”ধুত্তুরি বালো লাগে না, মা ক্যান যে আমার নাম রাজু রাখলো তা ভাইবা পাই না। ইস্ আমার নামডা বিজয়,,, হুম,,, স্বাধীন রাখলে খুব বালো হইতো। মা কইছে আমার জন্ম নাকি ডিসেম্বর মাসে হইছিল।’ তার চোখে মুখে খুশীর ঝিলিক দিয়ে যায়। রাজু মিরপুর রোড ধরে ধীর পায়ে হাটছে আর মাঝে মাঝে ভাবনার সাগরে বিলিন হয়ে যাচ্ছে। হাতে ধরা পতাকার লাঠি। পিঠে রয়েছে আরো একটা ব্যাগ। তাতে আরো পতাকা আছে। কেউ কেউ এসে তার নিকট হতে পতাকা নিচ্ছে। খুশীমনে পতাকা বিক্রি করছে।
এবার রাজু ডান হাত দিয়ে চুলগুলো পিছনের দিকে ঠেলে দেয়। পিঠের পতাকার ব্যাগটা আবার ঠিক করে নেয়। ’মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবার বয়স নাকি ১৪ বছর আছিল। বাবা নাকি পাকহানাদার আর রাজাকারগো খবর মুক্তিযোদ্ধাগো কইয়া দিত। আর মুক্তিযোদ্ধারা আচ্ছামতো রাজাকার আর পাকীদের প্যাদানী দিত। একবার পাকহানাদাররা ২জন মুক্তিযোদ্ধাকে ধইরা নিয়া গেল । বাবা দৌড়াইয়া অন্য মুক্তিযোদ্ধাগো খবর কইল। আর হক্কলে আইসা ঢিস,,,ইসসসসস, গুরুরুরুমমম কইরা সব কটা পাকী মাইর্যা সাফ কইরা দিল। ঐসময় নাকি ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা মইর্যা গেল। আহারে রে। আমার বাবার পায়ে একটা গুলি আইসা লাগছিল। বাবা গড়াইতে গড়াইতে ঝোপের আড়ালে পইড়্যা আছিল। তা না হইলে কিযে হইতো। বাবারেও মাইর্যা ফ্যালাইতো। কত কষ্টেযে বাবা ঐহান থিকা উইঠ্যা আইছিল। সেই থিকা বাবা আর আগের মত হাটতে পারত না। ইসসিরে আমি যদি ঐ সময় বড় থাকতাম,,, সব কটা রাজাকার আর পাকীদের মাইর্যা সাফ কইর্যা ফালাইতাম। এহন বাবার মত আমার বয়স ১৪ বছর।,,,’ এমন সময় একজন স্কুল ছাত্র আসে, বলে ’একটা পতাকা দেন’। রাজু পতাকা দেয়। রাজুর কথামত সে দাম দেয়। রাজু ভাবতে থাকে ’আমি যদি আবার স্কুলে যাইতে পারতাম, কত্ত কিছু শিখতে পারতাম। বাবা মইরা গেল, আর পড়তে পারলাম না, চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে’। কাঁধে রাখা গামছা দিয়ে চোখ মুছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে স্কুল ছাত্রটিকে ডাক দেয়,’ ও ভাই হুনেন’। ছাত্রটি রাজুর কাছে আসে, বলে ,’ কি বলেন?’ রাজু তার হাতে পতাকার টাকাটা তুলে দেয় এবং বলে,’ এই ট্যাহাটা রাইখা দেন। ট্যাহা লাগবো না। ছাত্রটি বলে,’ টাকাটা আপনি রাখেন।’ রাজু বলে,’ অনেক পতাকা বেছুম, এইট্যা আমি আপনারে এমনিই দিলাম।’ ছাত্রটি খুশী হয়। সে ব্যাগ খুলে পাঁচটি লজেন্স দেয়। বলে,’ এইট্যা আপনি খাবেন।’
রাজু একটা লজেন্স মুখে দিয়ে হাটতে থাকে। ’গ্রামে যখন থাকতাম, কত্ত মজা করছি, একবার ১৬ই ডিসেম্বরে ইসকুলে কত্ত গান, নাটক, খেলা হইল। সবাইরে একটা কইরা পতাকা দিছিল। আমি ৩টি খেলায় প্ররথম হইছিলাম। তহন ৪র্থ শ্রেণীতে পড়তাম। সেইদিন বাড়ি ফিরনের সময় আমি, ফুলকি আর করিম সরিষা খ্যাত দিয়া পতাকা হাতে দৌড়াইতেছিলাম। চারদিকে সরিষা ফুলের গন্ধ, অহ্ কিযে আনন্দ। এমন সময় কান্নার আওয়াজে আমরা পিছন ফির্যা তাকাইলাম। দেহি ফুলকি খ্যাতের আইলের উপরে বইসা কানতেছে। সামুকে পা কাইট্যা রক্ত পড়তেছিল। আমি কইছিলাম, একটুখানি কাটছে তাই কানতোছোস, হাটতে পারতোসোছ না। ঐ দেখলি না নাটকে দেহাইলো, কত্ত জায়গায় গুলি লাগলো, তারপরও যুদ্ধ করতেছে।’ আড়ংএর সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আবার ডাক পড়লো, ’এই পতাকা দাও তো’। একটা পতাকা বেচতে যেয়ে রাজুর ২৫টি পতাকা বেচা হয়ে গেল। ওর মনটা খুবই খুশি হয়ে গেল। মনে মনে বলল,’ ঐ স্কুল ছাত্র মনে হয় দোয়া করেছে। সে এইবার দোকান থেকে একটা সিংগারা খেল, সেভেন আপএর দিকে তার নজর গেল। খুব লোভ হলো একটা সেভেন আপ খেতে। রাজু ভাবলো, নাহ্ ওইডা খাইলে ট্যাহা কইম্যা যাইবো। আবার সে হাটতে শুরু করলো। ’ক্লাস ফাইভে ৬ মাস পড়ছিলাম। বাবা অসুস্থ হইলে মার সংসার চালাইতে খুব কষ্ট হইতেছিল। ৬ ভাইবোন। আমিইতো হক্কলের ছোড। দুইভাই বড়, বিয়া কইরা শ্বশুর বাড়ী থাহে। তাগো ছোটখাট মুদির দোহান আছে। আমগো খোঁজ খবর নেয় না। তারা ইচ্ছা করলে আমারে পড়াইতে পারতো। থাইকগ্যা কি আর কিরা। ২ বোইনের বিয়া হইছে। একজনের অবস্থা একটু ভালই। ঐদুলাভাই রাজাকারগো পক্ষে কথা কয়। কয়,’আমরা পাক আমলেই ভাল আছিলাম’। আসলে ওডা একটা শয়তান। এইজন্যই ঐ বাড়ীতে যাই না।’ রাজু পতাকার লাঠি বাম ঘাড় হতে ডান ঘাড়ে নেয়। ’ বাবা মইরা যাওনের পর থিকা মা কত্ত কষ্ট করলো। ভাইরা আগাইয়া আইলো না। আমারে কাম করনের লাইগা শহরে একটা হোটেলে পাঠাইলো। ইস কি যে কষ্ট করছি সেইহানে। ঠিকমত খাইবার দিত না। কতায় কতায় মারতো। পরে ঐহান থিকা এক কাঠমিস্রি তার দোকানে নিয়া আসে। সে অনেক ভাল। অবসর সময়ে আমি অন্য কাজও করতে পারি। মা কইছে ’টাকা জমাইতে হইবো। ছোড বোনটারে বিয়া দিতে হইবো। আর কয়, সব সময়ই সৎ থাকবি। সৎ চিন্তা করবি। কামে ফাঁকি দিবি না।’ আমিতো তাই করি। আমারে একদিন ফরকান কত্ত অনুরোধ কইরা কইছিল, এক ছিলিম গাঁজা খাওনের জন্যি, তাও খাই নাই।,,,, এমন সময় একটা ডাক আসে,,, একটা পতাকা দাও। রাজু পতাকা দেয়। টাকাটা পকেটে রাখে। রাস্তার ধারে বসে পতাকাগুলো ঠিক করে নেয়। একজন ৪০/৪৫ বয়সী লোক রাজুকে বলে এই ছ্যামড়া, অন্য কাম করতে পারোস না।’ রাজু হাসে আর বলে, এইড্যাও তো খুব ভাল কাম। দেশের কাম করা হইতেছে। লোকটি বলে তোর চাপায় দেহি জো-র আছে। কানের কাছে মুখ নিয়া চুপি চুপি বলে তুইতো ঢাকা শহরের অলি গলিতে ঘুরতাছোস, তোর কাছে কয়েকটা প্যাকেট দিমু, তুই শুধু ঠিক জায়গায় পাঠাইয়া দিবি, কারো কাছেই কবি না, কামডা পারবি তো? ভাইবা দেখ, তোরে ম্যালা টাকা দিমু।’ রাজুর মুখটা কালো হয়ে যায়। বলে, আমি পারুম না। এইডাতো খারাপ কাম। লোকটি বলে,’তুমি খুব ভালা কাম করতাছো? পত্তাকা বেইচা কি করবি, বড়লোক হবি?’ বাবার কথাগুলো মনে পড়ে রাজুর। বাবা একদিন কইছিলেন,’ পতাকার দিকে চাইলে দেশের কথা মনে করবি। এই পতাকারে সম্মান করা মানে দেশরে সম্মান করা। দেশের সাথে বেইমানী করবি না।’ রাজু বলে পত্তাকা বলবেন না, বলেন পতাকা। এইড্যা জাতীয় পতাকা। সম্মান কইর্যা কথা কন।’ লোকটি বলে ইসরে আমার পত্তাকা, সম্মান কইর্যা কথা কওয়া লাগবো।’ রাজুর রাগ নিয়ন্ত্রন করতে পারে না। সে এক দলা থুথু লোকটির গায়ে ছুঁড়ে দেয়। লোকটি রাজুকে কিল থাপ্পড় মারে। রাজু মাটিতে পড়ে যায়। মাটিতে পড়ে সে লোকটি দিকে তাকায়। রাজুর মনে হয় এই লোকটি পাকী অথবা রাজাকার। সমস্ত শক্তি দিয়ে উঠে লোকটির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দুচোখ তার জ্বলছে। লোকটির সামনে গদাম করে একটা লাথি মারে। লোকটি উহ্ করে উঠে। এবার উত্তম মধ্যম দিতে থাকে। লোকটিও অনেক জোরে আক্রমন করে। রাজুর গাঁয়েও এখন অনেক শক্তি জমা হয়েছে। আরো জোরে জোরে লাগাতে থাকে। এক সময়ে আবার সে সামনে গদাম করে লাথি মারে। লোকটি এবার পড়ে যায়। সে আবার উঠে রাজুর চোয়ালে জোরে একটা কিল লাগিয়ে জোড়ে দৌড় লাগায়। রাজুর মাথাটা ঘুরে যায়। সে মাটিতে বসে পড়ে। সামনের দিকে তাকিয়ে লোকটির দৌড় দেখতে থাকে। মুখ দিয়ে বের হয় ’শালা রাজাকার’। পতাকাগুলো এদিক ওদিক পড়ে ছিল। সেগুলো আস্তে আস্তে গুছিয়ে নেয়। একটা পতাকা রাজু পরম মমতায় বুকে আকড়ে ধরে। চোখ দিয়ে তখন গড়িয়ে পড়ছে আনন্দ ঝর্ণাধারা।
২২টি মন্তব্য
শুন্য শুন্যালয়
অনেক ভালো লাগলো আপু, অনেক ..
আমরা সবাই যদি রাজুর মতো একটা করে মন পতাকা পেতাম 🙁
স্বপ্ন নীলা
সত্যিই যদি আমাদের সবার মনে স্বাধীনতার মনোভাব অটুট থাকতো তাহলে দেশটা আরো এগিয়ে যেত,,,,,,,,,,বিজয় দিবসের সুভেচ্ছা,,,,,,,,,,
জিসান শা ইকরাম
অসাধারণ লিখেছেন -{@
সহজ সরল বর্ননায় চমৎকার পোস্ট ।
রাজুরা পরাজয় মেনে নেবে না কোনদিন
রাজুরা জিতবেই
সব রাজাকারদের বিচার করেই তবে রাজুরা শান্ত হবে ।
বিজয়ের শুভেচ্ছা আপনাকে।
স্বপ্ন নীলা
অনেক অনেক আন্তরিক ধন্যবাদ জিসান ভাই,,,রাজুরা কোন দিনই পরাজয় মেনে নেবে না,,,,,,,,কোন দিন না,,,,,,,,,,বিজয়ের শুভেচ্ছা আপনাকেও,,,,,,,,,,,,ভাল থাকবেন নিরন্তর,,,,,,,,,,
ছাইরাছ হেলাল
অনেক সুন্দর করে প্রাণ ছুঁয়েই লিখেছেন , পড়ে বুঝতে পারি ।
রাজাকারেরা সব সময়ই পালিয়ে বাঁচে ।
স্বপ্ন নীলা
পোস্টটি পড়ে আপনার ভাল লেগেছে জেনে আমার ভীষণ ভাল লাগলো,,,,,,,,,,,,,,,,ভাল থাকবেন সব সময়
বন্দনা কবীর
