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা।