আজ নীলু এসেছিলো। নীলু কে? নীলু আমার ছোটবেলার খেলার সাথী। আমার তিন বছরের ছোট সে, উচ্ছল শৈশবের নানান স্মৃতির সাক্ষী। ছোটবেলায় কতদিন কত বছর আমরা হাঁড়িপাতিল, দাড়িয়াবান্ধা, কুতকুত খেলেছি তার আর হিসেব নেই। দু’জনের কত খুনসুটি, লুকিয়ে তার মায়ের হাতে বানানো আঁচার চুরি করা খাওয়া, আমার বই তার বাসায় লুকিয়ে রেখে আম্মাকে বই হারানোর কথা বলে পড়া ফাঁকি দেয়া ; সে সব কিছুর নীরব সাক্ষী সেই নীলু আজ বাসায় এসেছে।
আমি অফিস থেকে ফিরেই দেখি নীলু আম্মার সাথে গল্প করছে। আমাকে দেখে খানিক লজ্জিত হলো মনে হয়। কথা বলছে মাথা নীচু করে পায়ের দিকে তাকিয়ে, হয়তো কান্না পাচ্ছে। এমন দৃশ্য তার মায়ের মৃত্যুর দিনে তার সেই ছোট্ট মুখে দেখেছিলাম; আমার মনে আছে।
নীলু কেমন আছ?
জ্বী ভাইয়া ভালো আছি। তার কন্ঠস্বরে সেই ভালো না থাকার আওয়াজটা যেন ম্লান হয়ে আমার কানে বেজে উঠলো।
বুকের বামদিকে খানিক ধক ধক করার শব্দে আমার কান গরম হচ্ছে বেশ বুঝতে পারছি। শুনেছিলাম নীলুর বিয়ে হয়েছে, এসএসসি পরীক্ষায় আর সে বসতে পারেনি। সুখে ছিলো বলেই জানতাম। যে নীলুকে আমি সেই কৈশরেই শেষবারের মত দেখেছি, সেই নীলু আজ আমার সামনে নেই। কঠোর আর শক্ত হয়েছে তার মুখের নীরব ভাষা। কি উজ্জ্বলতা আর দীপ্তিময় ছিলো তার মায়াবী মুখখানা। আমি খানিক তাকিয়ে রইলাম।
নীলু তুমি বসো, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
আচ্ছা ভাইয়া।
কি আশ্চর্য, তুমিতো আমায় তুই করে বলতে আর ভাইয়া কবে থেকে ডাকা শুরু করলে?
সে মাথা নামিয়ে নিলো, তাকিয়ে আছে পায়ের দিকে।
আমি ফ্রেশ হয়ে তাদের কাছে এসে বসলাম। এবার বলো, আছ কেমন? তোমার স্বামী, বাচ্চাকাচ্চা কে কি করে,কোথায় থাকে?
আম্মা বললেন, আরে হরহর করে সব প্রশ্ন করলে নীলু জবাব দেবে কেমন করে? আমি লজ্জিত হলাম, আসলে অনেকদিন পরে শৈশবের খেলার সাথীদের দেখলে বুঝি এমনি হয়।
আচ্ছা তোরা কথা বল আমি আসছি বলে আম্মা উঠে পরলেন। আমি এতক্ষনে লক্ষ্য করলাম নীলুর পরনে রংচটা শাড়ি, আড়চোখে তার হাতের দিকে তাকাতেই দেখি ভারী কাজ করার ছাপ তার আঙুলে স্পষ্ট।
সে বললো- তার একটা কাজ চাই, একটা সম্মানজনক কাজ।
কেন তোমার স্বামী? জুয়াড়ি স্বামী, অভাবের সংসার,সব ছাড়াছাড়ি হয়েছে, দু’বছর হলো। বাচ্চাটা তার সাথেই থাকে, প্রাইমারি পাশ করলো। বাবাও গত হয়েছে অনেকদিন। একা একটা মেয়ের কত রকমের ভোগান্তি হতে পারে তা আমি জানি। পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি থেকে যে সেও রেহাই পায়নি! কান্নায় ভেঙে পরা নীলু তার সব কথা আজ আমায় এমনভাবে বলেছে, যেন সে খুঁজে পেয়েছে তার ছোটবেলার খেলার সাথীকে, যাকে মন খুলে সব বলতো। খুঁজে পেত আস্থা।
আমার মনে পড়লো নীলুর আম খাওয়ার জেদ পুরন করবো বলে পাশের বাসার আম চুরি করতে গিয়ে ধরা পরলে সে লজ্জার হার থেকে নীলুই আমাকে বাঁচিয়েছিলো নিজের কাঁধে সে দোষ নিয়ে। আমি লুকিয়ে পুকুরে গোসল করতাম আর নীলু আম্মাকে সাক্ষী দিতো, আমরাতো খেলছিলাম খালাম্মা!