এমন রাজু যেন জন্ম নেয় বাংলার ঘরে ঘরে । বাঙালী পরাজয় কাকে বলে জানে না ।
আপনার লেখা আজ প্রথম পড়লাম মনে হয় । বেশ ভালো লিখেন আপনি ।
স্বপ্ন নীলা
বাঙালী পরাজয় মানে না,,,,,,,,,,মানতে পারে না,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,টুকিটাকি লিখি,,,,,,,,,,ভাল থাকবেন
লীলাবতী
এই রাজুর মত সবাই যদি হতো , তাহলে রাজাকারেরা এত সাহস পেতনা । সুন্দর লিখেছেন আপু।
স্বপ্ন নীলা
দেশের মানুষ দেশকে ভালবাসুক প্রাণ ভরে,,,,,,,,,,,,,দেশ এগিয়ে যাক,,,,,,,,,শুভকামনা
যাযাবর
অত্যন্ত সাবলীল ভাবে লেখায় অনেক ভালো লাগা । আমরা সবাই রাজু হবো।
স্বপ্ন নীলা
অনেক ধন্যবাদ ,,,,,,,,,,আমরা সবাই প্রকৃত দেশ প্রেমিক হবোই হবো,,,,,,,,,,,,
নীলকন্ঠ জয়
এমন রাজু চাই প্রতিটি তরুণের মাঝে। এমন রাজুর জন্ম হোক ঘরে ঘরে। লেখা পড়ে আবেগে শিউরে উঠেছি। মুখ থেকে অজান্তেই বেরিয়ে গেছে, “সাবাস রাজু”
বিজয়ের শুভেচ্ছা জানবেন। -{@
স্বপ্ন নীলা
বিজয়ে শুভেচ্ছা আপনাকেও,,,,,,,,,,,,,,,,, দেশপ্রেম জাগ্রত হোক প্রতিটি তরুন/তরুনীসহ সব মানুষের মনে,,,,,,,,,,,ভাল থাকুন
স্বপ্ন
রাজুর মত স্বাধীনতার চেতনা ধারন করুক এই প্রজন্ম। আবেগ গুলো খুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছেন। এমন লেখা আরো চাই।
স্বপ্ন নীলা
আমি আবেগকে জাগাতে চেষ্টা করেছি,,,,,,,,কারন নতুন প্রজন্মকে জানতে হবে ,,,,,বুঝতে হবে,,,,,,,,,সকল ধরণের অপরাধকে না বলতে হবে ,,,,,দেশের জন্য নিবেদিত হতে হবে,,,,,,,,,,আর এ কারণে প্রথমে নিজকে গড়তে হবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,শুভকামনা
নুরুন্ননাহার শিরীন
মনছোঁয়া লেখাটা পড়ে রাজুর মতোন পতাকাপ্রেমী হওয়ার জন্যই সাধনা করতে বলি সুবিধাবঞ্চিত সন্তানদের … আহ সবাই রাজু হয়েই জন্মাক বারংবার বাংলার প্রত্যেক ঘরেঘরে … তাহলে একদিন কোথাও আর রাক্ষস-খোক্কসের মতোন ঘাতক রাজাকারের বাচ্চাদের খুঁজেও যাবেনা পাওয়া … আহ কবে যে এমন বাংলাদেশ হবে …!
স্বপ্ন নীলা
সবাই দেশের জন্য নিবেদিত হোক,,,,,,,,,,,,,,শুভকামনা
মিথুন
মন ছুয়ে গেলো লেখায় । রাজুর মতো করে আমরা আগামী প্রজন্ম কে জানাতে চাই দেশপ্রেম ।
অনেক ভালো লাগা।। (y)
স্বপ্ন নীলা
পোস্টটি ভাল লাগার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ,,,,,,,,,,ভাল থাকেন নিরন্তর
ছন্নছাড়া
অনেক অনেক ভালো লেগেছে ………………
মাঝের অংশ ঠুকু পরে অনেক খারা লেগেছে রাজুদের জীবন সব কষ্টের হয় …………।।
যত দিন রাজুদের হাতে দেশ
পথ হারাবে না বাংলাদেশ ……… (y)
স্বপ্ন নীলা
রাজুদের জীবন এমনই ,,,তাদের জীবন হয় সংগ্রামী,,,,,,,তাইতো তারা বাস্তবতাটাকে খুবই ভালভাবে উপলব্ধি করতে পারে,,,,,,,,,,,,,,রাজুর মত তরুন প্রজন্ম গর্জে উঠুক,,,,,,,,,,,,ভাল থাকুন