সেই নীলুর এই হাল আমি মেনে নিতে পারছিলামনা। তার বিয়েরদিন বাসায় গিয়েছিলাম দেখা করতে, তার বাবা দেননি। পাছে যদি আমাকে দেখে নীলু অভিযোগ করে এই ভয়ে। সেদিন সেই শেষবার জানালা দিয়ে নীলুকে দেখেই চলে এসেছিলাম ; এরপর চলে গেছে অদেখা আঠারো বছর! আজ নীলু আমার সামনে বসে, রিক্ত সিক্ত, মৃয়মান। লজ্জায় জর্জরিত আঁটোসাঁটো তাকে দেখে আমার অনেক মায়া লাগছে। আমিতো নিজেই তার খোঁজখবর রাখিনি। কর্মব্যস্ততা, ঘরসংসারের ছুটাছুটিতে সত্যিই নীলুকে প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। কি স্বার্থপর আমি! অথচ নীলু আজ আমার কাছে এসেছে বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে!
ঠিক আছে নীলু তুমি কাল অফিসে এসো। একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে, চিন্তা করোনা। কিছু টাকা দিতে চাইলাম সে নিলোনা। আত্মসম্মানে বাঁধলো হয়তো। বললাম বাচ্চার জন্য কিছু কিনে নিও। এবার সে নিল, কিন্তু তার হাত যে আড়ষ্ট! আচ্ছা ভাইয়া আসি।
বললাম ভালো থাকিস, তুই এখনো আমার মনে সেই ছোট্টবেলার খেলার সাথী নীলু। লজ্জা পাসনা; আমার কাছে তুই পবিত্র, নিষ্পাপ ছোট্ট নীলু। একথা শুনে তার মাথা আবারো নুয়ে এলো, দৃষ্টি পায়ের দিকে। তার চোখ বেয়ে ঝড়ে পরা নোনা অশ্রু পায়ের আঙুলগুলোকে ভিজিয়ে মেঝেতে গড়ে পরছে।
(সমাপ্ত)
১২টি মন্তব্য
মাহমুদ আল মেহেদী
অস্বাধারন বাস্তব একটা চিত্র। অনেক মন খারাপ লাগলো নিলুর জন্য ।
তৌহিদ
নীলুর জন্য আমারো সেদিন খারাপ লেগেছিলো ভাই।
ছাইরাছ হেলাল
কঠিন কিন্তু করুন অনুভুতি সুন্দর করেই উপস্থাপনা করেছেন।
নীলুর জন্য মায়া হচ্ছে।
তৌহিদ
কিছু ঘটনা মনে নাড়া দিয়ে যায় এটি এমনি এক ঘটনা ভাইয়া। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
মোঃ মজিবর রহমান
চোখে জল এসে গেলো, তৌহিদ ভাই। এই রকম হাজারও বোন ভাই এইদেশে অসহায় বাস করছে। আল্লাহ তাদেরর তুমি সহায় হও।
তৌহিদ
আপনার অনুভুতি নিখাদ ভাই। আমাদের সবার মন আপনার মত সরলতায় ভরে উঠুক এই কামনা করি।
জিসান শা ইকরাম
আপনার গল্পগুলো এক নাগারে পড়ার মত হয়।
নিজের প্রিয় একান্ত আপন খেলার সাথীকে এমন অবস্থায় দেখলে সীমাহীন কস্টের মাঝে পরে যেতে হয়।
কস্টকে ভালোভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন গল্পে।
শুভ কামনা।
তৌহিদ
আপনারা পড়ে উৎসাহ দেন বলেই লিখতে ইচ্ছে করে ভাইয়া। ধন্যবাদ জানবেন।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
জীবন বোধ,মানবতা মায়া সব যেন আপনার গল্পে খুজেঁ পাই।এমন অসংখ্য নীলুরা এ নোংরা সমাজের বাস্তব রূপ।ভাল লাগল ভাই।
তৌহিদ
আমি একটু আবেগী টাইপ মানুষ, এ কারনেই লেখায় মনে হয় তা ফুটে উঠে ভাই। ধন্যবাদ জানবেন ভাই।
সাবিনা ইয়াসমিন
অনেক কষ্ট পেলাম,,লেখাটি মনে দাগ কেটে গেলো ভাই।
আরো পড়ার অপেক্ষায় থাকবো ,,শুভ কামনা ☺
তৌহিদ
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ আপু। এররকম হাজারো নীলু ঝড়ে পড়ে যায়। আমরা কতজন তার খবর রাখি তাইনা?